| 25 এপ্রিল 2024
Categories
অনুবাদ অনুবাদিত প্রবন্ধ

মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার শত বছর’: প্রসঙ্গ যাদুবাস্তবতাবাদ

আনুমানিক পঠনকাল: 7 মিনিট

 বি. জে. গীতা ।। ভাষান্তর- জয়ন্ত বিশ্বাস

 

১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি  সময়ে লাতিন আমেরিকার কলম্বিয়া নামক দেশটি অন্তত দুই লক্ষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রনোদিত হত্যাকান্ডের সাক্ষী হয়। এই মর্মন্তুদ ঘটনার সূত্র ধরেই ‘নিঃসঙ্গতার শত বছর’ উপন্যাসে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ যুদ্ধ, যন্ত্রণা আর মৃত্যুর আখ্যান তুলে এনেছেন যাদুবাস্তবতাবাদের নিরিখে। এই অঞ্চলের আঞ্চলিক রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলে আনার পিছনে তাঁর সবচেয়ে শক্ত যুক্তি হতে পারে- লাতিন আমেরিকার রাজনীতির অন্তঃসারশুন্যতা, প্রত্যাখ্যান আর বিয়োগাত্মকতার আবর্তনে আবদ্ধ যে প্রকৃতি, সেটিকে পাঠক মানসে একটি মূর্ত রুপ দেওয়া। মার্কেজ বাস্তবতার সাথে কল্পনার দ্যুতির অনবদ্য মিশ্রণ ঘটিয়েছেন যাতে পাঠক তাঁর একান্ত ‘কলম্বিয়া’ নামক ভূখণ্ডটির সাথে আত্মিকভাবে পরিচিত হতে পারে; যেখানে পৌরানিক রুপকথা, শ্রুতিকথা ও কিংবদন্তী সমূহ এখনো প্রযুক্তি ও আধুনিকতার পাশাপাশি দোর্দন্ড প্রতাপে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। উপন্যাসটির অন্যান্য উপাদান আর ঘটনার আবহ সেই পৌরানিক রুপকথার সাথে একাকার হয়ে যে গল্প বলে গিয়েছে, তা কলম্বিয়ার নিজস্ব ইতিহাসেরই বাস্তব খন্ডচিত্র।

                                                 [ গুরুত্বপূর্ণ শব্দসূত্রঃ কলম্বিয়া; যাদুবাস্তবতাবাদ; মার্কেজ ]


গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের লেখনীর বিশেষত্ব হচ্ছে- প্রাত্যহিকের সাথে অভিনবত্ব; ঐতিহাসিক সত্যের সাথে অসাধারণত্ব এবং মনোজাগতিক বাস্তবতার সাথে কল্পনাপ্রবণতার মিশেল ঘটানোর বিস্ময়কর দক্ষতা। সাহিত্যে যাদুবাস্তবতাবাদের বিনির্মাণ ও প্রয়োগে তাঁকে অন্যতম পথিকৃৎ হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তাঁর উপন্যাস ‘নিঃসঙ্গতার শত বছর’ নিঃসন্দেহে এক বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্ম। ঔপন্যাসিক নিজে লাতিন আমেরিকার কণ্ঠে সাহিত্যের ভাষা দিতে চেয়েছেন। আর এই উপন্যাস তাঁর চেতনা ও মননের দর্পনের ভূমিকাটি সাবলীলভাবে পালন করেছে।

‘যাদুবাস্তবতাবাদ’ মূলত সাহিত্যের এমন একটি অনুষঙ্গ, যেখানে আলোচ্য অবাস্তব, অসম্ভব ও স্বপ্নসুলভ রূপকথাকে সম্পূর্ণ বাস্তবের মতই উপস্থাপন করা হয়। যাদুবাস্তবতাবাদ গল্পকথনের স্বাভাবিক “একদা এক সময়…” ধারাটির সম্পূর্ণ বিপরীত। লেখক এখানে কাল্পনিক ঘটনাপ্রবাহের অসম্ভব চরিত্রাবলীর উপরে আলোকপাত করে থাকেন। যাদুবাস্তবতাবাদের দুনিয়ায় কথক পরবাস্তবতাকে এতটাই স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করেন যে এটিই পাঠকের কাছে আপাত বাস্তব হয়ে দেখা দেয়।
সাহিত্যকর্ম অথবা শিল্পকর্মে যাদুবাস্তবতাবাদের প্রয়োগের উদ্দেশ্য থাকে মূলত পৃথিবী ও পৃথিবীর বাস্তবতার পুনর্কল্পনা করা। পলায়ন প্রবৃত্তির উদ্যোগ নয়, বরং প্রতিদিনকার অভিনবত্ব অবলোকন করার সুযোগ সৃষ্টি করাই যাদুবাস্তবতাবাদের সারকথা। যাদুবাস্তবতাবাদের একাধিক ভাষাশৈলী সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এদের ভিতরে মুখ্য হচ্ছে- আত্মনিষ্ঠতা ও আবেগপ্রবনতাকে প্রত্যাখ্যান করা; অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের যুগপত্তা বজায় রাখা এবং ‘অপরিচিতিকরন’ । এই বৈশিষ্ট্যগুলোই যাদুবাস্তবতাবাদকে রূপকথার কাল্পনিক ধারাটি থেকে সুস্পষ্টভাবে পৃথক করেছে। কল্পনাভিত্তিক উপন্যাসে ঔপন্যাসিকের নির্মিত দুনিয়ায় একটি বাস্তবসম্মত যুক্তির স্থান থাকা বাঞ্ছনীয়। অন্যদিকে, যাদুবাস্তবতাবাদ প্রাকৃতিক অথবা ভৌত সূত্র বা নিয়মের উপরে নির্ভরশীল নয়।

মার্কেজ সর্বাপেক্ষা জটিল ও অর্থপূর্ন বিষয়বস্তু নির্দেশ করার জন্য যাদুবাস্তবতাবাদ এবং ইতিহাস ও রাজনীতিভিত্তিক অন্যান্য উপাদান ব্যাবহার করেছেন। তিনি যুদ্ধ, যন্ত্রণা আর মৃত্যুকে নির্দেশ করেছেন সরাসরি, রাজনৈতিক তির্যকতার অবস্থান থেকে। ১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কলম্বিয়া রাষ্ট্রটিকে অন্তত দুই লক্ষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হতে হয়। ‘লা ভায়োলেন্সিয়া’ অর্থাৎ ১৯৪৬-১৯৬৬ পর্যন্ত সময়কালকে পাঁচটি ধাপে বিভক্ত করা যেতে পারেঃ ১৯৪৬ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পূর্বে ও পরবর্তীতে রাজনৈতিক উন্মত্ততার পুনরুত্থান, গাইতানের হত্যাকাণ্ডের থেকে উদ্ভূত নগরকেন্দ্রিক গণঅভ্যুত্থান, উন্মুক্ত গেরিলা যুদ্ধ (প্রথমত অসপিনা পেরেজ নিয়ন্ত্রিত রক্ষণশীল সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত), রোহাস পিনিয়া-র (যিনি লরিয়ানো গোমেজ-কে উৎখাত করেছিলেন) উদ্যোগে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের ব্যর্থ চেষ্টা, এবং সবশেষে ১৯৫৮ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট’ নামে উদার/রক্ষনশীল দের যৌথ জোটের নেতৃত্বে অসংলগ্নভাবে যুদ্ধ।
‘নিঃসঙ্গতার শত বছর’ উপন্যাসটি যাদুবাস্তবতাবাদের দিক থেকে আদর্শস্থানীয়। এখানে অতিপ্রাকৃতকে উপস্থাপন করা হয়েছে গতানুগতিক রূপে, এবং গতানুগতিককে অতিপ্রাকৃত অথবা অভিনব রূপে। উপন্যাসটিতে একটি কাল্পনিক গল্প তুলে ধরা হয়েছে একটি কাল্পনিক স্থানে। মার্কেজ জীবনের বাস্তবসম্মত উপাদানকে (দারিদ্র্য অথবা ঘরদোর পরিষ্কার করা ) একই দাঁড়িপাল্লায় স্তম্ভিত করে দেওয়া কিছু নজিরের (একজন শূন্যে ভাসমান সন্ত) সাথে একই সমতলে রেখেছেন। এর পিছনে উদ্দেশ্যও রয়েছে। এখানে পাঠক পরিচিত হতে পারবেন মার্কেজের কলম্বিয়ার সাথে, যেখানে এখনও প্রযুক্তি আর আধুনিকতার পাশাপাশি টিকে রয়েছে পৌরাণিক রূপকথা, শ্রুতিকথা আর কিংবদন্তীসমূহ। আরেকটি কারন হচ্ছে, উপন্যাসটি পাঠকের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করবে যে কোনটি বাস্তব আর কোনটি অবাস্তব; বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অন্তঃসারশূন্যতা অথবা অর্থহীনতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলবার তাড়না দেবে। উপন্যাসটিতে রাজনীতির সর্পিল বক্রতাপূর্ন দুনিয়াটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিবেচনা করা হয়েছে (বিশেষ করে যে অধ্যায়ে কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া-র কথা উঠে এসেছে)। বস্তুত রাজনৈতিক দুনিয়া নৈরাশ্যময়। সাধারণ জনগণকে হত্যা আর শোষণের ব্যাপারে উদারপন্থী অথবা রক্ষনশীল, দুই দলই সমানভাবে দায়ী। মার্কেজের একটি সুনির্দিষ্ট পুঁজিবাদ-বিরোধী আদর্শ ছিল বলে আমরা অবগত। তবে এই উপন্যাসে আঞ্চলিক রাজনীতির চিত্র অঙ্কনের ক্ষেত্রে তিনি পক্ষপাতিত্ব প্রকাশ করেন নি। পরিবর্তে লাতিন আমেরিকার রাজনীতি কিভাবে অর্থহীনতা, প্রত্যাখ্যান আর বিয়োগাত্মক আবর্তনের পরিমণ্ডলে আবদ্ধ, এই ব্যাপারেই তিনি সোচ্চার হয়েছেন। অভিনব ঘটনাপ্রবাহ এবং চরিত্রের সমাবেশ ঘটানো হয়েছে। তবে, মার্কেজ যে বার্তাটি দিতে চেয়েছেন, সেটি দ্ব্যর্থহীনভাবে একটি সত্যি ঘটনাই ব্যাখ্যা করে।

 


আরো পড়ুন: অনুবাদ গল্প: মন্তিয়েলের বিধবা বউ । গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

 

কলম্বিয়ার ইতিহাসের রাজনীতি-বিজড়িত যে উন্মত্ত চরিত্র, সেটির সাথে কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার চরিত্র একই সমান্তরালে গতিশীল। বুয়েন্দিয়া রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে, কারন তারা বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তুলে দেওয়ায় মদত দিচ্ছিল। বিত্তশালী ‘ব্যানানা প্লান্টেশন’ নিজেদের স্বৈরচারী আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রক বাহিনী গঠন করেছিলো। বাস্তব ঘটনা এবং কলম্বিয়ার ইতিহাসের সুদক্ষ ব্যবহার ‘নিঃসঙ্গতার শত বছর’ উপন্যাসটিকে যাদুবাস্তবতাবাদের একটি অসাধারণ উদাহরণে পরিণত করেছে। শুধুমাত্র গল্পের বিষয়বস্তুই যে বাস্তবতা আর কল্পনার অন্তর্বুননে নির্মিত, এমনটি নয়। পূর্ণাঙ্গভাবে এই উপন্যাসটি একটি সমালোচনামূলক পরিপ্রেক্ষিত থেকে কলম্বিয়ার ইতিহাসেও আলোকপাত করে। এইভাবে উপন্যাসটিতে একক বিষয় হিসাবে লাতিন আমেরিকার কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস আবদ্ধ করা হয়েছে।

উপন্যাসটিতে বুয়েন্দিয়া পরিবারের ১০০ বছরের ইতিহাস গল্পাকারে বর্ণিত হয়েছে। পরিবারটি দক্ষিণ আমেরিকার এক অজ্ঞাতনামা রাষ্ট্রের উপকূলবর্তী জঙ্গলে বসবাস করে আসছে। সমানভাবে, এটাকে এই পরিবারের পত্তন করা শহর, মাকোন্দো-র গল্প হিসাবেও দেখা যেতে পারে। আরেকটি ব্যাখ্যায় এটাকে বলা হয়েছে- উরসুলা বুয়েন্দিয়া-র জীবনের গল্প। প্রত্যেকটি বিষয়ই পরস্পর অন্তর্নিহিতভাবে সম্পর্কিত। তাছাড়া, উপন্যাসের শিরোনামে উল্লেখ না থাকলে আরেকটি বিষয় হয়তো দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারতো যে, মানুষের জীবনে সম্ভাব্য যত প্রকারের একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা পীড়া দিতে পারে, সেগুলোর প্রত্যেকটির উদাহরণই উপন্যাসটিতে বর্তমান।
মাকোন্দো শহরে ইতিহাসের অনিবার্য পুনরাবৃত্তির বিষয়টি অত্যন্ত প্রবল। নিজেদের অতীত আর সময়কেন্দ্রিক জটিলতার দ্বারা কেন্দ্রীয় চরিত্রসমূহ নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। উপন্যাস জুড়েই চরিত্রগুলো বারবার অপচ্ছায়াদের মুখোমুখি হয়েছে। এই অপচ্ছায়াগুলো মূলত অতীত আর মাকোন্দো শহরের উপরে এই অতীতের বিকট প্রভাবের সংকেত বা চিহ্ন হিসাবে ক্রিয়াশীল। এই অপচ্ছায়াগুলো আর এদের বিচ্ছিন্নভাবে পুনরাগমনের সূত্র প্রথিত রয়েছে লাতিন আমেরিকার সুনির্দিষ্ট ঐতিহাসিক বিনির্মাণের ভিতরে। ভাবাদর্শগত রূপান্তরকরণ এই নিশ্চয়তাই দেয়, যে মাকোন্দো আর বুয়েন্দিয়া পরিবার, এক দিক দিয়ে তারাই অপচ্ছায়া হিসাবে বর্তমান। কারন তারা তাদের নিজস্ব ইতিহাস থেকেই বিচ্ছিন্নতার শিকার। শুধুমাত্র নির্ভরশীলতা ও অনুন্নয়নের কঠিন বাস্তবতাই নয়, সামাজিক পরিস্থিতিকে ঘাড়ে ভর করে বলবত হওয়া ভাবাদর্শগত প্রহেলিকাও তাদেরকে কলুষিত করেছে। .
চরিত্রসমূহ পরিস্ফূটনের ক্ষেত্রেও মার্কেজ যাদুবাস্তবতাবাদের আশ্রয় নিয়েছেন। মেলকুয়েস চরিত্রটির ব্যাপারে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন, “মনুষ্যজাতির উপরে নেমে আসা যাবতীয় সংক্রামক মহামারী অথবা দুর্যোগকে সে ফাঁকি দিয়ে বেঁচে আছে ।“ যদিও এই বক্তব্য মেনে নেওয়া কষ্টসাধ্য, কিন্তু মার্কেজ যোগ করেছেন, “সে পারস্য-তে অপুষ্টির প্রকোপ, মালয়েশিয়া-তে স্কার্ভি, আলেকজান্দ্রিয়া-তে কুষ্ঠরোগ, জাপানে বেরি বেরি, মাদাগাস্কারে মহামারী আকারে ছড়ানো গ্রন্থিস্ফিতি, সিসিলি-তে একটি ভূমিকম্প এবং ম্যাগেলান-এ ভয়াবহ এক জাহাজডুবি থেকে রক্ষা পাওয়া একজন মানুষ।“ দেখা যাচ্ছে, এখানে তিনি পুনরায় অবিশ্বাস্য বিষয়কে আপাতসম্ভব হিসাবে উপস্থাপন করছেন।

উপন্যাসটি আমাদের বিস্ময় আর আনন্দ দান করেছে এটির সম্পূর্ণ পরিধি ব্যাপী। যখন যে চরিত্র বা ঘটনার সাথেই ঔপন্যাসিক আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, আমরা অভাবনীয়, বর্ণিল এবং মৌলিক কিছু পাওয়ার ব্যাপারটি শিখতে পেরেছি। শিল্পানুগ সৌন্দর্যময় কিছু মুহূর্ত (প্রজাপতিদের গতিপথের মত) থেকে শুরু করে ব্যঙ্গাত্মক (যাজকের চকলেটের দিকে ভাসমান যাত্রার মত) অথবা অশালীন যৌনদৃশ্য ও আশ্চর্যজনক যৌনতা (বাড়ির সব ফুল ঝরিয়ে দেওয়ার মত বায়ুত্যাগ অথবা পুরুষাঙ্গের উপরে বিয়ারের বোতলের ভারসাম্য সামলে মানুষের দৌড়ানোর মত) প্রতিটিই উপন্যাসে উপস্থিত। এখানে যে ব্যঙ্গাত্মক শক্তির স্ফুরণ ঘটেছে, সেটিকে একরকম বিখ্যাতই বলা চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চরিত্রের নির্মাণ দ্বিমাত্রিক; এদের মধ্যে আবার কোন কোনটির ব্যাপ্তি মাত্র কয়েকটি পৃষ্ঠার। কিন্তু সম্পূর্ণ পরিসরে, এই গল্পটিকে শক্তিশালী করে তুলেছে জীবনীশক্তির চেতনা এবং পার্থিব কিছু বিস্ময়।

মার্কেজ লিখেছেন- অন্য সবকিছুর মতই, এই গল্পটিতেও কিছু সত্য এবং অনেকটা অলীকতার ছোঁয়া রয়েছে। গল্পটিতে অন্তর্নিহিত সত্যটি হচ্ছে, ‘নিঃসঙ্গতার শত বছর’ মূলত উপন্যাসিকের কাছে একটি আত্মভূত বই। তিনি যেরূপ শৈশবকাল নিজে অতিবাহিত করেছেন, সেটির অন্যথা হলে এই উপন্যাসটি লেখা নাও হতে পারতো। মার্কেজ কলম্বিয়ার আরাকাতারা-য় তাঁর নানা-নানীর সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠেন। তাঁর নানা-নানী ছিলেন জ্ঞাতি ভাইবোন। পাতার ঝড় (?) শুরু হওয়ার কয়েক বছর পূর্বে, হাজার দিনব্যাপী যুদ্ধ (১৮৯৯-১৯০২) শেষ হওয়ার পরপর, তাঁরা রিওহানচা থেকে আরাকাতারা-য় পাড়ি জমিয়েছিলেন। মার্কেজের শৈশবের উপাখ্যান রচিত হয়েছিলো প্রেতাত্মায় পূর্ণ একটি বিরাট বসতবাড়ি, সাংকেতিক কথোপকথন এবং নিজেদের মৃত্যুর ভবিষ্যৎবাণী করতে সক্ষম প্রতিবেশীদের সান্নিধ্যে। এই বাড়িটি প্রায়শই অতিথি সমাগম আর সামাজিক অনুষ্ঠানে সরগরম থাকতো। বৃক্ষছায়া আর ফুলের ঢলে এর চারপাশ অনেকটা স্বপ্নিল পরিবেশ পেয়েছিলো। নানা মৃত্যুবরণ করার পরে মার্কেজকে তাঁর বাবামায়ের সাথে বসবাস করার জন্যে পাঠানো হয়েছিলো। তাঁর নানার মৃত্যুর পরে, অন্ধপ্রায় নানী একাকী বসতবাড়ির দেখাশোনা করতে অসমর্থ হয়ে পড়েছিলেন। বাড়িটি প্রায় বিধ্বস্ত দশায় ছিল; গাছপালা আর ফুলগুলোও লাল পিঁপড়ার আক্রমনে ধংসপ্রাপ্ত হচ্ছিলো। তাছাড়া, তিনি শৈশবেই একটি রেল স্টেশনে ‘মাকোন্দো’ নামের একটি কলা বাগানের শ্রমিকদের উপরে গনহত্যা চালানোর দৃশ্য অবলোকন করেছিলেন। তৎকালীন সরকার কলাবাগানের বিদেশী মালিকদের শান্ত রাখার উদ্দেশ্যে এই গনহত্যার সংবাদ জনগনের কাছ থেকে অজানা রাখার সম্ভাব্য সবরকম চেষ্টা চালিয়েছিল। তখন মার্কেজ নিশ্চিতভাবেই আতঙ্কিত হয়েছিলেন। তবে এর চাইতে বড় আতঙ্ক তাঁকে ঘিরে ধরেছিল উচ্চ বিদ্যালয়ে আসার পরে। কারন তিনি দেখেছিলেন, ইতিহাস বিষয়ক পাঠ্যবই থেকে এই ঘটনা পুরোপুরি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।

সাহিত্যে যাদুবাস্তবতাবাদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে দ্ব্যর্থহীনভাবে গার্সিয়া মার্কেজ এক অনবদ্য শিল্পীর নাম। তারপরেও তাঁর নিজস্ব মতামত অনুযায়ী, এককভাবে শুধু যাদুবাস্তবতাবাদের ব্যবহারই একজন লেখককে মহৎ করে তুলতে পারে না। মার্কেজের ব্যবহৃত ধারাটির চাইতে বরং তাঁর নিজস্ব কল্পনাশক্তি, মানবিক অন্তর্দৃষ্টি এবং সাহিত্যিক দক্ষতাই তাঁর শৈল্পিক লেখনী আর জনপ্রিয়তার মূল ভিত্তি। জনৈক সমালোচকের দৃষ্টিতে , গার্সিয়া মার্কেজের উপন্যাসে যাদুবাস্তবতাবাদ এক বিস্তৃত ও বহুমুখী বর্নচ্ছটা নির্মাণ করে। এর প্রান্তসীমা শুরু হয়েছে- যেটি সম্ভব হলেও সরাসরিভাবে অনন্যসুলভ, সেখান থেকে ভৌতবিচারে অসম্ভাব্যতার যে সর্বশেষ পর্যায়, সেইটি পর্যন্ত “(Bell-Villada 108)। উদাহরণস্বরূপ, কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া আত্মহত্যা করবার অভিপ্রায়ে নিজের বুকে গুলি চালায়; কিন্তু তার শরীরের কোন একটি অঙ্গেরও ক্ষতিসাধন না করে গুলিটি তার শরীর ভেদ করে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়!
‘নিঃসঙ্গতার শত বছর’ উপন্যাসের সম্পূর্ণ পরিসর জুড়েই গার্সিয়া মার্কেজ কল্পনাকে রূপ দেওয়ার জন্য অতিরঞ্জন প্রক্রিয়া ব্যাবহার করেছেন। এই অতিরঞ্জন সাংখ্যিকভাবে নির্দিষ্ট, এবং প্রত্যেকটি ঘটনা বাস্তবতার বোধের জন্ম দেয় “(Bell-Villada 109)। এর উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যায়- কর্নেল বুয়েন্দিয়া-র বত্রিশবার ব্যর্থ অভ্যুত্থান; দীর্ঘ চার বছর, এগারো মাস আর দুই দিন ব্যাপী ঝড়বৃষ্টি; ফার্নান্দা-র ক্রস-রেখা দ্বারা চিহ্নিত যৌনসঙ্গমের দিনপঞ্জি, যাতে ঠিক বেয়াল্লিশটি ‘প্রাপ্য’ দিন রয়েছে। গার্সিয়া মার্কেজ অসম্ভব বিষয়কে বাস্তবতায় রূপান্তরিত করার জন্য যাদুবাস্তবতাবাদ-কে ব্যাবহার করেছেন। ‘নিঃসঙ্গতার শত বছর’ উপন্যাসে আমরা যেমনটি দেখেছি, অবিশ্বাস্য-কে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে তিনি পুরোপুরি সক্ষম। ‘নিঃসঙ্গতার শত বছর’ উপন্যাসে বিদ্যমান বাস্তবতা আর যাদু- আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরের বিপরীত। বস্তুত, তাদের মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছে নিখুঁতভাবে। এই পৃথিবী সম্পর্কে মার্কেজের সুনির্দিষ্ট ধারণা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে উভয়েরই প্রয়োজন রয়েছে। শুধুমাত্র একজন পর্যবেক্ষকের অভিজ্ঞতালব্ধ যে বাস্তবতা, মার্কেজের উপন্যাসের প্রতিফলন সেই অবস্থানেই সীমাবদ্ধ নয়। ভিন্ন ভিন্ন পরিমণ্ডল থেকে উদ্ভূত মানুষদের স্বকীয় অভিজ্ঞতাসমূহের আখ্যান তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাসে। লাতিন আমেরিকার অনন্যসাধারণ বাস্তবতার হিসাবে এই বহুবিধ পরিপ্রেক্ষিতসমূহ সঙ্গতিপূর্ণ এবং যথার্থ। কারন মার্কেজের লাতিন আমেরিকা আধুনিকায়ন ও প্রাক-শিল্পায়নের মধ্যবর্তী অবস্থানে অচলাবস্থায় রয়েছে; গৃহযুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদের দ্বিমুখী আক্রমনের জর্জরিত অবস্থায় রয়েছে। একমুখী সামাজিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে সেখানকার মানুষের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মাত্রাও প্রতিনিয়ত নতুন বাঁক নেয়। যাদু, কুসংস্কার, ধর্ম ও ইতিহাস, এদের প্রতিটিই নিঃসন্দেহে পৃথিবীর বুকে প্রবিষ্ট হয়েছে; মানুষের জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে। যাদুবাস্তবতাবাদের বলিষ্ঠ প্রয়োগের মাধ্যমে মার্কেজ পাঠকদের কাছে এমন একটি বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছেন, যেটি এই উপাদানসমূহকে একীভূত করতে সক্ষম।

 

 

টীকাঃ

Rupkatha Journal on Interdisciplinary Studies in Humanities (ISSN 0975-2935), Vol 2, No 3, 2010
URL of the Issue: http://rupkatha.com/v2n3.php
URL of the article: http://rupkatha.com/V2/n3/MagicRealisminMarquez.pdf

গ্রন্থবিবরণীঃ

Bell-Villada, Gabriel Garcia Marquez’s One Hundred Years of Solitude: A Casebook Oxford:
Oxford University, 2002.
Marquez, Gabrial Garcia. One Hundred Years of Solitude : Harper and Row Press, Colombia.
1967.
Martz. John D. Colombia A Contemporary Survey. The University of North Carolina Press:
1962
Rausch, Jane M. Colombia: Territorial Rule and Llanos Frontier. University Press of Florida:
1999.
Wood, Michael. Garcia Marquez 100 Years of Solitude. New York: Cambridge University
Press, 1990
B. J. Geetha is an Assistant Professor in the Department of English, Periyar
University, India. Email: [email protected].

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত