| 19 এপ্রিল 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

ইরাবতী গদ্য: উত্তরপাড়ায়  শ্রীমধুসূদন  । দিলীপ মজুমদার

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

  উত্তরপাড়ায় থাকেন শশাঙ্ক অধিকারী। ভালো চাকরি করতেন। এখন অবসর নিয়েছেন। কবি ও কবিতার কাছে নিবেদিতপ্রাণ তিনি। ‘উত্তরণ’ আর ‘কবিতার ভুবন’ নামে দুটি উচ্চমানের পত্রিকা প্রকাশ করেন। বিজ্ঞাপন ছাড়া লিটল ম্যাগাজিন চলে না।  অথচ শশাঙ্কবাবুর পত্রিকায় থাকত না কোন বিজ্ঞাপন। নিজের উপার্জনের একটা মোটা অংশ ব্যয় করতেন তিনি পত্রিকার জন্য। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর ব্যাপার আর কি!

আরও একটা জিনিস করতেন তিনি। প্রতি বছর ২৫ জানুয়ারি তাঁর পত্রিকার পক্ষ থেকে একটা অনুষ্ঠান হত। ২৫ জানুয়ারি কবি মধুসূদন দত্তের জন্মদিন। শশাঙ্কবাবুর অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে থাকত মধুসূদন সম্পর্কে আলোচনা, আর দ্বিতীয় পর্বে কবি সম্মেলন। রবীন্দ্র-নজরুলের জন্মদিবস পালনের রেওয়াজ আমাদের দেশে আছে, মধুসূদনের নয় ; বাংলাদেশের যশোরের সাগরদাঁড়িতে অবশ্য ‘মধুমেলা’ হয়। এ রাজ্যে মধুদিবস পালনের ঘটনা শুনি নি। সে দিক থেকে শশাঙ্ক অধিকারীর অনুষ্ঠান একেবারে ব্যতিক্রমী। এই অনুষ্ঠানের জন্য প্রচারের ঢক্কানিনাদ ছিল না।

বছর চারেক আগে তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এই অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য। রাজি হয়েছিলাম দুটো কারণে।  প্রথমত , উত্তরপাড়ায় আমার বোন আর ভগ্নীপতি থাকে, তাদের সঙ্গে দেখা হবে। দ্বিতীয়ত মধুসূদন সম্পর্কে আমার একটা আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল অধ্যাপক ক্ষেত্র গুপ্তের ভাষণে-সংলাপে।  তাঁর ‘মধুসূদনের কবিআত্মা ও কাব্যশিল্প’ এক অসাধারণ বই। মধুসূদনের ‘ক্ষত্রিয় ভোগবাদের’ কথা বলতেন তিনি। পরে গোলাম মুরশিদের ‘আশার ছলনে ভুলি’ বই পড়ে আরও আকৃষ্ট হই। আমার মনে হয় জীবনকে নিয়ে আর কোন কবি এমন জুয়া খেলেননি। আমার কেমন যেন মনে হয়, ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের রাবণ চরিত্রে মধুসূদনের আত্মজীবনের ছায়া পড়েছে। এক হয়ে গেছে রাবণ ও মধুসূদনের নীরব হাহাকার।

শশাঙ্কবাবুর অনুষ্ঠানে যোগ দেবার জন্য ‘দুর্বার কলম’ সম্পাদক ও কবি অমর নস্করকে নিয়ে গেলাম উত্তরপাড়া। বোনের বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজ শেষ করে  ভগ্নীপতির নেতৃত্বে  পৌরসভার মঞ্চে এলাম আমরা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করলাম। কবিদের কবিতা শুনলাম। নিজেদের কবিতা পাঠ করে কবিরা চম্পট দিচ্ছেন।  এটা কবি সম্মেলনের পরিচিত দৃশ্য। তারপর এক সময় শেষ হল অনুষ্ঠান। তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমেছে।   মনে হল একবার গঙ্গার ধারে জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরির কাছে গেলে কেমন হয়! এই লাইব্রেরির দোতলার ঘরে দুবার এসেছিলেন মধুসূদন, একবার ১৮৬৯ সালে, শেষবার ১৮৭৩ সালে মৃত্যুর আগে।

আমার কথায় সঙ্গীরা সম্মত হলেন। আমরা  গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়ালাম রাজা জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরির সামনে। এই লাইব্রেরি নিজেই একটি ইতিহাস। শুধু ভারতে নয়, সম্ভবত সমগ্র এশিয়া মহাদেশে এটি প্রথম ফ্রি পাবলিক লাইব্রেরি, রাজা জয়কৃষ্ণ মুখার্জীর এক অক্ষয় কীর্তি। ১৮৫২ সাল থেকে শুরু হয়েছিল চেষ্টা। উত্তরপাড়ায় পাবলিক লাইব্রেরি স্থাপনের জন্য জয়কৃষ্ণ বর্ধমানের বিভাগীয় কমিশনারের কাছে পেশ করেন প্রস্তাব; জানিয়ে দেন তিনি নিজে এ জন্য ৫ হাজার টাকা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু বিভাগীয় কমিশনার সে প্রস্তাব মঞ্জুর করলেন না। হতাশ হলেন জয়কৃষ্ণ। কিন্তু দমে গেলেন না। সম্পূর্ণ নিজের ব্যয়ে গঙ্গার তীরে এক একর জমির উপর  লাইব্রেরি ভবন তৈরির কাজ শুরু করে দিলেন জয়কৃষ্ণ। ব্যয় হল ৮৫ হাজার টাকা। ১৮৫৬ সালে উদ্বোধন হল লাইব্রেরির। জয়কৃষ্ণের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে ৩ হাজার বই দেওয়া হল লাইব্রেরির জন্য, সেই সঙ্গে কিছু পত্র-পত্রিকা। লাইব্রেরিতে প্রথমে ছিলেন ৭ জন কর্মী। একজন লাইব্রেরিয়ান, একজন সহকারী লাইব্রেরিয়ান, একজন কেরানি, দু’জন মালি, একজন ঝাড়ুদার, একজন দারোয়ান। এঁদের বেতনও জোগাতেন জয়কৃষ্ণ।

মেরি কার্পেন্টার যখন লাইব্রেরিতে আসেন তখন বইএর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ৩ থেকে ১২ হাজার হয়েছে, যুক্ত হয়েছে অনেক দুষ্প্রাপ্য পত্র-পত্রিকা। মেরি কার্পেন্টার তাঁর ‘Six months in India’ বইতে এই লাইব্রেরির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়েছেন। বলেছেন  প্রথম তলায় ছিল লাইব্রেরি, দ্বিতলে ছিল অতিথিদের থাকার ঘর এবং আলোচনার জন্য হলঘর।

মেরি কার্পেন্টারকে এখানে এনেছিলেন বিদ্যাসাগর। ১৮৬৬ সালে। আরও অনেকের পদধূলিতে ধন্য এই লাইব্রেরি। যেমন স্যার উইলিয়াম উইলসন হান্টার, রেভারেণ্ড জেমস লঙ, স্যার এডুইন আর্নল্ড, কেশবচন্দ্র সেন, বিপিনচন্দ্র পাল, সুরেন ব্যনার্জী আর মধুসূদন দত্ত। 

১৮৭৩ সাল ! তার মানে কবির মৃত্যুর সাল !

লাইব্রেরির দোতলার দিকে তাকিয়ে আমি যেন দেখতে পেলাম মধুসূদন আর হেনরিয়েটাকে। একটি ঘরে আছেন তাঁরা দু’জন। মুমূর্ষু দম্পতি। ঘরের মেঝেতে ছটফট করছেন হেনরিয়েটা। মধুসূদনের  স্ত্রী অথচ আইনত স্ত্রী নন। দুর্ভাগা নারী। রেবেকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি যে মধুসূদনের। হেনরিয়েটা ছটফট করছেন প্রবল জ্বরে। একটা আরাম কেদারায় বসে আছেন মধুসূদন। জীর্ণ, বিধ্বস্ত। আর্তনাদ শুনছেন হেনরিয়েটার। কিন্তু কিছু করার নেই। একে একে নিবিছে দেউটি, নীরব রবাব। মধু অসহায়। বিড় বিড় করে কি বলছেন মধু? নিজের লেখা ‘আত্মবিলাপ’। আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়, তাই ভাবি মনে। দিন দিন আয়ুহীন হীনবল দিন দিন তবু এ আশার নেশা ছুটিল না এ কি দায়।

মধুর মনে ভিড় করে আসছে কত ছবি।  হ্যাঁ, রেবেকা আর তার ছেলেরাও আছে সে ছবিতে। তাদের পরিত্যাগ করে মধু লুকিয়ে চলে এসেছেন মাদ্রাজ থেকে কলকাতায়। আজ মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে অনুশোচনায় ভরে যাচ্ছে মন। অনুশোচনা তো আরও আরও কৃতকর্মের জন্য। কলকাতায় মাত্র ৬ বছরের মধ্যে কবি হিসেবে যখন একটা জায়গা করে নিয়েছেন, তখন ব্যারিস্টার হবার জন্য কেন চলে গেলেন শ্বেতদ্বীপে! কেন শুনলেন না বন্ধুদের, বিদ্যাসাগরের সতর্কবাণী! পরধর্ম এমন যে ভয়াবহ হবে, তা তিনি ভাবতে পারেননি।

এমন সময়ে বন্ধু গৌরদাস বসাক ঢুকলেন ঘরে।  হাওড়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বদলি হয়ে এসেছেন তিনি, মধু এখানে আছেন শুনে ছুটে এসেছেন। বন্ধু আর বন্ধুপত্নীর অবস্থা দেখে হতবাক তিনি।  গৌরকে দেখে মধু সংবরণ করতে পারলেন না  অশ্রু। কাঁদছেন মধু? বীর্যশুল্কে বিশ্বকে জয় করার বাসনা যার! ভেঙেচুরে যাচ্ছে গৌরদাসের হৃদয়। হেনরিয়েটার দিকে তাকাতে তিনি অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘আমাকে নয় , আপনার বন্ধুকে দেখুন।’ বন্ধুকে গৌর বললেন যে তাঁকে হাসপাতালে যেতে হবে।  জবাবে মধু জানান ব্যবস্থা হয়েছে। ২১ জুন বজরায় কলকাতা যাবেন তাঁরা।

গেলেন কলকাতা। কিন্তু হেনরিয়েটার সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে পারলেন না। হেনরিয়েটাকে নিয়ে গেলেন তাঁর জামাই, অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান পাড়ায়—১১নম্বর লিণ্ডসে স্ট্রিটে। মধু এলেন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে। ২৬ জুন মৃত্যু হল হেনরিয়েটার। বড় অবহেলায় মধু মারা গেলেন ২৯ জুন। মৃত্যুর পরেও পড়ে রইল তাঁর মৃতদেহ। শেষকৃত্য কিভাবে হবে তাই নিয়ে কূটতর্ক। পচন ধরতে লাগল মধুকবির মৃতদেহে। কি ফল লভিনু হায় তাই ভাবি মনে।

এ সব ভাবতে ভাবতে ঝাপসা হয়ে এল আমার দৃষ্টি। মনে পড়ল হেনরিয়েটার মৃত্যুসংবাদ শুনে মুমূর্ষু মধুসূদন ব্যারিস্টার মনমোহন ঘোষকে শুনিয়েছিলেন ম্যকবেথের এক সংলাপ। লেডি ম্যাকবেথের মৃত্যুর পরে ম্যাকবেথ বলেছিলেন সে কথা। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল সেই লেখা:

Tomorrow  and  tomorrow  and  tomorrow,

Creeps  in  this petty  pace  from  day  to  day,

To  the  last  syllable  of  recorded  time,

And  all our  yesterdays  have  lighted  fools……………

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত