মাসুদ খানের কবিতাগুচ্ছ
লঙ্কাকাণ্ড
মরিচ পাকতে থাকে ক্রমে
ঝাঁজ বাড়তে বাড়তে উঠে যায় সেই মাত্রায়, যেখানে
লঙ্কার ঝালাঙ্ক গিয়ে মিলে যায় তার দাহ্য উষ্ণতায়।
মরিচ তখন কথা বলে ওঠে আগ্নেয় ভাষায়।
মহাসাগরের পাড়ে মহামরিচের গাছ
টোকা দিলে তাতে মহাসর্বনাশ
আপন ঝাঁজেই আগুন লেগেছে মরিচের গাছে
আর আশেপাশে, জমজ টাওয়ারে…
সশব্দ ঝালের সেই তাণ্ডবে
দুনিয়াদাপানো লঙ্কাকাণ্ডে
তাজ্জব মনুকুল।
তারা রোপণ করছে মরিচের গাছ, দেখছে সর্ষেফুল।
সেই দুর্ঘটে পঙ্গপালেরা উদ্বিগ্ন, এবং
উত্তেজনায় গিরগিটিদল দ্রুত বদলায় রং।
পরমাপ্রাকৃতিক
যা কিছুই নিই, তোমা থেকে নিই।
যা কিছুই দিই, তোমাতেই দিই।
এই শষ্প পুষ্প কুশ কাশ রজঃ রেণু গর্ভাশয়
তোমাতে প্রকাশ যদি, তোমাতেই বিকাশ বিলয়।
তোমার বুকেই ভোরবেলা দস্যি হামাগুড়ি…
খরগোশ হয়ে, কোলাব্যাঙ হয়ে প্লবগতি ছোটাছুটি সারাবেলা
যত চিত্রবিচিত্র ডাংগুলি, খোঁড়াখুঁড়ি, বুড়িছোঁয়া খেলা…
কী আধানে আহিত, কী মোহে সম্মোহিত
কী এক অচেনা অভাবের তাড়নায় ছুটে যাই ভুতগৃহীতের মতো!
পুরাতন, খোসা-খসতে-থাকা শিথিল দেহটা বিছিয়ে দিয়ে শরীরে তোমার,
লীন হয়ে সারাদিন শুষে নিই মেধা, বলাধান, জৈবতাপ…
আর, সবই তো তোমারই আবেশ আদেশ আর প্রভাব প্রতাপ।
তোমারই শরীর থেকে শস্যদানা দুধমধু আহার-আহরণ-
যে-মধু স্বভাবে সান্দ্র, যেই দুধ সহজ দ্রাবক।
সেই দুধ সেই মধু অধীরা তরলা
আর্দ্র্র উপদেশরূপে তোমার শরীর থেকে আস্রবণে
সারাদিন ক্ষরণে ঝরণে
ফোঁটা-ফোঁটা চলে আসে সরাসরি শিরায় আমার।
দিনান্তে আবার সারমর্ম হয়ে তোমাতে ছড়াই।
সেই একই দুগ্ধমধুভাবে, খাদ্যরেণুরূপে তোমাতেই ঝরে যাই।
ভোরবেলা জেগে উঠি পুনরায়।
যা কিছুই নিই, তোমার থেকেই নিই।
যা কিছুই দিই, তা-ও তোমাতেই দিই।
জীবন
মোলাকাত হবে মরণের সাথে তাই
এতটা বছর বাঁচতে হলো তাকে।
লোকে বলে– বেশিদিন বাঁচলে মানুষ
এক ঘোরবর্ণ তপ্ত তমসা-উটের বাচ্চা হওয়া দ্যাখে।
জৈবনিক
কেশর-হাঁকানো কোনো বলিষ্ঠ ঘোড়ার
দ্বিভঙ্গ-দাঁড়ানোভঙ্গি ঘুমের ভেতর ডুব দিয়ে
বহুদূরে গিয়ে ভুশ করে ভেসে উঠব
শুশুকের ভেজা-ভেজা স্বপ্নের ভেতর।
ওইদিকে, নদীতীরে
কী-কী সব কুহককীর্তন করতে করতে
পুরাতন গাছে উড়ে এসে বসবে
আধুনিক পাখি, আধুনিক প্রজাপতি।
শজারুর কাঁটাকাঁটা উপলব্ধি নিয়ে
জানবাজি জেগে থাকতে হবে নিদ্রাহীন
সম্ভবত আরো একটি সম্পূর্ণ বছর…
অণ্বেষণ
“তোমারে যতন কইরা দিলাম যাহার ঠাঁই
সেই তোমারে দিলো ফাঁকি, চলো লইয়া যাই…”
বহু বছর আগে গোলকগাঁয়ের বাঁকে
চোখধাঁধানো আলোকধাঁধায় হারিয়ে ফেলি তাকে।
অনেক কাল ধরে খুঁজে ফিরছি, ওরে,
ভুবনগাঁয়ের মেলা, বাজার, আড়ত, গুদামঘরে।
বদলে-যাওয়া দিনে ঝড়বাদলের ক্ষণে
বসিয়ে রেখে গিয়েছিলাম মেলার এক কোণে
বহু সময় ধরে সওদাপাতি করে
ফিরে এসে পাই না খুঁজে, বিকল লণ্ঠনে…
উদ্ভ্রান্তের স্বরে আহাজারি করে
শুধাই আমি জনে জনে, শুধাই মহাজনে।
খুঁজে ফিরছি রোজ, কিন্তু তোমার খোঁজ
কেউই দিতে পারছে না এ বেঘোর বরিষণে।
তবু আমি ছাড়ছি না হাল
সময় যতই বেতাল-মাতাল হোক না ঝড়ের তোড়ে
খোঁজার ব্রত, খুঁজেই যাব
খুঁজে একদিন ঠিকই পাব প্রবল মনের জোরে।
অন্য সবাই ভোলে ভুলুক
কিংবা খুঁজে পাক বা না পাক
কিংবা তোমার নামে ছড়াক কালি-কেলেঙ্কারি
যার যা খুশি ভাবে ভাবুক
কিংবা কেউই নিক বা না নিক
আমিই তোমায় ধীরে ধীরে ফিরিয়ে নেব বাড়ি।

কবি