| 19 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

দেশভাগ, অনাদরের মাটি এবং আটটি উপন্যাস । প্রসেনজিৎ দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 6 মিনিট

‘‘এসো দেখে যাও কুটি কুটি সংসার / স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ছড়ানো বে-আব্রু সংসারে / স্বামী নেই, গেল কোথায় তলিয়ে / ভেসে এসে আজ ঠেকেছে কোথায় ও-যে / ছেঁড়া কানিটুকু কোমরজড়ানো আদুরি, ঘরের বউ / আমার বাংলা।’’ কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের অনাদরে পড়ে থাকা এ-কবিতার মতোই অনাদর পেয়েছিলেন তামাম দেশবাসী। ১৯৪৭। প্রায় ২০০ বছর শাসনের পরে ব্রিটিশরা অবশেষে ভারতীয় উপমহাদেশে ছেড়ে চলে যায়। এই প্রস্থানের আগে উপনিবেশকারীরা বালিতে একটি রেখা আঁকেন। যা দু’টি নতুন আধিপত্য তৈরি করেছিল: হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান। প্রায় দেড় কোটি মানুষ এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। যাকে ইতিহাসের বৃহত্তম মানব অভিবাসন বলা হয়ে থাকে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, এরপরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিলেন। তবুও বহু মানুষই বরাতজোরে বেঁচে যান। সেইসব মানুষ তাঁদের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন বহু আগ্রহীকেই। সেগুলো সংগ্রহ করলে সময়ের এক জীবন্ত দলিল উঠে আসে। বহু প্রকল্প শুরু করে এই দলিল সংগ্রহের কাজ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাকিস্তানের “সিটিজেন্স আর্কাইভের ওরাল হিস্টোরি প্রকল্প” (Oral History Project by the Citizens Archive of Pakistan)। তারা গল্পসংগ্রহ শুরু করে ২০০৭ সালে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের ওপর যে লেখাগুলি হয়েছিল, সেগুলিকে সংগ্রহ করে আর্কাইভ করা হয়।

ইতিবাচক বিষয় হল, এই বিভাজনকে কেন্দ্র করে কেবল ছোটোগল্পই নয়, বিভিন্ন দেশে একাধিক ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল বিভিন্ন কল্পকাহিনি এবং কথাসাহিত্য। এরমধ্যে উর্বশী বুটালিয়ার ‘দ্য আদার সাইড অফ সাইলেন্স: ভয়েজেস ফ্রম দ্য পার্টিশন অফ ইন্ডিয়া’ খুবই উল্লেখযোগ্য। এই বইটি থেকে একটি অংশ উদ্ধৃত করছি: “How do we know this event except through the ways in which it has been handed down to us: through fiction, memoirs, testimonies, through memories, individual and collective?” অর্থাৎ লেখক বলেছেন, আসলে আমাদের পক্ষে এই বিশেষ ঘটনাটি সম্পর্কে লিখিত ফিকশন, আত্মকথা, স্মৃতিকথা সেগুলি ব্যক্তিগত হতে পারে অথবা সমষ্টিগত হতে পারে, এগুলির সাহায্য ব্যতিরেকে জানার উপায় আছে কি বিশেষত যেভাবে এই ঘটনাটির বিষয়ে আমাদের হাতে তুলে ধরা হয়েছে।

অঞ্জলি ইঞ্জেটি তাঁর প্রথম উপন্যাস “দ্য পার্টেড আর্থ”-এ এগুলোই তুলে ধরেছিলেন। সেই সময়কার মানুষগুলির জীবনযাপনকে তুলে ধরেছেন লেখক। এই উপন্যাসে প্রায় ৭০ বছর, ১৯৪৭-২০১৭ অবধি অনেকগুলি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। উপন্যাসের একটি চরিত্র হল দীপা। যার বয়স ১৬। সে দিল্লিতে থাকে। আরও এক চরিত্রের নাম শান জনসন। ৪১ বছরের শান এই সময় আটলান্টায় থাকে। শান জনসন হলেন আসলে দীপারই নাতনি। কীভাবে এই দেশভাগ তাঁদেরকে প্রভাবিত করেছে, তা-ই অঞ্জলি ইঞ্জেটি তাঁর উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। উল্লেখ্য যে, এটি অতীতের কোনও ঘটনা নয়, বরং দেশের এই বিভাজন তাঁদের পরিবারকে বর্তমানেও প্রভাবিত করে তুলেছে, উপন্যাসে সে-কথাই অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ঔপন্যাসিক।

এরপরে আমরা উর্বশী বুটালিয়ার “দ্য আদার সাইড অফ সাইলেন্স”-এ ফিরব। পার্টিশনের পর যে-মানুষগুলি বেঁচেছিলেন, তাঁদের জীবন তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাসে। যেমন লাহোরের একজন শিখ রিফিউজি। তিনি পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। একমাত্র তাঁর কাকা সেখানে থেকে গিয়েছিলেন। প্রায় চল্লিশ বছর সেই কাকার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করতে পারেননি, কারণ তিনি একটা সম্পূর্ণ অন্য দেশে থাকতেন। বইটিতে আরও দেখানো হয়েছে যে, সেই সময় মহিলাদের ওপর কীভাবে নির্যাতন করা হতো। প্রায় পঁচাত্তর হাজার মহিলা সেই সময়ের ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। মতান্তরে, সংখ্যাটা এক লক্ষের কাছাকাছি। এমনও তথ্য উঠে এসেছে যে, অপহরণ, ধর্ষণ এবং ধর্মান্তরিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে পুরুষরা বাধ্য হতো তাদের পরিবারের অনেক মহিলাকেই হত্যা করে ‘শহিদ’ ঘোষণা করতে। প্রসঙ্গত, উর্বশী বুটালিয়া’র বইটির একটি উদ্ধৃতি আমরা তুলে ধরব: “Killing women was not violence, it was saving the honour of the community; losing sight of children, abandoning them to who knew what fate was not violence, it was maintaining the purity of the religion; killing people for the other religion was not murder, it was somehow excusable… seldom has a process of research I have been engaged in brought me more anger, and more anguish.” অর্থাৎ, মহিলাদের হত্যা করা নৃশংসতা নয়, এটা জাতির সম্মান রক্ষার ব্যাপার; সন্তানদের হারানো, তাদের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া নৃশংসতা নয়, এটা ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা করা; অন্য ধর্মের জন্য মানুষ মারা হত্যা নয়, এটার অজুহাত দেওয়াই যায়… এর আগে আমি এমন কোনও গবেষণায় যুক্ত ছিলাম না যার ফলে আমার এত রাগ হয়েছে, এবং রাগের থেকে বেশি ক্ষুব্ধ হয়েছি।

আসব ভাস্বতী ঘোষের “ভিকট্রি কলোনি ১৯৫০” উপন্যাসটির কথায়। এখানে তিনি পূর্ব পাকিস্তান, যা বর্তমানে বাংলাদেশ, সেখানকার দুই চরিত্রকে কলমের ডগায় ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি। তাদের নাম অমলা মান্না এবং তার ছোটো ভাই কার্তিক। দাঙ্গার সময় এক মুসলিম পরিবার তাদের রক্ষা করে। এরপর তারা কলকাতায় চলে আসে। তবে রেলস্টেশনে তারা একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যায়। অমলা রিফিউজি ক্যাম্পে তার নতুন জীবন খুঁজে পায়। কিন্তু সে যা হারিয়েছে, তা আর কোনও দিন সে খুঁজে পায়নি। অকল্পনীয় লোকসানের ভাগিদার এই অমলা।

নিসিদ হাজারি লিখেছেন “মিডনাইট ফিউরিয়াস: দ্য ডেডলি লেগেসি অফ ইন্ডিয়া’স পার্টিশন”। কীভাবে একটি দেশ ভাঙতে ভাঙতে দু’টুকরো হয়ে দু’টি আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হল, সে-কথাই লিখেছেন তিনি। জওহরলাল নেহরু এবং মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ তাঁরাও বোধহয় এই বাটোয়ারার জন্য এভাবে তৈরি ছিলেন না। তবে তাঁদের নীতিগত কিছু ত্রুটি ছিল। যে-কারণে এত বড়ো মাশুল দিতে হয়েছিল দেশকে। হাজারি একটি প্রশ্ন তুলেছেন যে, কীভাবে দু’টি দেশ এত তাড়াতাড়ি শত্রুতে পরিণত হল? তিনি বিভিন্ন নোট, চিঠিপত্র, রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতাদের ডায়েরি, অর্থনৈতিক তথ্য, বিভিন্ন প্রতিবেদন, গভর্নমেন্টাল গসিফ সহ ব্যক্তিগত চিঠিপত্রের মাধ্যমে তিনি এর জবাব দেন।

এর পর আসব আয়েশা জালালের “দ্য সিটি অফ পার্টিশন: মান্টো’স লাইফ, টাইমস অ্যান্ড ওয়ার্ক অ্যাক্রস দ্য ইন্ডিয়া-পাকিস্তান ডিভাইড”-এর কথায়। এতে সাদাত হাসান মান্টো’র জীবন নিয়ে লেখা হয়েছে। মান্টো দেশভাগ নিয়ে লেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার। এই উপমহাদেশের জীবনযাত্রায় তিনি আজও সমান প্রাসঙ্গিক। ১৯১২ সালে জন্মানো এই লেখক দেশভাগের সময় পাকিস্তান চলে গিয়েছিলেন। তিনি প্রচুর ছোটোগল্প লিখেছেন। পরবর্তীতে সেই সব ছোটোগল্প সংকলিত হয়ে ৭০০ পৃষ্ঠার এক মলাটে আসে। বইটির নাম হয় “বিটার ফ্রুট”। অন্যদিকে, জালাল এই বইটিতে বিভিন্ন চিঠিপত্র, প্রবন্ধ কিংবা গল্পের আধারে মান্টোর জীবনী তুলে ধরেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টাফসের এক পাকিস্তানি-আমেরিকান ঐতিহাসিক আয়েশা জালালকে বইটি সম্পূর্ণ করতে সাহায্য করেছিলেন। মাত্র ৪২ বছর বয়সে ইন্তেকাল করা মান্টো’র কুড়িটির বেশি ছোটোগল্প, একটি উপন্যাস এবং বেশ কয়েকটি নাটক সৃজনশীলভাবে এই বইয়ে তুলে ধরেছেন জালাল। ওই সময়কার মানুষগুলোর জীবন তছনছ হয়ে গিয়েছিল। মান্টো সেইসব মানুষেরই প্রতিনিধি। ওই সময় এক ধরনের লেখার চল ছিল। উপনিবেশিক দেশের বীভৎসতাকে ফুটিয়ে তুলে এক ধরনের আকৃতি দেওয়া হতো। মান্টো এই একপেশে রোমান্টিক সমাজ-বাস্তবতায় আটকে থাকেননি। সমাজের এক্কেবারে নীচু তলার মানুষের কথা তিনি তুলে ধরেছেন।
   অমিত মজুমদারের “পার্টিশনস” বইটিও প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য। উপন্যাসে তিনি কেশব এবং শংকর নামে ছয় বছরের দুই যমজ শিশুর কথা লিখেছেন। তারা দিল্লি থেকে ট্রেনে চড়েছিল। ট্রেনে চড়ার সময় তারা তাদের মায়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। সিমরান কৌর নামে এক শিখ কিশোরী নারী, যিনি সেই সময় তাঁর পরিবার ছেড়ে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন। তাছাড়াও ইব্রাহিম মাসুদ নামে একজন মুসলিম চিকিৎসক, তিনি সে-সময় পাকিস্তান যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। মূলত এই চারজনকে নিয়ে গড়ে উঠেছে এই উপন্যাসটি। ট্রেনে ওঠার সময় মা-হারা ওই যমজ শিশু দু’টির বাবাও মারা গিয়েছিল। তাদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে। তাছাড়াও ট্রেনে যাতায়াতকারী মানুষের ভয়ানক ভ্রমণ অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়েছে এই উপন্যাসে। অমিত মজুমদারের কৃতিত্ব এখানেই যে, তিনি কেবল তথ্য দিয়ে থেমে থাকেননি। বরং ওই মানুষগুলোর দুঃখ ও দুর্ভোগের সাক্ষী থেকে এই উপন্যাস লিখেছেন যেন।

এবার বলব এমন একটি বইয়ের কথা, যার প্রথমে নাম দেওয়া হয়েছিল “আইস ক্যান্ডি ম্যান, দ্য ক্র্যাকিং ইন্ডিয়া”। পরবর্তীতে সেই উপন্যাসের নাম কেবল “ক্র্যাকিং ইন্ডিয়া” রাখেন বাপসি সিদ্ধা। পোলিও জয় করা আট বছরের এক শিশুর কথা লিখেছেন ঔপন্যাসিক। লেনি নামে শিশুটি তার পার্সি পরিবারের সঙ্গে লাহোরে থাকত। তার চোখ দিয়েই পুরো উপন্যাসটাকে দেখানো হয়েছে। তাদের পরিবারের যে-আয়া কাজ করতেন, তাঁকে অপহরণ করা হয়। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে উদ্ভব হওয়া সমস্যাগুলো লেনি চোখের সামনে দেখেছে। সেই সমস্যাগুলো বাড়তে বাড়তে মস্ত একটা দাঙ্গায় পরিণত হয়ে গেল। তার চোখের সামনেই ধর্মীয় স্লোগানের ধুয়ো তুলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে হত্যাযজ্ঞ ঘটেছিল লেনির চোখের সামনেই। সে এক ভয়ানক বাস্তবতা। যে-শিশু ছোটো বয়সেই এসব প্রত্যক্ষ করে ফেলে, তার তো শৈশব চুরি হয়ে যায়! উপন্যাসের লেনির জীবন এমনই করুণ।
   শেষ বইটি খুশবন্ত সিং-এর “ট্রেন টু পাকিস্তান”। দেশভাগের ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল বইটি। উল্লেখ্য যে, লেখকের প্রথম উপন্যাস ছিল এটি। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একবার বলেছিলেন— “সাংবাদিক, সম্পাদক, ইতিহাস রচয়িতা যেভাবেই হোক না খুশবন্তের লেখালিখি ছিল উসকে দেওয়া গল্প কথকের মতো, যেসব লেখায় মানব পরিস্থিতিতে আলোকপাতের বিষয় তিনি কখনোই পরান্মুখ নন।” আজও সমানভাবে জনপ্রিয় বহু পুরস্কারপ্রাপ্ত “ট্রেন টু পাকিস্তান” দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নিয়ে রচনা। দেশভাগের ওপর উপন্যাসের ধারায় প্রথম ইন্দো-অ্যাংলিয়ান উপন্যাস এটি। উপন্যাসটির প্রথমে “মানো মাজরা” নামে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে এর নাম দেওয়া হয় “ট্রেন টু পাকিস্তান”। এই ‘মানো মাজরা’ হল সীমান্তবর্তী এক অনুল্লেখ্য গ্রাম। এই গ্রামে শতবর্ষ ধরে শিখ-হিন্দু-মুসলমানরা সুখে শান্তিতে দিন কাটাত। এমনকী পঞ্জাবে যখন দাঙ্গা বেঁধেছিল, সেই সময়েও এই গ্রামে সৌহার্দ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। সত্তরটি পরিবার ছিল গ্রামটিতে। এখানে লালা রামলালের পরিবারই ছিল একমাত্র হিন্দু পরিবার। বাকি পরিবার ছিল মুসলমান এবং শিখ। গ্রাম সংলগ্ন যেসব জমি ছিল, সেইসব জমির মালিক ছিল শিখেরা। আর শিখেদের জমির বর্গাদার ছিল মুসলমানরা। গ্রামে ছিল তিন ফুট উচ্চতার একটি পাথরের চাঁই, দেবতার প্রতীক। গ্রামের সকলে শ্রদ্ধাবনত ছিল এর প্রতি। গ্রামে কখনোই নিজস্ব ধর্ম পালনে কোনও বাধা ছিল না। একদিকে শতদ্রু নদী বইছে। আর এক দিকে দর্শনীয় রেলওয়ে সেতু। এর দুই প্রান্তে আবার রেললাইন বসানোর জন্য পাথরের বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কোনও ট্রেন এই গ্রামে না-থামলেও মানো মাজরার পরিচিতি রেল স্টেশনের জন্যই।

ডাকাতি, কলিযুগ, মানো মাজরা এবং কর্ম— চার ভাগে বিভক্ত উপন্যাসটির শুরু হয় গ্রামের মহাজন লালা রামলালের হত্যার ঘটনা দিয়ে। একদল ডাকাত এই ঘটনা ঘটায়। উপন্যাসে নজর কাড়ে মুসলমান অন্ধ তাঁতির মেয়ে নুরান। তার সঙ্গে না-ইনসাফি হয়েছিল। তাছাড়াও হিন্দু ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম চাঁদের গ্রামে আবির্ভাব এবং মুসলমানদের বিব্রত করার অভিসন্ধি নিয়ে বিভিন্ন ফন্দিফিকির আমাদেরকে এক ঘোরতর বাস্তবতার সামনে দাঁড় করায়। তখন ইতিমধ্যেই লালা রামলালের হত্যার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জ্যুগত নামে একজনকে। অন্যদিকে, ম্যাজিস্ট্রেট সাব ইন্সপেক্টরের কান ভাঙায়— হাজারখানেক মুসলমান শরণার্থীদের মৃতদেহ সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে না-কি প্রতিশোধ নিচ্ছে শিখরা। মুসলমানদের গ্রাম থেকে তাড়ানোর জন্য এটি ছিল ওই ম্যাজিস্ট্রেটের কুৎসিত অভিসন্ধি। তখনও গ্রামের মানুষ জানত না যে, দেশটা দু’-টুকরো হয়ে গেছে।

এভাবেই উপন্যাসের কাহিনি দানা বেঁধেছে। ততক্ষণে ‘ভুতুড়ে ট্রেন’-এর যাতায়াত শুরু হয়ে গিয়েছে; ততক্ষণে দেশভাগের ট্র্যাজেডিতে জনজীবন পক্ষাঘাতগ্রস্ত। সেনা টহল, তাদের বুটের শব্দ, ট্রেন ভর্তি লাশ আসা… এসব শান্তি ছিনিয়ে নিয়েছিল। এ সেই ট্রেন, যা ভূমিপুত্র-কন্যাদের শরণার্থী করেছিল। শরণার্থী! যাদের দায়িত্ব নিতে চায় না কেউ-ই। তবু ইমাম বক্স তার স্বজাতি মুসলমানদের গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলে বেড়াল। “সে রাতে মানো মাজরার খুব বেশি মানুষ ঘুমাল না। তারা বাড়ি বাড়ি গেল— কথা বলল, কাঁদল, ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের কসম কাটল। একে অন্যকে আশ্বস্ত করল যে, খুব শীঘ্রই সব ঝামেলা চুকে যাবে।” ঝামেলা হয়তো আজও চোকেনি।

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত