Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com, mohit-kamal-fiction-writer

স্পর্শ । মোহিত কামাল

Reading Time: 3 minutes

‘ভাই, দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেওয়ার পর মাথা ঝিমঝিম করছে; জ্যাম হয়ে আছে। চোখ-কানও ব্যথা করছে। ভাই, বাঁচব তো? রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে না তো? হচ্ছেটা কি?’

আমার প্রশ্ন শুনে হেসে উঠলেন তিনি। কিছুক্ষণ হাসলেন। তাঁর হাসির মধ্যে প্রবল আত্মবিশ্বাসের দাপট দেখতে পেলাম। হাসি থামিয়ে তিনি বললেন, ‘শোনেন, জহির সাহেব, অচঞ্চল হবেন না, অস্থির হবেন না। উপসর্গগুলো মেনে নিন; ভোগ করুন। আর আপনার মাথার কুচিন্তাটা আমার মাথায় ঢেলে দিন। তারপর নিশ্চিন্তে থাকুন, দৈনন্দিন কাজে মনোযোগ দিন, যে কাজটা যেভাবে করা উচিত, সে-কাজ পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে করুন।’
‘আপনি কি মনে করছেন আমি ফান করছি? মিছে কথা বলছি ? আমার কষ্ট হচ্ছে, আর আপনি তার কোনো দামই দিচ্ছেন না!’ কিছুটা উষ্মা নিয়ে বললাম আমার চিকিৎসকের উদ্দেশে।
‘শোনেন, নিউটনের তৃতীয় সূত্রের কথা শোনেন। জানা থাকলে ভালো। না জানলে জেনে নিন: প্রত্যেক ক্রিয়ার একটা সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া থাকে। ফল পেতে হলে প্রতিক্রিয়াটাকে মেনে নিতে হবে। পাল্টা প্রতিক্রিয়াটা ধ্বংসাত্মক নয়, ক্ষতিকরও নয়। এটা গ্রহণযোগ্য বিষয়। কয়েকদিনের মধ্যে তা মিলিয়ে যাবে। বুঝেছেন?’
ধমক না দিয়ে বেশ জোরেশোরে তিনি উত্তরটা দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতি মনে ঢুস মারা ক্ষোভ আর বিদ্বেষটা কমে গেল। তবু মনের মধ্যে জেগে উঠতে লাগল নানা চিন্তা। শুনেছি টিকার কারণে বহু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, রক্ত জমাট বেঁধে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। কতশত কথা টেলিভিশনে বলতে শুনি, পত্রিকার পাতায় দেখি, ফেসবুকে সয়লাব হয়ে গেছে এসব ‘ইনফোডেমিক’ টক্সিক তথ্য-উপাত্তে। সব মাথার মধ্যে ঘোরে। তারপরও চিকিৎসকের কথাটা কেমন করে যেন মন মেনে নিয়েছে।
নতজানু মন নিয়ে তাঁর চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম। তাকালাম আকাশের দিকে। খোলা আকাশ কত ব্যাপক ও বিস্তৃত! আকাশে এত চকচকে রোদ, এমন ঝলমলে দিন! এত সুন্দর! আর এ সুন্দর জগৎ-ই দখল করে রেখেছে অদৃশ্য শত্রু, অণুজীব করোনা। আবার টেলিভিশন খুললেই দেখা যায় ইসরাইলি বোমারু বিমান কীভাবে গাজায় আক্রমণ করছে, কীভাবে হামাস বাহিনী শত শত রকেট ছুঁড়ছে ইসরাইলের দিকে, আর কীভাবে তাদের ‘আইরন ড্রোম’ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে রকেটের পর রকেট! একদিকে মরছে মানুষ করোনার অভিঘাতে, আরেকদিকে মানুষ মারছে মানুষকে। নারী-শিশু বিলাপ ছেড়ে কাঁদছে, থর থর করে কাঁপছে। করোনার প্রাণঘাতী বিলাপ আর মানবসৃষ্ট মানবতাধ্বংসী বিলাপ যেন একাকার হয়ে গেছে এই বিশ্বসংসারে!

রাস্তায় নেমে এলাম আমি। হাঁটছি। ফুটপাত ধরে হাঁটছি এখন। কেউ কি আছেন সঙ্গে? আরে আছেন তো! অনেকেই আছেন! আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি আমার সঙ্গী হওয়ার জন্য। চোখ মেলে দেখুন, দেখুন। সামনে দেখুন। কত মানুষ হাঁটছে দেখুন-সবাই কি মাস্ক পরে হাঁটছে?
আমি আর কী বলব, আপনারাই তো দেখছেন: অর্ধেক মানুষ মাস্ক ছাড়া ছুটছে। বাকি অর্ধেকের অর্ধেক মানুষ মাস্ক গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে! সেই অর্ধেকের অর্ধেক মানুষ নাকখোলা রেখে মাস্ক পরেছে। কজন ঠিকমতো মাস্ক পরেছে দেখতে পাচ্ছেন?
আপনারা বলুন, কীভাবে আমরাই অদৃশ্য শত্রু মোকাবিলা করব?
থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। ফুটপাতের পাশে দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে একবার দেখার চেষ্টা করলাম নিজের ভেতরটা। কী আশ্চর্য, আপনাদের কেউ তো নেই আমার সঙ্গে! সবায় পালিয়েছেন? ভয় পেয়েছেন? চোখ খুলে ডানে তাকালাম। বায়ে দেখলাম। সত্যিই তো কেউ নেই! আপনারা পালিয়েছেন! ভয় পেয়েছেন?
ভয় পাওয়া ভালো। তবে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। শুনে রাখুন, আমি একা। এ জগৎ-সংসারে একা। একদম একা। আমি করোনা নিয়ে আতঙ্কিত নই। টিকা নিয়ে ফেলেছি। দুই ডোজ কোভেক্স আমি গ্রহণ করে ফেলেছি। টিকার প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভীত ছিলাম। সেই ভীতিও উড়ে গেছে। করোনা আমাকে আর ঘায়েল করতে পারবে না।
আপনি কী করেন? আপনি কি এখনো টিকা নেননি? ভয়ে? নাকি আপনার সিরিয়াল আসেনি? নাকি ডাক আসেনি? নাকি রেজিস্ট্রেশন করেননি? নাকি বয়স এখনো আপনার অনুকূলে নয়? নাকি প্রথম দফায় যাদেরকে করোনার টিকা দেওয়া হবে সেই দলভুক্ত আপনি হননি?

আমি আবার হাঁটতে শুরু করেছি জনারণ্যের ভেতর দিয়ে। হেঁটে যাচ্ছি। হাঁটাপথে কেউ কারও দিকে তাকাচ্ছে না। সবাই অদৃশ্য শত্রুকে বাহবা দিচ্ছে, স্যালুট দিচ্ছে! কীভাবে শত্রুকে বন্ধু ভেবে বুকে তুলে নিচ্ছে! আমাদেরকে ডানা বানিয়ে কীভাবে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এ অদৃশ্য, এই গোপন শত্রু! দেখে মনটা ভারী হয়ে যাচ্ছে!
‘আরে, জহির! কী হয়েছে তোমার!’
‘কী আর হবে?’
‘এমন উদভ্রান্তের মতো লাগছে কেন তোমাকে! শরীরটাও তো দেখছি ভেঙে গেছে, মলিন হয়ে গেছ! বিষয়টা কী?’
এক সময়ের খেলার সঙ্গী পপলুর কথা শুনে অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি!
‘এমন অবাক হয়ে কী দেখছ?’
উত্তর দিতে পারছি না। ওর মুখের দিকে তাকিয়েই আছি। কেবল মনে পড়ছে একমাস আগে নিউজ হয়েছে নিউইয়র্কে করোনার অভিঘাতে মারা গেছে পপলু! ভুল শুনেছি! ও যে সামনে দাঁড়িয়ে আছে! এমন ভুল সংবাদ প্রচারিত হতে পারে!
‘না। না। এভাবে মাস্ক ছাড়া বাসা থেকে বের হওয়া উচিত হয়নি তোমার!’ আবারও ওর কথা শুনে চট করে মুখে হাত দিলাম। নাকে হাত দিলাম! নাক ধরতে পারলাম, মুখও!আবারও অবাক হয়ে বড়ো বড়ো চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

ও আমার হাত ধরে বলল, ‘চলো, বাসায় চলো’ তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি। এই কঠিন সময়ে কি মাস্ক ছাড়া বের হওয়া ঠিক হয়েছে, জহির ?
‘নিজের ভুলটা চট করে স্বীকার করতে চাইলাম না। কারণ দর্শানোর মতো করে বললাম,’ দুই ডোজ টিকা নিয়ে ফেলেছি তো! বোধহয় সাহস বেড়ে গেছে!’
‘ভারতে করোনার দ্বিতীয় প্রজন্ম দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। হাজার হাজার মানুষকে ওপারে পাঠিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশেও সে অণুজীবের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে! কোভ্যাক্স টিকা কি তোমাকে করোনার সব প্রজাতি থেকে মুক্তি দিবে? চলো, বাসায় চলো!’
পপলুর কথা শুনে সচেতন হয়ে ওঠলাম। ওর দিকে হাত বাড়ালাম। নির্ভরতার হাতটা ধরতে চাইলাম। একি! পপলু কোথায়! ফুটপাতের পাশে ইলেকট্রিক পিলার ধরে যে দাঁড়িয়ে আছি আমি! নাকে হাত দিলাম। নাক ধরতে পারলাম না। স্পর্শ পেলাম মাস্কের!

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>