| 17 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত গল্প

মানুয়েল মুহিকা লাইনেস-এর গল্প গুরুত্ব |  আলম খোরশেদ 

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

মূল: মানুয়েল মুহিকা লাইনেস
অনুবাদ: আলম খোরশেদ

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

লেখক পরিচিতি
আর্হেন্তিনীয় ঔপন্যাসিক ও ছোট গল্পকার মানুয়েল মুহিকা লাইনেস-এর জন্ম ১৯১০ সালে বুয়েনস আইরেস-এ। ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড-এ পড়ালেখা শেষে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে দুটো ছোটগল্প সঙ্কলন হেয়ার দে লিভ্ড (১৯৪৯) ও মিস্টিরীয়াস বুয়েনস আইরেস (১৯৫০) এবং কয়েকটি উপন্যাস, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্য হাউজ (১৯৫৪), গেস্টস্ ইন প্যারাডাইস (১৯৫৭), এর আঙ্গিকে আর্হেন্তিনার ইতিহাস রচনায় ব্রতী হন । তার অন্যান্য খ্যাতনামা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে দ্য ওয়ান্ডারিং ইউনিকর্ণ (১৯৬৫) , বোমার্সো (১৯৬২), দ্য স্কারাব (১৯৮২) ইত্যাদি ।


মিসেস এরমোসিয়া দেল ফ্রেসনো একাধারে বিধবা ও গুরুত্বপূর্ণ মহিলা। অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বিধবা অধ্যুষিত এই বিশাল শহরে মিসেস এরমোসিয়া দেল ফ্রেসনো-র মত এতটা গুরুত্বপূর্ণ আর কেউই নন। তার গুরুত্বের সঙ্গে মানানসই এক বিশাল প্রাসাদে তিনি গুরুত্বপূর্ণ আসবাবপত্র ও এক পাল পরিচারক পরিবেষ্টিত হয়ে বাস করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজনে সদাব্যস্ত, গুরুত্বপূর্ণ সভাসমিতির পৌরোহিত্য করেন। ভাগ্যের এক আজব কারসাজিতে এই চমৎকার প্রেক্ষাপটে একটা বিষয়েই কেবল গুরুত্বের অভাব, সেটা তার পরিবার : তার সন্দেহজনক বংশপরিচয়, সে ব্যাপারে কারো কোনো সংশয় নেই, বিশেষত সমাজের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মহিলাদের। তার বংশপরিচয়ের (যা কিনা তার রাজসিক বিবাহ অনুষ্ঠানের চটকেও চাপা পড়েনি) সাক্ষী কতিপয় যারপরনাই দীনহীন দূরসম্পর্কের আত্মীয়স্বজন, যাদের তিনি কালেভদ্রে দেখে থাকবেন। কখনো তাদের পরিচয় দিতে বাধ্য হলে – যা তিনি কৌশলে এড়িয়ে চলেন সচরাচর – তিনি তাদের নামধাম এবং সম্পর্কসূত্র আধহাসি আর আনমনা চাহনির মোড়কে ঢেকে দিতে সক্ষম হন, যদিও তার ভেতরের ছাইচাপা দেমাগ তখন ওঁৎ পাতা বাঘের মত আড়মোড়া ভেঙে অগ্নিথুতু ছিটাতে থাকে।

মিসেস এরমোসিয়া দেল ফ্রেসনো ঈশ্বর ও স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস করেন। তার বিশ্বাস (যে বিষয়ে গীর্জার পুরোহিত ও তার সেবা সংগঠনের চেলাচামুণ্ডারা তাকে প্রায়শই নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে) স্বর্গে তার জন্য একটা বড়সড় স্থান বাঁধা রয়েছে। তিনি অবশ্য, স্বাভাবিকভাবেই, এই পৃথিবীতেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পছন্দ করতেন কেননা এই জীবনটার সঙ্গে তার চমৎকার বনিবনা হয়ে গেছে ইতোমধ্যে – একমাত্র বংশপরিচয় বিষয়ক আজগুবী অভিযোগটুকু ছাড়া – , কিন্তু কোন এক সকালে হঠাৎ তার গুরুত্বপূর্ণ শয্যায় ঘুম থেকে জেগে (কিংবা না জেগে), মিসেস এরমোসিয়া দেল ফ্রেসনো তার গুরুত্বপূর্ণ চাকরবাকরদের চীৎকার আর আহাজারিতে হৃদয়ঙ্গম করেন যে তিনি মারা গেছেন। তিনি কিছুটা বিস্মিত এবং ভীত হয়ে পড়েন, কেননা তিনি বাইরে অতটা প্রকাশ না করলেও, ভেতরে ভেতরে বিশ্বাস করতেন যে তিনি অমর। সময় গড়িয়ে যায়, মিসেস এরমোসিয়া দেল ফ্রেসনো বৃথাই প্রতীক্ষা করে চলেন ফেরেশ্তাদের, যাদের তাকে বেহেশ্তের এক বিশাল প্রাসাদের কোনো এক নির্বাচিত কক্ষে নিয়ে যাওয়ার কথা। পরিবর্তে তার আত্মীয়স্বজনেরা (সেই অসহ্য আধভগ্নিটাসহ) এসে হাজির হয় সদলবলে এবং এই ভাবে অবশেষে তার বংশপরিচয় ফাঁস হয়ে যায় জপমালা হাতে সমাগত এবং তাকে পরিবেষ্টন করে রাখা গুরুত্বপূর্ণ মহিলাদের কাছে।

মিসেস এরমোসিয়া দেল ফ্রেসনো কথা বলতে চান কিন্তু একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারেন না । তিনি ব্যাখ্যা করে বলতে চান যে এই আত্মীয়রা গুরুত্বপূর্ণ কেউ নয়, যে তারা আসলে তার আত্মীয়ই নয়, তারা তাদের সম্পর্ক বাড়িয়ে বলছে, তাদের সঙ্গে হাত মেলাবার, আলিঙ্গন করার কিংবা সান্ত্বনা দেয়ার দরকার নেই, প্রয়োজন নেই তাদেরকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার, বোকা বোকা প্রশ্ন করার, কেননা তাদের কোনো গুরুত্ব নেই…কিন্তু ততক্ষণেও কেউ আসে না তাকে বেহেশ্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য। যখন-তখন যাকে-তাকে যত্র-তত্র হুকুম দেয়ায় অভ্যস্ত মিসেস এরমোসিয়া দেল ফ্রেসনো ক্রমশ অধৈর্য হয়ে ওঠেন। ছয়টি অস্বস্তিকর দিন পার হয় এবং মিসেস এরমোসিয়া দেল ফ্রেসনো, অসহায় ভীতি আর ক্ষোভের সঙ্গে উপলব্ধি করেন যে তার উকিল, যাকে তিনি তার মূল্যবান ওয়ারিশপত্র (যেখানে তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি দান করে যান বৃহদাকার সেবা সংগঠন সমূহকে যারা তার গুরুত্বের কথা প্রচার করবে জীবনভর) রচনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তাকে বলছে যে এরকম কোনো ওয়ারিশপত্রর অস্তিত্ব নেই, কেননা মিসেস এরমোসিয়া দেল ফ্রেসনো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত – ঈশ্বর জানেন কেন! সংকোচ নাকি সংস্কার নাকি তার চরিত্রের দৃঢ়তা – তা তৈরি ও স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছিলেন ।

সেবা সংগঠন এর চেলাচামুণ্ডাদের একটাই মন্তব্য ‘এমনটা কে ভাবতে পেরেছিল!’ বৈধ ওয়ারিশপত্রর অনুপস্থিতিতে তাহলে এটাই ধরে নিতে হয় যে তার সমূহ সম্পত্তির মালিক হবে তার বিষণœ আত্মীয় পরিজন। মিসেস এরমোসিয়া দেল ফ্রেসনো কথা বলতে চান, এই অসম্ভব অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে চান, কিন্তু এখন তিনি এক ভূতুড়ে রাজ্যের বন্দি বাসিন্দা, কণ্ঠস্বর যাকে পরিত্যাগ করেছে। তিনি স্বর্গের দিকে তার হাত তুলতে চান, সেই স্বর্গ যা তার জন্য অদ্ভুতভাবে স্থগিত হয়ে গেছে, এবং সবাইকে জানাতে চান যে তার মহৎ অভিপ্রায়ের সঙ্গে প্রতারণা করেছে তার উকিল, সম্ভবত ঘৃণিত আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগসাযশেই। কিন্তু তিনি তা পারেন না। তিনি কিছূই করতে পারেন না।

সপ্তাহের পর সপ্তাহ তিনি সেখানে পড়ে থাকেন, তার চমৎকার প্রাসাদে অনাকাক্সিক্ষত আত্মীয়স্বজনদের (সেই ঘৃণ্য আধভগ্নিটাসহ) অনুপ্রবেশের সাক্ষী হয়ে। তিনি তাদের দেরাজ খুলে তার চিঠিসমূহ পড়তে দেখেন, তার গয়না ও পশুচামড়ার পোশাক পরতে দেখেন, দেখেন তার চাকরদের হুকুম দিতে, মদের ভাণ্ডার শূন্য করে দিতে, শহরের গণ্যমান্য মহিলাদের আপ্যায়ন করতে দেখেন, যারা তাদের মরিয়াভাবে তোষামোদ করে নিজেদের সেবামূলক সংগঠনে যোগ দিতে। তিনি সেই মহিলাদের অনুনয় করতে শোনেন, এবং তার আত্মীয়দের অবশেষে সম্মত হতে ও চেক লিখে দিতে দেখেন। তিনি দেখেন তারা কীরকম ঠিক তার মত করে হাসতে শিখে গেছে, এবং যখন তার নাম উচ্চারিত হয় তখন ঠিক একই রকম আলগা ও উদাসীন মুখভঙ্গী করে থাকতেও।

তখন পর্যন্ত কেউ আসে না তাকে স্বর্গে তুলে নিয়ে যেতে। তিনি নিঃসাড়ে অদৃশ্য দেহে শুয়ে থাকেন তার বিছানায় অন্যদের মাঝখানে, যারা সেখানে তার গায়েবী শরীরের ওপরেই বিশদভাবে যৌনকর্ম করে, তার পবিত্র স্মৃতিকে অপবিত্র করে স্থূল, মোটা দাগের রসিকতায়, যারা তার দেমাগ নিয়ে খোলাখুলি মশকরা করে, যেনবা আর সব মানুষের মধ্যে তিনিই একমাত্র এই পাপে পাপী। যারা মূলত অসুখী তারাই দেমাগী হয়, তিনি তো কখনো অসুখী ছিলেন না – তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ, অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

অবশেষে একদিন, তিনি, মিসেস এরমোসিয়া দেল ফ্রেসনো, ধীরে ধীরে (যিনি কী না উন্মাদের জগতেও পালিয়ে বাঁচতে পারেন না) উপলব্ধি করেন, বিস্ময় ও হতাশার সঙ্গে, যে তাকে কখনোই এই ধরাধাম থেকে তুলে নেয়া হবে না, অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো নরকেও নয়। কেন না, এটাই আসলে নরক, তা যত অদ্ভুত, অসম্ভব, অপ্রথাগত ও অধার্মিকই শোনাক না কেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত