| 28 মার্চ 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

অসমিয়া অনুবাদ গল্প: ভুলসত্য । মনোজ কুমার গোস্বামী

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

লেখক পরিচিতি-

১৯৬২ সনে অসমের নগাঁও জেলায় গল্পকার,লেখক,সাংবাদিক মনোজ কুমার গোস্বামীর জন্ম হয়।গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র শ্রীগোস্বামী অসমের প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র ‘নতুন দৈনিক’,‘আজিরবাতরি’, ‘আমার অসম’, ‘দৈনিক জনসাধারণ’ ইত্যাদি পত্র পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।বর্তমানে ‘ডি ওয়াই ৩৬৫’নামে উত্তর পূর্বাঞ্চলের একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের ম্যানেজিং এডিটর।‘সমীরণ বরুয়া আহি আছে’,‘মইরাজেন বরুয়াক সমর্থন করো’,’এলুমিনিয়ামর আঙ্গুলি’লেখকের অন্যতম গল্প সংকলন।   ‘ভুলসত্য’ গল্প সংকলনের জন্য ২০২২ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।

বাংলা অনুবাদ বাসুদেব দাস


সেই কফি শপটার একটা কোণ আমরা অধিকার করে বসলাম। আমরা মানে আমি,নীলয়,আব্রাহাম এবং রঞ্জনা।আমাদের টেবিলের ঠিক পাশেই ছোটো একটি বেলকনি। নীলয়ের সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস, মাঝেমধ্যে সে একটা অ্যাসট্রে  নিয়েবেলকনির দিকে উঠে যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন এই শহরটিতে সে পুলিশ ডিপার্টমেন্টে কাজ করছে।আজকালজনসমাগমেধূমপানকরায় একটা অস্বস্তি রয়েছে। আব্রাহাম আগে থেকেই স্পষ্টভাষী মানুষ, কথার মাঝেমধ্যে ঠোঁটের কোণে হাসি। চোখে দামি ফ্রেমের চশমা, ব্যাকব্রাশ করা চুল, পেশীবহুল কাঁধ ফিল্ম এক্টর জাতীয় চেহারা। কলেজে সে অভিনয়ও করেছিল, এখন ব্যস্ত ব্যবসায়ী, একাধিক মাল্টিন্যাশনাল প্রোডাক্টের ফ্রেঞ্চাইজ আছে, দিল্লির দিকে রিয়েল এস্টেটে ও নেমেছে।বেশিরভাগসময় সে রাজ্যের বাইরে থাকে। একেবারে শেষে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলরঞ্জনা। না, আজকে আসার  অসুবিধা রয়েছে, অনেক কাজ আছে জেনেও সে এসেছে । আমরা চারজন কলেজে একসঙ্গে পড়েছিলাম,আব্রাহাম হায়ারসেকেন্ডারি পাস করে ইঞ্জিনিয়ারিংপড়তেগিয়েছিল। আমাদের সমসাময়িক হলেও রঞ্জনাকে যথেষ্ট কম বয়সের বলে মনে হয়। আমাদের প্রত্যেকেরই চল্লিশ পার হয়ে গেছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে হয়তো বয়সটা যথেষ্ট। আসলে কলেজের দিন থেকেই রঞ্জনা খুব আকর্ষণীয় ছিল। ব্যাডমিন্টন খেলত, দু একবার ইন্টার কলেজ চ্যাম্পিয়ন ও হয়েছিল। সেই ফিটনেসর  আভাস তার চলাফেরায় এখনও রয়েছে। রাজ্যের একজন উচ্চপদস্থ আমলা তার স্বামী, সে নিজেও দুই তিনটিএনজিওর সঙ্গে  সোসিয়াল  কাজকর্মনিয়ে খুব ব্যস্ত, আর আমি স্থানীয় কলেজটিতেসাইকোলজি পড়াই। খুব বোরিং একটা চাকরি।

এই যে আমরা চারজন বসে আছি, নিজের সমস্ত কাজকর্ম, ব্যস্ততা বাদ দিয়ে, আসলে আমরা অলির জন্য অপেক্ষা করছি। অলি মানে অলি বরুয়া। সেও আমাদের এককালেরসহপাঠী, আর ইন্টারেস্টিংকথ এটাই যে আমরা বাকি চারজনই বিভিন্ন ধরনে অলির সঙ্গে জড়িত। কেউ ছিল বন্ধু, কেউ প্রেমিক, কেউ তার বিরুদ্ধে তীব্র হিংসায় নিমজ্জিত ছিল। কারও হয়তো অলিকে নিয়ে আছে খুবই ব্যক্তিগত কাহিনি, যা একান্ত গোপন, অপ্রকাশিত।

– আশ্চর্য! অলি হঠাৎ কোথা থেকে এল? আব্রাহাম ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিয়ে বলে উঠল। ইনফেক্ট, কুড়ি বছরেরও বেশিসময় পার হয়ে গেল। অলির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। সে নিস্পৃহ ভাবে বলল।

নীলয় এবং রঞ্জনা সম্মতি সূচক ভাবে মাথা নাড়ল। নীলয়ের ব্যস্ত মোবাইল ফোন মাঝে মাঝে বেজে উঠছে, অনুচ্চকণ্ঠে সে কাউকে কোনো নির্দেশ দিচ্ছে বা নীরবে শুনছে। তার মুখে এক আত্মবিশ্বাস এবং প্রত্যয়ের যেন সে যা খুঁজছে তা পাবেই । ঠিক পুলিশি কঠোরতা নয়, এক ধরনের দৃঢ়তা। অনেকদিন ক্ষমতা এবং প্রাচুর্যের মধ্যে থাকলে মানুষের মুখ এরকম হয়। হঠাৎ নীলয় আমার দিকে তাকিয়েজিজ্ঞেস করল, ঠিক তেইশ বছর পার হল, তথাপি তুই অলিকে দেখেই চিনতে পারলি? 

– আমি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে গাড়ি পার্ক করে ঠিক ভেতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলাম। তখনই আমি অলিকে  দেখতে পেলাম। আমি বর্ণনা করলাম। সে একটা সবুজ শাড়িপড়েছিল এবং বিশ্বাস কর আমার এক মুহূর্তও লাগল না ওকে চিনে নিতে, কারণ…

– কারণ? আব্রাহামেরউৎসুকতা দেখা গেল।

– কারণ সেই একই অলি। এখনও কী অদ্ভুত ধরনের সুন্দর, ব্রেথটেকিং।

– তেইশ বছর পার হয়ে গেছে অনাদি, শী মাইট বি গেটিং ওল্ড লাইক উই অল ডু। মুচকি হেসেরঞ্জনা বলল।

– তারপরে? তোকে দেখে কী বলল ও? কী রিয়েকশন? নীলয়জিজ্ঞেস করল।

– আমাকে চিনতে ওর অবশ্য কয়েক সেকেন্ড লাগল। তারপর সে বলল, ইউ লুক ম্যাচিউরড অনাদি। জানিনা কী বোঝাতে চাইল।

– এটাই বোঝাল যে, তুই বুড়োহয়েছিস। অর্থাৎ ইউ লুক ওল্ডার দেন ইউরএইজ? আব্রাহাম খুব মজা পেয়ে হেসে উঠল, হাঃ হাঃহাঃ। 

– ও একা ছিল, কিন্তু কারও জন্য অপেক্ষা করছিল বলে মনে হল না। আমি বলে গেলাম। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, কপালে চুলগুলি পড়ে আছে, চোখের মনি নাচছে। বিশ্বাস কর যেন সেই তেইশ বছর আগেকার অলি, যেন তখনকার একটা ছবি থেকে উঠে এসেছে। আমি তাকে বললাম, সামনের চৌরাস্তায় একটা ভালো রেস্তোরাঁ আছে, খুব ভালো কফি পাওয়াযায়। চল বসি।না, সে বলল। এভাবে নয়, বলতো ওরা কোথায় কোথায় আছে। কী করছে।

– ওরা মানে? নীলয়জিজ্ঞেস করল।

– আমিও তাকে এ কথা জিজ্ঞেস করলাম। জানিস ,ও তোদের কথা বলল। বলল আব্রাহামের সঙ্গে দরকার ছিল। মুখোমুখি। নীলয় শুনেছি বড়োপুলিশ অফিসার। পুলিশেরড্রেসে ওকে কী রকম দেখায়?আর রঞ্জনা? রঞ্জনা সংসার করছে? অলির নাকি বিশ্বাসই হয় না।

আমার সামনে তিনজন শ্রোতা চুপ। যেন অন্যমনস্ক। টেবিলের কফি ধীরে ধীরেঠান্ডা হয়ে আসছে। আমি সপ্রতিভ ভঙ্গিতে ওয়েটারকে ডাকলাম, চার কাপ কেপুসিন দাও। ভালো বিস্কুট দেবে।

– তখন আমি বুঝতে পারলাম, ও একবার তোদের সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমি নীলয়কে ফোন করলাম, ইনফেক্ট আব্রাহাম গুয়াহাটিতে এসেছে বলে আমি জানতামই না। নীলয় বলল, আব্রাহাম এসেছে। রঞ্জনাকে খবর দিলাম। সো হিয়ার ইউ আর! 

– কী বলল আমার কথা? আব্রাহাম পুনরায় জিজ্ঞেস করল। মুখোমুখি কথা বলা উচিত ছিল।কী কথা?

– আমি কি জানি। আমি উদাসীনভাবে বললাম। আমিতো অলিকে বলেছিলাম যে আব্রাহাম বেশিরভাগসময়দিল্লিতে থাকে। তুই যে এই সময় এখানে আছিস সেটা কয়েনসিডেন্স। সামনে পেলে নিজেই জিজ্ঞেস করে নিবি।

হু! আব্রাহাম গম্ভীর হয়ে পড়ল।

– অলি কোথায় থাকে? এতদিন কোথায় ছিল? নীলয় তার সেই স্বাভাবিক প্রত্যয়ের সুরে জিজ্ঞেস করল। তার নাম্বারনেওয়ারবুদ্ধিটুকুওহলনা প্রফেসরের?

– আরে এতদিনে এতটুকুডিসেন্সি তো শিখেছি। ও আমার নাম্বারচায়নি, আমিও আগবাড়িয়েচাইলাম না। আমার সঙ্গে একটু এগিয়ে এসে এই রেস্তোরাঁটা ও দেখে গেল। আমাকে বলল, ঠিক আছে, যদি পার এখানে শনিবার বিকেল চারটারসময় দেখা কর। আমি ফ্রি থাকব। রবিবারে কিন্তু আমার ফ্লাইট। নীলয়, রঞ্জনাকে কিন্তু যেভাবেই হোক আসতে বলবে, তেইশ বছর পরে আমরা অন্তত এক ঘন্টা একে অপরকে দিতে পারি, নয় কি? আর পরে আব্রাহামও এসেছে জেনে সবকিছু মিলে গেল।


আরো পড়ুন: অসমিয়া অনুবাদ: সংস্কার । মামণি রয়সম গোস্বামী


– আচ্ছা, তাহলে অলি বরুয়াইজব্যাক। রঞ্জনাস্বগতোক্তি করার মতো বলল।

–কিছুদূর ফুটপাত দিয়ে যাবার সময় অলি কেবল আমাকে বলল রঞ্জনাকে আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করার ছিল। তেইশ বছর ধরে এই কথাটা আমি মনের মধ্যে পুষে রেখেছি।

– কী কথা? রঞ্জনা সঙ্গে সঙ্গেজিজ্ঞেস করল।

– জানিনা অলি যেন আমাকে কথাটা বলতে চাইছিল না। যেন মুখ থেকে তার অজান্তে বেরিয়ে গেল।

– ও আজকাল কোথায়?কী করে? নীলয় পুনরায় আগের প্রশ্নটাতে ফিরে গেল।

– এতকিছুজিজ্ঞেস করা হল না আর। আমি বললাম। সম্ভবত সাউথ ইন্ডিয়ায়। বাঙ্গালরু,মাদুরাই আসা যাওয়ার কথা বলছিল। কী একটা অর্গানাইজেশনের জন্য কাজ করছে। ও ,আরও একটি ইন্টারেস্টিং কথা…

কী? তিনজনের অদ্ভুত কণ্ঠস্বর শোনা গেল!

–প্রবাবলি শীইজসিঙ্গেল, প্রবাবলি!

পাঁচটা বাজতে চলেছে। নীলয়েরদামি সিগারেটের গন্ধ ব্যালকনি থেকে ভেসে আসছে। রেস্তোরায়কয়েকটি কলেজের ছেলে- মেয়ে, পাশের টেবিলে একজন বৃদ্ধ নীরবে কফিতে চুমুক দিচ্ছে।

– অলি তো এখনও এসে পৌঁছালনা। নীলয়অধৈর্যেরমতো বলল। আর তুই অনাদি ওর নাম্বারটাওনিলিনাইমপ্রেস করার চেষ্টা করে!

– ডোন্টপ্রভোকমীনীলয়, আমি বললাম। অলি তোর কথা কী বলেছে আমি তো তোকে বলিইনি।

– কী বলল? ইব্রাহিম, রঞ্জনা একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল।

– বাদ দে! ফরগেট ইট! পুনরায় কফির কাপ তুলে কপট অনীহার সঙ্গে আমি বললাম!

–ন’ন’ন’… একসঙ্গে কয়েকটি ন’ উচ্চারণ করে নীলয়হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে গেল। জাস্টস্পিক আপ!

– কোনো সিরিয়াস কথা নয় ভাই! সে কেবল জিজ্ঞেস করল নীলয় আগের মতোই ভীতু  রয়েছে না কিছুটা সাহস বেড়েছে!

– হোয়াট!নীলয় টেবিলে একটা চাপড় মেরে দিল, কাপ-প্লেট- চামচ সবকিছুঝনঝন  করে উঠল। তারপরে সে নীরব হয়ে গেল। নিজেকে সামলেনিল।

কফিশপটিতে  একটি পুরোনো ইংলিশ গানের যন্ত্রসংগীত চলছে। খুব মৃদু। কোনো একটি কোণ থেকে হঠাৎ নারী কন্ঠের হাসি ভেসে এল।

– সাহস মানে? আব্রাহাম বলে উঠল। কাউকে বিছানায়নিয়ে যাওয়াটাই যদি সাহসের চিহ্ন তাহলে আমার চেয়েবেশি সাহসী তো কেউ ছিল না।

– প্লিজ আব্রাহাম! আমি বললাম, অলি ঠিক সেটা মীন না ও করতে পারে। বেনিফিট অফ ডাউটদেওয়া ভালো যেহেতু এই মুহূর্তে অলি এখানে নেই।

সময় পার হয়ে চলেছে। সাড়ে ছয়টা বেজে গেল। রাস্তায়গাড়িরহেডলাইটজ্বলে উঠেছে। স্ট্রিট লাইটে উদ্ভাসিত শহর। না– আমাকে যেতে হবে একটু পরে। অনেক দেরি পর্যন্ত  বসলাম। নীলয় আপাত বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল। আর প্রফেসর সাহেব! অলিতো এখনও এসে পৌঁছাল না।

– ইতিমধ্যে এসে পড়ার কথা ছিল। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। আমি তো আব্রাহাম আসবে  বলে ওকে বলিনি। তা নিয়ে কোনো মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিংএর প্রশ্ন ওঠেনা। আমি অবশ্য আজও জানিনা অলির সঙ্গে আব্রাহামের কী সম্পর্ক ছিল।

প্রত্যেকের মুখ আব্রাহামের দিকে ঘুরে গেল। আব্রাহাম কলেজে মেয়েদের কাছে ক্রেজ ছিল। পুরুষালী চেহারা, ধনী ঘরের ছেলে, ভালো অভিনয় করে এবং খুব সপ্রতিভ। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রুমাল পরিবর্তন করার মতো সে গার্লফ্রেন্ড পরিবর্তন করত। আর একদিন অলির সঙ্গেও তাকে ঘনঘন দেখা যেতে লাগল, বা বারান্দায় অথবা কখনও রাস্তায়।

– আই হ্যাভ এ কনফেশন! আব্রাহাম বলল। অলি আসার আগে একটা কথা বলি, এটা সত্যি যে  অলিকে  আমার খুব ভালো লেগেছিল। আর একদিন আমার রুমে তাকে নিয়েগিয়েছিলাম। আজ এত বছর পরে আমার লুকোনোরমতো কিছু নেই। আমি তার কাছ থেকে জাস্ট একটা চুমুপেয়েছিলাম, অ্যান্ডসিসেইডনো। সেদিন আমি বুঝতে পারলাম কোথাও আমার একটা বুঝতে ভুল হয়েছে। অলির সঙ্গে নীলয়ের সম্পর্ক তো সত্যি। দে ওয়ারএকচুয়ালি ইন এ রিলেশনশিপ।

– হাঃ হাঃহাঃ! নীলয় বলপূর্বক একটা হাসি হাসল। এইসব রিলেশনশিপের কথা কলেজের ক্যাম্পাসে কত শোনা যায়। হ্যাঁ, অলির সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার  সময় আমি একটু চমকে উঠেছিলাম। কিছু একটা রহস্যময়তা ছিল তার মধ্যে, যেন এই গ্রহের মানুষ নয় সে, হরিণের মতো চোখ, মায়াবী মুখ, সোডার জলের বোতলের মতো শরীর। আজও কি সে এ রকমই আছে অনাদি?

– আছে, আমি বললাম। সেই একই অলি। সুন্দর পরিপূর্ণ। চঞ্চল অথচ গভীর নদীর মতো। তেইশ বছর পরে দেখা হল। অথচ এরকম মনে হল সে যেন কলেজের ক্লাসরুম থেকে এইমাত্র বেরিয়ে এল।

-তার মানে নীলয় তোমার অলির সঙ্গে কোনো রিলেশনশিপই ছিল না? রঞ্জনা আস্তে করে জিজ্ঞেস করল। ইউওয়্যারজাস্ট ফ্রেন্ডস! কিন্তু গোটা কলেজ তোলপাড় ছিল তোমাদের দুজনের প্রেম নিয়ে।

– আজ এত বছর পরে আমি তোমাকে পুনরায় এক্সপ্লেইন করতে হল রঞ্জনা? নীল উদাস ভাবে বলল। আমি একটা কনফেস করি যে অলিকে কীভাবে যেন ভালো লেগে গিয়েছিল। কিন্তু সে আমাকে কি বলেছিল জান, তুমি প্রথমে রঞ্জনাকে তোমার ভালোলাগা না লাগার কথা বলতে হবে। ওকে তুমি চিট করতে পারবে না। চব্বিশ ঘন্টা পরে আমার প্রেম শেষ। আমি রঞ্জনাকে বলতে সাহস করতে পারলাম না। কিন্তু তোমার মস্তিষ্কে সেই ভুল বোঝাবুঝি জায়গা করে নিল। যার জন্য একটা সময় তুমি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে বেশিসময়নিলে না!

– শী ইজ এ বীচ! রঞ্জনা ঘৃণার সঙ্গে বলল।

– না রঞ্জনা শী ইজ নট! আজ দেখ তুমি সুখী, ভালোভাবে সংসার করছ, নীলয় সুখী, আমি সুখী। আমাদের প্রফেসর অনাদি ছোটোছোটো ছেলে মেয়েদেরসাইকোলজির অদ্ভুত থিওরি বুঝিয়ে সুখী। আর অলি হয়তো নিজেকে নিয়েই সুখী। সবাই নিজের নিজের বৃত্তে  নিজে সুখী।

কয়েকদিন সে ছিল আমাদের কলেজে! রঞ্জনা বলল, সেই কয়েক মাসে তোমাদের মাথা ঘুরে গিয়েছিল।

– অলি আমাদের কলেজে মাত্র দশ মাস ছিল।ফাইনাল পরীক্ষার আগেই ট্রান্সফারনিয়ে চলে গিয়েছিল। সেই দশ মাসকে এত গুরুত্ব দেবার দরকার কি? যা হয়েছিল,হয়েছিলআ্‌র, নিজেকে আশ্বস্ত করার মতো আব্রাহাম বলল।

– ইস,অলি এখনও এল না দেখছি। আমি জানালার কাছে গিয়েএমনিতেই নিচের দিকে তাকালাম।

– আটটা বাজতে চলল। কাফে এখন বন্ধ হয়ে যাবে। রঞ্জনা বলল। আমি যাই ,আমারড্রাইভারবোধহয় অপেক্ষা করে করে বোর হয়ে গেছে।

– শী হ্যাজ নট টার্নড আপ। নীলয় ধীরে ধীরে বলল। আসলে অলি হয়তো আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়নি, আর এই প্রফেসরও তার নাম্বারটানেয়নি। 

– দ্যাটসহোয়াই আই স্টিল ডোন্টবিলিভইউনীলয়! রঞ্জনাক্ষীণভাবেহেসে উঠে দাঁড়াল। আব্রাহাম, নীলয়ওয়েটার এর কাছে বিল চেয়ে পাঠাল। দুজনেরই মুখ এক স্মৃতি মেদুরতায় ম্লান।

– না, না, আমি বললাম, আজ তোরা আমার গেস্ট। অনেকদিন পরে তোদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এই কয়েক কাপ কফির দাম আমি দিতে পারব। আমি অলির জন্য আরও কিছু সময় অপেক্ষা করছি, যদি আসে এবার মোবাইল নাম্বারনিয়ে নেব।

তিনজনেই আমার দিকে কিছুক্ষণের জন্য তাকিয়েরইল। অল দ্যাবেস্ট অনাদি, আব্রাহাম বলল।

– যদি ওর সঙ্গে দেখা হয়, উইশ হার বেস্ট অফ লাকফ্রম মাই সাইড। নীলয়ও বলে উঠল। সিঁড়িদিয়েপ্রত্যেকেই নিচে নেমে যাওয়ার পরে আমি সামনের টেবিলের দিকে তাকালাম– পরিত্যক্ত সিগারেটের প্যাকেট, খালি কাপ-প্লেট, মলিনমেনু কার্ডে অবিন্যস্ত। যাপিত জীবনের মতো শূন্য, বিশৃঙ্খল এবং নিঃস্ব। 

আমি,অনাদি

অলি এল না। আসলে অলি আসার কথা ছিল না। সেদিন আমার সঙ্গে কোনো ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে কোনো অলির সঙ্গে দেখা হয়নি। অস্পষ্টভাবে গাড়িতে পার হয়ে যাওয়া কেবল আব্রাহামকে দেখেছিলাম। এক সময়ে কলেজের লেডি কিলার হিসেবে কুখ্যাত আব্রাহামকেনিয়েই আমার গেমপ্ল্যান রচনা করেছিলাম। কলেজে ভীষণ চর্চা ছিল যে অলিকে আব্রাহাম রুমেনিয়েগিয়েছিল। হোস্টেলের দু একজন ছেলে প্রত্যক্ষদর্শীও  ছিল। আর নীলয়ের সঙ্গেও অলির কি সম্পর্ক ছিল? অনেকে বলেছিল ওদের নাকি দূর্ঘোর প্রেম ছিল? যার জন্য একটা সময়েরঞ্জনার সঙ্গে নীলয়ের ব্রেকআপহয়েছিল। প্রায় তেইশ বছর আগে কলেজটা ছেড়ে এসেছিল অলি। যেন স্বপ্নের মাঝখান থেকে উঠে আসা একটি মেয়ে, কলেজ চৌহদে অলিকে নিয়ে হাহাকার লেগে গেল। অদ্ভুত লাবণ্য তার মুখে, তার পেলব শরীর,রহস্যময়চাহনি বিচলিত করে তুলল সবাইকে। প্রথম দিন তাকে দেখার পরেই আমি তাকে অনুসরণ করেছিলাম। সান্নিধ্য পাইনি, কিন্তু চোখের আড়াল হতে দিতেওচাইছিলাম না, আর সবার অজান্তে অলক্ষে আমি হয়ে পড়লাম তার দুরন্ত প্রেমিক। জীবনে অলির সঙ্গে আমি একটাও কথা বলার সুযোগ পাইনি, কিন্তু তার আশেপাশে কেউ এলেই তার প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা এবং হিংসা জেগে উঠে। আজ এত বছর পরেও আব্রাহাম নীলয়দের আমি ক্ষমা করতে পারিনি। কেবলমাত্র দশ মাসের মতো আমাদের শহরে থেকে অলি চলে গেল। তার বাবার রেলওয়ে চাকরি ছিল। অলি কারও হাতে কোনো ঠিকানা দিয়ে গেল না। কেবল সেই কয়েক মাস সে তুফানের মতোবিধস্ত করে গিয়েছিল অনেককে। তেইশ বছর পার হয়ে গেল। সেসব কথা সবাই ভুলে গেছে, আমি অলিকে ভুলিনি। আজও আমি তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, ইন্টারনেট, সোশ্যালমিডিয়ায়সার্চ করছি, সে একটা সুখস্বপ্নেরমতো ধীরে ধীরেহারিয়ে যেতে চলছিল।

কিন্তু আমি জানতে চেয়েছিলাম অলি কারও কাছে সত্যিই ধরা দিয়েছিল নাকি? সে আমাকে কখনও চিনতে না পারে। কিন্তু আমিই তো তার প্রকৃত প্রেমিক। আমি আমার সাইকোলজির শিক্ষা কাজে লাগালাম। আব্রাহাম, নীলয়দের সঙ্গে আমি এক মাইন্ডগেম আরম্ভ করলাম।তাই আমি সৃষ্টি করে নিলাম এক অলীক অলিকে। কল্পনার জাল পেতে আদায় করলাম আব্রাহাম, নীলয়দেরস্বীকারোক্তি। অলীকতার মধ্য দিয়ে প্রকৃত সত্য জেনে নিলাম আব্রাহাম নীলয়দের কাছ থেকে! আসলে কল্পনার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে বাস্তব। আমি জানলাম, আমার অলি অনাঘ্রাত, নিষ্পাপ, সে কেবল আমার জন্য। একদিন সত্যিই অলি আসবে আমার কাছে, তার জন্যই আমি অপেক্ষা করছি এতদিন।

– এই  কে আছ? বিল নিয়েএসো!

         

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত