| 29 মার্চ 2024
Categories
এই দিনে বিনোদন

মেহেদি হাসান: যে কণ্ঠস্বর বহু মানুষের হৃদয়ের কথা বলে দিত

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

লতা মঙ্গেশকর তার সঙ্গীত শুনে বলেছিলেন, “স্বয়ং ঈশ্বর যেন তার কণ্ঠে অবস্থান করেন।” আরেক কিংবদন্তী জগজিৎ সিং বলেছিলেন “তার মাপের গজল শিল্পী আরেকজন তৈরি হওয়া অসম্ভব”। কাওয়ালি শিল্পী আবিদা পারভীনের মতে, “সঙ্গীতের ভুবনে তিনি এক জীবন্ত টাইটানিকস্বরূপ”। 

যার সম্পর্কে এত কথা বলা হচ্ছে, তিনি আর কেউ নন, গজল সম্রাট মেহেদী হাসান। যিনি আজও বিশ্ববাসীকে মোহাবিষ্ট করে রাখছেন তার সুমিষ্ট কণ্ঠের গজলে। শাহেনশাহ-ই-গজলের বেড়ে ওঠা ছিল সিনেমার গল্পের মতো। ১৯২৭ সালের ১৮ জুলাই রাজস্থান প্রদেশের ঝুনঝুনু জেলার লুনা গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী শিল্পী পরিবারে। সঙ্গীতের প্রাচীন ধ্রুপদী ধারাকে নিয়ত লালন করে, এমন পরিবারে মেহেদী হাসান ছিলেন সঙ্গীত সাধনার ১৬তম প্রজন্ম। শিশুকালেই তালিম নেন তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে। তার পিতা ওস্তাদ আজিম খান ও চাচা ইসমাইল খান ছিলেন তার প্রথম শিক্ষাগুরু। তার সঙ্গীতে দক্ষতা কিশোর বয়স থেকেই বিকশিত হতে শুরু করে। উদীয়মান প্রতিভা হিসেবে খুব দ্রুতই পরিচিতি লাভ করেন তিনি। শোনা যায়, একবার বারোদার মহারাজার দরবারে প্রায় চল্লিশ মিনিট রাগ ‘বসন্ত’ পরিবশেন করে উপস্থিত সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি, তখন তার বয়স ছিল মাত্র আট বছর।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


১৯৪৭ এর দেশভাগের পর মেহেদি হাসানের জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা। এ সময় তার পরিবার ভারত ছেড়ে পাকিস্তানের সঞ্চিয়াল জেলার ছিচা ওয়াতনি এলাকায় বসতি গড়েন। দেশভাগের আঁচ লাগে পরিবারের মধ্যে। তাঁরা চলে যান পাকিস্তানে। তখন মেহদি ২০ বছরের যুবক। শুরুর দিকে পাকিস্তানে রীতিমতো দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে মেহদির পরিবারকে। এক সময় তাঁকে স্থানীয় একটি সাইকেলের দোকানে কাজও নিতে হয়েছিল। কিন্তু, দারিদ্রের মধ্যেও দু’বেলা রেওয়াজ জারি রাখতেন। ১৯৫৭-য় প্রথম পাকিস্তানের রেডিওয় ডাক পান তিনি। 

অডিশনে একের পর এক গাইলেন ঠুমরি, রাগ- খাম্বাজ, পিলু, দেশ ইত্যাদি বিভিন্ন ঘরানার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। তার অসাধারণ সুরের জাদুতে মুগ্ধ হন বিচারকগণ। তাকে ৩৫ রুপী সম্মানীতে ‘এ’ গ্রেডের ঠুমরী শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। রেডিওতে গান গাওয়ার সুবাদে তার পরিবারের যেমন আর্থিক সঙ্কট লাঘব হয়, তেমনি সঙ্গীত জগতে ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ শুরু করেন মেহেদি হাসান।

ঠুমরী শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেলেও নিজেকে তিনি মনে করতেন একজন পরিপূর্ণ গজল শিল্পী। গজলের প্রতি তার ভালোবাসা তখন একটুও কমেনি। এ সময় তিনি ঝুঁকে পড়েন উর্দু কবিতার প্রতি। কিছু কবিতাও লেখেন তিনি উর্দুতে এবং তাতে সুর করেন। একবার রেডিওর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুরোধে পরীক্ষামূলকভাবে দুটো গজল পরিবেশন করেন, আর তাতেই তার জীবনের মোড় ঘুরে দাঁড়ায়। তিনি রেডিওতে আরো বেশ কয়েকটি গজল পরিবেশনের মাধ্যমে শ্রোতাদের মন কাড়েন। গজল শিল্পী হিসেবে হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পেতে থাকেন তখন থেকেই। ‘ম্যায় হোস ম্যায় থা তো ফির’, ‘রাফতা রাফতা ও মেরি হাস্‌তি কা সামান হো গ্যায়ি’, ‘খুবাকু ফেইল গেয়ি’, ‘মহব্বত করনে ওয়ালে’, ‘দুনিয়া কিসিকে পেয়ার’, ‘জিন্দেগি মে তো সাবহি পেয়ার কিয়া কারতি হে’, ‘বাত কারনি মুঝে মুশকিল’, ‘খুলি জো আঙ্গা ওহ থা’,  ‘আব কি বিচরে’ সহ বহু গজল তাকে এনে দেয় গজলের মুকুটহীন সম্রাটের সম্মান। সঙ্গীত ও গজল হয়ে ওঠে তার আমৃত্যু সঙ্গী।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


১৯৬২ সালে পাকিস্তানের উর্দু চলচ্চিত্রে প্রথম প্লে ব্যাক করার সুযোগ পান মেহেদি হাসান। তার গাওয়া ‘জিস নে মেরে দিল কো দর্দ দিয়া’ গানটি শ্রোতাদের বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ১৯৬৪ সালে ‘ফারাঙ্গি’ ছবিতে কবি ফৈয়জ আহমদ ফৈয়জের সৃষ্টি ‘গুল সে রাংগ ভারে’ গজল গানটির প্লে ব্যাক শিল্পী হিসেবে তিনি ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। এরপর আর তাকে থেমে থাকতে হয়নি। একের পর এক জনপ্রিয় গানের প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্র জগতে তিনি স্থায়ী আসন করে নেন। পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে শতাধিক গান গেয়েছেন এই শিল্পী।
মেহেদি হাসানের উল্লেখযোগ্য অ্যালবামের মধ্যে রয়েছে- ক্যাহনা উসে, ইন কনসার্ট, মাহফিল, খুলি জো আঙ্গ, নজরানা, লাইভ অ্যাট রয়েল অ্যালবার্ট হল, আন্দাজ-ই-মাস্তানা, শাম-ই-গজল,  ক্লাসিক্যাল গজল- ১, ২, ৩, দিল জো রোতা হেয়ি, গালিব গজলস, গজলস ফরেভার-১, রিমেমবারিং মেহেদি হাসান, ট্রেজারস, গোল্ডেন কালেকশন অব মেহেদি হাসান-১, ২, গোল্ডেন গ্রেট, লাইফ স্টোরি, লাইভ আর্ট খাম্বাজ, দরবার গজল ও লাইভ কনসার্ট ইন ইন্ডিয়া। ২০১০ সালের অক্টোবরে এইচএমভি হতে প্রকাশিত হয় তার সর্বশেষ অ্যালবাম ‘সারহাঁদে’।

পেশাদার গায়কের সাথে সাথে তিনি ছিলেন এক অনন্য সঙ্গীত পরিচালক। তার সর্বশেষ অ্যালবাম ‘সারহাঁদে’-তে ফারহাদ শাহজাদের কথা ও মেহেদি হাসানের সুরে লতা মঙ্গেশকরের সাথে গাওয়া ‘তেরা মিলনা’ গানটি শ্রোতাদের বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। মেহেদি হাসান উর্দু, বাংলা, পাঞ্জাবি ও আফগান ভাষায় ২০ হাজারের অধিক গান গেয়ে বিভিন্ন ভাষাভাষী ভক্তদের মনের খোরাক মিটিয়েছেন। সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি পেয়েছেন অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা।


Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com


পকিস্তানের চলচ্চিত্রে প্লে ব্যাক শিল্পী হিসেবে তিনি পেয়েছেন ‘নিগার এওয়ার্ড’, অনবদ্য গজলের জন্য ভক্তদের কাছ থেকে লাভ করেন ‘শাহেনশাহ-এ-গজল’ ও ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ উপাধি। সঙ্গীতে সারাজীবন কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পাকিস্তান সরকার তাকে ‘তঘমা-ই-ইমতিয়াজ’, ‘হিলাল-এ-ইমতিয়াজ’ এবং ‘নিশান-এ-ইমতিয়াজ’, ভারত সরকার ‘সায়গল অ্যাওয়ার্ড ইন জলান্ধর’, নেপাল সরকার ‘গোর্খা দক্ষিণা বাহু’ উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের সর্বাধিক পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত গজল শিল্পী |
আজ এই গুণী শিল্পীর জন্মদিন। শুভ জন্মদিন গজল সম্রাট মেহেদী হাসান।
লেখা শেষ করবো আরেক কিংবদন্তি মোহাম্মদ রফির এক মন্তব্য দিয়ে। মেহেদী হাসান সম্পর্কে রফি বলেছিলেন, ‘জনগণের জন্য আমরা গান করি। আর আমাদের জন্য গান করেন মেহেদী হাসান’।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত