গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের চিঠি
আমি কোথায় পৌঁছেছি সেকথা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে স্রষ্টা যদি আমাকে আরো কিছুটা জীবন দান করেন তবে আমি যথাসাধ্য তা ব্যবহার করার চেষ্টা করবো৷
সম্ভবত আমার মনে যা আছে তার সবটাই আমি বলবো না, কিন্তু যা বলতে চাই তার সবচেয়ে ভালোটাই আমি বলবো৷
কিছুর গুরুত্ব আমি দিবো তার মূল্যের জন্য নয়, বরং তার অর্থবহতার জন্য৷
আমি ঘুমাবো কম, স্বপ্ন দেখবো বেশি, কেননা আমি জানি চোখ বন্ধ করে রাখা প্রতিটি মিনিটে আমরা আলোর ৬০টি মুহূর্ত নষ্ট করি৷
যখন অন্যরা থেমে যাবে তখন আমি হাঁটবো; যখন অন্যরা ঘুমাবে তখন আমি জেগে থাকবো৷
স্রষ্টা যদি আমাকে আরো কিছু সময় দেন, আমি সাদাসিধে পোষাকে নিজেকে সূর্যের সামনে মেলে ধরবো, শুধু আমার শরীর নয়, বরং আমার আত্মাকেও এর ক্ষমার সম্মুখে নগ্ন করে মেলে দিবো৷
সবাইকে বলবো কি ভুলটাই না তারা করে যখন তারা ভাবে যে বুড়ো হওয়া মানে প্রেমে পড়া বন্ধ হওয়া, এটা না জেনে যে প্রেমে পড়া বন্ধ হওয়া মানেই বুড়িয়ে যাওয়া৷
আমি শিশুদের ডানা দিবো, কিন্তু উড়তে শেখার ভারটা আমি ওদের উপরই ছেড়ে দিবো৷
বৃদ্ধদের বলবো, বার্ধক্যে মৃত্যু আসে না, মৃত্যু আসে ভুলে যাওয়ার প্রবণতায়৷
সবার কাছ থেকে আমি এত বেশি শিখেছি৷ দেখেছি সবাই পর্বত চূড়ায় বাস করতে চায় এটা না জেনেই যে চূড়ায় ওঠার প্রচেষ্টা ও যাত্রাপথেই আসল সুখ অর্জিত হয়৷
আমি শিখেছি সদ্যজাত শিশু যখন তার ছোট্ট আঙুল দিয়ে তার পিতার আঙুল আকড়ে ধরে, সে আঙুল তখন তাকে বাকি জীবনের জন্য বন্দী করে ফেলে৷
আমি শিখেছি একজন মানুষ আরেকজনের দিকে নীচু হয়ে তাকাবার অধিকার শুধু তখনই পায়, যখন মাটি থেকে ওঠার জন্য সেই মানুষের সাহায্যের প্রয়োজন হয়৷
সব সময়, যা তুমি ভাবো সেটা না বলে বরং সেটাই বলো যা তুমি অনুভব করো৷ আমি যদি জানতাম এই শেষবারের মত আমি তোমাকে ঘুমন্ত দেখছি, আমি সর্বশক্তিতে তোমাকে জড়িয়ে ধরে নিজেকে তোমার আত্মার প্রহরী দূত করার জন্য বিধাতার নিকট প্রার্থনা করতাম৷
যদি জানতাম এই শেষবারের মত তোমাকে দেখছি, বলতাম, “আমি তোমাকে ভালোবাসি৷”
আজকের পর সব সময় আগামীকাল আসে, আর জীবন আমাদের সব সময়ই ভুল শুধরানোর সুযোগ দেয়, কিন্তু আমি যদি ভুল হই আর আজই যদি জীবনের শেষ দিন হয়, আমি তোমাকে বলতে চাই তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি আর আমি তোমাকে কখনো ভুলবো না৷
শিশু অথবা বৃদ্ধ কারো জন্যই আগামীকালের নিশ্চয়তা নেই৷ প্রিয়জনদের দেখার আজকেই হয়তো শেষ সুযোগ, তাই কখনো অপেক্ষা করা উচিত নয়; যদি আগামীকাল না আসে৷ আমি নিশ্চিত যে হারিয়ে ফেলার পর প্রিয়জনদের একটু হাসি, আলিঙ্গন বা চুম্বন দেয়ার সুযোগ হারিয়েছো বলে তুমি দুঃখিত হবে৷
প্রিয়জনদের কাছে রাখো; তাদের বলো তোমার তাদেরকে কতটা প্রয়োজন আর তুমি তাদের কতটা ভালোবাসো৷ তাদেরকে ভালোবাসা দাও৷ তাদের বলো “আমি দুঃখিত”, “দয়াকরে ক্ষমা করো”, “ধন্যবাদ” আর এই জাতীয় চমৎকার সব কথা৷
তোমার মনের গহীন গোপন চিন্তা দিয়ে তোমাকে কেউ চিনবে না৷ তাদেরকে প্রকাশ করার জ্ঞান ও শক্তি প্রভুর নিকট যাজ্ঞা করো৷
তোমার বন্ধু ও প্রিয়জনদের জানাও তারা তোমার কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ৷
তোমার প্রিয়জনদের এই চিঠি পাঠিয়ে দাও৷ যদি আজ তুমি এটা না করো, আগামীকালও গতকালের মত হবে, আর তুমি যদি কখনও এটা না করো, তাহলে কিছুই বদলাবে না, আজই কিছু করার প্রকৃষ্ট সময়৷
তোমাদের জন্য ভালোবাসা,
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ
(ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর একটা সময়ে এসে স্বাস্থ্যের কারণে মার্কেজ এক সময় লেখালেখি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন আর বন্ধু বান্ধব ও সাহিত্যের পাঠকদের বিদায় জানিয়ে এই চিঠি লেখেন৷)
(অনুবাদ এখান থেকেঃ http://www.prrb.ca/articles/issue08-marquez.html)
.

সমকালীন বিশ্বসাহিত্যের একজন প্রবাদপুরুষ। ১৯২৭ সালে কলম্বিয়ার ক্যারিবীয় উপকূলীয় গ্রাম আরাকাতাকায় জন্ম।
বিশ্ববিদ্যালয়-পর্যায়ে আইনশাস্ত্রে অধ্যয়নের পর সাংবাদিকতা দিয়ে পেশাজীবনের শুরু স্বদেশ কলম্বিয়ায়। গল্প দিয়ে লেখালেখির শুরু হলেও ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত মহাকাব্যিক উপন্যাস সিয়েন আনিয়োস দে সোলেদাদ (নির্জনতার এক শ বছর) তাঁকে জগৎজোড়া খ্যাতি এনে দেয়। ১৯৮২ সালে নোবেল সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন। তাঁর গল্প, উপন্যাস, আত্মজীবনী, নাটক, বক্তৃতামালা—সবই বিশ্বব্যাপী পাঠকদের আকৃষ্ট করেছে। ১৭ এপ্রিল ২০১৪ মেহিকো সিটির নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন।