| 25 এপ্রিল 2024
Categories
গল্প সাহিত্য

ইরাবতী ছোটগল্প : মুখোশ । পার্থসারথি গুহ

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

“তুমি নাচ শেখাবে? তাও আবার কুচিপুড়ি নাচ।” অষ্টমাশ্চর্য দেখার মতো অবাক চোখে ধ্রুপদের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল সেমন্তি।

“শিবরাজ চিন্নাসত্যমজির কাছে এতদিন ক্লাস করছি। সেই শিক্ষাটাই না হয় কলকাতার ছেলেমেয়েদের কাছে একটু বিলিয়ে দিলাম। দুটো পয়সা রোজগারও হবে। আবার শিক্ষাটাও বেঁচেবর্তে থাকবে। “সপ্রতিভ ভঙ্গিতে উত্তর ফেরাল ধ্রুপদ।

“তাও এতো কিছু থাকতে নাচই শেখাতে হবে? “বিরক্তি যেন উথলে উঠেছে সেমন্তির।

“নাচ কী শুধুই তোমাদের আই মিন মেয়েদের মৌরসিপাট্টা নাকি?” ধ্রুপদ দত্তগুপ্তর গলায় এবার ঠেসের ছাপ স্পষ্ট।

আসলে সেমন্তি বসু আধুনিকা মেয়ে হলে কী হবে পুরুষদের নাচে ওর বেজায় আপত্তি। ভাবখানা এমন চাকরি, ব্যবসা, খেলাধুলা, গানবাজনা সব চলতে পারে। কিন্তু নাচ নৈব নৈব চ। ওটা মেয়েদেরই মানায়। সেমন্তির সেই প্রেমিক মানুষটাই কিনা সবকিছু ছেড়ে নাচ নিয়ে পড়েছে। ওদের যখন প্রথম আলাপ হয়েছিল তখন অবশ্য ধ্রুপদের মাথায় নাচের ভূত চাপেনি। কলেজে এক বছরের সিনিয়র ছেলেটাকে প্রথম দেখেই ভাল লেগেছিল সেমন্তির। ওই যে বলে না লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। বড়লোক বাপের একমাত্র মেয়ে। ছোট থেকেই মা মরা মেয়েটা যা বায়না করত তাই হাতের কাছে এনে দিতেন ডাক্তার ইন্দ্রজিত বসু। পারলে আকাশের চাঁদও পেড়ে দেন যেন। এহেন সেমন্তি ড্যাডির মতো ডাক্তারির পথে হাঁটল না। পরিষ্কার বলে দিয়েছিল, “ওসব সাপ-ব্যাঙ কাটতে পারব না মোটেই।”

কলেজে হিস্ট্রি অনার্স নিয়ে পড়তে গিয়েই আলাপ ধ্রুপদের সঙ্গে। ইকনমিক্স অনার্স নিয়ে পড়ছে। সেকেন্ড ইয়ারের কৃতী ছাত্রও বটে। তারওপর বড্ড কিউট। মুখের আদলটা অনেকটা ক্যাডবেরি হিরো আমির খানের মতো। চোখদুটো যেন সবসময় কিছু বলতে চাইছে। সেই চোখের দিকে বারকতক তাকিয়েই কুছ কুছ হয়ে গিয়েছিল। প্রথম প্রথম সেমন্তিকে পাত্তাই দিত না। অবশ্য কোনও মেয়ের সঙ্গেই পিরিত ছিল না। কিন্তু, সেমন্তির যে ছোটবেলা থেকেই অভ্যেস। যেটা চাই সেটা পেতেই হবে। সে ল্যাব্রেডর পোষা হোক আর হ্যান্ডসাম বয়ফ্রেন্ড।

সেমন্তির জেদের কথা তো শোনা গেল। এবার আসি ওর মুখশ্রীর দিকে। হয়তো ডাকসাইটে সুন্দরী বলা চলে না। তবে মিষ্টি দেখতে বলাই যায়। চোখ দুটো সবসময় যেন স্বপ্ন-সাগরে ডুব দিয়ে আছে। তবে সেমন্তি আবার বড্ড ছেলেঘেষা। মেয়েবন্ধুর চেয়ে পুরুষ বন্ধুই বেশি। যদিও সেই বন্ধুত্বে এতদিন প্রেম ছিল না। সেই স্বপ্ন-সাগর মন্থন করেই উঠে এল ধ্রুপদ। বলাবাহুল্য, এই মন্থন অমৃত না দিলেও প্রেমের জিজীবিষা বয়ে আনল। বন্ধুত্ব থেকে প্রেমের সরণিতে বেশ সাবলীল চলাফেরাও হচ্ছিল। বাধ সাধল ধ্রুপদের নাচ শেখানো। শেখা পর্যন্ত বরদাস্ত করেছিল সেমন্তি। ভেবেছিল ধ্রুপদের এই পাগলামি অচিরেই সেরে যাবে। কিন্তু কোথায় কী! নিজে শেখার পাশাপাশি সেই শিক্ষা ভোগপ্রসাদের মতো বিলানো নিয়ে শুরু হল তু তু মে মে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কুচিপুড়ি নৃত্যগুরু শিবপ্রকাশ চিন্নাসত্যম থাকেন অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে। কলকাতায় ছেলের কাছে আসা-যাওয়া প্রায় লেগেই থাকে। সেই সূত্রে এখানে প্রোগ্রামও করে তাঁর কুচিপুড়ি ইন্সটিটিউট।

রবীন্দ্রসদনে এরকমই একটা নাচের শো হয়েছিল কয়েক বছর আগে। শিবপ্রকাশজির গ্রুপের প্রেজেন্টেশন অর্ধনারীশ্বর দেখে ধ্রুপদ পুরো ফিদা। পাশে বসা সেমন্তির হাতটা চেপে ধরে বলেই ফেলেছিল, “ওনার কাছে কুচিপুড়িটা শিখতেই হবে।”

“কী তুমি নাচ শিখবে? মাথাটা কী একেবারে খারাপ হয়ে গেল?” সেমন্তি বিরক্তি চেপে রাখতে পারেনি। মনে মনে নিজেকেই দোষ দিচ্ছিল কী কুক্ষণে বন্ধুর দেওয়া পাসটা নিয়ে এখানে এসেছে। তাও আবার ধ্রুপদকে বগলদাবা করে। ছেলেটা যে এখন বেঁকে বসেছে।

ধ্রুপদের এই এক ব্যাপার। কোনও শখ মাথায় চাপলে সহজে তা আর নামবে না। একসময় নাটক নিয়ে এমন ভূত চেপেছিল। তখন কলকাতা ও মফস্বল জুড়ে গ্রুপ থিয়েটারের রমরমা। ঢাকুরিয়ার কাছে এমনই একটা গ্রুপে ভিড়ে গিয়েছিল ধ্রুপদ। স্কুলের তখন উচু ক্লাস। স্বাভাবিকভাবেই এই নাটক করা নিয়ে বাড়িতে ফরমান জারি হয়েছিল। হাজার ওজর-আপত্তির বেড়ি পরিয়েও আটকে রাখা যায়নি ওকে। গিরিশ মঞ্চ, রবীন্দ্রসদন, শিশির মঞ্চ, মুক্তাঙ্গন, নিরঞ্জন সদনে তখন মাঝেমধ্যেই শো পড়ছে ধ্রুপদের। খুব যে আহামরি ক্যারেক্টর করছে তা নয়। কিন্তু, ওই ছোট চরিত্রেই বেজায় খুশি। আত্মীয়-বন্ধুদের খোঁটাও শুনতে হত বিস্তর।

এই তো ধ্রুপদের মামাতো দাদা সর্বজ্ঞানের অধিকারী ঋজু প্রায়শই বলত, “ধুস ওসব ছোট ক্যারেক্টর করে কোনও দিন নাম করা যায় নাকি?” ধ্রুপদ মুখে কিছু না বললেও হাবেভাবে বুঝিয়ে দিত এই ছোট রোল কটা লোকের ভাগ্যে জোটে। তাছাড়া নামের জন্য তো নাটকের পিছনে ছুটছে না। নাটকটাকে আত্মস্থ করতে চাইছে। সেজন্য নিজের অভিনয়ের চেয়েও অন্যান্য কাজের দিকে মন ওর।

ধ্রুপদের এই অন্যদিকে নজরটা বেশ বুঝতে পেরেছিলেন ওদের গ্রুপের কর্ণধার শান্তনু পাল। প্রথমদিন সুরতীর্থে রিহার্সালে গিয়েই অবশ্য রাশভারী মানুষটার তিরিক্ষি মেজাজ টের পেয়েছিল ধ্রুপদ। পাড়াতুতো এক দাদার পরিচিত শান্তনুদা। ভেবেছিল আর পাঁচজন দাদার মতোই অগ্রজ স্নেহ পাবে। কিন্তু, কোথায় কী? এই মানুষটা তো প্রথম কয়েকমাস ওকে জুতোচপ্পল পাহারার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। পরিস্কার বলেছিলেন, “নাটক করতে এসেছো। আগে গ্রুপের মানসিকতা বোঝো। সহমর্মী হতে শেখো।”

বলেই ওই কাজটা গছিয়ে দিয়েছিলেন। গ্রুপের যত অভিনেতা, অভিনেত্রী বা টেকনিক্যাল কাজের লোকজন তাঁদের জুতোর খেয়াল রাখা। কে কী পরে আসছেন। বর্ষার দিনে ছাতা বা বর্ষাতি সামলানোর কাজ। তারওপর আবার স্টেজ রিহার্সাল বা নাটকের দিন সেটের বাড়তি দায়িত্ব ন্যস্ত হত ওর ওপর।

কাগজে কলমে একজন সেট ইনচার্জ থাকলেও তিনি নাকি রাজ্যের কাজে ব্যস্ত। স্টেজের সেট ঠিক করা যে কী কঠিন কাজ সেটা একমাত্র যারা করেছে তারাই জানে। একটা দৃশ্য থেকে পরবর্তী দৃশ্যের মধ্যে সেট রদবদল করতে অনেকসময়ই ভুল হয়ে যেত। তার জন্য সবার সামনে যা নয় তাই বলে তিরস্কার করতেন শান্তনুদা। তাও নাটক শেখার তাগিদে সেটা গায়েই মাখত না ধ্রুপদ। এভাবে বেশ কয়েকমাসের সাধনার পর ছোটখাটো চরিত্র পেতে থাকল। বেশ মনে আছে জীবনের প্রথম অভিনয় করেছিল এক ফেরিওয়ালার চরিত্রে। খুব একটা ডায়লগ না থাকলেও অব্যক্ত একটা এক্সপ্রেশন ছিল। আন্তরিকভাবেই সেটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছিল ধ্রুপদ। তাও শান্তনুদার কিছুতেই যেন পছন্দ হত না। বলতেন, “আরেকটু, আরেকটু ফোটাতে হবে চরিত্রটাকে।” কখনও বলতেন, “বড্ড স্টিফ হয়ে যাচ্ছিস।”

ধ্রুপদ মনে মনে ভাবত নাটকের এতগুলো চরিত্র। নায়ক, নায়িকারাও আছে। কই তাদের দিকে তো মোটেই নজর নেই শান্তনুদার। বেছে বেছে সেই ওর পিছনে পড়ে আছেন। আরে বাবা! ধ্রুপদের রোলটা তো এক রকম মৃত সৈনিকের মতো। তার অভিনয় ফুটল কী ফুটল না তাতে নাটকের কী এসে যায়? তাও যদি একটা বড় ক্যারেক্টর পেত বোঝা যেত। কিন্তু, শান্তনুদা মনে হয় ওর ওপর ভরসা করতে পারছেন না। শান্তনুদা হয়তো ওর ওপর ভরসা করতে পারেননি। কিন্তু, একটা সময় এল যখন নাটকের ওপর ভরসাটাই চলে গেল ধ্রুপদের।

খুব সাধারণ ঘরের ছেলে। বাবা মারা যাওয়ার পর অসুস্থ মাকে নিয়ে কোনওরকমে মাথা গুঁজে আছে যাদবপুরের বসত বাড়িতে। অর্থের অভাবে অবশ্য সেই বাড়ি পুরানা হাভেলির আকার নিয়েছে। সারিয়ে তকতকে করে তুলবে সেই টাকা কোথায়? ভাল মার্কস নিয়ে গ্র‍্যাজুয়েট হওয়ার পরেও তাই মাস্টার্স করা আর হল না। নাটক বন্ধ হয়ে জীবন নাটকের রঙ্গমঞ্চে নেমে পড়ল ধ্রুপদ। ইকনমিকস অনার্স বলেই প্রাইভেট একটা কোম্পানিতে চাকরিটা হয়ে গেল। খুব আহামরি না হোক হেলাছেদ্দা করার মতো নয় মোটেই।

এতকিছুর পরেও অবশ্য সেমন্তির সঙ্গে সম্পর্কটা ভোকাট্টা হল না। বলাবাহুল্য, দুজনের পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস এতে ইন্ধন জুগিয়েছিল। সেমন্তির বাবা প্রথমদিকে ধ্রুপদের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু, সেমন্তির মা স্বামীকে বাধ্য করলেন ধ্রুপদকে মেনে নিতে। দুই পরিবারের সম্মতিতে যখন সম্পর্কটা পরিণতি পেতে চলেছে তখনই ধ্রুপদের নাচের স্কুল খোলা নিয়ে শুরু হল বাকবিতণ্ডা। ক্রমেই যা ধুন্ধুমার আকার ধারন করল। সেমন্তি রীতিমতো নিদান দিল, ধ্রুপদ নাচ শেখানো বন্ধ না করলে এই বিয়ে হবে না।

এতদিন যে ডাক্তারবাবু এই মেলামেশাটা সেভাবে মানতে পারেননি তিনিই এবার মেয়েকে বোঝাতে আরম্ভ করলেন। সেমন্তির মা রেবতিদেবীও আসরে নামলেন। সেমন্তির এক গোঁ, “ও নাচ শিখল। খারাপ লাগলেও মেনে নিয়েছিলাম। তা বলে নাচ শেখাবে। ছি! এরকম কারো সঙ্গে কিছুতেই সংসার করতে পারব না।”

যাদবপুরের কাছে ততদিনে আবার ধ্রুপদ ডান্স আকাদেমি বেশ জমে উঠেছে। ছাত্রছাত্রীও মন্দ হচ্ছে না। আসলে কলকাতায় কুচিপুড়ি নাচ শেখানোর এত ভাল টিচার কোথায়? ভারতনাট্যম, কত্থক, মণিপুরী বা ওড়িশির মতো ক্লাসিক্যাল নাচ শেখানোর প্রতিষ্ঠান অনেক কিন্তু কুচিপুড়ির তালিম দেওয়ার যোগ্য শিক্ষকের এখানে ভারী অভাব। সেই শূন্যতাই এতদিন পর পূর্ণ করছে ধ্রুপদ। আফটার অল ইকনমিকসের ছাত্র। প্যাশনের পাশাপাশি রোজগারপাতির ব্যাপারটাও ভালই বোঝে। সত্যি বলতে কী, এখন এত ছাত্রছাত্রী হয়ে গিয়েছে যে চাকরিটা টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হয়ে গিয়েছে।

ধ্রুপদও সেটাই ভাবছিল। অনেকদিন তো হল। এবার চাকরিতে ইতি টেনে পুরোপুরি নাচ শেখানো নিয়েই থাকবে। ভেবেছিল সেমন্তি পাকাপাকিভাবে জীবনে এসে গেলে ওকেও আকাদেমিতে সামিল করে নেবে। কর্তা-গিন্নি মিলে পুরো জমিয়ে দেবে। সেমন্তি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনটা ভালই বোঝে। দেশ ও বিদেশের নানা জায়গায় শোয়ের অফার আসছে। আকাদেমির শ্রীবৃদ্ধি এবং লক্ষ্মীলাভ এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে গুছিয়ে। এমতাবস্থায় কিনা ওর নাচ নিয়ে মেয়েটা এত আপত্তি করছে। বিয়ে করবে না বলেও ফতোয়া জারি করেছে। সেমন্তির একটাই কথা, ” আগে নাচ শেখানো বন্ধ করো। তারপর ভাবা যাবে।” এদিকে চাকরি ছেড়ে নৃত্য আকাদেমিকেই সম্বল করতে ততদিনে অনেক কদম এগিয়ে গিয়েছে ধ্রুপদ। এখন ফিরবে কী করে?

সেমন্তিরই বা এত আপত্তিরই কারণ কি? আর পাঁচজনের মতো এটা প্রথম প্রথম তাড়িত করত ধ্রুপদকেও। পরে বুঝেছে মেয়েটা ওকে হারানোর ভয় পাচ্ছে। কিন্তু নাচ শেখানোর সঙ্গে প্রেম খোয়ানোরই বা কী সম্পর্ক? এই ভাবনা থেকেই উঠে আসে সুরঞ্জনার কথা।

সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত। এই মুহূর্তে কলকাতা শহরের একজন নামি মনস্তত্ত্ববিদ। এর বাইরেও অবশ্য তাঁর একটা পরিচয় আছে। তিনি হলেন সেমন্তির প্রিয় পিসিমণি। ওর বাবা ইন্দ্রজিতবাবুই বোনের সঙ্গে মেয়ে এবং হবু জামাইয়ের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে দিলেন। যদিও তখন জামাই হওয়ার ব্যাপারটা বিশ বাঁও জলে ডুবসাঁতার কাটছে।

অনেকদিন পর আবার সেমন্তি আর ধ্রুপদ এক জায়গায় হয়েছে। যোধপুর পার্কের শীততাপনিয়ন্ত্রিত চেম্বারের মধ্যেও দুজন কেমন জড়-ভরতের মতো বসে আছে। আর সমানে ঘেমে চলেছে। মনের ভিতরের উথালপাতাল তখন ওদের সুস্থির থাকতে দিচ্ছে না কিছুতেই।

এরপর শুরু হল সুরঞ্জনা দাশগুপ্তর সেশন। প্রথমে আলাদা আলাদাভাবে দুজনের সঙ্গে ইন্টারেকশন সারলেন মিসেস দাশগুপ্ত। পরে মুখোমুখি বসিয়ে চলল আরও একপ্রস্থ। পিসিমণির কাছে সত্যিই ভেঙে পড়ল সেমন্তি। জানাল ধ্রুপদ নাচের প্রতি অনুরক্ত হওয়ার পর থেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ধ্রুপদ একেই অতিরিক্ত সুন্দর। ছোটবেলায় ওর ঠাকুমা নাকি এও বলতেন, “আমার বাবুসোনাটাকে মেয়ে গড়তে গিয়ে ছেলে বানিয়ে ফেলেছেন ওপরওয়ালা।” ধ্রুপদ এই কথাটা আবার ফলাও করে বলেছিল সেমন্তিকে। সেদিন থেকেই মনে হয় সন্দেহের বিজটা গেঁথে গিয়েছিল। তারপর থেকে ধ্রুপদকে নিয়মিত জরিপ করত সেমন্তি। ওর হাঁটাচলা, বাচনভঙ্গীতে কোনওরকম মেয়েলি ছাপ পড়ছে কিনা…

না সেরকম কোনও কিছু মোটেই নজরে পড়ত না। কী হ্যান্ডসাম। জিম করা পেশিবহুল চেহারায় ভরপুর হিম্যান উপস্থিতি। যদিও তারমধ্যেই ওর লাল টুকটুকে ঠোঁটটা যেন কেমন বেমানান। মনে হত যেন কেউ লিপস্টিক রাঙিয়ে দিয়েছে। “একটু আধটু সিগারেট খেতে পারো তো! তাহলে বেশ কালচে ঠোঁট হবে। “ধ্রুপদের মধ্যেকার মেয়েলি বিউটি স্পটটা বোধহয় এভাবেই মুছে দিতে চেয়েছিল সেমন্তি।

এপর্যন্ত তাও ঠিক ছিল। কিন্তু সব তোলপাড় করে দিল ধ্রুপদের নাচের প্রতি আসক্তি। মুখে লিপস্টিক, চোখে টানা টানা কাজল, প্লাক করা ভুরু, মুখ ভর্তি প্রসাধন আর পায়ে ঘুঙুড় পরে ক্লাস ধ্রুপদকে ক্লাস করাতে দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারেনি সেমন্তি। মনে হচ্ছিল যেন কোনও এক অজানা পাতালপুরীতে তলিয়ে যাচ্ছে। তবে সমস্যা থাকলে তার সমাধানও থাকে। আর সমাধানের খুল যা সিম সিম মন্ত্র নিয়ে হাজির হলেন সুরঞ্জনা দাশগুপ্তই। সাপও যাতে মরে আর লাঠিও না ভাঙে ফর্মুলা অনুযায়ী ঠিক হল ধ্রুপদ নাচ ছাড়বে না মোটেই। ক্লাসও চলবে পুরোদমেই। তবে হ্যাঁ, প্রেমের স্বার্থে, পরিণতির লক্ষ্যে সর্বোপরি সেমন্তির মুখ চেয়ে একটা রফায় গেল ধ্রুপদ। সেই সমঝোতাসূত্র অনুযায়ী কুচিপুড়ি ছেড়ে অন্য ঘরানার এক ক্লাসিক্যাল নাচ শেখাবে ধ্রুপদ।

 

শিবপ্রকাশ চিন্নাসত্যমের কাছে কুচিপুড়ির তালিম নেওয়ার সময় আরও একটা নাচেরও শিক্ষা পেয়েছিল ধ্রুপদ। শিবপ্রকাশজির ছেলে প্রখ্যাত কথাকলি নৃত্যশিল্পী রবিপ্রকাশ। তাঁর কাছেই এই অন্য ধারার উচ্চাঙ্গ নাচের কলাকৌশল শিখে নিয়েছিল মেধাবী ধ্রুপদ। সেটাই এবার থেকে একটু ঝাড়াইবাছাই করে শেখাবে ধ্রুপদ। কুচিপুড়ির ক্লাসটা চালাবে ওরই এক বন্ধু। কথাকলির শিক্ষক ধ্রুপদ দত্তগুপ্তকে বিয়ে করতে আর কোনও আপত্তিই রইল না সেমন্তি বসুর। মনস্তাত্ত্বিক থুড়ি পিসিমণি সুরঞ্জনাকে থ্যাংকস দিয়ে সেমন্তি কবুলও করেছে সেকথা। “যত খুশি নাচ শেখাক। নো প্রবলেম। আরে বাবা যতই হোক এখন তো ও মুখোশের আড়ালে নাচবে। “

ধ্রুপদও মনে মনে ভেবেছে গোটা দুনিয়াটাই যদি মাস্কের আবরণে ঢেকে যেতে পারে তাহলে সেমন্তির জন্য তারও মুখোশ পরে নাচে সমস্যা কোথায়।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত