রক্তমাংস ও একটি মানুষের উৎসব
হোরি খেলত নন্দলাল, বিরজমেঁ। ব্রজভূমিতে হোরি খেলতে গেলে কানু ছাড়া গীত নাই। ইতিহাস বলছে কানুই অনার্যদের আদি নেতা। বহিরাগত আর্যদের সঙ্গে সমানে সমানে লড়ে কখনও জিতেছিলেন, কখনও বা পারেননি ভারতভূমির এই কৃষ্ণবর্ণ ব্যক্তিত্বটি। ইনি পুরাণবর্ণিত দ্বারকার ন’ন, মথুরার ন’ন, ন’ন মহাভারতের গীতাকথক। ব্রাহ্মণদের ছাঁচে ফেলা ‘ভদ্রলোক’ সভ্যতার যেসব উৎসব অনুষ্ঠান, তার সমান্তরালে নিম্নবর্গীয়দের প্রাণের উদযাপন, যার আবশ্যিক অঙ্গ বন্ধহীন শৃঙ্গাররসে উত্তাল, আসব নিমজ্জিত হোলিকা দহন ও প্রমত্ত ব্যসন, তাকে আশ্রয় দিতে কানু ছাড়া আর কেই বা আছেন। অতএব ব্রজভূমির পশুপালক সমাজ, যাঁরা এ মাটির আদত সন্তান, বসন্তের ব্যাকানালিয়ায় প্রকৃতির সঙ্গে যখন একাত্ম হয়ে ওঠেন, কানু তখন তাঁদের স্বাভাবিক অবলম্বন হয়ে ওঠেন। মুক্তির, ভক্তির, শক্তির দেবতা। তাই ব্রজভূমির নন্দলালকে বন্দনা করেই এদেশের বসন্ত উৎসব, হোলি।বাঙালির দোলযাত্রা। ইস মেঁ বুরা ক্যা?
হোলির বাজারে একটাই স্লোগান। বুরা না মানো, হোলি হ্যাঁয়। হাজার বছর আগে রাজারা বছরের এই একটা দিন ভাঁড়েদের অনুমতি দিতেন তাঁদের নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি করার জন্য। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে। তা কেউ না মানলেও বিহারিদের জন্মগত ভাঁড়ামির অধিকারে হোলির দিন ” সা রা রা রা রা” র জলে এসব শৌখিন মজদুরিকে রঙের বালতিতে চুবিয়ে দেওয়ার গপ্পো শেষ হওয়ার নয়।
বহুদিন হলো। খ্রিস্টিয় পঞ্জিকা শুরু হবার সমসময়। এদেশের আদি সামাজিক উৎসব ছিলো ফসল কাটার পর উদ্দাম বসন্ত উদযাপন। মানুষ তাদের গৃহ ও পরিবেশ সংস্কার করতো। সামাজিকভাবে সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতো সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য। প্রত্যেকে নিজেদের বাসস্থান ধুয়ে–মুছে, তৈললেপন করে সুগন্ধি লতাগুল্মের ধূপদীপ দিয়ে সজ্জিত করতো তাকে। মাঘ–ফাল্গুন মাস জোড়া এই উদযাপনের মুখ্য অংশ ছিলো নির্বাধ ভোগসুখের পরম্পরা। এই উৎসবটি আসলে প্রাচীন প্রজননমুখী লোকবিশ্বাসের অঙ্গ । শৃঙ্গারকেন্দ্রিক খেলাধুলো, নৃত্যগীত ও ভাঁড়ামির প্রমত্ত আয়োজন। পুরুষ ও নারী, জাতি–বর্ণ নির্বিশেষে পরস্পরকে নানাভাবে রঙিন রঞ্জক দিয়ে আবৃত করতো। এই সময় এবিষয়ে কোনও রকম সামাজিক বিধিনিষেধ নিয়ে লোকে মাথা ঘামাতো না। সন্ধ্যা নামলে মানুষ ফুলসাজানো রথ আর জ্বলন্ত মশাল নিয়ে পুর বা গ্রামপরিক্রমা করতো। প্রথামাফিক এই সময় উদ্দাম নৃত্যগীতের সঙ্গে পরস্পরের প্রতি ফুল, তণ্ডুল ও সুগন্ধি নিক্ষেপ করার সঙ্গে ঢোলক, মৃদঙ্গ ও শঙ্খ বাজিয়ে উদযাপন করাই ছিলো বসন্ত–উৎসবের মুখ্য আকর্ষণ।
এই অনুষ্ঠানের পর রাজা নিজে হলকর্ষণ করতেন। ঘৃতসিক্ত বীজ রোপন করে কৃষিকাজশুরু করা হতো। এর ঠিক পক্ষকাল পরেই ছিলো মদন আরাধনা বা কামমহোৎসব।
‘প্রদ্যোতস্য সুতা বসন্তসময়স্তংচেতি নাম্রা ধৃতি
কামঃ কামমুপৈত্বয়ং মম পুনর্মনৈ মহানুৎসবঃ ।।‘
( শ্রীহর্ষের রত্নাবলী নাটকে কামউৎসবে রাজার উক্তিঃ সপ্তম শতক)
‘প্রদ্যোতের কন্যা ( রতি দেবী), বসন্তসময় এবং তুমি বিদ্যমান। অতএব নাম দ্বারাই কাম পর্যাপ্ত সন্তোষ লাভ করুন। এই মহান উৎসবকে ( বসন্তকালীন কামমহোৎসবকে) নিজস্ব উৎসব মনে করছি। ‘
জীমূতবাহন লিখেছিলেন দায়ভাগ গ্রন্থ দ্বাদশ শতকে। তা‘তে রয়েছে হোলাক বা হোলক উৎসবের কথা। সারা উত্তর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশেও এই উৎসবটির সম্যক প্রচলন ছিলো। সময়ের সঙ্গে এই পার্বণটির ক্রমবিবর্তন বেশ আকর্ষণীয় বিষয়। আদিযুগে এই উৎসবটি ছিলো কৃষিসমাজের পূজা অনুষ্ঠান। শস্যপূর্ণা চ বসুন্ধরার কামনায় নরবলি ও যৌনলীলাসম্পৃক্ত নৃত্যগীত উদযাপন ছিলো এর মুখ্য অঙ্গ। এই অনার্য ঐতিহ্যের সঙ্গে পরবর্তীকালের বৈদিক উপচার হোমযজ্ঞ মিলে যায়, নরবলির বদলে পশুবলি প্রচলিত হয়। সুশস্যকামনায় পূজা অর্চনার ক্ষেত্রে যেমন বলি ও যজ্ঞ গৃহীত হয়, একইভাবে হোলির শৃঙ্গাররসমুখর দিকটি কেন্দ্র করে বসন্ত, মদন ও কাম উৎসবের এবং রাধাকৃষ্ণের লীলাখেলার উৎপত্তি হলো। এর সঙ্গে কোন এক মূর্খ রাজাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করার জন–ইচ্ছাটিও প্রথা হিসেবে সামগ্রিকভাবে হোলি উৎসবের অংশ হয়ে গেলো।
যেরকম নথিভুক্ত ইতিহাসে দেখা যায়, তৃতীয়–চতুর্থ শতকে, অর্থাৎ গুপ্তযুগের প্রাথমিক সময়কাল থেকেই ষোড়শ শতক পর্যন্ত সম্পূর্ণ পুরাণযুগে বসন্ত বা মদন বা কামমহোৎসব নামে একটি উৎসব উত্তরভারতের সর্বত্র অতিসমারোহে পালিত হতো। এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায় তৃতীয়–চতুর্থ শতকে বাৎসায়নের কামসূত্রে, সপ্তম শতকে শ্রীহর্ষের রত্নাবলীতে, অষ্টম শতকের মালতী–মাধব নাটকে, একাদশ শতকে অল–বিরুনির লেখায়, দ্বাদশ শতকে জীমূতবাহনের কালবিবেক গ্রন্থে এবং ষোড়শ শতকে রঘুনন্দনের বিবরণে। এই উৎসবে প্রচুর নৃত্যগীতবাদ্য, শৃঙ্গারসূচক সংলাপ ও যৌনতাব্যঞ্জক অঙ্গভঙ্গি মুখ্য স্থান নিয়ে থাকতো। পূজা অনুষ্ঠানের অভীষ্ট দেবতা ছিলেন মদন ও রতি দেবী এবং পুষ্পময় চৈত্রের অশোকবৃক্ষের ছায়ায় তার আয়োজন করা হতো। সপ্তম শতকে রচিত শ্রীহর্ষের রত্নাবলী নাটকে মদন মহোৎসবে ভিজ্যুয়ালটি এইভাবের বর্ণনা করা হচ্ছে,
‘অহো, পৌরগণের আহ্লাদ অত্যন্ত উৎকর্ষ প্রাপ্ত হইতেছে, যেহেতু দিবস প্রারম্ভতুল্যকারী কুন্কুমচূর্ণবদ গৌর , বিক্ষিপ্ত পীত চূর্ণরাশি ও স্বর্ণালংকরণ দীপ্তি এবং কিণ্কিরাত পুষ্পশোভিত ভার অবনত পীত পরিচ্ছদশোভিত কৌশাম্বী নগর যেন স্বর্ণদ্রব মন্ডিত লোকযুক্ত হইয়া শোভা পাইতেছে‘। (অর্থ, পীত বস্ত্রশোভিত পুরবাসীরা পীতচূর্ণরাশি ( আবির) প্রক্ষেপ করে অশোকবৃক্ষের ছায়ায় স্বর্ণমন্ডিত হয়ে কামউৎসব উদযাপন করছে।)
ব্যাপারটি অবশ্য পুরোপুরি এদেশী নয়। য়ুরোপে এর প্রচলন দীর্ঘকাল ধরেই ছিলো। রোমান পঞ্জিকায় পয়লা মার্চ ছিলো বর্ষারম্ভ। মার্চ মাস মঙ্গলগ্রহের দেবতার নামে। যিনি পৌরুষের দেবতাও ছিলেন। এইদিনটি থেকে পুরোহিতরা একপক্ষকাল পথে পথে নেচে গেয়ে উল্লাস উদযাপন করতেন। ১৬ই ও ১৭ই মার্চ ছিলো ব্যাকাস নামে যে দেবতাটি গ্রিক ডায়োনিসাসের প্রতিরূপ, তাঁর পর্ব । সারা রোমান সাম্রাজ্য জুড়ে উদ্দাম পানভোজনের উৎসব হিসেবে পালন করা হতো সেটি। নিম্নবর্গীয়, অ–রোমান মানুষদের এই ব্যাপক উদযাপন দেখে রোমক অভিজাত শ্রেণীর সিনেট এই উৎসবটির উপর নানা বাধানিষেধ আরোপ করে। যদিও জুলিয়স সিজরের আদেশে এই উৎসবটির উপর রোমক সিনেটের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় যিশুর জন্মের বেশ আগেই।
পুরোহিতদের এই নৃত্যগীতকে মহাজাগতিক শক্তির প্রতি আহ্বান মনে করা হতো। পরবর্তীকালে প্রায় সমগ্র খ্রিস্টিয় বিশ্বে যে কার্নাভল (Carnaval) শোভাযাত্রা দেখা যায়, তার উৎস প্রাচীন পুরোহিতদের নৃত্যসংকীর্তন। এর মূল রয়েছে সুমেরিয়দের পৃথিবীমাতা ও প্রজননমুখী লোকধারার (Fertility Cult) উত্তরাধিকার ।
প্রাচ্যের এইসব লৌকিক উদযাপন খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়শতক থেকেই প্রচলিত ছিলো। প্রকৃতিবাদী ‘ধর্ম‘বিশ্বাসের নানা অঙ্গ রোমান সভ্যতার আগে থেকেই প্রভাবিত করেছিলো য়ুরোপিয় লোকযাপনকে। আদি খ্রিস্টিয় লোকাচারের মধ্যে ব্যাকাসের নামে প্রকৃতিবাদী উৎসব ভালোভাবেই জায়গা করে নিয়েছিলো। কিন্তু কালক্রমে ক্যাথোলিক বিশ্বাসের প্রভাবে তা ক্ষীণ হয়ে যায়।
রোমান সিনেটের পুরুষ সদস্যরা এর বিরোধিতা করলেও তাঁদের অন্তঃপুরিকারা প্রকৃতিবাদী ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন। ব্যাকাস বা ডায়োনিসাসের নামে যে বাধাবন্ধহীন উৎসব পালন করা হতো তার মূল চালিকাশক্তি ছিলেন রোমান অভিজাত মহিলারা। মার্চমাসের ১৬ই ও ১৭ই তাঁরা রোমের অ্যাভেন্তাইন পাহাড়ে সিমিলিয়া কুঞ্জে প্রাচীন গ্রিকদের অনুসরণে জাঁকজমক সহকারে এই উৎসব উদযাপন করতেন। ক্ষমতাশালী নারীপুরোহিতদের নেতৃত্বে এই উৎসব সমাজের বিভিন্ন স্তরে বেশ আধিপত্য বিস্তার করে। বসন্তঋতুকালীন শৃঙ্গার উৎসব পালন সারা পৃথিবীতেই বিশেষভাবে প্রচলিত ছিলো। যদিও এই উৎসবটিকে ঘিরে ক্ষমতাশালী ও নিম্নবর্গীয় মানুষের মধ্যে ক্ষমতার রাজনীতির টানাপোড়েন কখনও স্তিমিত হয়নি।
যেরকম অনুমান করা হয়, এদেশে ষোড়শ শতকের পরবর্তীকালে চৈত্রীয় কামমহোৎসব, ফাল্গুনী দোলপূর্ণিমায় প্রচলিত হোলি উৎসবের সঙ্গে মিলে যায় এবং পৃথকভাবে মদন উৎসব উদযাপনের দিন শেষ হয়ে যায়। আসলে মুসলিম রাজাদের আমলে হোলি উৎসব রাজ অনুগ্রহে প্রচুর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং মদন উৎসবকে গ্রাস করে নেয়। তবে এর ধর্মীয় দিকটি বেঁচে থাকে যখন একাদশ শতক নাগাদ রাধাকৃষ্ণের ঝুলন উৎসব এই চৈত্রীয় পার্বনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। অল–বিরুনির বিবরণ ছাড়াও গরুড় ও পদ্মপুরাণে এমত পড়া যায়। তারও পরবর্তীকালে এই অনুষ্ঠান চৈত্র পূর্ণিমা থেকে ফাল্গুনী পূর্ণিমায় এগিয়ে আসে। এই উৎসবের প্রধান পালনীয় কৃত্য ছিলো ঝুলন আরোহী রাধা ও কৃষ্ণের প্রতি সখিসহচরীরা আবীর, কুমকুম ও পুষ্পবৃষ্টি করবে। বাংলায় এই জন্যই উৎসবটিকে ‘দোলযাত্রা‘ বলা হয়, ঝুলনে দোলায়িত পুরুষ–প্রকৃতির যুগ্মসম্মিলনের দৈবী মাহাত্ম্য মুখর এর গরিমা। প্রাক বৈদিক আদিম কৃষিজীবী সমাজের ব্যাকানালিয়ার উদযাপন ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে হোলির বর্তমান রূপে বিবর্তিত হয়েছে। এখনও এই উৎসব মূলত ‘শূদ্রে‘র উৎসব। হোলিকাদহন বা বাংলায় যার নাম চাঁচর, তার আগুন অস্পৃশ্য শূদ্রদের থেকে গ্রহণ করার বিধি রয়েছে।
উত্তরভারতের অন্যান্য প্রান্তের মতো বঙ্গদেশেও দোলপূণিমার দিন বসন্ত উৎসব পালন করা হতো।বস্তুত এদেশে এই উৎসবটির আর্যসংস্কৃতিমুখিন রূপরেখাকে অতিক্রম করে আর্যেতর উদ্দাম উদযাপন অনেক বেশি প্রকট হতে দেখা যেতো। কারণ এটি মূলত কৃষিজাত সমাজের উৎসব। ‘নিম্নবর্গীয়‘দের প্রাণের উদযাপন। পুরাণযুগের পর সুলতানি আমলে এই উৎসবের সঙ্গে কামদেবতার পরিবর্তে কৃষ্ণরাধার আধ্যাত্মিক সংযোগটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলে আর্যাবর্তের হোলি এবং বাংলার বসন্ত–উৎসব তার নবতর সংস্করণ ‘দোলযাত্রা‘ নামে বৈষ্ণবমত বিশ্বাসীদের প্রধান উদযাপন হয়ে দাঁড়ায়। শ্রীচৈতন্য ছিলেন এই পরিবর্তনটির পথিকৃৎ। মূল বসন্ত বা কামমহোৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোত শৃঙ্গারমুখী নগরভ্রমণ বৈষ্ণব অধ্যাত্মপ্রথায় নগরসংকীর্তনে বদলে যায়। বৌদ্ধ সহজযান থেকে উদ্ভূত বাংলা সহজিয়া লোকধর্মের বিভিন্ন শাখার অনুগামীদের কাছে দোলযাত্রা ক্রমে অত্যন্ত লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে। নবাবি আমল শেষ হবার পর বৈষ্ণবদের দোলযাত্রা উদযাপন বড়ো মাপের সামাজিক অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়। সমাচার দর্পণে (৯ই মার্চ, ১৮২২) দেখতে পাই, “মোকাম শ্রীরামপুরের গোস্বামিদিগের স্থাপিত শ্রীশ্রীযুত রাধামাধব ঠাকুর আছেন পরে এই মত দোল যাত্রাতে শ্রীযুত বাবু রাঘবরাম গোস্বামির পালা হইয়া দোল যাত্রাতে রোসনাই ও মজলিশ ও গান বাদ্য ও ব্রাহ্মণ ভোজন ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরদিগের পুরস্কার আশ্চর্য্য রূপ করিয়াছেন ইহাতে অতিশয় সুখ্যাতি হইয়াছে।“
কয়েকবছর পরে এই সংবাদপত্রেরই ২৮শে মার্চ, ১৮৪০ সালে বঙ্গদেশে এই উৎসব পালনের একটি অন্য রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়।
“হুলির উৎসব।–বর্ত্তমান কালীন হুলির উৎসবে নানা দাঙ্গাহঙ্গামা ঘটিয়াছে বিশেষতঃ কলিকাতাস্থ শিক জাতীয়েরা ঐ উৎসবের ব্যয় নির্ব্বাহার্থ চাঁদা করিয়াছিল। পরে তাহারা অত্যন্ত মদ্য পানে মত্ততা পূর্ব্বক আবির দ্বারা অতি ভয়ঙ্কর রক্তবর্ণ হইয়া এবং নানা কুৎসিত গান করত পথে২ বেড়াইতে ছিল ইতি মধ্যে কাবল হইতে আগত কএক জন মহম্মদীয়েরদিগকে দেখিয়া তাহারদের গাত্রও আবিরাক্ত করিল।….” (বানান অপরিবর্তিত)। ‘শিক‘ জাতীয় বলতে মনে হয় শুধু শিখধর্মীয়দের নয়, সামগ্রিকভাবে উত্তর ভারতীয়দের কথাই বলা হয়েছে। বস্তুত প্রায় দুশো বছর আগের এই বর্ণনা আজকের উত্তরভারতের হোলি উদযাপনের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। বাঙালির ‘দোলযাত্রা‘র থেকে এর বিপুল ফারাক।
উত্তর ভারতে প্রচলিত হোলি উৎসবের যে সাধিত অমার্জিত উদযাপন রয়েছে তার থেকে ঊনবিংশ শতকের বাবুকালচারভিত্তিক নাগরিক বাঙালির ‘দোলযাত্রা‘র চোরাস্রোত আর অবক্ষয়ের ডাইনামিক্সের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিলোনা। এই পর্যায় থেকে দোলউৎসব উদযাপনে ব্রাহ্ম রুচিবোধ ও য়ুরোপিয় সফিস্টিকেশন নিয়ে আসার কৃত্যটি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেকালের বাঙালির থেকে একালের বাঙালির রুচি ও মননবোধে আরো অসংখ্য পরিমার্জন সাধনের পথে কবির এই প্রয়াসটিও অল্পবিস্তর সফল হয়েছিলো। তবে শান্তিনিকেতনী দোলের পৌত্তলিকতা, কালিদাসের কুমারসম্ভব বা বিহার অওধের শারীরমাংসে তপ্ত “রং বরসে” জুনুন, সবই পরস্পর পৃথক নিগূঢ় রণিত সন্ধান। দিনের শেষে উৎস খুঁজতে গেলে হোলি একান্তভাবে মানুষের উৎসব। দৈবী মহিমা আরোপ করে তার প্রতি অবিচার করার কোনও হেতু নেই।
আমাদের কবি যেমন বলেছেন, সহজসুন্দর,
…..সেইখানে তার পরাণখানি, যখন পারি বহে আনি,
নিলাজ রাঙা ফাগুন রঙে রাঙিয়ে দিতে থরে থরে ।।
ফাগুন হাওয়ায় রঙে রঙে পাগলঝোরা লুকিয়ে ঝরে ….