মারমা লোক সংস্কৃতি বিলুপ্তির পথে । পুছাইনু মারমা
আদিবাসী তথা মারমা সমাজে আমোদের ভাব খানিকটা বেশি।মারমা সমাজে একজন শিশুর জন্ম মানেই আনন্দ যজ্ঞে তাঁর অনুপ্রবেশ।বুদ্ধের দর্শনে বিশ্বাসী মারমা জাতিগোষ্ঠী জীবনকে দুঃখময় মনে করলেও তারা দুঃখকে কিভাবে সুখে রুপান্তরিত করতে হয় তা রপ্ত করে ফেলেছে সেই চর্যাপদের যুগ থেকে।জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানা বৈচিত্রময়, লোকসংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও পরম্পরার মধ্যে দিয়ে সে নিজের ক্ষুদ্র জীবনকে সুশোভিত করে।
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের সমাজচিত্রে যে সম্মৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকসংস্কৃতি, আচার অনুষ্ঠানের বিবরণ আমরা পেয়ে থাকি তার সবই আদিবাসী সমাজে এখনো বিদ্যমান। যদিও কালের বিবর্তন ও যুগের পরিবর্তনের কারণে অধিকাংশ সংস্কৃতি,ঐতিহ্য আমাদের জন্মের আগেই হারিয়ে গেছে। তবুও ক্ষয়িষ্ণু সেই ঐতিহ্য ও অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে এখনো কিছুটা টিকে রয়েছে এবং স্বমহিমায় তার স্বকীয়তা বজায় রেখে চলেছে।
মারমা সমাজের লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য এতোই সমৃদ্ধশালী যে এখানে মৃত্যুর মতো শোকাতুর,ব্যাথাতুর,চিরবিদায়ের মতো কঠিন পরিস্থিতিতেও একটি স্বতন্ত্র অনুষ্ঠান রয়েছে যা বেদনা,মর্মপীড়া ও যাতনাকে খানিকটা লাঘব করে লিলুয়া বাতাসের মতো কিছুটা হলেও আনন্দ অনুভূতির যোগান দিয়ে চিত্তাকর্ষক পরিবেশের সৃষ্টি করে।
মারমা সমাজে বিগত,প্রয়াত,মৃত ব্যক্তির সৎকার অনুষ্ঠান করা হয় বহু আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশের মধ্যে দিয়ে। মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হবার পর থেকেই আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীর ঢল নামতে থাকে মৃত ব্যক্তির ঘরে।
আবার একদল সুযোগ সন্ধানী আনন্দ পিয়াসীর দল মৃত্যুসংবাদ শুনলেই খুশি হন। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই সত্যি। কেননা মৃত ব্যক্তির সৎকারের আগ পর্যন্ত প্রাণহীন দেহকে ঘিরে বিনিদ্র রজনী পার করার জন্য সারারাত দ্যূতক্রীড়ার আয়োজন করা হয়। এবং শুধুমাত্র এই দ্যূতক্রীড়ায় অংশ নেয়ার জন্য আনন্দ পিয়াসী এই দল মৃত্যুসংবাদ শুনলেই খুশি মনে মৃতের বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়। এটিও সংস্কৃতির একটি বিরাট অংশ। দ্যূতক্রীড়ার আয়োজন হওয়াতে প্রচুর লোকের সমাগম হওয়াই শোক কিছুটা স্তিমিত হয়ে সুখে পরিণত হয়ে যায়।
দ্যূতক্রীয়ায় অংশ নেয়া লোকেদের নির্ঘুম রাত্রি পার করতে যেনো কোনো অসুবিধা না হয় সে জন্য চা,নাস্তা ও প্রয়োজনীয় সকল উপকরণের আয়োজনও করে থাকে মৃতের পরিবারের লোকজন। দ্যূতক্রীড়ার আয়োজন করার একমাত্র কারণ হলো প্রাণহীন দেহকে পাহাড়া দেয়া। অর্থাৎ কবর দেয়ার আগ পর্যন্ত যেনো প্রাণহীন দেহটি জনশূন্যে নিপতিত না হয়।
এতসব মহাসমারোহের আর একটি মূল আকর্ষণ হলো নিজস্ব এক বাজনার আয়োজন। নিশ্চুপ,নির্জনতা মারমাদের কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই মৃতের ঘরে সুনসান নিরবতা থাকবে এটি কারোর-ই পছন্দ নয়। সে জন্য বিশেষ এক বাদ্য দলকে আহবান করে আনা হয়।গায়ক,বাদক ও নর্তক একত্র হয়ে সম্মিলিতভাবে অসাধারণ এক পরিবেশ সৃষ্টি করেন । বাদ্যযন্ত্র, নাচ,গান সমস্তকিছু সম্পূর্ণ মৌলিক।
বাদকের তালে তাল মিলিয়ে সুরে সুর মিলিয়ে গাওয়া হয় শোকগীতি। শোকগীতির কথা গুলো খতিয়ে দেখলে পাওয়া যায় বিদায় লগ্নে এসে প্রিয় তাঁর প্রেয়সীকে অতি বেদনার্ত কণ্ঠে কাব্যিক সুরে ও সাহিত্যের ভাষায় বিচ্ছেদের করুণ মর্মযাতনা প্রকাশ করছে। শোকগীতিগুলোকে গাওয়া হয় পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে। কিন্তু সবকটি ধাপ আর গাওয়া হয় না। দলের সদস্য যাঁরা আছেন বয়স ও বার্ধক্যের কারণে তাঁরাও আর সমস্তকিছু মনে করতে পারেন না। তবুও এখনো সচরাচর তিনটি ধাপে শোকগীতি গাওয়া হয় সেগুলো হলো।
১। “য়ুদিয়া” অর্থাৎ পুষ্পপদ্মের ন্যায় স্বচ্ছ পবিত্র ভালোবাসার প্রকাশ। খুব সুন্দর করে গীত করা হয় এই গানটি। প্রেম,বিরহ,বিচ্ছেদ,যাতনা প্রিয় মানুষ ও আত্মীয় পরিজন সমস্ত কিছুকে পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছি অনন্তের পথে এরুপ বেদনার্ত হৃদয়বিদারক শব্দ উচ্চারির হতে থাকে গানের প্রতি পরতে পরতে।
২। “অলোওয়েং” এটিও মূলত শোকগীতি। দুইটির মধ্যে পার্থক্য বিশেষ কিছু নেই শুধু শোক প্রকাশের মাধ্যমটা ভিন্ন।ভিন্ন ভাবে ভিন্ন আঙ্গিকে আরো মর্মষ্পর্শী বাক্য উচ্চারির হতে থাকে এতে। মাটিতে শায়িত হবার অন্তিম মুহূর্ত যত ঘনিয়ে আসে তত গীত ও বাদ্যের ঝংকারে মুখরিত হতে থাকে চারপাশ।
৩।”মাহবুং দ” অর্থাৎ আহবান করা।এটি মূলত আহবানি মূলক গান।অন্তরদাহন ও প্রেয়সীর নিকটে আসার অভিলাষ ব্যক্ত করা হয় এই গানে।
সর্বোপরি শোকগীতি গুলো অনেকটা মধ্যযুগের রচিত সাহিত্যের মতো। আলাওলের পদ্মাবতী ও দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী মজনুর রোম্যান্টিক উপখ্যানের সাথে সাদৃশ্য রয়েছে। লায়লী বিরহে কাতর মজনুর শোক গাথার মতোই অনেকটা গীতগুলো ।
গায়ক একই সাথে গান ও নাচ দুটোই একসাথে করে থাকেন। । নাচতে নাচতে ব্যাথা বেদনার কথাগুলো বলতে থাকেন। স্নিগ্ধ পুষ্পের মতো কর্ণে গানের কথাগুলো স্পর্শ করে। গানের কথা গুলো তীক্ষ্ণ বাণের মতো হৃদয়কে বিদ্ধ করে। চঞ্চল মন খনিকের জন্য শান্ত দিঘির মতো স্থির,নিশ্চল হয়ে যায়।
আমাদের বিলুপ্তপ্রায় লোক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই বাদ্যদলের সদস্যদের আর্থিক অবস্থার দৈন্যদশা তাঁদের পোশাকে-আসাকে স্পষ্টরুপে প্রতীয়মান হয়। জুতো ক্ষয় হতে হতে একেবারে তলানি ফেটে গেছে তবুও নতুন জোরা জুতো কেনার সামর্থ্যটুকু নেই। বয়স,বার্ধক্য ও নিজে মৃত্যুরপথযাত্রী হয়েও অন্যকে এগিয়ে দিয়ে আসেন এই অসহায় মানুষেরা।
সবচেয়ে খারাপ বিষয়টি হলো এই অতি পুরোনো সংস্কৃতিকে যাঁরা ধরে রেখেছেন তাঁদের যথাযথ মূল্যায়নটাও অন্তত ঠিকমতো করা হয় না। মহান এই কাজের স্বীকৃতি দেয়ার বদলে দেয়া হয় একরাশ অবজ্ঞা,উপেক্ষা,বঞ্চনা। তুচ্ছতাচ্ছিল্য জ্ঞান করা হয় তাঁদের কাজটিকে। সমাজের বক্র দৃষ্টি ও কাজটিকে নিকৃষ্ট বলে গণ্য করার কারণে নতুন কেউ এ জ্ঞান সংরক্ষণ করে রাখতে উৎসাহী নয়। প্রয়োজনে শহরে গিয়ে পৃষ্ঠদেশে মনিবের পদাঘাত খেয়ে হলেও পয়সা উপার্জন করতে রাজি কিন্তু এই কাজে কেউ যোগ দিতে রাজি নয়।
প্রত্যক্ষ আলাপে তাঁদের কাছ থেকে জানা গেলো প্রচুর আক্ষেপ নিয়ে তাঁরা বলছেন দলের চারজন সদস্যের মধ্যে কেউ একজনও যদি মারা যায় তবে দলটি সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে যাবে। তাঁরাও খুব করে চান যেনো এই ধারা অব্যাহত থাকুক তাঁদের এই শিক্ষা কেউ সাগ্রহে গ্রহন করুক।।কিন্তু কেউ শিখতে আগ্রহী না হওয়াই বিলুপ্তির একেবারে দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হয়েছে এই ঐতিহ্য। কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয় কিন্তু সংরক্ষণ করে রেখে দিলে বিশেষ এই রীতি আর একটু দীর্ঘস্থায়ী হবে।
কিন্তু অন্যান্য সব হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির মতো এটিও অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে আর খুব বেশি দেরি নেই। আর একটি জাতির সংস্কৃতির বিলুপ্তি মানে ওই সমগ্র জাতির বিলুপ্তি।
লেখক পুছাইনু মারমা
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
বিশ্বের সর্বশেষ খবর, প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, সাক্ষাৎকার, ভিডিও, অডিও এবং ফিচারের জন্যে ইরাবতী নিউজ ডেস্ক। খেলাধুলা, বিনোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য সহ নানা বিষয়ে ফিচার ও বিশ্লেষণ।