| 24 এপ্রিল 2024
Categories
শিশুতোষ সাহিত্য

ছোট্ট বুড়ির বাড়ি ফেরা

আনুমানিক পঠনকাল: 8 মিনিট

প্রমার আজ খুব খুশি খুশি লাগছে। দুপুরে মা ঘুম পাড়াতে অনেক চেষ্টা করেছে; গল্প শুনিয়েছে, ছড়া শুনিয়েছে আর গুনগুন করে ঘুম পাড়ানি গান গেয়েছে। অন্যান্য দিন ঘুমিয়ে পড়লেও প্রমা আজ ঘুমায়নি, দুই চোখ বন্ধ করে মটকা মেরে শুয়ে ছিল। আজ দুপুরে সে কিছুতেই ঘুমাবে না। মা আজ তাকে কিছুতেই ঘুম পাড়াতে পারবে না।

কারণ আজ বাবা অনেক দিন পরে বাসায় এসেছে। বাবা চাকরি করে দূরের এক শহরে। পনের দিন কি এক মাস পরে বাসায় আসে, আর আসার সময় প্রমার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসবেই। এবার এনেছে একটা টুকটুকে লাল রঙের পুতুল হাঁস। নাম তার প্যাকপ্যাকি। প্যাকপ্যাকিকে কোলে নিয়েই প্রমা বিছানায় শুয়ে আছে, চোখ বন্ধ করে রেখেছে কিন্তু ঘুমায়নি। মাঝে মাঝে চোখ পিট পিট করে তাকিয়েছে। আবার মা তাকানোর সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করেছে। অপেক্ষা করেছে মা কখন হাল ছেড়ে দেয়।  

বাবা যে কয়দিন বাসায় থাকে সেই কয়দিন প্রমার খুশি আর আনন্দ। মজায় কাটে সারাটা দিন, কত রকমের গল্প আর কত ধরণের খেলা। বিকাল বেলায় বাবা তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়, বেড়াতে বের হয়। কখনো বাসার কাছেই মাঠে অথবা বাবা-মা মিলে দূরে কোথাও, মার্কেটে বা রেস্টুরেন্টে।

মা হাল ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে যেতেই প্রমা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, চোখ খুলে তাকাল। তারপর টুক করে বিছানা থেকে নেমে বাবাকে খুঁজতে শুরু করলো।

সামনের বারান্দায় গিয়ে দেখে নানু তার শখের ফুল গাছের টবে পানি দিচ্ছে। লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি নানান রঙের ফুল ফুটে আছে। বারান্দা থেকে ড্রইংরুমে এসে দেখে নানা টিভি দেখছে।

বাবা কোথায়?

এই ঘর ওই ঘর খুঁজতে খুঁজতে পিছনের বারান্দার এসে দেখে, বাবা মোড়ায় বসে বই পড়ছে। প্রমা দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে, বাবার গালে একটা চুমু খায়। তারপর বাবার একটা আঙ্গুল ধরে টানতে থাকে। বাবা এখন আর বই পড়তে পারবে না, এখন বাবাকে প্রমার কথা শুনতে হবে। বাবা বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ান। জানতে চান, কি আম্মু?

প্রমা আঙ্গুল দিয়ে দরজা দেখিয়ে বলে, মাঠে যাব। বাবা বুঝতে পারেন, এখন প্রমাকে নিয়ে মাঠে যেতে হবে। মাঠে যেতে পারলে প্রমা যে কী খুশি হয়!

প্রমাদের বাসা থেকে খানিকটা দূরে বেশ বড় একটা মাঠ। বিকাল হলেই পুরো মাঠ জুড়ে যেন মেলা বসে; চারদিক থেকে ভেসে আসে চিৎকার, চেঁচামেচি আর হৈ-হল্লা। নানান বয়সের শিশুরা দল বেঁধে খেলতে থাকে। একদল ফুটবল নিয়ে মেতে থাকে, আরেক দল ক্রিকেট। মাঠের এক কোনায় ঘাসের উপর দাগ টেনে একদল খেলে দাঁড়িয়াবান্ধা। সারা মাঠ জুড়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে একদল খেলে গোল্লা ছুট। সে এক এলাহী কাণ্ড!

প্রমার মতো ছোট্টমনিদের খেলার জন্য মাঠের এক কোনায় আলাদা জায়গা আছে। সেখানে আছে মজার মজার সব খেলনা। কী যে মজা সেই সব খেলনায় চড়তে, সেই সব খেলনায় খেলতে! আছে দোল দোল দোলনা; একবার সামনে একবার পিছনে, দোদুল দুল দুলুনি দুলতে থাকো। আছে পিছলে নামার জন্য স্লিপার, সিঁড়ি বেয়ে উঠে সাঁই করে নেমে যাও। আর আছে সি-স’; দুই দিকে দুই জনে বসে একবার উপরে উঠে যাও হাওয়ায় হাওয়ায় আবার নেমে আসো নিচে। 

বাবার আঙ্গুল ধরে প্রমা বাসা থেকে বের হয়। প্রতিবার বের হওয়ার সময় নানুর সেই একই কথা, প্রমা রাস্তা পার হওয়ার সময় সাবধান। গাড়ি চলে, রিক্সা চলে। বাবার হাত ধরে থাকবে।

মা বলেন, প্রমা আম্মু, সব সময় বাবার সাথে সাথে থাকবে। না হলে কিন্তু হারিয়ে যাবে। আর আমার মামনি হারিয়ে গেলে আমি পাগল হয়ে যাব। বলেই টুপ করে প্রমার কপালে একটা চুমু দেন।

তারপরও মাঠের কাছাকাছি এসে প্রমা আর বাবার হাত ধরে থাকতে পারে না। বাবার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মাঠের দিকে দৌড়াতে থাকে। এক দৌড়ে ঢুকে পড়ে মাঠের ভিতরে।

মাঠে ঢুকে খেলনার জায়গায় এসে প্রমা চুপ করে দাঁড়ায়। দেখে ছোট্ট ছোট্ট সোনামনিরা দল বেঁধে স্লিপারে উঠে পিছল খেয়ে নেমে যাচ্ছে। কেউ কেউ দোলনায় দোল খাচ্ছে । আবার অনেকে সি-স’তে উঠছে আর নামছে। প্রমা ঠিক করতে পারে না, কোথা থেকে শুরু করবে।

আহা, এমন যদি হতো সবগুলোতেই একই সাথে খেলা যেত!

বাবা জিজ্ঞাসা করেন, মামনি তুমি কোনটা খেলবে? প্রমা আঙ্গুল দিয়ে স্লিপার দেখিয়ে দেয়। বাবা প্রমাকে স্লিপারের সিঁড়িতে অন্যদের সাথে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেন। একে একে সবাই স্লিপারে পিছলা খেয়ে নেমে পড়ে। প্রমা নামার সময় শেষ প্রান্ত আসার আগেই বাবা তাকে ধরে আস্তে করে নামিয়ে দেন, যেন পড়ে গিয়ে ব্যথা না পায়।

প্রমার মন খারাপ হয়, নিজে নিজে পুরো খেলাটা খেলতে না পেরে। আস্তে করে বাবার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, বাবা আমাকে ধরবা না। আমি একা একা পারি।

বাবা মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলেন, আচ্ছা। তুমি পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলে মা কিন্তু আমাকে অনেক বকবে।

প্রমা পর পর অনেক বার লাইন ধরে স্লিপারে উঠে আর পিছল খেয়ে নামে। বাবা আর প্রমাকে ধরেন না, আবার স্লিপারের কাছ থেকে সরে দূরেও যান না।

স্লিপার খেলা শেষ হলে প্রমা দৌড়ে বাবার কাছে আসে, বাবাকে আঙ্গুল দিয়ে দোলনা দেখায়। এখন সে দোল দোল দুলুনি দোল খাবে। বাবা মাঠের এক পাশে এসে দাঁড়ান। প্রমাকে বলেন, আমি এখানে আছি। তুমি যাও, দোলনার লাইনে দাঁড়াও।

প্রমা গিয়ে দোলনার লাইনে দাঁড়ায়। বাবা একটু দূরে দাঁড়িয়ে প্রমার দিকে নজর রাখেন। আর দেখতে থাকেন মাঠ জুড়ে শিশুদের খেলা, দৌড়াদৌড়ি আর হৈ চৈ, হুলুস্থুল।

প্রমা দোলনায় উঠার পর একজন দোলনাটা একটু পিছনে টেনে নিয়ে ছেড়ে দেয়। মাত্র ছয় দুলুনি তারপর দোলনা ধরে থামিয়ে দেয়। প্রমা দোলনা থেকে নেমে আসে, লাইনে দাঁড়ানো পরের জন দোলনায় উঠে। প্রমার মন ভরে না। আবার দোলনায় দোল খাওয়ার জন্য সবার পিছনে গিয়ে লাইনে দাঁড়ায়। বাবার দিকে তাকিয়ে একটু হাসে। বাবাও মুচকি হেসে মাথা দোলায়। বাবার মাথা দোলানো আর হাসি দেখে প্রমা বুঝতে পারে দোলনায় আরো দোদুল দোল খেলতে পারবে, বাসায় ফিরতে দেরি আছে।

প্রমা খেলতে থাকে। ধীরে ধীরে তার জড়তা কেটে যায়। নিজে নিজেই দৌড়ে একবার স্লিপারে উঠে আর পিছল খেয়ে নামে, দুই হাত জামায় ঘষে ধুলা ঝাড়ে। আবার দোলনায় দোলার জন্য লাইন ধরে দাঁড়ায়। হঠাৎ হঠাৎ মাথা ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকায়। বাবা হাত উঁচিয়ে হাসি দেন, প্রমাও হাসে।

মাঠে খেলতে, দৌড়াতে কী যে আনন্দ, কী যে মজা, কী যে খুশি!

বাচ্চারা দল বেঁধে মাঠে ফুটবল খেলছে। যে যেভাবে পারছে ফুটবলের পিছে দৌড়াচ্ছে। ক্রিকেট খেলার দিক থেকে একটু পর পরই ‘আউট-আউট’ আর ‘ফোর-ফোর, সিক্স-সিক্স’ শব্দ ভেসে আসছে। প্রমার বাবা খুব মজা পান বাচ্চাদের এই সব কান্ড-কারখানা দেখে।

হঠাৎ ফুটবলটা কার ভুল কিক খেয়ে মাঠ ছেড়ে প্রমার বাবার দিকে এগিয়ে আসে। ফুটবলাররা হাত তুলে পা দেখিয়ে ইশারা দেয় বলটা মাঠে ফেরত পাঠানোর জন্য। প্রমার বাবার ছোটবেলায় ফুটবল খেলার কথা মনে পড়ে যায়। এক পা, দুই পা এগিয়ে বলটা থামান। তারপর বলটা মাঠে ফেরত পাঠানোর জন্য কিক করেন; দুর্বল কিক, বল বেশি দূরে যায় না। একটু পিছিয়ে এসে হালকা দৌড় দিয়ে জোরে একটা কিক মারেন। বল চলে যায় মাঠের ভিতরে ফুটবল খেলোয়াড়দের কাছে। তারা খুশিতে হাততালি দেয়। বাবাও হাত তালি দেন। একটু দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখেন, তারপর ফিরে আসেন ছোট্ট মনিদের খেলার জায়গায়।

না নেই! বাবার বুকের ভিতরটা ধক করে উঠে। প্রমাকে দেখতে পান না। দ্রুত চোখ ঘুরিয়ে নেন চারপাশে। স্লিপারের কাছে প্রমা নেই, দোলনার কাছে প্রমা নেই। গায়ে ছিল একটা হলুদ রঙের ফুলতোলা জামা। কোথাও হলুদ রঙের জামা পরা কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

বাবা গিয়ে অনেককে জিজ্ঞাসা করেন, একটু আগে যে একটা ছোট্ট মেয়ে হলুদ রঙের জামা পরে এখানে খেলছিল সে কোথায়? কেউ কি তাকে দেখেছে? দুই-এক জন প্রমাকে মনে করতে পারলেও বলতে পারলো না, সে এখন কোথায়।

ভয়ে বাবার গলা শুকিয়ে আসে, কান্না পায়। দৌড়ে মাঠের পাশের রাস্তায় আসেন। ডান দিকে তাকান, আবার বাম দিকে তাকান। না, রাস্তায় তো হলুদ জামা পরা কাউকে দেখা যাচ্ছে না।  এখন কি করবেন? কোথায় যাবেন? কোথায় খুঁজবেন প্রমাকে?

বাবা দৌড় দিয়ে রাস্তা ধরে মাঠের ডান প্রান্তে চলে আসেন। ডান প্রান্ত থেকে রাস্তা চলে গেছে দুই দিকে; যতদূর চোখ যায় কোন হলুদ রঙ্গের জামা পরা কাউকে দেখা যায় না। আবার এক দৌড়ে চলে আসেন বাম প্রান্তে; রাস্তা ধরে দুই দিকে তাকান। না হলুদ রঙের জামা পরা কাউকেই চোখে পড়ে না। বাবার নিজেকে খুব বোকাবোকা লাগে। কোথায় গেল প্রমা, এতো অল্প সময়ের মধ্যে! এক দৌড়ে আবার মাঠে আসেন। সারা মাঠ জুড়ে ঘুরে ঘুরে প্রমাকে খুঁজতে থাকেন।

ফুটবল খেলছে ছেলেরা, তাদের আশেপাশে নেই। ক্রিকেট খেলছে ছেলেরা, তাদের আশেপাশে নেই। গোল্লাছুট খেলছে ছেলে-মেয়েরা, তাদের মধ্যে নেই। মাঠের চারপাশে অনেকে দাঁড়িয়ে বসে খেলা দেখছে, তাদের মধ্যেও নেই। দোলনা, স্লিপার, সি-স’; কোথাও দেখা যাচ্ছে না হলুদ রঙের জামা পরা ছোট্ট সোনামনি প্রমাকে।

এখন তিনি কোথায় খুঁজবেন প্রমাকে? মাঠ থেকে বের হয়ে কোনদিকে গেল মেয়েটা? কোন ছেলেধরার খপ্পরে পড়ে নি তো? কেউ চুরি করে নিয়ে যায় নি তো? কেউ কি কিডন্যাপ করেছে? কতো রকমের কথাই তো শোনা যায়, পত্রিকায় খবর হয়। দুষ্ট লোকেরা চুরি করে নিয়ে হাত-পা ভেঙে পঙ্গু বানিয়ে ভিক্ষা করায়, বিক্রি করে পাচার করে দেয় ভিনদেশ। এখন কি হবে?

বাবা তাড়াতাড়ি মাঠ থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিয়ে আশে পাশের দুই একটা রাস্তা ঘুরে দেখেন। না, হলুদ রঙের ফুল তোলা জামা পরা কোন বাচ্চাই চোখে পড়ে না। বাবার কান্না পায়, দুই চোখ বেয়ে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। বুকের ভিতরটা কেমন খালি খালি লাগে, হু হু করতে থাকে। 

বাসায় বাবাকে একা ফিরতে দেখে মা খুব অবাক হন। দরজার কাছে গিয়ে বাহিরে এদিক ওদিক তাকান, প্রমাকে দেখা যায় কিনা। না, প্রমাকে দেখা যাচ্ছে না। মা হেসে ফেলেন, অনেক সময় প্রমা আড়ালে লুকিয়ে থাকে। মা ডাক দিলেই ঝুপ করে লাফ দিয়ে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায় আর চিৎকার করে বলে, টু উউউউ কি! এটাও প্রমার একটা খেলা, মায়ের সাথে।

মা ডাক দেন, প্রমা প্রমা। বুড়ি, বুড়ি। নানু প্রমাকে আদর করে বুড়ি বলে ডাকেন, দেখাদেখি মাও মাঝে মধ্যে ডাকেন।

না, ঝুপ করে লাফ দিয়ে প্রমা সামনে এসে দাঁড়ায় না। প্রমাকে দেখা যাচ্ছে না আবার বাবাও কিছু বলছে না।

মায়ের মুখের হাসিটা নিভে যায়। বাবাকে জিজ্ঞাসা করেন, আমার মেয়ে কোথায় ? প্রমা কই?

বাবা কী ভাবে কথা শুরু করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। আমতা আমতা করতে থাকেন। মা আর নিজেকে সামলাতে পারেন না। চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন, কি হলো? কথা বলছো না কেন? আমার মামনির কি হয়েছে?

মায়ের চিৎকার আর কান্না শুনে নানা-নানু দুইজনেই সামনের দরজার কাছে চলে আসেন।

নানা বলেন, কি হয়েছে? আমাকে খুলে বলো।

বাবার কাছ থেকে সব শুনে নানা বলেন, এখন মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। প্রমাকে খুঁজতে হবে। প্রথম কাজ হচ্ছে থানায় যাওয়া। কেউ যদি ওকে পেয়ে থাকে, থানায় পৌঁছে দিবে। আর থানায় জানালে পুলিশও খুঁজবে।

নানু কান্না চেপে ভারী গলায় বলেন, আল্লাহ! আল্লাহ! আমার বুড়িকে ফিরিয়ে দাও।

আচ্ছা প্রমা কি বাসার ঠিকানা বলতে পারবে?

মা বললেন, ঠিকানা মনে হয় বলতে পারবে না। কিন্তু আমাদের নাম বলতে পারবে।

কথা শেষ করেই মা আরো জোরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বলেন, তুমি কোন কাজের না। আমার মেয়েকে একটু দেখে রাখতে পার না। চল, এখনই থানায় চল। আমিও তোমার সাথে যাব।

বাবা আর মা থানায় গিয়ে দারোগা সাহেবের সাথে দেখা করলেন। তাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বললেন।

সব শুনে দারোগা সাহেব বললেন, আশে পাশে একটু খুঁজে দেখেন। পেয়ে যাবেন। ছোট মানুষ, বেশি দূর কোথায় আর যাবে। দেখেন হয়তো এতক্ষণে বাসায় ফিরে এসেছে।

মা বললেন, তা হলে আপনাদের কি কিছুই করার নেই?

দারোগা সাহেব বললেন, আপনি অস্থির হবেন না। আমরা তো আমাদের কাজ করবোই। এখনি ওই এলাকার টহল পুলিশকে বলে দিচ্ছি, ওরা খুঁজে দেখবে। আমাদের ওর একটা ছবি দেন, আমরা আমাদের আশে পাশের সব থানাকে অ্যালার্ট করে দিব।

বাবা বললেন, আমি এক্ষুনি বাসায় গিয়ে ওর একটা ছবি নিয়ে আসছি।  

দারোগা সাহেব বললেন, একটু শোনেন। আমরা সাধারণত চব্বিশ ঘন্টা পার না হলে কাউকে নিখোঁজ বলি না। আশা করি, এর ভিতরেই আমরা প্রমাকে খুঁজে পাব।

মা-বাবা থানা থেকে বের হয়ে একটা  রিক্সা নিয়ে বাসার দিকে রওনা হলেন। প্রমার একটা ছবি নিয়ে আবার থানায় আসতে হবে।

মা রিক্সায় বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, হে আল্লাহ! আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দাও।

বাসায় ফিরে ঘরে ঢুকে বাবা-মা দুইজনের চোখ ছানা বড়া।

তারা কী দেখছে?

ঠিক দেখছে তো!

ভুল দেখছে না তো!

নানুর পাশে সোফায় বসে আছে হলুদ রঙের ফুল তোল জামা পরা একটা মিষ্টি মেয়ে, পাশে নানা।

প্রমা! আমার আম্মু!! আমার বুড়ি!! আমার মা মনি!!! বলতে বলতে মা দৌড়ে এসে প্রমাকে কোলে তুলে নেন।

বার বার চুমু দিতে থাকেন। একবার কাঁদতে থাকেন আবার হাসতে থাকেন। প্রমা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় মার কাণ্ড দেখে। কী হয়েছে বুঝতে না পেরে অবাক চোখে মার দিকে তাকিয়ে থাকে।

এমন সময় বাবা গম্ভীর গলায় ডাক দেন, প্রমা!

বাবার গলা শুনে সবাই চুপ হয়ে যায়। বাবার দিকে তাকায়। প্রমাও তাকায়, বাবার কঠিন গলা শুনে সে ভয় পেয়েছে।

বাবা কিছু বলার আগেই নানু বলেন, খবরদার! আমার নাতনীকে কেউ বকবে না। কিচ্ছু বলবে না। এসেই বকাবকি করলে তো হবে না। আগে সব কথা শুনতে হবে।

নানু মায়ের কোল থেকে প্রমাকে নিজের কোলে নেন। বাবা, মা, নানা সবার চোখ নানু আর নানুর কোলে প্রমার দিকে।

নানু প্রমাকে জিজ্ঞাসা করেন, বুড়ি তুমি কোথায় গিয়েছিলে?

মাঠে। প্রমা উত্তর দেয়।

কার সাথে?

বাবার সাথে।

আর বাসায় ফিরেছো কার সাথে?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রমা বলে, কারো সাথে না। নিজে নিজে আসছি।

কেন? একা কেন? বাবার সাথে ফিরলে না কেন? নানু জানতে চান।

বাবাকে তো পাই নাই। খেলা শেষ করে দেখি, বাবা নাই।

তারপর তুমি কি করলা?

নিজে নিজে বাসায় চলে আসছি।

বাসা চিনতে পারছো?

প্রমা ঘাড় কাত করে বলে, হ্যাঁ।

কী ভাবে?

প্রমা দুই হাত আঁকা বাঁকা করে দোলাতে দোলাতে বলে, যেমনে যেমনে গেছি, তেমনে তেমনে আসছি।

প্রমার হাত দুলিয়ে রাস্তা দেখানোর ভঙ্গীতে নানু হেসে ফেলেন। আদর করে প্রমাকে বুকের ভিতরে জড়িয়ে ধরেন।

মা কাঁদতে কাঁদতে জানতে চান, যদি হারিয়ে যেতি?

প্রমা চোখ দুটো গোল গোল করে অবাক ভঙ্গীতে বলে, কেন হারাব? আমি তো রাস্তা চিনি।

বলেই আবার আগের মতো দুই হাত আকাঁ-বাঁকা করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলে, মাঠ থেকে বের হয়ে প্রথমে এই দিকে তারপর ওইদিকে; তারপর সোজা গিয়ে সেইদিকে গেলেই আমাদের বাসা।   

নানু প্রমার কপালে চুমু দিয়ে বলেন, দেখেছো আমাদের বুড়ি কেমন লক্ষী মেয়ে! কত তার বুদ্ধি! খেলা শেষ করে বাবাকে এদিকে খুঁজেছে, ওদিকে খুঁজেছে। কিন্তু কোথাও বাবাকে দেখতে পায়নি। এখন সে কি করবে? বুদ্ধি করে রাস্তা চিনে বাসায় ফিরেছে।

প্রমা বলে, হ্যাঁ, আমি একা একা আসছি। আমি রাস্তা চিনি।

ও তো ভেবেছে সে বুদ্ধি করে নিজে একা বাসায় ফিরতে পেরেছে, এটা জেনে মা-বাবা খুব খুশি হবে। এখন তোমরা ওকে বকতে চাও!

নানু প্রমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তবে বুড়ি আমাকে কথা দিয়েছে সে আর কখনো একা একা এভাবে রাস্তায় বের হবে না।

আর বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আমার বুড়িকে বকতে পারবে না। আমাদের বুড়ির অনেক বুদ্ধি।

নানুর কথা শুনে প্রমার ভয় কেটে গেল। নানুর দিকে তাকিয়ে বললো, আমি বুড়ি না, তুমি বুড়ি।

নানু হাসতে হাসতে বললো, দেখেছ। কেমন দুষ্ট মেয়ে। বলে, আমি নাকি বুড়ি!

নানু আর প্রমার কথা শুনে সবাই হাসতে লাগলো। এমনকি কান্না ভুলে মাও।

প্রমাও হাসতে হাসতে দুই হাত বাড়িয়ে দিল বাবার কোলে যাওয়ার জন্য।    

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত