Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

স্বপ্ন ছোঁয়ার দিন

Reading Time: 6 minutes

 

“পড় মা পড়, ভাল করে পড়, নইলে আমার মতো মাথা চাপড়াতে হবে একদিন…”, মমতা পড়তে বসলেই মা একবার না একবার বলতোই এমন কথা। খুব গরমে কখনো ওর পিঠের দিকে তালপাখার হাওয়া করতে করতে, কখনো  উঠোন ঝাড়ু দিতে দিতে, কিংবা দাওয়ার পাশে রান্নাঘরে মাছ কুটতে কুটতে আপনমনেই বলতো যেন মা।

মায়ের সারাদিন কাজের শেষ নাই। এই গোয়াল সাফ করছে, এই গরুকে খেতে দিয়ে রান্না চাপানো খড়ির চুলায় আরো দুটো পাটখড়ি ভেঙ্গে গুঁজে দিয়ে আসছে, রাতের জমা এঁটো বাসন-কোসন মাজতে বসছে কয়লার সাথে খানিকটা গুঁড়ো সাবান মিশিয়ে, কিংবা এক ডালা চাল নিয়ে বসছে ঝেড়ে ঝুড়ে রাখতে, এক ফাঁকে কলপাড়ে ভিজিয়ে রাখা কাপড়গুলো ধুয়ে মেলে দিচ্ছে বাড়ির পিছনে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় লম্বালম্বি বাঁধা দড়িটায়। তারই মধ্যে হয়ত বাটিতে এক খাবলা বাসনা তেল নিয়ে এসে বসলো মমতার পিছনে, খোঁপা করে বাঁধা চুলগুলো খুলে দিয়ে হাতের তেলোয় তেল ঢেলে ঘষতে লাগলো হুড়মুড় করে। বইয়ের উপর ঝুঁকে থাকা মমতা তখন বাধ্য হত মুখ তুলতে, মাথাটা পিছনে সরে আসতো মায়ের হাতের টানে; একটু কঁকিয়ে উঠে বলতো, উহ্‌ মা, লাগে তো! কিন্তু তাতে থোড়াই পাত্তা দিত মা, আরো জোরে জোরে তেল ঘষতে ঘষতে বলত, “মন দিয়ে পড়, মন দিয়ে পড়, কলেজে পড়া লাগবে তোকে, চাকুরী করা লাগবে বুঝলি? নইলে আমার মতো দাসী হয়ে থাকবি…”

“আচ্ছা মা, তুমি কি আব্বার দাসী?” মমতা হেসে বলতো।

মা সে কথার জবাব না দিলেও মমতা নিজেই আজকাল বোঝে অনেককিছু। আব্বার গোসল করে ছেড়ে রাখা লুঙ্গিটা গেঞ্জিটা, কিংবা আলনার নিচে ফেলে রাখা শার্টটা পাঞ্জাবিটা কুড়িয়ে এনে মা যখন কলপাড়ে বসে সাবান ঘষে ঘষে ধোয়, বারবার চোখের সামনে ধরে দেখে কলারের ঘামের দাগটা কিংবা রাস্তা থেকে ছিটকে এসে লাগা কাদার দাগটুকু উঠলো কিনা ঠিকমতো; তখন মমতা বোঝে মায়ের মূল্য যেন তার কাজের নিপুণতা দিয়েই স্থির হবে, যেন সবসময় শুধু তার শ্রম দিয়েই খুশি রাখতে হবে আব্বাকে। আব্বার সাথে কথা বলার সময় মায়ের মৃদু ভীরু ভীরু কণ্ঠস্বরে ঠিকই বোঝা যায় সংসারে মায়ের জোর কতটা কম। দুপুরে দোকান থেকে আব্বার বাড়ি ফেরার সময় হলেই মা কলপাড়ে বালতিতে পানি ভরে পাশেই চেয়ারের হাতলে লুঙ্গি গামছা গুছিয়ে রাখে, আর আব্বা যতক্ষণ বাড়ি থাকে মায়ের মুখটা কেমন যেন উদ্বিগ্ন হয়ে থাকে। আব্বা খাবার চাইলে মা ছোটাছুটি লাগিয়ে দেয় ছোট্ট টেবিলটায় থালা বাটি সাজাতে, কেননা দেরি হলেই, কিংবা খাবারটা ঠাণ্ডা হয়ে গেলেই আব্বা এমন বিরক্ত চোখে তাকায় যে মায়ের মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে যায়। মমতা বোঝে মায়ের উৎকণ্ঠাটুকু, আব্বার খাওয়ার সময় সেও এসে হাত লাগায় মায়ের সাথে।

কিন্তু শুধু ওই সময়টুকুই মা ঘরের কাজে মমতাকে হাত লাগাতে দেয়, আর সব কিছুতেই মায়ের ‘না’!

মা, দাওনা চালগুলো আমি বেছে দেই।

না তুই পড়!

মা, দাও তো কাপড়গুলা আজ আমি ধুই।

না তুই পড়!

উহ মা, সারাক্ষণ কেউ পড়ে!

তাইলে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক। চোখের মাথার বিশ্রাম হোক!

টেস্ট পরীক্ষার পর, এসএসসি পরীক্ষার আগে স্কুল যখন বন্ধ, মা-মেয়ের এমন কথাবার্তা প্রায় রোজই শোনা যেতো। দুপুরে আব্বা খেয়ে যখন ফের দোকানে চলে যেতো, মা-মেয়ে নাওয়া খাওয়া সেরে বিছানায় গড়িয়ে গল্প হতো খানিক। তেজ কমে আসা রোদটা তখন এসে লুটিয়ে পড়তো রান্নাঘরের পাশে শিউলি গাছটার গোড়ায়, পিছনের কাঁঠাল গাছের ডালে বসে ঘুঘু ডেকে যেতো একমনে, টিনের চালে মাঝেমাঝে ধুপ শব্দ তুলে খসে পড়তো এক একটা পাকা সুপারি। সেই থমকে দাঁড়ানো পড়ন্ত বেলায় মা-মেয়ের কত যে কথা হতো। মমতা বলতো ওদের স্কুলের গল্প, বলতো ওর প্রিয় শারমিন আপার কথা। আপা ওদের কত ভাল ভাল কথা বলেন। পড়ার বইয়ের বাইরেও কত বই এনে পড়তে দেন। মায়ের মতই উনিও বলেন, অনেক পড়তে হবে। অ-নে-ক দূর যেতে হবে পড়তে পড়তে।

আর মা? অন্য যত কথাই বলুক না কেন সব কথা এসে থামতো সেই মায়ের স্কুলের পড়া শেষ না হওয়ার দুঃখে। ঘরের মধ্যে যেন পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরতো মায়ের দীর্ঘশ্বাস। কতবার শোনা গল্প, তাও মমতা চুপ করে শুনতো। মায়ের জীবনে যেন এই একটাই আসল গল্প। সেই ক্লাশ নাইনে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে যাওয়ার গল্প। সেই স্কুলের পড়াটা শেষ না করেই সংসারের জোয়ালে জুতে যাওয়ার কাহিনী। বড় সাধের এসএসসি পাশের ডিগ্রিখানা না পাওয়ার, কলেজে না পড়ার দুঃখগাঁথা।

“জানিস রে মা, কেউ যদি আমাকে আগে একবার খালি বলতো, ভাল করে না পড়লে বিয়ে দিয়ে দিবে, তাইলে কত যে পড়তাম! কত মন দিয়ে পড়তাম! কেউ তো বলে নাই! আমি সালমাদের বাড়ি রোজ টিভি দেখতে যেতাম, শুক্রবারে সিনেমা দেখতাম, বাসায় সারাদুপুর বসে নভেল পড়তাম, আর পরীক্ষায় কম নম্বর পেতাম। তাও আমার কিন্তু স্কুলে যেতে ভাল লাগতো। তাও তো আমি ভাবতাম স্কুল পাশ করবো, কলেজ যাবো আমিনা বুবুর মতো এক কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে… হঠাৎ আব্বা এসে একদিন বললো, মেয়ের পড়ার মাথা নাই, অনেক হইছে পড়া, বিয়া ঠিক করে আসলাম এইবার।“

বলতে বলতে মা আবারো দীর্ঘশ্বাস ফেলতো, শুনতে শুনতে মমতারও শ্বাস ঘন হয়ে আসতো।

“কত কাঁদলাম! কতবার বললাম, মন দিয়ে পড়বো গো এইবার মন দিয়ে পড়বো, আমাকে স্কুলটা পাশ দিতে দাও…আমাকে কলেজে পড়তে দাও! কেউ শুনলো না। পড়ায় মাথা নাই এইটা তো অছিলা বুঝলি, অছিলা! মেয়ের পিছে বেশিদিন পয়সা খরচ করতে চায়নি তোর নানা, সেই তো বিয়ে দিতেই হবে… বিয়ের পরে এখানেও কান্নাকাটি করছিলাম জানিস পড়ার জন্যে, এই বাড়িতেও কেউ রাজি হলো না, তোর দাদিও বেঁচে ছিলেন তখন…”

মা হঠাৎ যেন শিউরে উঠে বলতো, “তুই ভাল করে পড়িস মা, তোর বাপে যেন এইরকম অছিলা না দিতে পারে!” যদিও মমতার আব্বার হাবেভাবে কখনো অছিলা খোঁজার কোন গোপন অভিসন্ধি টের পাওয়া যেতোনা, তবুও মমতার মনে চাপা ভয়ের আঁধার ঘনিয়ে উঠতো। পড়তে বসে আরো বেশি একাগ্রতায় ঝুঁকে পড়তো বইয়ের উপর।

মমতার বইগুলো মাঝে মাঝেই নেড়ে চেড়ে দেখতো মা। কখনো কখনো খাতায় লিখতো যা খুশি।  বাংলা বইগুলো পড়তে পড়তে বলতো, “উহ্‌ কত বদলে গেছে রে বইপত্র এই ষোল সতেরো বছরেই। আমাদের সময় বাংলা বইতে ওই কবিতাটা ছিল বুঝলি,” তারপর একটু ভেবে নিয়ে বলতো, …

“বায়েজিদ বোস্তামী,

শৈশব হতে জননীর সেবা করিতেন দিবাযামী।

দুপুর রাত্রে জননী জাগিয়া ডাকিলেন, বাছাধন,

বড়ই পিয়াস পানি দাও বলি, মুদিলেন দু নয়ন!”

খানিক আবৃত্তি করেই মায়ের কণ্ঠে লাগতো অভিমানের সুর, “দেখলি, এখনো মনে আছে! পড়ার মাথা আমার খারাপ ছিলো, তুইই বল? মিছামিছি বাহানা করে আমার স্কুলের পড়াটা শেষ করতে দিলো না! আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতো মা, “তোর বাপে পড়ালেখা জানা মানুষ, ডিগ্রি পাশ! তার পাশে কোনদিন নিজেকে একটা মানুষ ভাবতে পারলাম না!” তারপর একটু করুণ হেসে বলতো, “যাকগে! তুই পড় ভাল করে। তুই পাশ করবি, পাশ করে কলেজে পড়বি ভাবতেও সুখ!”

আজ মায়ের সেই সুখের দিন। মমতার এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে কিছুদিন আগে। আশেপাশের বাড়িতে মিষ্টি পাঠিয়েছে ওর আব্বা নিজে, এমন ভাল রেজাল্ট। আজ সে গিয়েছে কলেজে ভর্তি হওয়ার কাগজপত্র আনতে। ওই যে স্কুলের এক আপামনি আছে না, শারমিন আপা,…উনিই সাথে করে নিয়ে গেছেন কিসের যেন অফিসে। মা অত বোঝে না, কিসের অফিস, কিসের কাগজপত্র লাগবে, মায়ের শুধু আজ কাজে গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। খড়ি পুড়ে শেষ হয়ে চুলার আগুন নিভে যাচ্ছে তাও হুঁশ হচ্ছেনা, ডালটায় যে সম্বরা দেওয়া হয়নি ডালের রংটা দেখেও বুঝছেই না মা, চোখে পানি আসছে যে বারবার! মেয়েটা তাহলে কলেজে যাচ্ছে! কলেজে! আহা কতদিনের স্বপ্ন! মা পড়া শেষ করতে পারেনি তো কী হয়েছে, মেয়ে আজ স্কুল পাশ দিয়ে কলেজে যাচ্ছে!

“মা!” মমতার ডাকে তাড়াতাড়ি আঁচল টেনে চোখ মোছে মা। “এলি মা? কলেজে ভর্তি হলি, হ্যাঁ?” ব্যাগ্র হয়ে উঠে আসেন মা চুলার পাশ থেকে। “দেখি দেখি ঘামটা মোছ!”

“মা, বসোতো, বসো”, টেনে মা-কে হাঁটু সমান উঁচু বারান্দাটায় বসায় মমতা, “তোমার জন্যে একটা জিনিস আনছি।“

“কী?” অবাক হয়ে মা বলে, মমতার ঘাড়ের ঝোলা ব্যাগটা ছাড়া কিছু তো নেই হাতে।

সেই ব্যাগ থেকেই কি একটা কাগজ বের করে মমতা। হাসিমুখে বলে, ‘মা, কোন ওজর আপত্তি শুনবো না, তোমাকে আবার পড়তে হবে বুঝেছো?” মায়ের হতবাক মুখের দিকে তাকিয়ে সে আরেকটু জোরেই হাসে, “আমাদের শারমিন আপাকে তোমার কথা তো বলেছি মা কতবার, আজ আপা বললেন কি, মমতা, তোমার মায়ের পড়ালেখার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এই যে আপা এই ফর্মটা দিলেন, এটা পূরণ করে আবেদন করতে হবে বুঝেছো, তাহলে তুমি প্রাইভেটে এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারবা, বুঝছো মা? আপা বলেছেন সব ব্যবস্থা করে দেবেন।”

মা তবু কিছুই বোঝে না। রাজ্যের বিস্ময় চোখে মুখে মাখিয়ে বলে, ‘কী বলছিস পাগলের মতো! আমি আবার স্কুলে যাবো? নাইনের মেয়েগুলার সাথে বসে ক্লাশ করবো? তোর মাথা খারাপ!’

“না মা! ক্লাশ করতে হবে না, স্কুলে যেতে হবেনা, শুধু প্রাইভেটে পরীক্ষা দিবা। ঘরে পড়বা। আমি তোমাকে পড়াবো বুঝেছো?”

“আমি! আবার পড়বো! পরীক্ষা দেবো!” মা থেমে থেমে বলে প্রায় শোনা যায়না এমন স্বরে। বিহবল চোখে তাকিয়ে থাকে মমতার দিকে। মমতা বুঝিয়ে বলে মা-কে, কিভাবে স্কুলে না গিয়েও রেজিস্ট্রেশন করে  এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া যায় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বুঝিয়ে বলে, সে নিজের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ঠিকই মা-কে পড়াতে পারবে, মা শুধু মন দিয়ে পড়লেই হবে! 

মায়ের বিস্ময় তবু কাটেনা, অবিশ্বাস্য লাগে পুরো ব্যাপারটা। মমতার বাড়ানো হাতে ধরা ফর্মটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলে, “আমি পরীক্ষা দেবো? স্কুল পাশ দেবো? আমি পারবো? পারবো আমি!”

“কেন পারবে না মা? তোমার পড়ার মাথা কি খারাপ? অবশ্যই পারবে। স্কুল পাশ দিয়ে আরো পড়ে কলেজ পাশের পরীক্ষাও দিতে পারবে মা এরপরে।“

বলতে বলতে পাশে বসে মা-কে জড়িয়ে ধরে মমতা, “মা! শুধু আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলেই হবে! নিজের জন্যে দেখা স্বপ্নটাও পূরণ করো!”

হঠাৎ যেন মনে পড়ে মায়ের, একটু চমকে উঠে কণ্ঠ আরো নিচু করে বলে, “আর তোর আব্বা? কোনোদিন রাজি হবে না দেখিস!”

“এমন মিনমিন করে বললে তো রাজি হবেই না!” মমতা হাসে, তারপর গভীর বিশ্বাস নিয়ে বলে, “জোর গলায় বলতে হবে মা! আমার আপামণি বলেছেন, উচিৎ কথা, ভাল কথা, নিজের ন্যায্য অধিকারের দাবী জোর গলায় করতে হয়! সাহসের সাথে বলতে হয়! আমরা দুজন একসাথে বলবো মা!”

মা চুপ করে উঠানের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। চারপাশে তাকিয়ে মুখ বুঁজে করে যাওয়া পরিশ্রমে গোছানো সংসারে নিজের অধিকারের চিহ্ন দেখার চেষ্টা করে। সে মা, সে এই বাড়ির বৌ- এর বাইরেও বুঝি একটা অস্তিত্ব থাকার কথা ছিল, সেটা কোথায় আঁতিপাঁতি করে খোঁজে। হয়ত মনের গভীরে ডুব দিয়ে ভুলতে না পারা স্বপ্নগুলোও দেখে। তারপর আস্তে হাত বাড়িয়ে  ফর্মটা নিয়ে বলে, “কলমটা দে তো! এইটা এখনই পূরণ করে রাখি!”

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>