| 19 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

বাংলা গল্পের মপাসাঁ

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

আবাহন দত্ত

 

উনিশ-বিশ শতকের সন্ধিক্ষণে বাংলা সাহিত্য একদল লেখক পেয়েছিল, যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করতেন। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের লেখালিখিতে— বিশেষ করে ছোটগল্পে— উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এবং বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধও করেছিলেন। সেই দলেরই এক ঐশ্বর্যের নাম প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন— “ছোট গল্প লেখায় পঞ্চ পাণ্ডবের মধ্যে তুমি যেন সব্যসাচী অর্জুন, তোমার গাণ্ডীব হইতে তীরগুলি ছোটে যেন সূর্যরশ্মির মত।”

প্রবাসে

প্রভাতকুমারের আদি বাড়ি হুগলি জেলার গুরুপ। জন্ম বর্ধমানের মাতুলালয়ে, ১৮৭৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। তাঁর বাবা জয়গোপাল মুখোপাধ্যায়ের বদলির চাকরি— ঝাঝা, জামালপুর, দিলদারনগর। ই আই রেলে সামান্য বেতনের এই ‘সিগনালার’কে ঘুরতে হত পূর্ব ভারতের নানা প্রান্তে। প্রভাতকুমারের ছেলেবেলা অবশ্য এক জায়গাতেই কেটেছে। জয়গোপালের মাসতুতো ভাই রাজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জিম্মায় জামালপুরে শুরু হয়েছিল তাঁর লেখাপড়া, রাজেন্দ্রনাথ যে স্কুলে পড়াতেন, সেখানেই। ১৫ বছর বয়সে জামালপুর এইচ সি ই স্কুল থেকে এনট্রান্স পরীক্ষা দেন তিনি। তিন বছর পর পটনা কলেজ থেকে এফ এ, চার বছর পরে সেখান থেকেই বিএ।

বিএ পাশ করেই সরকারি ক্লার্কশিপের পরীক্ষা। ভারত সরকারের অফিসে চাকরি পান শৈলশহর শিমলায়। সেই অস্থায়ী চাকরি করতে করতেই শিমলা শহরকে ভালবেসে ফেলেন। পরে ‘প্রদীপ’ পত্রিকার ১৩০৪ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন সংখ্যায় ‘সিমলা-শৈল’ নামে তাঁর সচিত্র প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এক বছরের মধ্যে আবার সেখান থেকে কলকাতায় বদলি হন। ডিরেক্টর-জেনারেল অব টেলিগ্রাফ অফিস, এ বার স্থায়ী পদ।

কলকাতার এই অফিসেই প্রভাতকুমারের জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো একটা ঘটনা ঘটে। আলাপ হয় ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক সরলা দেবীর সঙ্গে। প্রভাতকুমার তত দিনে ‘ভারতী’র গণ্যমান্য লেখক, তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার উপর অগাধ ভরসা ও শ্রদ্ধা সরলা দেবীর। আলাপ ক্রমে ঘনিষ্ঠ হয়। ঠিক হয়, সরলা দেবীর মামা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের খরচে ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য বিলেত যাবেন প্রভাতকুমার। পাশ করে ফিরে এলে তাঁদের বিয়ে হবে। এমনিতেই কেরানিগিরিতে প্রভাতকুমারের মন টিকছিল না, তার উপর বিলেত যাওয়ার সুযোগ। ১৯০১ সালের ৩ জানুয়ারি কাউকে কিছু না জানিয়েই বিলেত পাড়ি দেন প্রভাতকুমার। না জানানোর অন্য একটা কারণও ছিল অবশ্য। আগের বছরই তাঁর বাবা মারা গিয়েছিলেন। মাতৃভক্ত প্রভাতকুমার জানতেন, মা সেই শোক তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কাজেই ছেলের বিলেত যাত্রায় আপত্তি উঠতেই পারত।

১৯০৩ সালের ডিসেম্বরে বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরলেন প্রভাতকুমার। কিন্তু সংসার পাতা হল না। কারণটা জানার জন্য একটু পিছিয়ে যাওয়া দরকার। এফ এ পরীক্ষা দেওয়ার ঠিক আগেই হালিশহরের ব্রজবালা দেবীর সঙ্গে প্রভাতকুমারের বিয়ে হয়েছিল। ব্রজবালা দেবী একেবারে অপরিচিত মানুষ ছিলেন না। ১৮৯৭ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘ভূত না চোর?’ নামে তাঁর একটা গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। সেই বছরই অকালপ্রয়াণ হয় তাঁর। এ বার ছেলের দ্বিতীয় বিবাহের ভাবনায় কোনও মতেই সায় দিলেন না প্রভাতকুমারের মা। এতটাই মর্মাহত হলেন প্রভাতকুমার, যে ঠিক করলেন আর কখনও বিয়েই করবেন না। ব্যারিস্টারি প্র্যাকটিসের জন্যও অনেক দূরে চলে গেলেন— শৈলশহর দার্জিলিংয়ে। কিন্তু সুবিধে হল না। পরের বছর জুলাইয়ে গেলেন রংপুর। সেখানে চার বছর। তার পর ১৯০৮ সালের মে মাসে গয়া। সেখানে আরও আট বছর। কিন্তু এত দিন প্র্যাকটিসের পরেও কিছুতেই ব্যারিস্টারিতে তাঁর মন বসছিল না। প্রভাতকুমারের জীবনীকার ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোধ্যায় লিখছেন, “সাহিত্যের কমল-বনে তিনি যে আনন্দের সন্ধান পাইয়াছিলেন, তাহাই তাঁহার সমস্ত চিত্তকে পরিপূর্ণ করিয়া রাখিয়াছিল।”

আবারও একটা অকস্মাৎ সুযোগ আসে প্রভাতকুমারের জীবনে। তখন ‘ভারতী’ ছাড়াও ‘প্রবাসী’, ‘মানসী’, ‘সাহিত্য’ ইত্যাদি পত্রিকায় ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখতে শুরু করেছেন তিনি। পাঠকরা তাঁকে চিনছেন। এই সময়ে, ১৩২০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে (১৯১৪ সাল) ‘মানসী’ পত্রিকার সম্পাদক হলেন নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়। তাঁর চেষ্টায় ‘মানসী’র সঙ্গে প্রভাতকুমারের পাকাপাকি সম্পর্ক তৈরি হল। দেড় বছরের মধ্যেই একটা সাপ্তাহিক পত্রিকারও পরিকল্পনা করে ফেললেন মহারাজা। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণকে সঙ্গে নিয়ে প্রকাশ করলেন ‘মর্ম্মবাণী’। সেখানে স্বনামে ও ছদ্মনামে নিয়মিত লিখতে থাকলেন প্রভাতকুমার। ছ’মাস পরে হঠাৎ সিদ্ধান্ত পাল্টালেন মহারাজা। ‘মর্ম্মবাণী’ উঠে গেল এবং ‘মানসী’র কলেবর বৃদ্ধি পেল— তৈরি হল নতুন পত্রিকা ‘মানসী ও মর্ম্মবাণী’। সহযোগী সম্পাদক প্রভাতকুমার। কিন্তু গয়াবাসী সম্পাদককে নিয়ে কলকাতায় পত্রিকার দফতরে কাজ চালাতে খুবই অসুবিধে হল। প্রথম কয়েক মাস পত্রিকা বার হওয়ার পাঁচ-সাত দিন আগে কলকাতায় পৌঁছে যেতেন প্রভাতকুমার। তাতেও যে খুব একটা সুরাহা হত এমন নয়। অবশেষে মহারাজাই একটা বন্দোবস্ত করলেন। ১৯১৬ সালের ১ অগস্ট কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ কলেজের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হলেন প্রভাতকুমার। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন এই পেশাতেই।

সাহিত্যপ্রেম

ছাত্রাবস্থাতেই প্রভাতকুমারের সাহিত্য রচনার শুরু। মূলত গল্পকার এবং কিছুটা ঔপন্যাসিক হিসেবেই বাংলা সাহিত্য তাঁকে চেনে। কিন্তু আদিতে তিনি যে কবি হতে চেয়েছিলেন, সে কথা হয়তো অনেকেরই অজানা। পুরনো ‘ভারতী’, ‘দাসী’, ‘প্রদীপ’-এর মতো পত্রিকায় তাঁর লেখালিখির শুরু। ‘ভারতী ও বালক’ পত্রিকার ১২৯৭ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যায় (১৮৯০ সাল) ‘চির-নব’ নামে প্রভাতকুমারের একটি কবিতা প্রকাশিত হয়— “নিতিই ভোরের খেলা/ কুহরে পিক-কুল/ পবন খেলা করে/ লইয়া ফোটা ফুল।…” বয়স তখন ১৭। পরের চার বছর আর কোনও রচনার খোঁজ পাওয়া যায় না।

এই সময়ে রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রতি অনুরক্ত হন প্রভাতকুমার, প্রবন্ধ ও গল্প রচনায় মন আকৃষ্ট হয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চিঠিপত্র মারফত যোগাযোগও ঘটে যায়। তাঁকে গদ্য লিখতে বলেন রবীন্দ্রনাথই। প্রভাতকুমার স্মৃতিকথায় বলেছেন, “কবিতার মা বাপ নাই, যা খুসী লিখিয়া যাই—কবিতা হয়। কিন্তু গদ্য লিখিতে হইলে যথেষ্ট পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন; সে পাণ্ডিত্য আমার কই?” রবীন্দ্রনাথের উত্তর— “গদ্য-রচনার জন্য প্রধান জিনিস হইতেছে রস। রীতিমত আয়োজন না করিয়া, কোমর না বাঁধিয়া, সমালোচনা হউক, প্রবন্ধ হউক, একটা কিছু লিখিয়া ফেল দেখি।” ‘দাসী’ পত্রিকায় বেনামে রবীন্দ্রনাথেরই ‘চিত্রা’ কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা লিখে ফেলেন প্রভাতকুমার। আর প্রথম বছরের ‘প্রদীপ’ (১৩০৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা) পত্রিকার জন্য লেখেন ‘শ্রীবিলাসের দুর্ব্বুদ্ধি’। প্রকাশিতও হয়। পরে স্মৃতিকথায় তিনি বলছেন, “কিন্তু তখন আমি ছিলাম “কবি”, সুতরাং গল্পে নিজের নাম না দিয়া শ্রীরাধামণি দেবী একটি কাল্পনিক নাম সহি করিয়া দিয়াছিলাম। এই কাল্পনিক নামটির একটু ইতিহাস আছে।” কী ইতিহাস? তার ঠিক আগের বছর কুন্তলীনের বার্ষিক পুরস্কারের বিষয় ছিল ‘পূজার চিঠি’। স্ত্রী যেন প্রবাসী স্বামীকে বাড়ি আসার জন্য চিঠি লিখছে, এটা-ওটা জিনিসের সঙ্গে এক বোতল কুন্তলীন আনতেও অনুরোধ করছে, এ রকম একটা চিঠি লিখতে হত। শ্রীমতী রাধামণি দেবী ছদ্মনামে একটা চিঠি পাঠিয়ে প্রথম পুরস্কার পান প্রভাতকুমার। কিন্তু কুন্তলীন কর্তৃপক্ষ কী ভাবে যেন খবরটা জেনে গেলেন। তার পর থেকেই কড়া নিয়ম হল, নাম পাল্টে চিঠি লিখলে প্রতিযোগিতায় পুরস্কার মিলবে না। প্রভাতকুমার বলতেন, ছেলেবেলায় এই পুরস্কারের সূত্রেই রাধামণি নামটার উপর তাঁর মায়া জন্মেছিল। কিন্তু ব্রজেন্দ্রনাথের মত, এই রাধামণি আসলে প্রভাতকুমারের শ্যালক-পত্নী, কাল্পনিক চরিত্র নন। 

যাই হোক, রবীন্দ্রনাথকে সেই ছদ্মনামের প্রসঙ্গও জানানোর সাহস করেননি প্রভাতকুমার। ‘ভারতী’তে সেই গল্পের সুখ্যাতিও করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, লেখক পরিচিতি না জেনেই। সাহস পেয়ে পরের ভাদ্র সংখ্যায় রাধামণির ছদ্মনামে ‘বেনামা চিঠি’ বলে আর একটা গল্প লেখেন প্রভাতকুমার। এ বারও ‘ভারতী’তে রবীন্দ্রনাথের কলমে তা উচ্চ প্রশংসা পায়। প্রভাতকুমার বলছেন, “দুইবার অনুকূল সমালোচনা হওয়াতে আমার বুক বাড়িয়া গেল। দ্বিতীয় বৎসর ‘প্রদীপে’ নিজ মূর্ত্তি ধরিয়াই বাহির হইলাম।” প্রকাশিত হল দু’টি গল্প, ‘অঙ্গহীনা’ ও ‘হিমানী’। এই সময়ে অবশ্য ‘ভারতী’র সম্পাদনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। নতুন সম্পাদক সরলা দেবী।

‘দেবী’ সিনেমার পোস্টারে কাহিনিকার হিসেবে প্রভাতকুমারের নামোল্লেখ; ‘নির্বাচিত সরস গল্প’ বইটির প্রচ্ছদ (ডান দিকে)

শূন্যস্থান

সাহিত্যিক হিসেবে প্রভাতকুমারের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পিছনে ‘ভারতী’র একটা বড় ভূমিকা ছিল। এখানে নিয়মিত ভাবে লিখতে লিখতেই পাঠকসমাজে জনপ্রিয় হতে শুরু করেন তিনি। হয়ে ওঠেন পত্রিকার একজন বিশিষ্ট লেখক। তার পর বই আকারে বেরোয় ‘ষোড়শী’, ‘দেশী ও বিলাতী’, ‘গল্পাঞ্জলি’, ‘নবীন সন্ন্যাসী’। বাংলা কথাসাহিত্যে তাঁর আসন পাকা হতে থাকে। সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলে তাঁর ছোটগল্পগুলো। ভাষা, বর্ণনাভঙ্গি, বিষয়বস্তুতে তাঁর নিজস্বতা পাঠক ভালবাসতে থাকেন। যেমন, বিলেতের বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা ‘দেশী ও বিলাতী’ বইয়ের গল্পগুলো রীতিমতো চমকে দিয়েছিল সবাইকে।

ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে: ‘Nature abhors a vacuum’ অর্থাৎ প্রকৃতি শূন্যস্থান পছন্দ করে না। বাংলা সাহিত্যে প্রভাতকুমার সম্পর্কে এ কথা বলতেন সমালোচকেরা। অনেকের মতে, রবীন্দ্রনাথ আর পাঠকের মাঝখানে একটা শূন্যস্থান ছিল। রবীন্দ্রবিরোধীরা তো সরাসরিই বলতেন যে, তাঁর সাহিত্য বস্তুতন্ত্রহীন, জনসাধারণের উপযোগী নয়। তাঁর ব্যাপ্তি, বাগ্রীতির তির্যক বৈদগ্ধ্য, সৌন্দর্যের অনুভূতির সূক্ষ্মতা এবং মনস্তত্ত্বের খেলা, কেবল বাছাই পাঠকসমাজের কাছেই উপাদেয়। কেউ কেউ বলতেন, সেই শূন্যস্থান পূরণ করেছিলেন প্রভাতকুমার। তিনি কোনও সংস্কার ভাঙেননি, কোনও নতুন সত্য সন্ধান করেননি, জীবনকে বিচার ও প্রশ্ন করার দুঃসাহস দেখাননি। বিষয়ের দিক থেকেও তিনি যে স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল ছিলেন, এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পকার হওয়ার গুণ হয়তো তাঁর ছিল না, কিন্তু পাঠকের ভালবাসা পাওয়ার যোগ্যতা প্রবল ভাবেই ছিল। “…‘great’ না হলেও তিনি ‘good’—তাঁর কৃতিত্ব সেইখানেই,” লিখেছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। সে কারণেই তাঁর গল্প-উপন্যাসের চাহিদা এমন তুঙ্গে ওঠে। শরৎচন্দ্রের আবির্ভাবের পর অবশ্য উপন্যাসে সেই জনপ্রিয়তা আর ধরে রাখতে পারেননি প্রভাতকুমার। গল্পের ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা হয়নি, ছোটগল্পে শরৎচন্দ্রের বিশেষ উৎসাহ ছিল না।

এত দিন পর সেই সময়টাকে দেখলে বোঝা যায়, বাংলা সাহিত্যে আরও একটা শূন্যস্থান পূরণ করেছিলেন প্রভাতকুমার। তাঁকে হয়তো সবাই নির্দ্বিধায় প্রথম শ্রেণির লেখক বলবেন না, কিন্তু তিনি যে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের মধ্যবর্তী পর্যায়ের সার্থক কথাশিল্পী হিসেবে একটা ফাঁক ভরাট করেছিলেন, সেটাও অস্বীকার করা যায় না। দীর্ঘ সময় না হলেও কিছু কালের জন্য নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন প্রভাতকুমার।

তিনি গভীর দর্শনের কথা শিখিয়ে-ভাবিয়ে যাননি, কিন্তু জগৎসংসারের হাল্কা-স্নিগ্ধ-সহজ কৌতুক এঁকে দিয়ে গিয়েছেন। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, সমসাময়িক ও সমানধর্মা অন্য সব গল্পকারের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলেন তিনি। চমৎকার প্রসাদগুণ মণ্ডিত ভাষায় লিখতেন, দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো উপাদানগুলোকে গল্পে পরিণত করতেন, এবং নিপুণ ‘ক্লাইম্যাক্স’ বানাতেন। গল্পের বুননে এমন সুবিন্যস্ত ‘সিচুয়েশন’ তৈরি হত যে, রোজকার লঘু হাসিকান্নাও পাঠকের মনে দাগ কেটে দিত। অথচ সেই সব অনুভূতি এমনিতে আমরা মনেও রাখি না।

১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে প্রভাতকুমারকে বলেছিলেন, “তোমার গল্পগুলি ভারি ভাল। হাসির হাওয়ায় কল্পনার ঝোঁকে পালের উপর পাল তুলিয়া একেবারে হুহু করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে। কোথাও যে বিন্দুমাত্র ভার আছে বা বাধা আছে তাহা অনুভব করিবার জো নাই।” গল্পের এমনই টান, যে কোনও কোনওটা দু’বার করে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রতি বারই তা নতুন করে ভাবিয়েওছিল। এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ নিজেই সে কথা ব্যক্ত করেছেন। 

বস্তুত, প্রভাতকুমারের সবচেয়ে সাফল্যের জায়গা ছিল সরস গল্প। সমসময়ে হাসির গল্প রচনায় তাঁর সমকক্ষ কেউই ছিলেন না। সরল, স্নিগ্ধ, মার্জিত, সজীব ভঙ্গিতে অনাবিল হাস্যরস তৈরি করতে পারতেন তিনি। কাহিনিসজ্জাও ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এমনিতে বাংলা সাহিত্যে কৌতুক-ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের অভাব কোনও কালেই হয়নি। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, কালীপ্রসন্ন সিংহ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, পরশুরাম, শিবরাম চক্রবর্তী— তালিকা শেষ করা যাবে না। এক এক যুগে এক এক চেহারায় এই শাখা সমৃদ্ধ হয়েছে। এই সব রথী-মহারথীদের কথা মাথায় রেখেও বলতে হয়, হাসির গল্প রচনায় প্রভাতকুমারের স্বকীয়তা চোখে পড়বেই। রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ ছিল, বাঙালি জাতির হৃদয় নাকি মনের সঙ্গে আমোদ করতে জানে না। তাঁর রসের গল্পগুলোয় সেই অভাব পূরণ হয়েছিল। 

প্রভাতকুমারের পাণ্ডিত্যের কথাও বলতে হয়। বিদেশি সাহিত্যে তাঁর অসামান্য দখল ছিল। তিনি জানতেন পাশ্চাত্যের আঙ্গিক, বাংলা কথাসাহিত্যে তা সৃষ্টিও করতে পেরেছিলেন। সাহিত্যের যে কৌশলকে ইংরেজিতে ‘Precision’ বলা হয়, প্রভাতকুমারের গল্পে তা দুর্দান্ত ভাবে দেখা যেত। আর তাই প্রমথ চৌধুরী তাঁকে প্রবাদপ্রতিম ফরাসি সাহিত্যিক গী দ্য মপাসাঁ-র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। প্রভাতকুমার হলেন ‘বাংলা গল্পের মপাসাঁ’। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরও একটি চিঠিতে প্রভাতকুমারকে লিখেছিলেন, “বড় বড় ফরাসী গল্প লেখকদের গল্প অপেক্ষা তোমার গল্প কোন অংশে হীন নহে।” 

অবশ্য আঙ্গিক ছাড়া দুই সাহিত্যিকের লেখালিখির আর কিন্তু কোনও মিল ছিল না। বরং বিষয়ভাবনায় তাঁরা একেবারে উল্টো মেরুর বাসিন্দা।

বিস্মৃতি

সরস কাহিনি ছাড়াও প্রভাতকুমারের যে সব সৃষ্টি পাঠকসমাজ যুগ যুগ ধরে মনে রেখেছে তার অন্যতম ‘দেবী’। তার একটা কারণ অবশ্য এই গল্প থেকে ১৯৬০ সালে ছবি বানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। পৌত্তলিক বিশ্বাসের শিকার হয়ে এক নারীর জীবন কতটা বিভীষিকাময় হয়ে উঠতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত ভয়ানক ট্র্যাজেডির চেহারা নিতে পারে, সেটাই দেখানো হয়েছিল এই গল্পে। সমাজের নানা আচারে মানুষের মন যে ভাবে বন্দি, এই কাহিনি তারই সমালোচনা। সময়ের নিরিখে ‘দেবী’ বহু যুগ এগিয়ে এবং শক্তির পরিচায়ক। এর আখ্যানভাগ রবীন্দ্রনাথের থেকেই পেয়েছিলেন প্রভাতকুমার। এই বহুপঠিত গল্প সম্পর্কে সাহিত্য সমালোচক জগদীশ ভট্টাচার্য বলেছিলেন, “‘দেবী’ গল্প রচনার পঞ্চাশ বৎসর অধিক কাল ধরে বাংলা ছোটগল্প অনেক পথ অতিক্রম করেছে। কিন্তু ছোটগল্পের সর্বাঙ্গীণ বিচারে এর সাফল্য ও উৎকর্ষ এখনো অনতিক্রম্য বলে মনে হয়।”

তা সত্ত্বেও প্রভাতকুমারকে কিন্তু বাঙালি সে ভাবে মনে রাখেনি। বাজারে তাঁর বইয়ের চাহিদা ছিল না এমন নয়। কিন্তু যথাযথ ভাবে প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেলে এক সময় পাঠকও লেখককে ভুলে যায়। ১৯৮৭ সালে বিমল করের লেখায় পাওয়া যায়, বহু বছর হয়ে গেল প্রভাতকুমার গ্রন্থাবলী আর পাওয়া যায় না। এক-আধটা ‘শ্রেষ্ঠগল্প’ জাতীয় বই অবশ্য বাজারে ছিল, কিন্তু সে আর কতটুকু? ফলে বৃহত্তর পাঠক গোষ্ঠীর সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র প্রায় ছিন্ন। অনেক পরে প্রভাত গ্রন্থাবলী বেরোতে শুরু করে, বড়ই অনিয়মিত। সব খণ্ডও পরপর পাওয়া যেত না। অথচ প্রকাশের পর বইগুলো বিক্রি ভালই হত! কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে স্তরেও এখন বাংলা সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীরা প্রভাতকুমারের লেখা খুব একটা পড়েন না। এটা ঠিকই যে, নিজের সময়ে অতি জনপ্রিয় বহু লেখকই পরবর্তী কালে অপঠিত হয়ে যান। কালের নিয়মেই সমাজ তাঁদের মনে রাখে না। কিন্তু বিমল করের মতে, “… প্রভাতকুমার সে জাতীয় লেখক নন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা তাঁকে ভুলতে বসেছিলাম।” পরে অলোক রায় তিন খণ্ডে প্রভাতকুমার গল্প গ্রন্থাবলী সম্পাদনা করেন। অন্য দু’-একটা বইও ফের প্রকাশিত হয়। বিমল কর নিজে সম্পাদনা করেন ‘নির্বাচিত সরস গল্প’।

অধ্যাপনা পেশা হলেও লেখালিখি করে কম রোজগার করেননি প্রভাতকুমার। ব্যারিস্টারির দিনগুলোতে সেই অর্থবল তাঁর সাহিত্য-সাধনায় সহায়কই হয়েছিল। পরে অধ্যাপনার সময়েও মন দিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। পাঠকের পাশাপাশি বিদগ্ধ মহলেও সম্মানিত হয়েছেন। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ তাঁকে অন্যতম সহকারী সভাপতি নির্বাচন করে। 

এর পরেও বাঙালি সমাজ প্রভাতকুমারকে সে ভাবে মনে না রাখার পিছনে একটা কারণ তিনি নিজেই। মানুষ হিসেবে আত্মগোপনপ্রয়াসী— সভা-সমিতিতে বিশেষ যেতেন না। নিজের মতো করে সাহিত্য সাধনা করতে ভালবাসতেন। নাম-যশের আকাঙ্ক্ষা নয়, তাঁর ব্রত ছিল পাঠককে অনাবিল আনন্দ দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ যে পঞ্চপাণ্ডবের কথা বলতেন, তার মধ্যে একজন ভীমও ছিল! রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখাকে বলতেন গদার মতো ‘বিষম ভারি’, যেন মাথার উপর এসে পড়ে। প্রভাতকুমারের অনাবিল আনন্দযাত্রা ঠিক এর বিপরীত।

মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন আন্তরিক ও সহৃদয়। সাহিত্যিক প্রভাতকুমারকে ছাপিয়ে যে হেতু মানুষ প্রভাতকুমার কখনও প্রকাশ্যে আসেননি, তাই তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানার সুযোগও আমাদের তেমন হয়নি। তবে ব্রজেন্দ্রনাথ লিখেছেন, মানুষ হিসেবেও কোনও অংশে কম ছিলেন না সাহিত্যিক প্রভাতকুমার। তাঁর সমগ্র পরিচয়েই তা বোঝা যায়।

ঋণ স্বীকার: প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়: ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সমকালীন: প্রবন্ধের মাসিকপত্র (দ্বাবিংশ বর্ষ॥ মাঘ ১৩৮১), বাংলা গল্প-বিচিত্রা: নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, নির্বাচিত সরস গল্প: প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (সম্পা. বিমল কর)

 

 

 

 

 

One thought on “বাংলা গল্পের মপাসাঁ

  1. সরস গল্প রচনার ক্ষেত্রে তার প্রতিভার কথা বলেছেন বটে কিন্তু উদাহরণ দিলে বক্তব্য জোড়ালো হয়। যেমন দেবীর কথা উল্লেখ থাকলেও বলবান জামাতা কিংবা রসময়ীর রসিকতা গল্পদুটির উল্লেখ করা যেত। রসময়ীর রসিকতা তো আকাশবানী কলকাতা থেকে নাট্যরুপ প্রচারিত হয়। আমার মতে এমন সহজ সরস গল্পকার বাংলা সাহিত্যে কমই আছে। তবু লেখককে ধন্যবাদ এই বিস্মৃতপ্রায় গল্পকারকে তুলে ধরার জন্য।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত