ফুল, অশ্রু, প্রেম-৩১ নারীর কবিতা (পর্ব-১২) । মুম রহমান
ভিস্লভা শিম্বোরাসকা [Maria Wisława Anna Szymborska ]
‘কবিতার মোৎজার্ট’ বলা হয় ভিস্লভা শিম্বোরাসকা [Maria Wisława Anna Szymborska](১৯২৩-২০১২)-কে। অথচ ধারণা করা হয়, তিনি ২৫০-এর বেশি কবিতা লিখেননি। তার প্রতিটি কবিতাই সুনিপুন, পাঠযোগ্য, আবৃতি যোগ্য। তিনি কবিতা লেখাকে একনিষ্ঠতায় গ্রহণ করেছেন। আবার ইতালিয় পত্রিকা ‘লা রিপাবলিকা’ তাকে বলেছিলো, ‘কবিতার গ্রেটা গার্বো’। তার কবিতার সুর, সৌন্দর্য, নিটোলতা কখনো তাকে সুর সম্রাট কখনো অভিনয় সম্রাজ্ঞী কথা মনে করিয়ে দেয়। পোলিশ কবি, অনুবাদ, প্রাবন্ধিক শিম্ব্রোরাসকা ১৯৯৬ সালে নোবেল পুরস্কার পান। কবিতা হাজারে একজন পড়ে, কবিতার বই বিক্রি হয় না- এ সব কথাকে মিথ্যে করে দিয়েই পোলান্ডে তার বইগুলো সেরা বিক্রির তালিকায় থাকে। কবিতার বইয়ের জন্যে এমন জনপ্রিয়তার নজির খুব কমই আছে।
আমার বোনের প্রশংসায়
আমার বোন কবিতা লিখে না।
আর এমন ভাবাও ঠিক না, সে আকস্মিক কবিতা লিখতে শুরু করবে।
সে তার মায়ের মতোই, তিনিও কবিতা লেখেননি।
এবং তার বাবাও, তিনি কবিতা লিখেননি।
আমি নিরাপদ বোধ করি আমার বোনের ছাদের তলায় :
আমার বোনের স্বামী লাগলে মরে যাবে কিন্তু কবিতা লিখবে না।
অপিচ পিটার পাইপারের* দাঁতভাঙা শব্দের পুনরাবৃত্তি মনে হলেও
সত্যটি হলো, আমার কোন আত্মীয়-স্বজনই কবিতা লেখে না।
আমার বোনের ড্রয়ারে, ডেস্কে একটা পুরনো কবিতা নেই,
আর হাত হ্যান্ডব্যাগেও একটা নতুন কবিতা নেই,
যখন আমার বোন আমাকে মধ্যাহ্নের ভোজনে আমন্ত্রণ জানায়,
আমি জানি সে আমাকে তার কবিতা পড়ে শোনাবে না।
তার স্যুপ সুস্বাদু কোন রকম নিগুঢ় উদ্দেশ্য ছাড়াই।
তার কফি কখনোই কোন পান্ডুলিপিতে ছলকে পড়ে না।
আসলে বহু পরিবার আছে যেখানে কেউই কবিতা লেখে না,
কিন্তু একবার তা শুরু হলে কোয়ারেন্টাইনে যাওয়া বড় কঠিন।
কখনোবা কবিতা ঝর্ণার মতো নেমে আসে প্রজন্ম ধরে,
তৈরি হয় মারাত্মক ঘূর্ণি যেখানে পারিবারিক ভালোবাসা হয়তো প্রথিত।
আমার বোন কিছুটা সাফল্যের সাথে মৌখিক গদ্যকে ধরতে পেরেছে।
কিন্তু তার সমগ্র রচনাবলী আদতে পোস্টকার্ড
ছুটিতে গিয়ে লেখা
যার ভেতরকার লেখাগুলো প্রতি বছরের পুরনো প্রতিশ্রুতির মতো:
যখন সে ফিরে আসে,
তখন তার বলার আছে
কতো কিছু
কতো কতো
কতো কিছু।
* ইংরেজিতে ‘পিটার পাইপার’ একটি সুপরিতি টাং টুইস্টার (Tongue Twisters)। বাংলায় যেমন আছে ‘পাখি পাকা পেঁপে খায়’। দাঁত ভাঙা এই শব্দযুগল উচ্চারিত হয় জিভের জড়তা কাটাতে। আগ্রহীরা চর্চা করতে পারেন-
Peter Piper picked a peck of pickled peppers;
A peck of pickled peppers Peter Piper picked;
If Peter Piper picked a peck of pickled peppers,
Where’s the peck of pickled peppers Peter Piper picked?
আরো পড়ুন: ফুল, অশ্রু, প্রেম-৩১ নারীর কবিতা (পর্ব-১১)
যথার্থ প্রেম
যথার্থ প্রেম। সেটা কি স্বাভাবিক
তা কি ঐকান্তিক, তা কি বাস্তবসম্মত?
পৃথিবী সেই দুইজন লোকের কাছ থেকে কী পেতে পারে
যারা নিজেদের জগত নিয়েই আছে?
কোন যথার্থ কারণ ছাড়াই একই পদস্তম্ভে দাঁড়িয়ে আছে,
এলোপাথারি আঁকছে লক্ষ লক্ষ ছবি কিন্তু নিশ্চিত যে
এমনভাবেই তা হবে- কিসের পুরস্কার হিসাবে?
বীনা কারণেই।
কোথাও থেকে আলো নেমে আসে।
কেন এই দুজনের উপর আর অন্যদের উপর নয়?
এ কি বিচারের অবমাননা নয়? হ্যাঁ এ তো তাই।
ও কি আমাদের বহুসাধ্যে জাগ্রত নীতিকে ব্যাহত করে না,
আর শীর্ষ থেকে নীতিকে ছুঁড়ে ফেলে না? হ্যাঁ দুটোই ঘটে।
দেখো সুখি দম্পতিকে
নিদেনপক্ষে তারাতো এটাকে লুকাতে পারতো,
বন্ধুদের জন্য হলেও একটু মিথ্যা বিষণ্ণতা দেখাতে পারে?
শোনো ওদের হাসি- এ তো অপমান।
যে ভাষা তারা ব্যবহার করে- তা বিভ্রান্তিকর পরিস্কার।
আর ওদের ছোট্ট উল্লাস, উদযাপন,
বিস্তৃত পারস্পরিক প্রাত্যহিক কাজ-
এটা সুনিশ্চিতই মানব জাতির বিরুদ্ধে একটা চক্রান্ত!
ব্যাপারটা কতদূর গড়াতে পারে তা কল্পনা করাও কঠিন
যদি লোকে তাদের উদাহরণ অনুসরন করতে থাকে।
ধর্ম কিংবা কবিতা কতটুকুই বা হিসাব করতে পারে?
কতোটুকু মনে রাখবে? কতটুকু অস্বীকার করবে?
কেইবা সীমারেখায় বন্দী থাকতে চায়?
যথার্থ প্রেম? সেটা কি সত্যিই দরকারী?
কৌশল আর সাধারণ জ্ঞান বলে নিরবে একে এড়িয়ে যাও,
জীবনের পরম চক্রের কেলেঙ্কারির মতো।
এর সাহায্য ছাড়াই নিখুঁত উত্তম সন্তান জন্ম দেয়া সম্ভব।
লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীকে জনবহুল করতে পারতো না এটা
এ জিনিস বড় দেরীতে আর বড় কম কম আসে।
যারা কোনদিন সত্যিকারের ভালোবাসা খুঁজে পায়নি
তাদেরকে বলতে দাও, এমন কিছু পৃথিবীতে নেই।
তাদের এই বিশ্বাস তাদের জীবন মৃত্যুকে আরো সহজ করবে।
জন্ম ২৭ মার্চ, ময়মনসিংহ। এমফিল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা লেখালেখি।