| 24 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ছোট গল্প: মার্চের গল্প । মাহমুদুল হক আরিফ

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
মার্চ মাস। ২ তারিখে পতাকা উত্তোলন। ৭ তারিখে ঐতিহাসিক ভাষণ। ২৫ তারিখে ভয়াল কালো রাত। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস। মার্চ, মার্চ, মার্চ কী অসম্ভব তাৎপর্যময় এক একটি দিন। একাত্তরের মার্চেও বসন্ত এসেছিল। রঙে রাঙানো এক বসন্ত। এ কারণেই কী বসন্তের ফুলগুলো এতো বেপরোয়া লাল? এ দেশে অনেকেই মুখ ফসকে বলে ফেলে ‘রক্ত ঝরা ফাগুন’। যদিও ‘আগুন ঝরা ফাগুন’ বাক্যটি এখন ভীষণ প্রচলিত। ফাগুনকে আগুনের সাথে তুলনা কেন? আগুনের তেজ নাকি শিমুল, পলাশ, অশোক, কিংশুক অর রক্ত কাঞ্চন রাস্তার দুধারে শোভা বাড়ায় বলে? নাকি এর পেঁছনে আছে মুক্তির আন্দোলন! তবে ফাগুনের খড় তাপে রাস্তার শোভা বাড়ুক আর নাই বাড়ুক লালুর যে শোভা বাড়ায় না তা শুধু লালুই জানে। খটখটা রোদে তামাটে শরীরটা পুড়ে পুড়ে আরো লাল হয়। আদালত পাড়ায় আসামী নিয়ে গেলে যেমন চেহারা দেখতে হয়- ওকে আমাদের সামনে ধরে নিয়ে আসার পর তেমনই লাগছিল। প্রায় বারো বছরের ছেলেটা নাকি দোকানে চুরি করেছে। হ্যাঁ চুরিই হবে হয়ত, তা না হলে- অমন জড়োসড়ো হয়ে রয়েছে কেন? যারা ওকে ধরে নিয়ে এলো তারমধ্যে একজন এলোপাথাড়ি কিলঘুষি মারলো। এতো তড়িৎ গতিতে ঘটনা ঘটলো, থামানোর আগেই- রক্ত ঝরতে শুরু করলো লালুর মুখ থেকে। অতি উৎসাহীদের নিবৃত্ত করার পর। কিছু প্রশ্ন করা হল লালুকে। উত্তরে যা উঠে আসলো, তাতে উপস্হিতদের কেউ ভাবেনি শাওয়াল জবাবে কী উন্মোচিত হতে চলেছে… আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য এখানে কোন উকিল নেই- ওর পক্ষে। বিচারকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো ওকে দাঁড় করানো হলো আমাদের মুখোমুখি। লালুর থুতনিটা বুকের কাছে নিচু হয়ে গেঁথে আছে- চিবুকের কাছেই তো হৃদয়। বিটগুলো দ্রুত হচ্ছিল, তা ওর বুকের উঠানামাই বলে দিচ্ছিল। আশেপাশের কেউ টের পেয়েছিল কী? না, কেউ টের পায়নি। আমাদের প্রশ্ন শুনে নিস্তেজ দেহে প্রাণ সঞ্চার হল ওর। নাইনটি ডিগ্রী এঙ্গেল থেকে একহারা গাছের মতো সোজা হয়ে উঠলো লালুর ঘাড়। এখানে অনেক মানুষ। কিন্তু একটি চোখও অনুসরণ করল না, লালুর চোখ। প্রশ্নটা আবার করা হলো-
: তোর বাবা কি করে? 
: এবার যেন সম্বিৎ ফিরে পেল লালু বলল আমার বাবা সম্পর্কে জীবনে প্রথম আপনি জানতে চাইলেন। আমার বাবা আমাকে তিন বছর বয়সে মায়ের কাছে ফেলে রেখে চলে গেছেন। তার চেহারা আমার মনে নেই, কারণ চলে যাবার পর আমি আমার বাবাকে আর একবারও দেখিনি। তিনি কি করেন, কোথায় থাকেন, আমি জানি না স্যার। বাপ চলে যাওয়ার পর বস্তিতে পড়ে থাকলাম আমি, আর আমার মা। ছোটবেলায় মায়ের কাছে বাবার কথা অনেকবার জানতে চেয়েছি… একবার রাগের মাথায় মা বলছিলো তর বাপে মরছে- এরপর আমি কোন দিন আর জানতে চাইনি। 
: তোর মা কি কাজ করে? 
: মানুষের বাড়িতে ছুটা কাজ করতেন। আমাকে ফেলে রেখে এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করতেন। বেশির ভাগ দিন মা বাসী ভাত নিয়ে এসে দিতেন।কোন কোন দিন একবেলা রান্না করতেন। যে দিন রান্না করতেন বেতনের টাকায় বাজার করতেন এবং এসেই ভাত চড়িয়ে দিতেন। গরম ভাত। এভাবে কিছু দিন যেতে না যেতেই ‘মা’ দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। তখন আমার বয়স সাত। যতটুকু মনে আছে তিনি ঐ রোগ নিয়ে কাঁতরাতে কাঁতরাতে অল্প দিনের মধ্যে মরে যান। 
কত দিন আগে? 
: দিন-সন-তারিখ মনে নেই। আমাকে রাস্তায় বসিয়ে বস্তির মানুষ টাকা তুলে মাকে- কবরখানায় রেখে আসে। 
: যদি তোর বাবাকে যদি খুঁজে পাওয়া যায় তুই কী তার সাথে থাকবি? 
: বাবা বেঁচে থাকলেও আমি তাকে চিনবো না, সে আমার স্মৃতিতে নেই। মায়ের মৃত্যুর পর আমি একা। একা হলেও কয়েক দিন বস্তির লোকজন আমাকে থাকতে খেত দিয়েছে। কিন্তু ঐ বস্তিতে যে দিন সরকারি বুলডোজার দৈত্যের মতো ঢুকলো আমাকে আশ্রয় দেয়া পরিচিত লোকগুলো দ্বিগবিদিক হারিয়ে গেলেন। আমার স্হান হল রাস্তায়। অনেকগুলো শীত-বর্ষা আমি আকাশে নিচে কাটিয়ে দিয়েছি। 
: কাজের সন্ধান করিস নি? 
: হ্যাঁ করেছি লেগুনার কন্টাকটরি করেছি। একটা গ্যারেজে কয়েকদিন কাম করছি, একটা হোটেলে ম্যাসিয়ারের কাম করছি। করোনায় হোটেল বন্ধ অনেক দিন কাম নাই। গার্মেন্টসে কাম করতে চাইলে কয় বয়স হয় নাই। 
: চুরি করলি কেন? 
: এর আগেও লেগুনার টাকা মিলাইতে পারি নাই বইলা মালিকে দূর্নাম দিছে- কাজ ছাইড়া চইলা আইছি। কিন্তু আমি তো চুরি করতে চাই নাই। কিন্তু ক্ষুধা তো থামে। বাক্যটা তখনও শেষ করতে পারেনি লালু। শেষ বাক্যটি অসমাপ্ত। একটি টহল পুলিশ ভ্যান হাজির। নতুন করে শোরগোল উঠলো। পুলিশ এগিয়ে এলো। ওকে হস্তান্তর করা হলো পুলিশের হাতে। 
আবার সবাই মিলিয়ে যাচ্ছিল যে যার মতো। একজন অপরাধী কিশোরকে ধরিয়ে দিয়ে আমরাও এগিয়ে চললাম। দূরে আরো দূরে পুলিশ ভ্যানটি মিলিয়ে গেল ভ্যানটি আর দেখা যায় না এর কারণ অনেকগুলো ব্যানার। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর উদযাপনের ব্যানার। আমার কান লালুর অসমাপ্ত বাক্যটি বহন করে আছে… ”ক্ষুধা তো থামে….” তারপরের শব্দটি সম্ভবত “না”। 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত