Irabotee.com,irabotee,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

‘মি টু’ নিয়ে আমার দু চার কথা

Reading Time: 9 minutes


১৫ অক্টোবর ২০১৭ রাত থেকে হ্যাশট্যাগ মি টু ক্যাম্পেন উত্তর আমেরিকার বুকে আছড়ে পড়ল। না এটা কোন হারিকেন বা নিম্নচাপঝড় নয়। তবে হ্যাঁ ভূমিকম্প বলা যেতে পারে। এখন দেখার, কতদিন স্থায়ী হয় এই কাঁপুনি।
যৌন হয়রানির শিকার বা ভিক্টিমদের অন্তরাল থেকে বের হয়ে এসে আত্মস্বীকারোক্তি। মূলত কর্মরতা মেয়েদের নীরবতাভঙ্গ।

মেয়েরা নীরবতা ভেঙে দিয়ে বলছেন, আমিও! আমারো ঘটেছে যৌন হেনস্থা।
লুকিয়ে রাখা একটি বিষয়। চূড়ান্ত গোপনীয় , লজ্জাকর বিষয় বলে বিচার্য। যেমন, যা থেকে সূত্রপাত এই স্বীকারোক্তির , সেই ঘটনাগুলো। বিভিন্ন অভিনেত্রীর সঙ্গে হলিউডের প্রযোজক হার্ভে ওয়াইনস্টাইনের গত ত্রিশ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে করে চলা নির্লজ্জ যৌন আগ্রাসন। সগর্বে, প্রকাশ্যে, যা তিনি করেছেন যে কোন উঠতি বা প্রতিষ্ঠা আকাঙ্ক্ষী মহিলার সঙ্গেই। ডেকে নেওয়া তাদের নিজস্ব হোটেলের ঘরে। কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিদান হিসেবে তাদের শয্যাসংগিনী হতে বলা। অবাঞ্ছিতভাবে স্পর্শ করা। ইত্যাদি ইত্যাদি।

মি টু , হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেন। ষোলই অক্টোবর সকালে ঘুম থেকে উঠে, নিজের টুইটার বা ফেসবুক খুলে, অনেকেই চেনা অচেনা মহিলাদের আত্মঘোষণা, মি টু! দেখে ভাবছেন, কী হল ব্যাপারটা? সেই থেকে হুলুস্থুল পড়ে গেছে । না শুধু মার্কিন মুলুকে নয়। গোটা পৃথিবীর সমস্ত নেট-স্বাবলম্বী মহিলা ( সেটা গোটা দুনিয়ার মেয়েদের কত শতাংশ , জানা নেই) , ভাইরাল পথে নেমে এসেছেন। প্রায়। বলেছেন, আমিও যৌন হেনস্থার শিকার। আমিও অন্য, হেনস্থা হওয়া মেয়েদের পাশে।

কী ঘটল ভারতে? অল্পবিস্তর গুনগুন কিন্তু কোন সেরকম অভিঘাত কি দেখা গেছিল প্রথম দিকে? ২০১৮ সালে এক বিশাল বিস্ফোরণের মত ফেটে পড়ল এ আন্দোলন আমাদের মানস পটে। এক মান্যবর মন্ত্রীমশাই যিনি এক বিখ্যাত সাংবাদিক এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে অসামান্য কন্ঠস্বর ও। এম জে আকবর। পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন এক গুচ্ছ মহিলার মুখ খোলায়। শুরু প্রিয়া রামানিকে দিয়ে। সাংবাদিকতার অন্যতম মুখ আকবর সাহেবের এই “অপ্রত্যাশিত ও বেমানান আচরণ” এর কথা অনেকেই জানলেও, মুখ এই প্রথম খোলা হল। রামানির পর একে একে এগিয়ে এলেন অনেক মেয়ে। সকলেই এশিয়ান এজের মালিক ও সম্পাদক আকবরের অভব্য অসভ্য আচরণের শিকার। খবরে প্রকাশ পেল আকবর নিজের সম্মান রক্ষার্থে মানহানির মামলা করেছেন ও বলেছেন এ সবই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ৯৭ জন উকিল লাগিয়েছেন রামানির বিরুদ্ধে।

আমাদের দেশে কিন্তু কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের যৌন হয়রানির গল্পটা নতুন নয়। ঘটনাগুলো অবমাননাকর। নিজেকে পণ্যায়িত হতে দেখার অভিজ্ঞতা। প্রায় মেয়েদের ই যে অভিজ্ঞতা আছে। যেসব ঘটনার সময়ে, সে দেখেছে, শুধু শরীরে পর্যবসিত ? তার গোটা মানুষের পরিচয় নেই। আছে শুধু খন্ড পরিচয়। শুধু অপরের লালসার , অপরের কামনা চরিতার্থ করার বিষয় , এক খন্ড মাংস শুধু?

হার্ভে ওয়াইনস্টাইনের স্ক্যান্ডাল সামনে আসার পর থেকে, এই ক্যাম্পেনে, নামজাদা একের পর এক মার্কিন অভিনেত্রীরা অন্তরাল থেকে বেরিয়ে এসে বলতে শুরু করলেন। এমন নয় যে অভিনয় বা চলচ্চিত্র জগতে এ ধরণের স্ক্যান্ডাল অপ্রতুল। কাস্টিং কাউচ নামের একটা জিনিশ আমরা বহুদিন জেনে এসেছি। শুধু চলচ্চিত্র কেন, নানা ক্ষেত্রে, খেলাধুলোর সাহিত্যের নাটকের গানের জগতেও এমন কত না কাহিনি বাতাসে ভাসে। মেয়েদের ব্যবহার করার জন্য তাকে কাজের বা সাফল্যের টোপ দেওয়া, পরবর্তীতে পুরুষ ক্ষমতাবানের হাত ধুয়ে ফেলা ও মেয়েটিকে চিরতরে চুপ করিয়ে দেওয়া। সাধারণ জনতার ভুলে যাওয়া, নির্বিবাদে। অথবা সহজেই বলে দেওয়া, অমুক মেয়ের সাফল্যের চাবিকাঠিই ত অমুক তমুক ক্ষমতাবান পুরুষদের খুশি করা।
এবারে, কিছু ব্যত্যয় ঘটল। টুইটারে প্রথম এই ক্যাম্পেন শুরু করলেন, শ্বেতাঙ্গিনী মার্কিন অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো। বললেন, তাঁর এক বন্ধুর কথা ধার করে। “If all the women who have been sexually assaulted wrote ‘Me too.’ as a status, we might give people a sense of the magnitude of the problem.”
মিলানো আরো বললেন, “If you’ve been sexually harassed or assaulted write ‘me too’ as a reply to this tweet.”
এই বিপদ, এই অন্যায়, লালসার এই থাবা কতটা বিস্তৃত, তা বোঝাতেই , এই ক্যাম্পেন। কত জন ভিক্টিম আসলে গোপনে রাখেন নিজেদের গল্প, সমস্যার কথা, তা জানান দিতেই শয়ে শয়ে মানবীর ঝাঁপিয়ে পড়া এই ভাইরাল ক্যাম্পেনে।

শুধু একমাত্রিক নয় এই অভিজ্ঞতা। জীবন ত নানা অভিজ্ঞতার সমষ্টি। ভাল ও খারাপ। তার ভেতরে বেছে বেছে , একটি মানুষ, যখন সে ঘটনাচক্রে এক মেয়েমানুষও, নানা দৃশ্য শ্রাব্য স্পর্শযোগ্য উপাদানের ভেতরে, জমা হয়ে উঠতে দেখে না কি, কোন কোন চূড়ান্ত অবমাননাকর কিছু অভিজ্ঞতাকেও? একটি মেয়ে সন্তান তার ছোট থেকে বড় হবার পুরো পথটা এধরণের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আসতে থাকে, প্রায়শই।
শুধু মিথ্যার খোলশ থাকে বাইরে। থাকে ঢাকা চাপার আবরণ। বলা হয়, আসলে কিছু ঘটেনা। আমাদের মেয়েরা সব ভাল। আমাদের পরিবারে সব মেয়েরা সংরক্ষিত প্রাণী। আমাদের ছেলেরাও অপাপবিদ্ধ। যৌন হেনস্থা? সেটা আবার কী? খায় না মাথায় মাখে? এসব কিছুই নেই। হয়না।

যৌন হেনস্থা কাকে বলে তার তালিকাটি দীর্ঘ। এ কেস বহুরূপে সম্মুখে তোমার। আইনে অনেক লেখা। কিন্তু কোন মেয়ে যখন যৌন হেনস্থা হচ্ছেন, তাঁর মন তো সুনিপুণ ভাবে পড়ে নিচ্ছে, সেই অবমাননা। তাঁর মগজ (আজ্ঞে হ্যাঁ মাথার বাইরের দিকটা বাদ দিলে মেয়েদের মাথার ভেতরদিকও আছে সেখানে মগজ বলে একটি বস্তুও থাকে, অন্যান্য অ-মেয়েমানুষের মতই) রেজিস্টার করছে, ওদিকের অন্য ব্যক্তিটি আমাকে বস্তুর মত, পণ্যের মত দেখল, চোখ দিয়ে চাটল, কাছে এসে আপত্তিকর ভাবে ছুঁল, আমি নিজেকে চিনতে পারলাম তার ভোগ্য হিসেবে, চিনতে পারলাম নিজেকে মেয়েশরীর বলে , শরীরমাত্র বলে। আমার মন আমার যুক্তি, ইচ্ছা বিবেচনা, চাওয়া , সব অস্বীকার করে যেইমাত্র আমাকে নিছক শরীর বানিয়ে দেওয়া হল, এবং ব্যবহার করার, বা অপব্যবহার করার চেষ্টা করা হল আমার অনুমতি না নিয়ে, সেই মাত্র আমি যৌন হেনস্থা হলাম।

১৯৯৭, ১৩ আগস্ট। রাজস্থানে বার বার উচ্চ বর্ণের যৌন উৎপীড়নের শিকার তথাকথিত নিম্নবর্গের ভাওরি দেবীর পক্ষ নিয়ে বিশাখা ও অন্যান্য মহিলা সংগঠনরা সোচ্চার হয়েছিলেন। কাজের জায়গায় পুরুষের হাতে মেয়েদের যৌন হয়রানি বন্ধ করতে তাঁদের দাখিল করা রিট পিটিশনের প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিমকোর্ট বিশাখা জাজমেন্ট আনলেন আজ। এটা নারীর কর্মক্ষেত্রে যৌন উৎপীড়ন প্রতিরোধ বিষয়ক নির্দেশাবলী মাত্র। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারি, প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে, সংগঠিত বা অসংগঠিত, সর্বত্র এই নির্দেশাবলী বলবৎ হল। আইন বানাবার দায়িত্ব পার্লামেন্টের অতঃপত। আপাতত এই নির্দেশাবলীর বলে ম্যানেজমেন্টকে এ বিষয়ে একটা “কমপ্লেন্ট কমিটি” বা অভিযোগ সমিতি গঠন করতেই হবে। কমপ্লেন্ট কমিটিতে মহিলা মেম্বার থাকা বাধ্যতামূলক, সম্ভব হলে কোন উচ্চপদস্থ মহিলা অফিসারকে এর চেয়ারপার্সন করতে হবে। অফিসে কোন মহিলা কর্মচারী যৌন উৎপীড়নের শিকার হলে, অবাঞ্ছিত লাঞ্ছনার শিকার হলে, এই সমিতির কাছে তাঁর অভিযোগ জানাবেন। সমিতির এনকোয়ারি রিপোর্টকে গুরুত্বসহ বিচার করতে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বাধ্য থাকবে।

এসবের পরেও, সরকারি ক্ষেত্রে কিছু বাধানিষেধের , ফর্ম আর রিটার্নের কড়াকড়ি ঘটলেও, প্রায় কোন প্রভাবই নেই এই গাইডলাইনের ( পরবর্তীতে যা আইন হল ৯ ডিসেম্বর ২০১৩ তে। The Sexual Harassment of Women at Workplace (Prevention, Prohibition & Redressal) Act, 2013 (“Act”) .

তার অধীনে নিয়ম কানুন ও তৈরি হল, Sexual Harassment of Women at Workplace (Prevention, Prohibition & Redressal) Rules, 2013 (“Rules”) । এর বলে প্রতি অফিসে একটি অ্যান্টি সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট পলিসি থাকার প্রয়োজন। একটি কমিটি থাকতেই হবে। যে কোন সংগঠিত ক্ষেত্র তা সে সরকারি হোক বা বে সরকারি।

এত সবের পরেও , কিছু পরিবর্তন ঘটেছে কি? ৩০ বছর প্রায় আগে, পাঞ্জাবের আই এ এস অফিসার রুপান দেওল বাজাজ এক পার্টিতে তাঁকে অবাঞ্ছিতভাবে স্পর্শ করা পাঞ্জাবকেশরী পুলিশ কমিশনার খালিস্তানিদের ঘুম ছোটানো বীর সিং হ কে পি এস গিলকে দোষী সাব্যস্ত করে সংবাদ শিরোনামে এসেছিলেন। তেমনই, অনেক সাংবাদিক মহিলা তাঁদের উর্ধতন পুরুষ সাংবাদিকদের অবাঞ্ছিত যৌন রঙে রাঙানো মন্তব্য এবং অসভ্য আচরণের বিরুদ্ধে এইচ আরকে জানিয়েও ফল না পেয়ে চাকরি ছেড়েছিলেন… যেমন লিখেছেন সাংবাদিক রাজশ্রী দাশগুপ্ত, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের তৎকালীন সম্পাদকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা।


আমরা আমাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে গত কয়েকদিনে কী দেখলাম? অজস্র অসংখ্য নারী, দক্ষিণ এশিয়ার এই ভারত ভূখন্ডের নারী, লিখলেন নিজেদের শৈশব কৈশোরের অভিজ্ঞতা। লিখলেন, কীভাবে বড় হয়ে ওঠার পথে, পাঁচ বা সাত বা দশ বছর বয়সে অচেনা বা চেনা পুরুষের নোংরা হাত তাঁকে ছুয়েছিল। কীভাবে বাসে ট্রামে বা অন্যত্র নিছক এক শরীর , শরীর বলে অজস্র কুৎসিত চাউনি, বিশ্রি সব স্পর্শ তাকে নিতে হয়েছে। হয়ত বা তারো চেয়ে বেশি ভয়াবহ নিগ্রহ, যন্ত্রণা, অপমান বুজে সইতে হয়েছে। প্রতিবাদ করেও ফল হয়নি হয়ত। হয়ত প্রতিবাদ করে, এমনকি নিগ্রহকারীকে শারীরিকভাবে প্রতিহত করতে চেয়েও শেষ মেশ সেসব ধামাচাপা পড়ে গিয়েছে। আজ এই চীৎকৃত প্রতিবাদের রূপে যা বেরিয়ে এসেছে। আসছে।
ভারতীয় তথা বাঙালি আমার , আশেপাশে গত পঞ্চাশ বছরে কি বদল ঘটেছে কিছুর? আজ অন্যদের কথা থেকে জানছি, ওদেরো আমার মতই অভিজ্ঞতা। আমিও , ওদের মতই , পৃথিবীকে নোংরা ভাবতে শিখেছি, বাসে ট্রামে ট্রেনেই, ভিড়ের ভেতর অযাচিত কোন শরীরের নোংরা স্পর্শে। এ দিক থেকে আমরা সবাই এক।
হ্যাঁ, যখন দশ বা বারো বছর বয়সে প্রথম একটা অসাধারণ নৃত্যানুষ্ঠান দেখে, কোন অতি উচ্চমানের প্রেক্ষাগৃহের পেছনদিকের একাচোরা লেডিজ টয়লেটে একলা চলে গেছিলাম, আর পাশের অন্ধকার গলি থেকে একটা পুরুষ নামক প্রাণী হঠাত বেরিয়ে এসে ছুঁয়ে দিয়েছিল আমার বুক, বা জড়িয়ে ধরেছিল আমায় অকস্মাৎ, আমি হতভম্ব, প্রস্তরবৎ স্থাণু, ন যযৌ ন তস্থৌ… লোকটা চলে যাবার পর হু হু করে ধেয়ে এসেছিল ভয় ঘেন্না লজ্জা, ছুট্টে বেরিয়ে এসে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু কী এক অজানিতের আশঙ্কা কন্ঠরোধ করেছিল আমার। কিচ্ছু বলিনি মাকে। মা যদি ভাবে আমি এত অদ্ভুত কেন, আমি এত ক্যাবলা কেন। আসলে আমারই বোধ হয় কোন খুঁত, আমিই বোধ হয় সম্পূর্ণ আলাদা সবার থেকে, একা ও অকেজো, উদ্ভট। তাই আমার সঙ্গে এসব ঘটে।
আসলে যখন মেয়েটি ছোট, মেয়েটি যখন জানে না তার সঙ্গে এটা কী ঘটছে। কারণ তার কোন শরীর বোধ তখনো জাগেনি। নিজেকে সে নারী শরীর বলে চেনেইনা।
একটা নোংরা স্পর্শ , অচেনা ও অপ্রত্যাশিত, ছোট মেয়েকে হতবাক করে দেয়। আর এটারই সুযোগ নেয় ওই লোকটা। যেভাবে, প্রফেশনাল হতে আসা মেয়েকে হঠাত টেনে বাথরুমে নিয়ে বাথটাবে ফেলে দেওয়া, তাকে এতটাই অবাক ও বিস্রস্ত করে দিতে পারে যে সে কোনমতে পালিয়ে এসেও এ জঘন্য অভিজ্ঞতাটি বলতেই পারেনা।
এই সব নোংরা স্পর্শের অনেকটা ভাগ আমি পেয়েছি। অন্য অনেকের মতই।
পাঁচবছর বয়সে কোন কাজের লোক বা বয়সে অনেক বড় তুতো দাদা “একটা মজার খেলা খেলবি, আয় আয়!” বলেছে, বা কোন পিতৃস্থানীয় বা পিতামহস্থানীয় কোলে বসিয়ে নিতে চেয়েছিল। সাত বছর বয়সে, রাস্তার ভিখিরি পয়সা চাওয়ার অছিলায় ছুঁয়ে গেছিল। দশ বছরে প্রেক্ষাগৃহের পেছনের গলির অচেনা লোকের জড়িয়ে ধরা, বারো বছরে পুজোর ছুটির ট্রেনে বাংকে হঠাৎ ধেয়ে আসা পাশের সিটের কাকুর হাত… এইসবই অন্য অনেকের মত আমার জীবনের এক একটা জ্বলজ্বলে মাইলস্টোন।
পাড়ার মাস্তানদের “বালাম পিচকারি হায় তু নে মুঝে মারি” গেয়ে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি তো অনেক পরের মাইলস্টোন, যখন স্কুল পেরিয়ে কলেজের দিকে যাত্রা।
এইসব মাইলস্টোন দিয়ে দিয়ে এ পোড়া বাংলার, এ পোড়া ভারতের , এ জ্বলা দক্ষিণ এশিয়ার, এ তপ্ত পৃথিবীর কোন মেয়ের নিজেকে মেয়ে হিসেবে চিনতে শেখা, আর নীরবতার অন্তরালে সে সব ঢাকতে শেখা, কারণ কেউ বলে দেয়নি ( আজকের শিশুকে যা শেখানোর তোড়জোড় খুব) কোনটা গুড টাচ কোনটা ব্যাড টাচ, বলে দেয়নি এমন হলেই বলতে হয় বাবা মাকে, চিনিয়ে দিতে হয় নোংরা হাতের মালিককে… কেউ বলেনি, আমি তোমার পাশে আছি, বলেনি, এটা সবার সঙ্গেই হতে পারে, তুমি একা নও, তুমি আলাদা কিছু নও। কুঁকড়ে, গুটিয়ে নিজেকে ঢেকে ফেলতে চেয়েছে শিশু-কিশোরী-বালিকাটি… আর ক্রমশ বড় হয়ে উঠেছে নিজের শরীরকে ঘৃণা করতে করতে… নিজেকে ঘৃণা করতে করতে। নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে ভাবতে।
আজ মি টু ক্যাম্পেন এসে সবার মুখে একটা ভাষা দিচ্ছে। এ ক্যাম্পেনকে ফেলে দিই কীভাবে।

আশ্চর্য ভাবে অনেক পুরুষও এ হ্যাশ ট্যাগ শেয়ার করেছেন। আসলে এ সমস্যা অনেক বিস্তৃত, সেটা বুঝতে ও দেখতে সক্ষম হয়েছেন অনেকেই। ছোটবেলায় অনেক পুরুষ শিশুও বয়সে বড় পুরুষ বা নারীর যৌন লালসার শিকার হয়। পিডোফিলিয়া নামক যৌন অপরাধ সারা পৃথিবীতে আছে। আসলে প্রশ্ন টা , ধর্ষণের ক্ষেত্রেও যেমন, এ ক্ষেত্রেও, মূলত যৌন পরিচয়ের না, বরং ক্ষমতার। যে বেশি শক্তিমান, ক্ষমতাবান, সেই অন্যের ওপর উৎপীড়ন করে, যৌন উৎপীড়ন তার বাইরে নয়। আর এই কারণেই ছোট ছেলেমেয়েদের, কিশোর বা কিশোরীদের ওপর চড়াও হবার প্রবণতা বয়স, সামাজিক অবস্থান, উচ্চতার নানা ধরণের ক্ষমতাবান ব্যক্তির।
তবে এই ক্যাম্পেনের অন্য কিছু দিক আছে। এক, এ ক্যাম্পেন দশ বছর আগেই শুরু করেছিলেন কালো চামড়ার অভিনেত্রী টারানা বুর্কে। তখন তা নিয়ে হৈ চৈ হয়নি একেবারেই।
দুই, অনেক মেয়েই প্রশ্ন তুলেছেন, এই ভার্চুয়াল প্রতিবাদে কাজ হবে কতটুকু। দায়সারা মি টু! লিখছেন অনেকেই , যাঁরা, বাস্তব জীবনে হেনস্থা হওয়া মেয়েদের পাশে দাঁড়ান না, এমনকি, নিজেরাও কোন কোন ক্ষেত্রে হেনস্থাকারী পুরুষকেই সমর্থন জানিয়েছেন।
তিন, যে পুরুষ আক্রামক, তাকে চিহ্নিত করার তো কোন চেষ্টা নেই এ ক্যাম্পেনে। নিজেকে ভিক্টিম বললেই সবটা বলা হয়না, কে আক্রামক, ধর্ষক, হেনস্থাকারী, তাকে টেনে বের করে এনে সবার সামনে নিরাবরণ করার দায়টাও থেকেই যায়। নইলে মেয়েরা নিজেদের ঠেলে দেবেন সেই পুরনো ভিক্টিম হুডের গর্তেই।
চার,গোটা ব্যাপারটাই কিন্তু ঘটছে নেটে। অর্থাৎ ভার্চুয়াল জগতে। সত্যি সত্যি পথে নামে নি কেউ। শুধু নিজের কথা খুলে লিখছে। এই প্রথম। আপত্তি, অস্বীকার, ডিনায়াল, মুখ ফেরান, নীরবতা, কুঁকড়ে ঘরে বসে থাকা… এসবের থেকে উল্টোদিকে ঘুরে গিয়ে, যেন এই প্রথম ভাষা পেয়েছে এত এত মেয়ের, মহিলার, তরুণীর, প্রৌঢ়ার , যুবতীর ক্ষতবিক্ষত হৃদয়। নিজেকে প্রকাশ করতে চেয়েছে, হ্যাশট্যাগ মি টুতে। আমাকে কখনো না কখনো, বা একাধিকবার , যৌনলালসার শিকার হতে হয়েছে। এটুকু জানান দিতে পেরে, মনে হয়েছে, বেঁচে গেলাম এতদিনের নীরবতার অত্যাচার থেকে।
সবটাই এই ভার্চুয়াল বিশ্বের এক হাস্যকর খেলাধুলো কী? এসব প্রতিবাদের কোন ফল কি আদৌ হয়? কারণ যে মুহূর্তে এ ক্যাম্পেন ঘটছে সে মুহূর্তেই কাগজে বেরিয়ে চলেছে ভারতের বুকে ধারাবাহিক যৌন হেনস্থার কাহিনি, যে বিষয়ে আর কারুর কোন হেলদোল নেই। সেদিনই নদিয়ার চাকদহে অ্যাসিড খেয়ে এক স্কুল ছাত্রী আত্মঘাতী হয়েছে বলে খবরে পড়লাম, তাকে পরিত্যক্ত বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল একটি যুবক এবং একাধিক যুবক সেখানে মেয়েটিকে যৌন হেনস্থা করে।
এই সব ঘটনা আর কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কিন্তু আত্মহত্যার দিকে না গিয়ে, সমাজের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানো, হেনস্থাকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে আমাদের। আমরা , গ্লোবাল থেকে লোকাল , বিশ্বগ্রাম থেকে পাশের গ্রাম অব্দি , ছড়িয়ে থাকা সেই কামুক, পিচ্ছিল দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে যারা আগেও ছিলাম এখনো আছি, অনুভব করছি প্রতিমুহূর্তে, লড়াই জারি।
তবে মি টু ক্যাম্পেন কেবল আন্দোলনকারী, নারীবাদী এসব তকমার বাইরেও টেনে নিল মেয়েদের, এমনকি সব মানুষের, নিজস্ব প্রতিবাদকে। নিজের শরীরের ওপর নিজের অধিকার রক্ষার কথাগুলোকে। এর একটা মূল্য তো আছেই। হোক না প্রতীকী মূল্য।

মূল্যটা যে আদৌ প্রতীকী নয় তা বিভিন্ন মহলের নীরবতা থেকেই মালুম। হয় নীরবতা, নয়ত তীব্র প্রতি আক্রমণ। প্রতি আক্রমণ বলতে, বার বার এই যে প্রশ্নটা তোলা হচ্ছে, যে, মেয়েদের এই আন্দোলন আসলে শখের আন্দোলন। কেননা সে আন্দোলন, মৌখিক, গা না লাগানো, কেবলই কেতাবি কিছু বকবক। তা কেবলই সীমাবদ্ধ থাকছে উচ্চবিত্তীয় মেয়েদের মধ্যে, সেসব মেয়েদের মধ্যেই যারা ইংরেজি শিক্ষিত, নেটে সক্ষম, যারা ‘অ্যাফোর্ড’ করতে পারেন ফেসবুকে গলা ফাটানো।

এবং এতে কিচ্ছু এসে যায়না সেইসব মেয়েদের যারা গরিব , যারা বছরের ৩৬৫ দিন ট্রেনে বাসে অটোতে ভিড়ে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে, রোদে পুড়ে ঘামে ভিজে কাজের জায়গায় যায় অথবা নিজের ছোট চালাঘরে চায়ের দোকান চালায়, যারা ঘরে ঘরে বাসন মাজে ও বাবুদের লালসার শিকার হয়। এই সমস্ত মেয়েদের কোন কন্ঠস্বর নেই, তারাই আসলে সমাজে পুরুষতন্ত্রের শিকার। কেননা ঘরে বাপ ভাই বা স্বামীর তাড়না খেয়ে আবার মেয়েজন্মের যাবতীয় দুঃখ বরণ করেও তারা বাইরে যায়, এবং কাজের জায়গায় পুনরায় তাড়িত হয় ম্যানেজার বস বা ঠিকেদারের হাতে। যৌন তাড়নার মুখে এই গরিব ও ক্ষমতাহীন মেয়েদের কোন প্রতিবাদই টেঁকে না, কেননা টুঁ শব্দ করলেই তাদের চাকরি চলে যাবে।

এই যুক্তি ছিদ্রযুক্ত, এই যুক্তি খোঁড়া যুক্তি। এই যুক্তি কুযুক্তি। কেন? কেননা পৃথিবীর একটিও দুরাচার অন্যায় বা দুঃশাসন নেই, যেখানে কিছু মানুষ বলি হয়েছেন কিন্তু চুপ থেকেছেন। কেউ কেউ সহ্য করেছেন, মুখ বুজে সরে গেছেন, ভয়ে কন্ঠ রোধ করা হয়েছে তাঁদের। সেই কারণেই, বাকিদের ও কন্ঠ রুদ্ধ রাখতে হবে? এ কেমন যুক্তি?

যে কোন অন্যায় সে দরিদ্রের সঙ্গে ঘটুক বা বড়লোকের সঙ্গে, উচু জাতের সঙ্গে ঘটুক বা নিচু জাতের সঙ্গে, তা অন্যায়ই থেকে যায়। আর তার প্রতিবাদ করার সাহস, সাহসই থাকে। সাহসের কোন জাত হয়না ধর্ম হয়না অর্থনৈতিক অবস্থান হয়না। বিশেষ করে আমাদের এই দেশে যেখানে যুগ যুগান্ত সঞ্চিত বিশ্বাস ও পারসেপশন, বা দৃষ্টিভঙ্গি, মেয়েদের সচরাচর চুপ থাকতে বলে। কালি মাখায় মেয়েদের মুখে, যদি সে কখনো মুখ খোলে। এই সমাজে, যেখানে পুরুষের অত্যাচারের সবচেয়ে বড় অস্ত্রই হল এটা, যে, ছোটবেলা থেকে মেয়েদের শেখান হয় , লজ্জা নারীর ভূষণ। এবং সচরাচর সে নীরব থাকে, সে মুখ লুকায় , তাই পুরুষের আত্মবিশ্বাস টোল খায়না, সে নিরাপদে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে। কেননা সে ও ত জানে, এই সত্যটা, যে অত্যাচারিত মেয়েটি সচরাচর নিজের চরিত্রের নিষ্কলুষতাকে রক্ষা করতেই , বা সমাজের চোখে নিষ্পাপ থাকতেই চুপ থাকবে, লজ্জায় কারুকে কিছু বলতে পারবে না। বললেই তাকেই নষ্ট মেয়ে বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে।

এই গোটা খেলাটা উল্টে দিতে বুকের পাটা লাগে। ধক লাগে। বড় ঘরের শিক্ষিত মেয়েরা মুখ খুলেছেন যাঁদের বিরুদ্ধে তাঁরা সমাজের সবচেয়ে বড় মাথা। কেউ বা মন্ত্রী আমলা বা অতি উচ্চ পদে আসীন কর্মী, সংবাদপত্রের মুখ্য , বা অধ্যাপক। এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মুখ খোলার দায় ও দায়িত্ব নিয়েই ত তাঁরা মুখ খুলেছেন, এর পেছনে ত অনেক নির্ঘুম রাত ও অনেক ঝুঁকি থেকেই যায় কর্মক্ষেত্রে আলাদা হয়ে যাওয়ার, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার, সমাজে একঘরে হয়ে যাওয়ার। উঁচু তলার মেয়েরা আজ যদি মুখ খুলে থাকেন, তার ধাক্কা নিচের দিকেও নামবে, আর এই নিদর্শন বা উদাহরণ গুলো খুব বড় জোর হয়ে দাঁড়াবে অন্যদের জন্য। একজনের দেখাদেখি অন্যজনের মধ্যে আসবে সাহস ও উদ্দীপনা। বেঁধে বেঁধে থাকলে , জোট বাঁধলে তবেই সম্ভব হবে এই যুগ যুগ ধরে চলা বিশাল পাথরের মত ভারি নীরবতাটাকে ভাঙা, টুকরো করা।

এক মুটে বা মজুর মেয়ে যখন ম্যানেজারের হাত থেকে টাকা নিতে গিয়ে লাঞ্ছিত হয় তার লড়াইকে কোনমতে অসম্মান বা খাটো করার নেই । কিন্তু তার নীরবতা দিয়ে বাকি আর সমস্ত স্তরের সমস্ত মেয়েদের লড়াইকে খাটো করার, বা সব মেয়েদের নীরব হতে বলার যুক্তিও যে ভীষণ ছেঁদো, এক রকমের অপমান ছাড়া আর কিছুই নয়!

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>