ভোজন রসিক কবি মির্জা আসাদুল্লাহ্ খান বেগ । সুকন্যা দত্ত
” হামকো মালুম হ্যায় জান্নাত কি হকিকত লেকিন,
দিল কো খুশ রেহেনেকো’ গালিব’ ইয়ে খেয়াল আচ্ছা হ্যায়”……
দিল্লির একটি অন্ধকার ঘরে বসে আছেন এক বৃদ্ধ। বাইরে কোলাহলমুখর পথ। বাইরের জৌলুস স্পর্শ করেনি ঘরের অভ্যন্তরের ঘরগুলোকে। কাগজের উপর অক্ষর সাজিয়ে একমনে লিখে চলেছেন তিনি।
স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে দারিদ্র্যতার ছাপ সুস্পষ্ট। মোগল সাম্রাজ্য তখন অস্তাচলে, একে একে সাত সাতটি সন্তানের মৃত্যু শোকে তিনি জর্জরিত। সেই ব্যক্তির নাম মির্জা আসাদুল্লাহ্ খান বেগ তবে কবি মহলে তিনি গালিব নামে পরিচিত। গালিব শব্দের অর্থ বিজয়ী। গালিবের প্রতিটি লেখায় সুর ঝরে পড়ে। কি গভীরতা, অসম্ভব আবেগ রয়েছে তার কাব্যে।
“ইয়ে না থি হামারি কিসমত,
কি বিসাল- ইয়ার হোতা
আগার অওর জিতে রেহেতে
ইয়েহি ইনতেজার হোতা”।
প্রিয়ার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার ব্যথা দিয়ে সাজালেন কবিতা। অসম্ভব আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন গালিব কখনও প্রশংসা কুড়োতে চাননি।
” না সাতায়িশ কি তামান্না,
না সিলে কি পরওয়া,
গর নেহী হ্যায় মেরে অশহার মে মানি না সহি”…
ব্রিটিশদের কারণে রাজভাতা বন্ধ হওয়া, বন্ধু আকস্মিক মৃত্যু, চরম অভাব, জুয়া- মদের নেশা এসবের পর ও কৌতুকবোধ ভোজন রসিক হিসেবে গালিব বেশ পরিচিত ছিলেন।
প্রতি বছর গ্রীষ্মকাল এলেই মির্জা গালিব আমের জন্য অপেক্ষা করতেন। তাঁর বন্ধুরা পশ্চিমবঙ্গের মালদা থেকে আম পাঠাতেন। পরিচিতদের কাছে বিভিন্ন ধরণের আমের জন্য বার বার প্রশ্ন করতেন।মুঘল আমলের শেষের দিনগুলির সাক্ষী ছিলেন তিনি। মুঘল যুগে সম্রাটদের প্রাসাদে নারীদের জন্য একটি বাগিচা ( জনানা বাগ) এবং পুরুষদের জন্য পৃথক একটি বাগিচা ছিলো( মর্দানা বাগ)। একদিন মির্জা গালিব, মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ও কয়েকজন রাজ পারিষদের সাথে লাল কেল্লার বাগ-ই- হায়াত-বক্স বা মর্দানা বাগে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন কিন্তু তার দৃষ্টি ছিলো জনানা বাগের আম গাছের আমগুলোর দিকে। সম্রাট যখন তাকে প্রশ্ন করেন,
তিনি কি দেখছেন,মির্জা গালিব উত্তর দেন , তিনি আমগুলো দেখছেন,কারণ কথায় আছে দানায় দানায় লেখা থাকে খানেওয়ালার নাম( “দানে দানে পে লিখা হ্যায় খানেওলাকে কা নাম”)। তিনি আর ও বলেন,
তাই, আমি প্রতিটি আম ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করে আমার প্রতিটি পূর্ব পুরুষের নাম খোঁজার চেষ্টা করছি। তাঁর সেই রসিকতার অর্থ বুঝতে পেরে, সেই দিনই সম্রাট তাঁর বাড়ীতে বাক্স ভরে আম পাঠিয়ে দেন।
গালিবের খাবারের মধ্যে তার ভোজন রসিকতার ছোঁয়া পাওয়া যায়।প্রাতরাশে তার প্রিয় ছিলো কাঠবাদামের দুধ। এছাড়া অন্যান্য খাবারের মধ্যে ছিলো, কাবাব,মুরব্বা, দই, কাবাব, সোহানা হালুয়া এবং গোলাপ জল মিশ্রিত জিন( মদ)।”ওল্ড টম” কোম্পানীটি কেবলমাত্র জিন( মদ) পানীয়ের একটি প্রাতিষ্ঠানিক নামই নয়, এরা প্রাচীন পদ্ধতিতে জিন তৈরি করতেন।গালিব মদ ছাড়া থাকতেই পারতেন না। নেশার জন্য দেনায় ডুবে গিয়েছিলেন তবু ও ‘ওল্ড টম ‘ এর জিন( মদ) কে পরিত্যাগ করতে পারেননি। দিল্লীতে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন শেষে ব্রিটিশ যখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, দিল্লিবাসী অত্যাচারিত ও নিপিড়ীত হচ্ছে সেই সময়ের একটি গল্প প্রচলিত আছে। মির্জা গালিব কে ব্রিটিশ অফিসার কর্ণেল ব্রাউন প্রশ্ন করেন,
আপনি কি মুসলমান কিনা?
মির্জা গালিব উত্তরে বলেন,
আমি আধা মুসলমান, জিন বা মদিরা পান করি ঠিকই কিন্তু শূকরের মাংস খাই না।
উদ্দিষ্ট সেই অফিসার তাকে সেই মুহূর্তে বিদায় জানান।
মির্জা গালিব প্রতিদিন মাংস খেতেন। লেখক আলতাফ হুসেন হালি লিখেছেন,
শেষ বয়সে ওনার হজম শক্তি কমে গেলে ও প্রতিদিন দুপুরের খাবারে তিনি ২৫০ গ্রাম মাংসের কিমার কাবাব চাইই চাই । মাংসের টুকরো ও ঝোল ভিন্ন পাত্রে পরিবেশন করা হতো।ফুলকো লুচির উপরের নরম অংশটা ঝোলে ভিজিয়ে আলাদা পাত্রে রেখে দিতেন এবং ধীরে ধীরে খেতেন। ডিম খাওয়ার সময় কুসুম কে ও অন্য পাত্রে তুলে রেখে আয়েস করে খেতেন।
সন্ধ্যার সময় গালিব শাম্মি কাবাব ও শিক কাবাব খেতে ভালোবাসতেন। অপর একদিনের ঘটনা,
একদিন মির্জা গালিবের খাওয়ার সময় টেবিলে কাপড় বিছিয়ে তার উপর যখন নানান বাসন ও ভিন্ন ভিন্ন পদ সাজানো হয়। বাসনপত্রের বহুল সামগ্রী ও তার বৈপরীত্যে খাবারের স্বল্পতায় মির্জা গালিব উপহাস করে বলেন,
বাসনপত্রের আড়ম্বরে আমায় সমৃদ্ধশালী বলে মনে হলেও খাবাবের স্বল্পতায় আমায় দরিদ্র বলেই বোধ হবে। গালিবের আম্র প্রিয়তায় আর একটি গল্প শোনা যায়।
একদিন, মির্জা গালিব তার বন্ধু হাকিম রাজি- উদ্-দিন- খানের সাথে বাড়ীর বারান্দায় বসে গল্প করছিলেন।হাকিম সাহেব আমের বিলাসী ছিলেন না। সেই সময় একটা গাধার গাড়ী সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলো। গাধাটা রাস্তার পাশে পড়ে থাকা আমের খোসা শুকে চলে যাওয়ায় হাকিম সাহেব বলেন,
” দেখো, গাধা ও আম খায় না”,
মির্জা গালিব উত্তরে বলেছিলেন,
” নিঃসন্দেহে, গাধারাই আম খায় না।
আরেকদিনের কথা, মৌলানা -ফজল -ই- হক তার সকল বন্ধুদের সাথে আমের গুণাগুণ নিয়ে কথা বলছিলেন, সেই আলোচনায় মির্জা গালিব ও উপস্থিত ছিলেন। মৌলানা সাহেব মির্জা গালিব কে এ বিষয়ে প্রশ্ন করায় তিনি বলেন,
আমের ক্ষেত্রে আমার কাছে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, মিষ্টতা এবং পরিমাণের আধিক্য। তারপর মৌলানা সাহেব ওনাকে আম উপহার দেন।
মির্জা গালিবের একটি প্রিয় পদ হলো কালিয়াম্বা।এই পদটি শাম্মি কাবাব ও কাঁচা আম দিয়ে তৈরি করা হতো।
কলম ও চামচ দুটোই ওনার জীবনে তৃপ্তি দিয়েছে। কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা অক্ষরে পেয়েছেন মানসিক তৃপ্তি আর চামচের আগায় খাবার তুলে খেয়ে মিটিয়েছেন উদরের তৃপ্তি।

বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। কয়েকটি ব্লগে লেখাও প্রকাশিত হয়েছে।তথ্যমূলক লেখার প্রতি আগ্রহে কলমে ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি, নানান দেশের খাদ্যাচরণ, ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ রয়েছে।বিভিন্ন দেশের প্রকৃতি ও ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকে গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকের জন্য রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।