| 20 এপ্রিল 2024
Categories
অমর মিত্র সংখ্যা

অমর মিত্র সংখ্যা: আমার ময়মনসিংহ যাত্রা | অমর মিত্র

আনুমানিক পঠনকাল: 9 মিনিট

 

ময়মনসিংহের গীতি কাব্য নিয়ে নাটক হয়েছে কলকাতায়। অনেক বছর আগে বিভাস চক্রবর্তী নির্মাণ করেছিলেন মাধব মালঞ্চী কইন্যা, তারপরে আরও একটি নাটক হয়েছিল ময়মনসিংহ গীতিকা নিয়ে। তা ময়মনসিংহ গীতিকার এক অংশ নিয়েই নির্মাণ করা হয়েছিল। তার বাইরে যায়নি। পালার গল্পই এসেছিল কলকাতার  মঞ্চে। আমি ভেবেছিলাম পূর্ববঙ্গ গীতিকার যে কোনো   একটি পালা  নিয়ে উপন্যাস লিখব। ছোটবেলায় মায়ের কাছে গারো পাহাড়, পূর্বধলা… শুনতাম। স্বাধীনতার আগে ফজলুল হক সায়েব যখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, বাবা ঋণ সালিশি বোর্ডের তদন্তকরী অফিসার হয়ে ময়মনসিংহ জেলায় কর্মরত  ছিলেন। তদন্ত করে ঋণজর্জর কৃষককে ঋণমুক্ত করাই ছিল তাঁর কাজ। এই উপন্যাস রচনার পিছনে মায়ের বলা সেই কাহিনি কাজ করেছে কি না জানি না। এখন মনে হচ্ছে পিতৃঋণ শোধ করছি যেন, বাবা যতটা অবধি গিয়ে থেমেছিলেন, আমি তারপর থেকে আরম্ভ করেছি। লেখা ব্যতীত আর কিছুই করার ক্ষমতা নেই আমার। কিন্তু  এই উপন্যাসে ঋণ জর্জর কৃষকের বিদ্রোহ আছে। আমি তা লিখেছি, লিখেছি  দীর্ঘ এক সময় জুড়ে সেই  নিম্ন  বর্গের মানুষের উত্থানের উপাখ্যান। 

ময়মনসিংহ এক মস্ত জেলা। তার উত্তর পশ্চিম কোণে নেত্রকোণা। নেত্রকোণা ছিল একটি মহকুমা। সেই মহকুমা এখন জেলা হয়ে গেছে। নেত্রকোণা থেকে মাইল কুড়ি-পঁচিশ  সুসঙ্গ দুর্গাপুর। সেই গঞ্জ এবং তার আশপাশের গ্রাম থেকেই উঠে এসেছিল এই গান।  দীনেশচন্দ্র সেন সংগ্রহ করেছিলেন চন্দ্রকুমার দে নামে এক গ্রামীন সংগ্রাহকের মাধ্যমে। চন্দ্রকুমারের বাড়ি নেত্রকোণায়। আর ময়মনসিংহ-গীতিকার গ্রাম্য গীতিকার, কবিরা সকলেই প্রায় নেত্রকোণার গ্রামের মানুষ।  

আসলে লিখতে লিখতেই লেখার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে আসে আমার কাছে। একটা সূত্র ধরে লেখা আরম্ভ হয়, তারপর তা প্রলম্বিত হতে থাকে। এইটি মনোজগতের ক্রিয়া। প্রাকৃতিক ক্রিয়াও বলা যায়। প্রথমে নেত্রকোণার অদূরে গারো পাহাড়ের কোলে সুসঙ্গ দুর্গাপুরের কমলা সায়র নিয়েই ছিল সেই লেখার পরিকল্পনা। ভেবেছিলাম গীতিকার কাহিনিকে সম্প্রসারিত করব। একটি সায়র খনন ছিল সেই উপন্যাসের বিষয়। লিখব জলের জন্ম বৃত্তান্ত। জল এবং  জলহীনতা  বহুদিন আমার লেখার বিষয়। অনাবৃষ্টি নিয়েই যেন সারাজীবন লেখা যায়। কমলা সায়রের কাহিনি অনাবৃষ্টির কাহিনি নয়। কিন্তু জলের জন্ম  কাহিনি। পুষ্করিণী খনন। সায়র সৃজন। এই বিষয়টি ধ্রুবপুত্র উপন্যাসে ছিল। সায়র খনন হল অনাবৃষ্টি প্রতিরোধের এক উপায়। কমলা সায়র খননের যে বৃত্তান্ত আছে পূর্ববঙ্গ গীতিকা বা ময়মনসিংহ গীতিকায়, তা হল আমার উপাখ্যানের  এক অংশ, এবং তা শুধু সূত্র হয়েই এল। বাকি কাহিনি আমিই নির্মাণ করলাম। লিখেছিলাম অনেকদিন ধরে।  তা ছাপতে দিলাম এক প্রকাশকের কাছে। প্রায় পাণ্ডুলিপি থেকেই বলা যায়। কিন্তু একমাস বাদে মনে হলো, এই লেখার অর্থ কী? কেন লিখলাম? উপন্যাস লেখা মানে তো কাহিনি বয়ন নয়। আর কমলা সায়রের কাহিনি ময়মনসিংহ গীতিকায় রয়েছে। আমি তাকে সম্প্রসারিত করেছি। কিন্তু তা কতটা নতুন হলো। নতুন কথা কী বলা হলো? হ্যাঁ, খনন কাহিনি লিখেছিলাম নিজের মতো করে। পাতাল- আঁধার বৃত্তান্ত তা। কলকাতার উপকন্ঠে বসে সেই কাহিনি রচনা করতে থাকেন এক প্রবীণ। তাঁর পিতৃপুরুষ ছিলেন ময়মনসিংহ জেলার ঐ অঞ্চলের অধিবাসী।  কিন্তু মনে হচ্ছিল অনেক লেখার কথা ছিল, কিছুই লেখা হয়নি। গীতিকার বাইরে যে ব্যপ্ত ময়মনসিংহ, তার ইতিহাস কি জুড়বে না গীতিকার সঙ্গে?  নিজেই বুঝতে পারছিলাম ওভাবে হবে না। কোথায় এক অপূর্ণতা আছে। আমি প্রকাশকের কাছ থেকে  লেখা ফেরত নিয়ে এলাম। 

বছর চার আগে সেই প্রকাশকের কাছ থেকে ‘সোমেশ্বরী গাঙের পারে’ নামের পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে এনে ভাবলাম গারো পাহাড়ের দেশে, সুসঙ্গ দুর্গাপুর যাব। জায়গাটি দেখব। কমলা সায়র দেখব। রাজার বাড়ি দেখব। আসলে পটভূমি, পরিবেশ মাথার ভিতরে চাপ ফেলে। তাইই আমাকে লিখিয়ে নেয়। প্রকৃতি এক বড় শিক্ষক। জায়গাটি না দেখে লেখা হবে কীভাবে ? কাহিনি বয়ন করা যায়, পটভূমির সবই যদি বানাতে হয়, লেখা এগোবে না। পটভূমি কিছুটা চেনা প্রয়োজন।  

নেত্রকোণা জেলার জন্ম ১৯৮৪ সালে।  আমাকে নেত্রকোণা যেতে হবে।  এমনি চলে যাব? বাংলাদেশের কিছু  বন্ধু আছে আমার, তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম। আমাকে নিউইয়র্ক নিবাসী  কুলদা রায় বললেন, রুমা মোদকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। রুমাই আমার কথা যতীন স্যারকে বলবে। যতীন স্যার, যতীন সরকার। তিনি থাকেন নেত্রকোণা। দুই ভাইই, যতীন, মতীন্দ্র ছিলেন অধ্যাপক। সুপণ্ডিত। যতীন সরকার পরম শ্রদ্ধেয়। তাঁদের কাছেই আছে ময়মনসিংহর সব খবর। রুমা মোদক গল্প লেখক, নাট্যকর্মী। তার প্রথম বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলাম আমি। তীব্রতা আছে রুমার গল্পে। আছে বাংলাদেশের নিম্নবর্গের মানুষের অসহায়তা। রুমার বাড়ি সিলেট, হবিগঞ্জে। সে মতীন্দ্র সরকারের ছাত্রী। রুমার সঙ্গে ফেসবুকে যোগাযোগ করতে ও বলল, দাদা, বাংলাদেশে আসুন, কোনো অসুবিধে হবে না।  সুযোগ এসে গেল।  

২০১৮-র জানুয়ারি মাসে ঢাকায় বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে গিয়ে রুমার জন্য অপেক্ষা করলাম। শেষের আগের দিনে রুমা হাজির। ও ফোনে যোগাযোগ করে দিল যতীন্দ্র সরকার মশায়ের সঙ্গে। যেতে হবে ট্রেনে নেত্রকোণা। বাসযাত্রায় খুব কষ্ট হবে। স্বকৃত নোমান তখন যোগাযোগ করিয়ে দিল লেখক জয়দীপ দের সঙ্গে। রেল দপ্তরে তার যোগাযোগ আছে। রিকশা নিয়ে কমলাপুর স্টেশনে চললাম আমি ও স্বপ্নময়। স্বপ্নময় গিয়েছিল সেই যাত্রায় ঢাকায়। আমি নেত্রকোণা যাব শুনে বলল, সেও যাবে, দেখে আসবে। দেশটা তো দেখা হবে। সঙ্গী পেলাম। আমরা দুজনে বড় লাগেজ ঢাকার বাতিঘর পুস্তক বিপনীতে দীপঙ্কর দাসের কাছে রেখে চললাম নেত্রকোণা। কবি অঞ্জন আচার্য ময়মনসিংহর সন্তান। সে  একজনের ফোন নম্বর দিল, কবি শিমুল মিলকী। শিমুল  আমাদের সঙ্গে যাবে সুসঙ্গ দুর্গাপুর অবধি।   

ঢাকা থেকে ১৫ তারিখে রাতের ট্রেন হাওর এক্সপ্রেসে  চললাম নেত্রকোণা। হাওর এক্সপ্রেস যায় ঢাকা থেকে  সিলেট সীমান্তে মোহনগঞ্জ অবধি। কমলাপুর থেকে সেই গাড়ি ছাড়ার কথা ছিল রাত এগারটা কুড়ি, লেটে ছাড়বে, পরের দিন, রাত বারোটার পর। তখন ঢাকা কেন সমস্ত বাংলাদেশ জুড়ে শৈত্য প্রবাহ চলছিল। সোয়েটার শাল মুড়ি দিয়ে হৈহল্লায় ভরা স্টেশনে অপেক্ষা করছিলাম আমরা। কতদিকে রাতের কত গাড়ি যাবে, ঘোষণা শুনতে শুনতে মন খারাপ লাগছিল। দেশটা আমারও ছিল। এখন নেই। আমি বিদেশী। কমলাপুর স্টেশনে সেই রাতে বিচিত্র এক যুবকের সঙ্গে এবং দুই সন্তানের জননীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। যুবকটি আমাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়  মনে করেছিল। আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করেছিল, স্যার কেমন আছেন, সন্ধে বেলায় আপনাকে টিভিতে দেখলাম।

ভাবলাম বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে দেওয়া কোনো সাক্ষাৎকারের কথা বলছে। না, তা নয়। ঐ সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন বাংলাদেশের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অন্তিম ভাষণ দিতে ঢাকায় গিয়েছিলেন  রাষ্ট্রপতি মাননীয় প্রণব মুখোপাধ্যায়। টেলিভিশনে তাঁর ভাষণ শুনেছে সন্ধ্যায়। ভাবুন, ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনের জন্য কমলাপুর স্টেশনে অপেক্ষা করছেন। সামনে টয়লেট থেকে মানুষ বেরচ্ছে। টয়লেটে প্রবেশ করছে। 

যুবকটি খুব কবিতা পড়ে। গল্প পড়ে। তার ভ্রম বা বিভ্রম দূর করার পর অনেক কথা হলো। সে কোথাও যাবে না। কাছেই থাকে। স্টেশনে আসতে তার খুব ভালো লাগে। স্টেশনে একজনের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল, সে তাকে চাকরি দেবে বলেছিল। কিন্তু দেখা হয়নি। যুবকের বাড়ি ফরিদপুর। সে কাজের খোঁজে এসেছে ঢাকায়। আর সেই দুই সন্তানের জননী আমার উপন্যাসে এক বড় চরিত্র হয়ে এসেছেন। তিনি যাবেন ঈশ্বরগঞ্জ। ঈশ্বরগঞ্জ নেত্রকোণার আগের ষ্টেশন।  নাম জিজ্ঞেস করিনি। কিছু কথা হয়েছিল মাত্র। তিনি হয়ে গেলেন আয়না বিবি। পূর্ববঙ্গ গীতিকায় আয়না বিবির পালা আছে। আমার সামনে তিনি যেন সেই পালা থেকেই উঠে এসেছিলেন। উপন্যাসে বিদ্ধৃত সেই অংশ এমনি।

“তারা ভিতরে ঢুকে দেখল ট্রেন ছাড়তে লেট হবে আধ ঘন্টা।  মানে ১২টা ২০। তারিখ বদল হয়ে যাবে। হেসে ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার বলল, আমার দেশের হাওর এক্সপ্রেস, রেলগাড়ি সবদিনই আজকের গাড়ি কালকে ছাড়ে। আগামীকাল ছাড়বে সুতরাং ঘন্টা খানেক বসতে হয়। ১২টা ২০ না হয়ে ১২টা ৩০ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।  অতএব ওয়েটিং রুমে বসতে হয়। শীত খুব বেশি। মোটা সোয়েটার মাফলার, মাঙ্কি ক্যাপেও শীত যাচ্ছে না। শাল গায়ে জড়িয়ে জবুথবু হয়ে বসল তারা পাশাপাশি। তার পাশে এক মহিলা দুইটি নাবালক সন্তান নিয়ে। দেখেই মনে হয় দুঃস্থ। বিপুলের সামনে টয়লেটের খোলা দরজা। ক্রমাগত ভিতরে ঢুকছে আর বেরোচ্ছে মানুষ। টয়লেট থেকে ভেসে আসছে কড়া অ্যামোনিয়া যুক্ত  প্রস্রাবের কটু গন্ধ। জিন্সের নিচে লম্বা ড্রয়ার থাকলেও পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।এক হকার  ইসলামী কিতাব,  বিক্রি করছে। বেহেস্তের পথ, দোজখের আগুন, প্রশ্নোত্তরে ইসলাম, নমাজের শিক্ষা, মৈমনসিঙের কিসসা। মৈমনসিঙের কিসসা বইটি হাত বাড়িয়ে নিল বিপুল। লেখক বাণেশ্বর গাজী। আলেয়া বুক হাউস, গেন্ডারিয়া, ঢাকা। চমকে উঠল সে। তার পাশের মহিলা প্রশ্নোত্তরে ইসলাম কিনেছে। তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি হিঁদু নন?

কেন বলুন দেখি? বিপুল জিজ্ঞেস করে। 

ইসলামের কিতাব কিনলেন না আপনি।

এইটা কি হিন্দুর কিতাব?

মাথা নাড়ে বছর তিরিশের মহিলা, বলল, না বটে, কিন্তু তুমি  হিঁদুর কিতাবও কিনোনি, তবে কি কেরেস্তান? 

এইটা কি খ্রীস্টানের কিতাব? বিপুল জিজ্ঞেস করে। 

না, কেরেস্তানের কিতাব না, তবে কি তুমি বুদ্ধদেবের ধর্ম মানো ?

বিপুল জিজ্ঞেস করে, এইটা কি বৌদ্ধ ধর্মের কিতাব ? 

সেই ময়লা চাদর মুড়ি দেওয়া মহিলা তার দুই সন্তানকে দুই ধারে ঘুমন্ত ধরে রেখে বলল, না, তা না।

তবে এইটা কী  কিতাব ? বিপুল  জিজ্ঞেস করে। 

ধম্মোর কিতাব না। মহিলা বলে। 

বিপুল হেসে বলল, গল্পের কিতাব।

কিসসা। মহিলা বলল, কিন্তু তুমি  তাহলে কোন ধম্মোর লোক?

বিপুল বলল, থাক না দিদি।

আফনের কিসসা না পড়া ভালো। মহিলার সম্বোধন বদল হয়ে গেল। 

কেন, কিসসা  পড়ব না কেন?

মহিলা বলল, কিসসায় সব মিথ্যে কথা থাকে, ঝুট বাত, গন্ধী বাত।

কী করে বুঝলে মিথ্যে? বিপুল তার কথা বাড়িয়ে যায়। 

বুঝা যায়, মিথ্যে শুনলিই আমি ধরতি পারি আসলডা কী?

আসল না থেকে যদি সবটাই মিথ্যে হয়? বিপুল জিজ্ঞেস করে।

আসল একটা থাকবেই, যারে কয় ফ্যাক্ট, তারে যতই তুমি যতই বাদ দেও, ফুটি ওঠবে।

তোমার নাম কী? বিপুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, বলে, তুমি অনেক জানো।

কিছুই জানিনে, আল্লা সব জানে, আমার নাম আয়না বিবি, লীলাবতী খাতুন, আয়না  আমার বরের দিয়া নাম, লীলাবতী নাম দিয়েসিল এক ফকির, ঐটা আমার বাপের বাড়ির নাম।

       লীলাবতী! বিপুল বিস্মিত!

       জ্বি, লীলাবতী, কিন্তু বিয়ের পর সে নাম আর থাকল না।

       লীলাবতী! সেই ত্রিলোচন বামুনের শেষ পক্ষ ছিল লীলাবতী, তাই লিখে গেছেন তো সুধীন্দ্র। অবাক হয়ে বিপুল ভাবে সে যেন এক যাদুর দেশে যাত্রা করেছে। না হলে লীলাবতী কিংবা আয়না বিবি তার সহযাত্রী হবে কেন? বিস্ময় লুকিয়ে বিপুল বলল, কী সুন্দর দুটো নাম! 

         সোন্দরের কিসু নাই, আল্লার পিথিবীতে সবই সুন্দর, অসুন্দর কী আছে কন?  বলল আয়না  বিবি।

         বিপুল  জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

         আমি যাব পূর্বধলা, কংস নদীর ধারের গেরাম, বাপের বাড়ি।

         শ্বশুরবাড়ি কোথায়?  বিপুল জিজ্ঞেস করে। 

         গাজিপুর, সোয়ামী গেছে আরবে, ফেরতেসে না, শেষবার যহন ফুন দেয়, বলেসিল আসমানতারা শাড়ি কিনসে মুর জন্যি, সিডা আর কাউরে দে দেসে মনে হয়।  আয়না বিবি  বলল।  

          কথা হয় না আর? জিজ্ঞেস করে বিপুল। 

          দুমাস ফুন বন্ধ, তারে ফুনেও মিলসেনি। আয়না বিবি বলল, আল্লাহ ভরসা, এখন খুব অভাব যাচ্ছে,  আমার ভাই আমারে যেতি বলেসে, সে ইমামতি করে, অন্তঃকরণ ভালো বলে জানি।   

           কী নাম ভাইয়ের? জিজ্ঞেস করল ইমতিয়াজ আলী চন্দ্রকুমার।

           জ্বি, বদিউল ইসলাম।

           ঢ্যাঙা মানুষ? জিজ্ঞেস করে ইমতিয়াজ।

           জ্বি, ঢ্যাঙা বলা যাবে না, গেঁড়াপানা।

           ধলা না কালা? জিজ্ঞেস করে ইমতিয়াজ। 

           ময়লা রঙ, সে আল্লা ছাড়া কিছু জানে, আল্লা ছাড়া তার জবান নাই। সম্ভ্রম দিয়ে কথাটা বলল আয়না বিবি।

           কী কথা বলে আল্লা নিয়ে ? জিজ্ঞেস করল চন্দ্রকুমার। 

           এই ধরো, মুদের সৃষ্টিকর্তার নাম কি?

           উত্তরঃ আল্লাহ্‌।

                 তখন জিগাবে,  আল্লাহর কতগুলো নাম রয়েছে?

                 উত্তরঃ আল্লাহ তা’আলার নাম অসংখ্য-অগণিত।

                 তখন ফের জিগাবে,  আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্‌ কোথায় আছেন?

                 উত্তরঃ সপ্তাকাশের উপর আরশে।

                 প্রশ্নঃ আল্লাহর আরশ কোথায় আছে?

                 উত্তরঃ সাত আসমানের উপর।

                 প্রশ্নঃ আল্লাহ কি সর্বস্থানে বিরাজমান?

                 উত্তরঃ না। আল্লাহ্‌ সবজায়গায় নাই। তিনি সপ্তকাশের উপর তাঁর সিংহাসন। 

বিপুল অবাক। মুখস্ত সব আয়না বিবির। বয়স বছর তিরিশ। মুখখানি সুগোল, চোখদুটি ছোট, বলছে, তার ভাই বদিউল যা জিজ্ঞেস করবে, উত্তর দিতিই হবে, সেই কারণে কিতাবখানা সে আবার কিনল। ঠিক উত্তর না পেলে ভাই রেগে যাবে। ভাত বন্ধ করে দেবে। ভাই এমনি ভালো, কিন্তু আল্লার কথায় কোনো রেয়াত করে না। ভুল হলি বেত মারবে পর্যন্ত।  আগের কিতাবখানা  তার ননদ আয়েশা নিয়ে  গেছে  তার শ্বশুরবাড়ি, সেখেনে তার সোয়ামী জিজ্ঞেস করে এইসব কথা। বলতে না পারলে তারও বিপদ হয়। মার খায়।   

             বাণেশ্বর গাজীর বইটি খুলল বিপুল। বই দেখে চন্দ্রকুমার অবাক। বলল, এই বই কে দিল?

             কেন, কে দেবে, কিনেছি।

             বাণেশ্বর গাজী কেডা? চন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করল। 

             তা তো জানি না, তুমি জানতে পারো চন্দ্রকুমার।

             চন্দ্রকুমার বলল,  এই দেখুন স্যার, এতে কী লিখসে, লিখসে, হাতিখেদা বিদ্রোহ কী?

             প্রশ্নোত্তর?

             জ্বি, এই লিখেসে, মৈমনসিঙের  টঙ্ক আন্দোলন কী?

             বাহ, আমার দরকার।

             জ্বি, এই লিখেসে, মণি  সিং কে?

             তখন আয়না বিবি বলল, কুমুদিনী হাজং আর রাশিমণি, কলাবতী?

             আছে, সব আছে।

             আয়না বিবি বলল, আমারে কিতাবটা দাও না দাদা, আমি পড়ব।

             তুমি তো ইসলামী কিতাব পড়বে বলে কিনলে।

             আমি এইডাও পড়ব দাদা, আমার খুব জানতি ইচ্ছে হয়। আয়না বিবি বলল, আমি কিসুই জানিনে।

             তোমার ভাই যদি না বলে?

             লুকোয় রাখব, কিন্তু আমার জানা হয়ে যাবে তো, একবার পড়লিই মাথায় ঢুকি যাবে, ভোলব না।” 

নেত্রকোণায়  অধ্যাপক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীন সরকার এবং মতীন্দ্র সরকারের বাড়িই ছিল উদ্দেশ্য। অসম্ভব ঠাণ্ডা। যত যাই উত্তরে ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিলাম ট্রেনের ভিতরেই।  শেষ রাতে, রাত ৪টে নাগাদ, প্রবল শীতে যখন নেত্রকোণা  পৌঁছই তাপমাত্রা ছিল ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশেপাশে।  অন্ধকারে স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক  মতীন্দ্র সরকার এবং অধ্যাপক বিধান মিত্র। এই আতিথেয়তার কথা ভুলব না। যতীন্দ্র সরকার মশায়ের বয়স সত্তরের উপরে। আমাদের জন্য অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে।

আমি স্টেশনে পা দিয়েই জিজ্ঞেস করেছিলাম, গারো পাহাড় দেখব সকালেই। দেখা যায় নিশ্চয়। এখন কি ঐ পাহাড়ের উপর তুষারপাত হয়েছে?

মতীন্দ্র সরকার বললেন, গারো পাহাড় তো নেত্রকোণা থেকে দেখা যায় না। 

সে কী, আমি তো কল্পনা করেছিলাম নেত্রকোণা  থেকে দেখা যায়, আমার মা বলেছিলেন।

হা হা করে হাসলেন মতীন্দ্র। এই কথা শুনে আরো হেসেছিলেন ৮০ বছরের  যতীন সরকার। তাঁর হাসি যে শুনেছে সে ভুলবে না। প্রাণময় মানুষ। গারো পাহাড় বাল্যকাল থেকে আমার স্মৃতিতে আছে যেন। মা শোনাতেন সেই পাহাড়ের  কথা। তখন দেখা যেত, এখন যায় না কেন? পাহাড় কি পিছিয়ে গেছে। উপন্যাসের সূত্র এল। আমার মা যখন বলেছেন,  তাহলে নিশ্চয় দেখা যেত নেত্রকোণা  কিংবা ময়মনসিংহ থেকে। এখন যায় না। হ্যাঁরে মতিন, তাই? হা হা করে আমার কথা শুনে হেসেছিলেন যতীন। হ্যাঁ, দাদা, আগে কি দেখা যেত নেত্রকোণা  থেকে?  

মতীন্দ্র সরকার মশায় এর পরের  সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ১৬ তারিখ দুপুরে নেত্রকোণা শহরটি দেখি কবি শিমুল মিলকীর সঙ্গে। বহু প্রাচীন এক জনপদ। শহরের ভিতর দিয়ে শীর্ণ হয়ে আসা মগরা নদী বয়ে যাচ্ছে, কিংবা থমকে আছে। শহরের কলেজটিতে যাই। যাই সেই নাগরাইয়ের মাঠে, যেখানে ১৯৪৫-সালের জানুয়ারি মাসে অবিভক্ত ভারতের  কৃষক সভার শেষ  সম্মেলন হয়েছিল। সেই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ কবি  সুভাষ মুখোপাধ্যায়। আমার এই উপাখ্যানে তাঁরা আছেন। এখানে না এলে কি জানতাম ভালো করে? সেই সময় নাগরাই মাঠে ইসলামিক জলসার আয়োজন হচ্ছে। কোন হুজুর আসবেন। ইসলাম নিয়ে গরম গরম বক্তৃতা দেবেন। তাতে সংখ্যা লঘু ভীত হবে, যার বিপরীত আরম্ভ হয়েছে আমাদের এই দেশেও। এদেশ আর ওদেশে তফাৎ নেই। 

আমি কলকাতায় বসে এতদিন কিছু কাজ করেছিলাম। ময়মনসিংহ এবং সুসঙ্গ দুর্গাপুরের ইতিহাস যতটা জানা যায়, জেনে ছিলাম। বাকিটার কথা যতীন ও মতীন্দ্র সরকার, দুই ভাই  বললেন। সেই প্রবল শীতের ভিতরে,  একটি সি এন জি ভাড়া করে চললাম সুসঙ্গ দুর্গাপুর। সেদিন ছিল মেঘলা আর কুয়াশায় ভরা। যাত্রাপথ সুগম ছিল না। যাওয়ার পথে কংস নদী পার হলাম। সবই ছিল অফুরান বিস্ময়ে ভরা। সারাদিন  সুসঙ্গ দুর্গাপুর ঘুরেছি। একদম ভরাট হয়ে যাওয়া কমলা সায়র দেখেছি। হ্যাঁ, সেই সায়র কল্পিত নয়, কাহিনি কল্পিত হতে পারে। 

সোমেশ্বরী নদী দেখেছি। ঐ নদীর আসল নাম সিমসাং নদী। সুসঙ্গ দুর্গাপুরের রাজা সোমেশ্বর পাঠকের নামে নদীর নাম বদল হয়ে গিয়েছিল। ৭০০ বছর আগে  সোমেশ্বর পাঠক গারো রাজাকে পরাস্ত করে এখানে তাঁর রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন বণিক। এসেছিলেন কামরূপ কামাখ্যায় তীর্থ করতে। সঙ্গে নিশ্চয় সেনাদল ছিল, নাহলে জয় করবেন কীভাবে? এই দেশ ছিল গারো উপজাতির দেশ। কয়েক পুরুষ বাদে   সিংহ উপাধি তাঁরা মোগল সম্রাট আকবরের কাছ থেকে পান। রাজাদের আয়ের উৎস ছিল হাতি বিক্রয়। হাতি ধরার জন্য তাঁরা পাহাড়িয়া হাজং উপজাতিদের ডেকে এনে পাহাড়তলিতে বসত করান। তারপর তো বিদ্রোহ।   গারো পাহাড়  মাইল কয়েক দূরে হবে সুসঙ্গ দুর্গাপুর থেকে। পুরোন রাজবাড়ি দেখেছি। রোদে পিঠ দিয়ে সুস্থিরচন্দ্র মল্লিকের সঙ্গে গল্প করেছি। মনে হয়েছে সকলেই কবি। বিরিসিরি মিউজিয়ম দেখেছি। ফিরেছিলাম সন্ধ্যার আগে। একটি বই দিলেন যতীন স্যার, টঙ্ক আন্দোলনের ইতিহাস। আমার দরকার ছিল। শিশির রাজনের বইটি ৬০ পাতার পুস্তিকা। তার ভিতরে নানা বইয়ের সূত্র ছিল। ধীরে ধীরে  বুঝতে পারছিলাম কী লিখব। গীতি কাহিনির বাইরে যে ময়মনসিংহ তাকে জুড়ে দেব ময়মনসিংহ গীতিকার সঙ্গে। কৃষক আন্দোলন, তার আগে উনিশ শতকের হাতিখেদা আন্দোলন, তার আগে পাগলপন্থী আন্দোলন, কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ, ললিত সরকার, জেলা শাসক ব্যাস্টিন…। লিখব তো। ফিরে এসে কলম সরাতে পারি না। হচ্ছে না। যাওয়া যেন ব্যর্থ হয়ে গেল। এই অবস্থায়  মার্চের শেষে  আমেরিকা গেলাম কথামালার অনুষ্ঠানে। মিশিগানে তখন  তুষারপাত হচ্ছে। বিশ্বদীপ চক্রবর্তীর বাড়ির পেছনটা তুষারে ছেয়ে আছে। অনেক বাড়ির সমুখে তুষার জমাট হয়ে আছে। মনে হচ্ছিল শ্বেত গোধিকা পড়ে আছে অনন্ত ঘুমে।  মিশিগান থেকে শারলট সিটি ৭৫০ মাইল। সড়ক পথে দুদিন ধরে  গিয়েছিলাম ওই পথ। আশ্চর্য ছিল সেই যাত্রা। প্রবল শীত,নিষ্পত্র বৃক্ষেরা তুষারে ছেয়ে আছে। রবার্ট ফ্রস্টের একটি কবিতা আছে এই প্রকৃতি নিয়ে। পাহাড় প্রকৃতির সেই অনন্য রূপ ৫০০ মাইল জুড়ে। দেখলাম  ব্লু রিজ মাউন্টেনের কুয়াশা আবৃত পথ, ফগি এরিয়া। হাই উইন্ড এরিয়া।  আশ্চর্য নিঝুম প্রকৃতি আমার মাথার ভিতরে প্রবেশ করল। আমেরিকা থেকে  ফিরে এলাম মে-মাসে। ময়মনসিংহের নতুন আখ্যান, লুক্কায়িত ইতিহাস  লিখতে বসলাম। চোখের সামনে রয়েছে কুয়াশায় ঢাকা এক জনপদ, সুসঙ্গ দুর্গাপুর আর ব্লু রিজ মাউন্টেনের সেই পথ। ব্লু রিজ মাউন্টেন হয়ে গেল গারো পাহাড়। কুয়াশার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল ইতিহাসের প্রায় অজ্ঞাত অধ্যায়। হাতির পায়ের তলায় মনা সর্দারের মরণ, টঙ্কের নিগড়ে হাজং কৃষকদের বেঁধে ফেলা, তারপর সেই নিগড় ভাঙার কাহিনি…।

ময়মনসিংহ গীতিকার বাইরে এও এক পরণকথা হয়ে এল আমার কাছে। আমি সেই কুয়াশা আর মেঘাবৃত দিনটির কথা স্মরণ করি। প্রকৃতিই যেন লিখিয়ে নিয়েছে আমাকে। যখনই লিখতে বসেছি, কুয়াশা আর কুয়াশা, কুয়াশার ভিতর থেকে মুখ বের করছে প্রকৃতি, আমার উপন্যাসে কুয়াশাই এক চরিত্র হয়ে উঠেছে।  মাথা নত করি ইতিহাসের কাছে, গারো পাহাড়ের কাছে, আর এই মহাপৃথিবীর কাছে। পরস্পরে সংযুক্ত তিন পর্ব এই উপন্যাসে, পাতাল আঁধার বৃত্তান্ত, আয়না বিবির উপাখ্যান ও বুনো হাঁসের উড়াল। একত্রে “মোমেনশাহী  উপাখ্যান”।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত