পরাধীনতার আগল থেকে দেশকে মুক্ত ও স্বাধীন করার সংগ্রামে আত্মোৎসর্গকারী, দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মাস্টার দা সূর্যসেন। জন্ম ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের নোয়াপাড়া গ্রামে। আজ এই মহান বিপ্লবীর ১২৫তম জন্মবার্ষিকী।
উচ্চ মাধ্যমিকে সূর্যসেন ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র। বি.এ পাশ করেন কলকাতার বহরমপুর কলেজ থেকে। এখানেই বিপ্লবী দলের সাথে তাঁর যোগাযোগ ঘটে। স্নাতক পাশ করে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে উমাতারা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। সূর্যসেন হয়ে ওঠেন মাস্টার দা। সেই সাথে চলতে থাকে সংগঠন তৈরির কাজ। সংগঠন তৈরির কাজে তাঁর সাথী ছিলেন অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, নির্মল সেন প্রমুখ। গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন সূর্যসেন। নিজের বিপ্লবী দলের জন্য অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তিনি বাংলাদেশ ও কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরেছেন। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার দখলের মতো ঐতিহাসিক ঘটনা এবং এর কিছুদিনের মধ্যে চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে ব্রিটিশদের সাথে সূর্যসেনের বিপ্লবী দলের সম্মুখযুদ্ধে সাময়িক হলেও ব্রিটিশদেরই পরাজয় হয়। সূর্যসেনের বিপ্লবী দলের অন্যতম কর্মী ছিলেন বীরকন্যা নামে খ্যাত বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, যিনি মাস্টার দার দলের সাথে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে সশস্ত্র আক্রমণ করেছিলেন এবং ধরা পরার আগ মুহূর্তে পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। সূর্যসেন ব্রিটিশদের কাছে ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। ব্রিটিশরা তাঁকে গ্রেফতারের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। ১৯৩৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সূর্যসেন ইংরেজ সেনাদের হাতে গ্রেফতার হয়ে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলে মহান এই বিপ্লবীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। দেশের জন্য মাস্টার দা সূর্যসেনের এই আত্মত্যাগ যুগ যুগ ধরে বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে।
মাষ্টারদা সূর্য সেনের শেষ চিঠি
“…আমার শেষ বাণী-আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায়
করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই ত’ সাধনার সময়। বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এই ত সময়। ফেলে আসা দিনগুলোকেও স্মরণ করার এই ত সময়। কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমার ভাইবোনেরা, তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিএ্যহীন আমার এই জীবনের একঘেঁয়েমিকে ভেঙ্গে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহুর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহুর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করছিল। জীবনভর উৎসাহ ভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মত সেই স্বপ্নের পিছনে আমি ছুটেছি। জানিনা কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষে পৌছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মত তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমার বন্ধু্রা- এগিয়ে চল। এগিয়ে চল- কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুন। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশির্বাদ করুন। ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোন দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলধা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যে সব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো। আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসে- এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভিতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশির্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক বন্দে মাতরম্।”