| 29 মার্চ 2024
Categories
সাক্ষাৎকার

সাক্ষাৎকার: ডাকাত মানেই খারাপ | শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

অনিমেষবৈশ্য: আপনার ডাকাতের অম্বল হয়…

শীর্ষেন্দুমুখোপাধ্যায়: হা হা হা। তাই নাকি? এমন লিখেছিলাম নাকি? তা হয়তো হবে। আজকাল মনে থাকে না।

হ্যাঁ লিখেছেন তো। আপনার মুশকো চেহারার পালোয়ান ডাকাত যেমন আছে, তেমনি দরকচা মারা সিড়িঙ্গে চেহারার ডাকাতও আছে। আবার এই ডাকাতের সঙ্গে যাঁর লড়াই করার কথা, সেই দারোগাবাবুর কাঁঠাল খেয়ে পেট ছেড়েছে। এই বিচিত্র মানুষদের আপনি পেলেন কোথায়?

পাইনি কোথাও। মনের মধ্যেই ঘাপটি
মেরে ছিল।

দেখেননি কোনও দিন?

দেখব না কেন? জীবনে তো কম ঘুরিনি। আমার সমসাময়িকদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে বেশি ঘুরেছি। ঠাকুরের কাজে বহু জায়গায় গেছি। যাদের সঙ্গে ঘুরেছি তারা সাহিত্য-টাহিত্য অত বোঝে না। আমার লেখা খুব বেশি পড়েওনি। জানে, আমি লিখিটিখি। এই যা।

হেঁটে ঘুরেছেন?

হেঁটে। যাকে বলে পদাতিক। কোথায় না কোথায় গেছি। সে কথায় পরে আসছি। ডাকাত আমি আমি আশেপাশেই দেখেছি। হয়তো পাশের বাড়িতেই আছে। হয়তো দূরে। জানি যে, এ ব্যাটা ডাকাত। এই যে রাম চ্যাটার্জি…

হুগলির রাম চ্যাটার্জি?

হ্যাঁ। তিনিও তো ….। যাক গে। তবে আমার দেশের বাড়িতে একবার ডাকাতি হয়েছে।

মানে বাংলাদেশে?

বিক্রমপুরে। যদিও আমার জন্ম ময়মনসিংহে। আমি বিক্রমপুরে যাইনি। ছিলামও না ডাকাতির দিন। তবে শুনেছি।

কী শুনলেন?

শুনলাম যে ডাকাত পড়েছিল। কেন পড়েছিল জানি না। ডাকাতের কাণ্ডজ্ঞানের অভাব আর কী! আমরা মোটেই পয়সাওয়ালা পরিবার নই। আমাদের ছিল শিক্ষাদীক্ষার পরিবার। মাস্টারি-টাস্টারি করতেন সব। দাদু ছিলেন মোক্তার।

বিক্রমপুরে শিক্ষার খুব চল ছিল।

তা ছিল। মাটি থেকে আয় ছিল না তো। মানে ওই এলাকায় চাষবাস খুব হত না। তাই লেখাপড়া না-করে উপায়ও ছিল না। তো আমাদের বাড়ি ছিল রং চয়েস। ডাকাতরা বিশেষ কিছু পায়নি। খুদকুঁড়ো নিয়ে গেছে। আর হয়তো কিছু গয়নাগাঁটি। নগদ টাকা তখন লোকের হাতে খুব একটা ছিল না।

মারধর করেনি?

না, তা করেনি। খুবই ফ্রেন্ডলি। পিসিমা ছিলেন বাড়িতে। তিনি বলেছিলেন, যা পারো নিয়ে যাও। মেরো না বাবা। তা ডাকাতরা পিসিমার কথা শুনেছিলেন। তবে আমি কোনও দিন ডাকাতি দেখিনি। যাকে বলে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, তা
আমার নেই।

আপনার এক শ্রদ্ধাস্পদ ডাকাত-চরিত্র ছিল রাখালহরি গড়াই। তার ভাইপো ছিল খাঁদু গড়াই। সে বেচারা সাতে-পাঁচে নেই। তাকে কেউ বাসি চা আর খান দুই রুটিও দেয় না। সে একদিন আক্ষেপ করে বলছে, আজ যদি আমার খুড়োমশাই রাম দা বাগিয়ে এসে দাঁড়াতেন, তা হলে দেখতেন, খাতির কাকে বলে। এতক্ষণে গরম গরম ফুলকো লুচি আর মোহনভোগ, সঙ্গে রসগোল্লা-পান্তুয়ার গাদি লেগে যেত। হা হা হা।

ডাকাতে মোহনভোগ আর পান্তুয়া খাচ্ছে। সঙ্গে গরম লুচি। শীর্ষেন্দু ছাড়া কে-ই বা ভাববেন এমন?

আসলে কী জানো, ডাকাতের চরিত্র কল্পনা করা খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়। আর আমি কল্পনা করিও না। যা মনে আসে লিখি।

ওই যে নামগুলো— টেকো টগরকুমার, চাক্কু চপল, বাঘা বগলা— এগুলো কি ডাকাতের নাম? কোথায় রঘু ডাকাত আর কোথায় বগলা! এই নামগুলো কি আগেই ভেবে রাখেন? নাকি…

না, না। আগে আমি কিছুই ভাবি না। কোনও স্কিম করে আমি লিখি না। নামগুলো লেখার সময় কলমের ডগায় এসে যায়। প্রচুর লোক আমি দেখেছি। নানা ঘাটের জল খেয়েছি। এই সব লোক আমার মনের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকে। কাউকে হয়তো কাটিহারে দেখেছি, কাউকে বা কাছাড়ে, কারও বাড়ি হয়তো ময়মনসিংহ বা সুন্দরবন। কম তো ঘুরিনি। লিখতে গেলে আমাকে বিশেষ কসরত করতে হয় না।

বিপুল অভিজ্ঞতা।

তা বলতে পারো। তবে আমি ঘুরেছি খুব সাধারণ ভাবে। লোকলস্কর নিয়ে গেস্ট হাউসে উঠলাম। প্রচুর খানাপিনা। বিডিও এলেন। এসডিও এলেন। না, এসব আমার ধাতে নেই। আমি হেঁটে ঘুরেছি। সুন্দরবনে নৌকা থেকে নেমে চটি হাতে নিয়ে হেঁটেছি। জোয়ারের জল নেমে গেলে চারদিকে শুধু কাদা আর কাদা। তখন চটি পরে হাঁটা যায় না। কাদায় চটি গেঁথে যায়। সঙ্গী কেউ বললেন হয়তো এই তো পনেরো মিনিটের পথ। পরে দেখা গেল সেটা আড়াই ঘণ্টার রাস্তা। এ সব পথচলা আমার খুব কাজে লেগেছে।

ডাকাতের চরিত্র লিখতে…

শুধু ডাকাত নয়। যে কোনও চরিত্র। গ্রামের মানুষ কেমন হয়, কেমন কথা বলে…। আমি তো গ্রামেই থেকেছি বহুকাল। আজকাল তো কলকাতার লোকেরা গরুও চোখে দেখতে পায় না। গরু দেখতে হলে ট্রেনের টিকিট কাটতে হয়। আমার ছোটদের লেখার চরিত্ররা গাঁয়ে-গঞ্জে থাকে। আমি তাদের খুব ভাল চিনি। আর ডাকাতের চরিত্র লেখা খুব কঠিন কাজ নয়। সমরেশদা আমাকে এক বার ডাকাতের গল্প শুনিয়েছিলেন।

সমরেশ বসু?

হ্যাঁ। তিনি একবার এক বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নীচের তলায়। হঠাৎ রাতে শোনেন, হা রে রে রে আওয়াজ। তিনি এই আওয়াজের কথা আগে বইয়ে পড়েছেন। শোনেননি কোনওদিন। ইট ওয়াজ সাচ এ সাউন্ড…মানে ওই ধ্বনিতে এমন কিছু ছিল যেন বাড়িটা কাঁপছে। সবাই স্থবির। বাকশক্তিরহিত। ওই ডাকাতরা মরদ ছিল। ওরা আমাদের মতোই মানুষ। কেউ হয়তো খিদের জ্বালায় ডাকাত হয়েছে। কেউ বা রক্তের দোষে। মানে বাপ-ঠাকুর্দাও ডাকাত ছিল আর কী!

আপনি কোনওদিন এমন ডাকাত দেখেননি?

না আমি দেখিনি। একবার ট্রেনের কামরায় এক ব্যাটাকে ভোজলি চালাতে দেখেছিলাম। আমি তখন বালিতে থাকি। বালি থেকে রোজ ট্রেনে হাওড়া আসতাম। মাস্টারি করি তখন। তা একদিন ফেরার পথে দেখি ভিড় কামরায় একজন হিন্দিতে কথা বলছে আর ভোজালি চালাচ্ছে। কেউ তেমন গুরুতর জখম হয়নি। হয়তো কারও কোনও কথায় ওর আঁতে লেগেছে। তাই ভোজালি চালিয়ে দিয়েছে।

আপনার প্রহ্লাদ ডাকাতকে নিয়ে তো আবার যাত্রাপালা লেখা হয়…

মনে আছে তোমার?

হ্যাঁ, সেই যে প্রহ্লাদকে নিয়ে পালা লিখল হরিহর নিয়োগী। বিষ্টুপুরে ডবল শো। দুটো শো-ই হাউসফুল। আর সেই পালা দেখে হাপুস নয়নে কাঁদছে ডাকাত প্ৰহ্লাদ। এতে তো একেবারে শীর্ষেন্দুর সিগনেচার।

হা হা হা। আসলে কোনও মানুষই পুরোপুরি খারাপ হয় না।

আপনার লেখায় তো খারাপ মানুষই নেই। ঠিক কিছু না কিছু ভাল খুঁজে বের করেন।

একেবারে খারাপ বলে দেগে দিতে আমার যেন কোথায় বাধে। চোর-ডাকাতের রসবোধও আছে। সেই যে ওই গল্পটা। চোর বলছে ডাকাতকে, ব্যাটা তোর কোনও আর্ট নেই। হইহই করে ডাকাতি করিস। মানুষ মারিস। কোনও সূক্ষ্ম কাজ নেই। আমাকে দেখ। লোককে না-জাগিয়ে চুপি চুপি কী করে কাজ হাসিল করি দেখ। এটা একটা আর্ট। তুই তো মাথামোটা। এ সবের বালাই নেই।

তা বটে। ডাকাতি একটু মোটা দাগের।

তবে এটা ঠিক, আগেকার দিনের ডাকাতরা কিন্তু সহজে মানুষ মারত না। বেয়াদবি করলে তবেই। খুব বেশি অস্ত্রশস্ত্রও থাকত না। মারামারি মানে হাতাহাতি। দূর থেকে গুলি চালিয়ে মাস্তানি নয়। ওতে ডাকাতের মানহানি হয়।

কিন্তু এখন তো…

এখন তো গুলি চালিয়ে দিলাম। তার পর টু হুম ইট মে কনসার্ন। যার গায়ে লাগে লাগল। হা হা।

আগের ডাকাতরা মানুষের ভালও করত। গরিবের মেয়ের বিয়ে দেওয়া, বুড়ো বরের হাত থেকে তরুণীকে বাঁচানো…

তা তো করতই। রবিনহুড… আমাদের দেবী চৌধুরানি। আহা কী লিখেছিলেন বঙ্কিম। কী লুসিড লেখা।

তখন অনেক জমিদারও ডাকাত ছিল।

তাই তো ছিল। জমিদার, রাজা-রাজড়া, বাবর, তৈমুর লং, আলেকজান্ডার দি গ্রেট… সবাই ডাকাত। কিন্তু আমরা ওঁদের ডাকাত বলি না। বলি দিগ্বিজয়ী বীর। হা হা হা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত