ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৭) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
এবার ফিরে আসি এসময়ে।দরজা খোলা,তাই দাঁড়াবার জায়গা মাঝখানে।মানে পুরনো সময়ের হাওয়া এসে ছুঁয়ে দেয় নতুন সময়ের দরজায় দাঁড়ানো আমাকে।
অনেকগুলো বছর পার করতে করতে চারপাশের পৃথিবীর বদল কেমন গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। কোনকিছুই আর তেমন অবাক করেনা।পর্দা তোলার পর নাটকের কুশীলবেরা মঞ্চের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ায়,আর নাটক শুরু হয়ে যায় । ঠিক তেমন করেই ‘এইসময়’ তার সমস্ত পরিবর্তন নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে একেবারে দৃষ্টির সামনে।তাকে গ্রহণ না করে উপায় কী?
এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি, তার ফ্ল্যাট বারোতলায়। সে কাজে বেরোনোর পর, সকাল এগারোটা থেকেই তার ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজতে থাকে,আর তার অনুপস্থিতিতে একটার পর একটা পার্শেল আমি নিতে থাকি।
বেচাকেনাই চলে,তবে এ বেচাকেনার ধরণ আলাদা। নিঃশব্দে,ল্যাপটপ্ বা মোবাইলের বোতাম টিপে কাজ হয়ে যায়।যাকে বলে অনলাইন বা আন্তর্জালের বিকিকিনি। ওর বাড়িতে সকালে অনলাইনে এসেছিল একটি নারকেল কুরোবার মেসিন।দুপুরে বাচ্চাদের খেলনা। বিকেলে জামাকাপড়ের প্যাকেট।রাতে বেডসিট আর পিলোকভারের সেট। জিনিস বাছাই করা, কেনাকাটা আর অর্ডারের পর্বের পুরোটাই চলেছে অনলাইনে। ক্রেতা বিক্রেতার মুখ দেখেননি।বিক্রেতাও ক্রেতাকে দর্শন করেননি।অদৃশ্য হস্তের সেই বিকিকিনি একদম শুরুতে আমাকে অবাক করলেও এখন আর করেনা।
দিল্লীতে বেড়াতে গিয়ে লোকে দেখে কুতুবমিনার। দেখে লালকেল্লা।আমি দেখেছিলাম ‘মল।’বাংলায় ‘মল’ শব্দটির নানা অর্থ। বিভিন্ন অর্থ আর তার ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার।তবে এ ‘মল’ সে ‘মল’ নয়। একেবারেই আলাদা। বিশালাকায় বিপনী।আর সেই বিপনীতে সব কিছুরই কেনাকাটা চলছে।
পুরুষরা কেউ কিনছেন শার্ট তো কেউ কিনছেন কোট ।মহিলা বা শিশুদের জন্যও আছে আলাদা আলাদা বিভাগ।থরে থরে সাজানো কাচের বাসন,ঘর গেরস্থালীর নিত্য ব্যবহারের নানা জিনিস।বাড়ি সাজানোর বাহারে বস্তু,আনাজপাতি,বাচ্চার খেলনা, কোনকিছুই কম পড়েনি।তবে আকৃতি প্রকৃতিতে একইরকম।শুধু সাইজ আলাদা। আবার একেবারে অন্যরকমেরও আছে।নানা রঙের ঢঙের জিনিসের অবাধ প্রদর্শনী।
আরো পড়ুন: ইরাবতী ধারাবাহিক: খোলা দরজা (পর্ব-৬) । সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়
এখন এখানেও মলে যাই।মল বা এইসব অনলাইনের বাজারে ঢুকে মনে হয় আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ বুঝি আমার হাতে।যা চাইব তাই পাব।
এসব বাজারে ঘুরতে ঘুরতেই মনে পড়ে যায় এক বৃদ্ধার করুণ মুখ।গাছের কটি লাউ বা কুড়োন সজনে ফুলের ঝুড়িটি কোলের কাছে নিয়ে বিড়বিড় করছেন, “নিবিতো মা? তুই নিলে তবে আমার হাঁড়ি চড়বে।”
সোনা বাঁধানো দাঁতের ঝিলিক তোলা মাছওয়ালিকে কোথাও আর খুঁজে পাইনা। অনলাইনের ধাক্কায় হারিয়ে গিয়েছে তাদের প্রিয় মুখ।আর হারিয়েছে বেচাকেনার দিনগুলোতে এইসব বাজারের ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে গড়ে ওঠা নিগূঢ় সম্পর্ক। যার সন্ধান আর কোনদিন পাওয়া যাবেনা।এইসব ছোট ছোট ‘দিন আনা দিন খাওয়া’ বিক্রেতাদের বেঁচে থাকার অবলম্বনটুকু হারিয়ে গেল বড় বড় আন্তর্জাল বিপণীর ঘোলা জলে। কে জানে, বিপুল জনসংখ্যার দেশে ছোট ছোট চাষীদের ওইটুকু সম্বল কেড়ে নিলে, থাকবে কি?তারা বাঁচবে কী করে?
আর একরকমের বিকিকিনির সাক্ষী হলাম নিজের জন্মদিনে। সান্ধ্য পূজার তোড়জোর করছি।হঠাৎ কলিংবেলে হাত ছুঁইয়ে এক বিক্রেতার আবির্ভাব।“আপনাদের কেক ধরুন আর আমার কাগজে সই করে দিন।”
বিশাল বড় কেক,তারপরেও এলো বিরিয়ানি।এসব আর তেমন অবাক করেনা। বরং আনন্দ দেয় ! বিস্মিত হই বিদেশে বসবাস করা ব্যস্ত ছেলের বিবেচনা বোধে, ভালবাসায়। আর পৃথিবীর দুইপ্রান্তের সময়ের সমীকরনে।
সারাপৃথিবী এখন হাতের মুঠোয়।তাই গুরগাঁওয়ে বোনের বাড়ির ডিনারে মৌরলা মাছ ভাজা বা টাটকা ইলিশ পাতুরি, আজ খুব সহজেই মেলে। তার কাছেই শুনি কলকাতার জগুবাজারের গলিতে পাওয়া সুনির্বাচিত মাছগুলি প্লেনে চেপে প্রায়শঃই তাদের রান্নাঘর থেকে খাবার টেবিলে পৌঁছে যায়।জানি তো সব দূরত্ব এভাবেই ঘুচে যাবে।আর বাজারের আঁচল ক্রমশঃ বিস্তৃত হবে। কিন্তু আমাদের ইচ্ছাপূরণের আড়ালে বেশ কিছু মানুষের চাওয়া পাওয়ায় টান পড়বে না তো? তাদের কথা ভাববে কে?
ঐতিহ্যময় শহর চন্দননগরের স্থায়ী বাসিন্দা সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতক।১৯৯৬ সালে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়’দিবারাত্রির কাব্য’ পত্রিকায়।২০০১ সালে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়।‘আনন্দবাজার’, ‘বর্তমান’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘তথ্যকেন্দ্র’, ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ ছাড়াও, ‘অনুষ্টুপ’, ‘কুঠার’, ‘এবং মুশায়ারা’-র মতো বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনেও তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রকাশের ধারা অব্যাহত। প্রকাশিত উপন্যাস পাঁচটি, গল্পগ্রন্থ চারটি, এবং কবিতার বই একটি।