অদেখা কাশবন
আপনি কি আমার ওপর বিরক্ত? সরাসরি জানতে চায় ফারিয়া।
হুমম। ওমর বিরক্তি লুকানোর চেষ্টা করে না।
এজন্য মেসেজের উত্তর দিলেন না!
আপনি একবার একটা মেসেজ লেখেন, তারপর ঘন্টাখানেক ঘুমান। তারপর ওঠেন। আবার কিছু লেখেন। কি উত্তর দেব?
এখন আর ফেসবুকে চ্যাট করা নয়। কথা হচ্ছিল সরাসরি মোবাইলে। দোষটা ফারিয়ারই। এতক্ষণ দুই বান্ধবী তিন্নি আর নূপুরের সঙ্গে চ্যাটিংয়ে ব্যস্ত ছিল। ওদিকে ওমরকে যে মেসেজ দিয়ে রেখেছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই। খেয়াল হবার পরে ’রিপ্লাই’ পাঠালো। কিন্তু এবার ওই পক্ষ নীরব। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ফারিয়া অবশেষে ফোন করল ওমরের মোবাইলে।ফেসবুকে আমার এক ফ্রেন্ড একটা ছবি দিয়েছে। সেটা নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা তিন ফ্রেন্ড।
খুব ভালো।
সাধারণ ভদ্রতা করে ওমর জানতে চাইতে পারতো- কিসের ছবি? তার পরিবর্তে কেমন টিটকারির সুর। খুব ভালো। এটা কোন কথা হল।
আপনি জানতে চাইলেন না কিসের ছবি দেখছিলাম! ফারিয়ার কণ্ঠে উষ্মা।
কিসের ছবি?
দায়সারাভাবে বলল ওমর। ফারিয়া বুঝতে পেরেও ছবি বিষয়ক আলোচনার লাগাম টানতে পারছিল না।
কাশবনের ছবি। পাশে শান্ত নদী। তির তির করে পানি বইছে। সাদা কাশ ফুল। কি যে সুন্দর ছবিটা ভাবতেই পারবেন না।
আমার মেসেঞ্জারে পাঠান, দেখব…
আপনি কি কখনও কাশফুল দেখেছেন?
দেখব না কেন! ব্রহ্মপুত্র নদীর পাশেই আমার গ্রামের বাড়ি। এখন তো শরৎকাল। কাশফুলের মৌসুম। এ সময় তো আমরা কাশবনে সারাক্ষণ পড়ে থাকতাম।
জানেন, আমরা ফ্রেন্ডরা মিলে কি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ?
বলেন শুনি!
সবাই মিলে কাশবনে বেড়াতে যাব।
হুম।
আমি সবাইকে অফার করলাম। সবাই সাথে সাথে রাজী। কেমন হল আমাদের প্ল্যান?
দারুণ।
আপনি মনে হয় মজা করছেন!
মজা করব কেন?
কেমন টিটকারি ভাব।
আমার মনে হয়- আপনাদের কাশবনে যাওয়া হবে না।
মানে?
মানে আমি পলের মতো ভবিষ্যৎ বাণী করলাম।
পল কে?
পল দ্যা অক্টোপাস। ওই যে একটা অক্টোপাস বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় ভবিষ্যদ্বানী করেছিল। মনে নেই?
ফারিয়া এবার স্পষ্ট বুঝতে পারল, ওমর আসলে ওর ওপরে শোধ নিচ্ছে। দেরী করে মেসেজের উত্তর দেবার প্রতিশোধ। ইচ্ছে করে ফারিয়ার মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছে। আর মেজাজ খারাপ হলে ভালো কোন উত্তর মাথায় আসে না ওর।
ঠিক আছে রাখি।
বলা নেই কওয়া নেই ফোন কেটে দিল ফারিয়া। ওমরকে কিছু বলার সুযোগ দিল না।
২.
ফোন কেটে দেবার পরে নিজের ওপর লজ্জা লাগলো ফারিয়ার। এমন কেন করল ও! বলার সময় ও তো কম কথা শোনায় না! ওমর তো কখনও ফোন কেটে দেয় না।
মনে খচখচ ভাব নিয়ে ঘুমাতে গেল ফারিয়া। সকালে উঠে নিউ ইস্কাটন রোডে অফিসে ছুটতে হবে। দুই মাস হল একটা বেসরকারী ব্যাঙ্কে জুনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরী হয়েছে ওর। পড়াশুনা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে চাকরি হওয়াতে বড় বাঁচা বেঁচে গেছে।
গত বছর বাবা চলে যাবার পরে বাড়িতে নেতৃত্বের সংকট চলছে। ফারিয়া বুঝতে পারে না- এ বাড়ির প্রধান আসলে কে? মা নাকি বড় ভাইয়া? বড় ভাবীও হতে পারে। তাহলে আবার ছোট ভাই ও ভাবী বা ছাড়বে কেন? মা-ভাবীরা সারাদিন বাসায় থাকেন। দিনভর তাদের টুকটাক ঝগড়াঝাটি লেগে থাকে। এজন্য ভাইয়াদের মন বেজার।
ব্যাংকের চাকরীটা ফারিয়াকে এই সমস্যা থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কাজটা অবশ্য একঘেয়েমিপূর্ণ। জুনিয়র অফিসারের চেয়েও কম বেতন। তবে সেটা সময়মতো পাওয়া যায়। যে কারণে মাস গেলে একটা সুন্দর পরিকল্পনা করা যায়। কেনাকাটা আর বন্ধুদের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে আড্ডা তো প্রতি সপ্তাহেই আছে। ফারিয়ার বাসাতেও আসে ওর বন্ধুরা। ওর বাবার কেনা বাড়িটা দেখতে একটু পুরনো ধরনের হলেও ভিতরের জায়গা আছে প্রচুর।
তবে ঢাকার বাইরে কখনও যাওয়া হয়নি। বাবা-মায়েরা অনেকটা ফার্মের মুরগীর মতো বড় করেছে ওদের। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আর বেসরকারী ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে। গাড়ি ছাড়া কোথাও যায়নি। যে কারণে ওমর যখন ওর জীবনের লড়াইয়ের কথা বলে ফারিয়ার খুব অবাক লাগে। এমন কখনও হয় নাকি!
ঢাকার বাইরে কাশবন দেখতে যাবার পরিকল্পনা আদতে বাস্তবায়িত হওয়ার সুযোগ খুব কম। বাসায় কাউকে না বলে যাওয়া যায়। কিন্তু পরে সমস্যা হলে, তখন কিভাবে সামাল দেবে! কিন্তু ওমরের মতো সাদামাটা একটা লোকও সেটা বুঝে ফেলল!
ঘুমানোর আগে লম্বা একটা গেঞ্জি আর ঢোলা প্যান্ট পরে ফারিয়া। এটা ওর রাতের পোশাক। তারপর ড্রেসিং টেবিলে বসে শক্ত করে চুল বেধে মুখে ক্রিম লাগায়।
ঘুমিয়ে পড়ার আগে মনে মনে শপথ করে। যেভাবে হোক এবার কাশবনে যেতেই হবে।
৩.
পরদিন অফিসে গিয়ে লাঞ্চের সময় তিন্নিকে ফোন করে ফারিয়া। ‘জরুরী কথা আছে চল কোথাও বসি।’
ফারিয়ার অফিসের কাছে এক কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেয় তিন্নি। ক্লাসমেটরা সবাই হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে। সবাই ঈর্ষা করে ফারিয়াকে। এমনিতে ও দেখতে খুব সুন্দর। ব্যাংকের ক্লায়েন্টরা আড়চোখে দেখে ওকে। টের পায় ফারিয়া।
ফারিয়া যে ব্যাংকে কাজ করে ওমর শরীফ তার মাঝারি সারির ক্লায়েন্ট। ব্যবসার কাজে লেনদেনের জন্য প্রায় সময় ওদের ব্যাংকে আসে। আজকেও এসেছিল। তবে দূরে দূরে ছিল। ফারিয়া ওভাবে হঠাৎ করে ফোন কেটে দেওয়াতে রাগ করেছে হয়ত।
আমাকে আগে বল ওমর কে? নূপুর এমন জোরে কথা বলে ওঠে যে আশেপাশের অনেকে ফিরে তাকায়।
কাজ শেষ করার পরে তিন বন্ধু মিলে পাশে একটা ফ্রাইড চিকেনের দোকানে বসেছে। জায়গাটা ছোট। কেউ জোরে কথা বললে অন্যরা শুনতে পায়।
আস্তে কথা বল নূপুর। লোকজন শুনতে পারছে। ফারিয়ার কণ্ঠে সংকোচ।
লোকজনের কথায় কি এসে যায় ফারিয়া! বল বল ওমর কে? হাত ঘুরিয়ে নাটকীয় কায়দায় বলে ওঠে তিন্নি।
ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ার থেকে বন্ধুত্ব তিনজনের। দিনের চব্বিশ ঘন্টা কথা বললেও কথা শেষ হতে চায় না ওদের।
ওমর ভাই আমাদের ব্যাঙ্কের একজন ক্লায়েন্ট। ওনার এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যবসা আছে। অনেকদিন দুবাই ছিলেন। ওখানে একটা তেলের কোম্পানীতে চাকরী করতেন। দেশে ফেরার পরে ব্যবসা শুরু করেছেন। বাংলা মটরে একটা মটর পার্টসের দোকানে যৌথ মালিক তিনি। প্রায় প্রতিদিনই আমাদের ব্যাঙ্কে আসেন। আজকেও এসেছিলেন। আমার ডেস্কে ওনার প্রায়ই কাজ থাকে।
কাজ থাকে ভালো কথা। কিন্তু দুজনের বন্ধুত্ব হল কিভাবে? নূপুর প্রশ্ন করে।
এটা কোন প্রশ্ন হল! ভদ্রলোক মাঝে মাঝে আমার মোবাইলে কাজের প্রয়োজনে ফোন করতেন। তারপর ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেন। তারপর মেসেঞ্জারে চ্যাটও হয়।
কি কথা হয় বল না! তিন্নি ওর কপালের চুল ঠিক করতে করতে বলে।
তেমন কিছু না! এই যে দেশের অবস্থা, অফিসের কথা- এসব। তোরা যা ভাবছিস, তেমন কিছু না।
আমরা কি ভাবছি তুই কিভাবে জানলি রে! তিন্নি এবার রহস্যময় ভঙ্গীতে বলে।
দেখ তোরা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। এখানে ভনিতার কিছু নাই। ওনার সঙ্গে আমার বিশেষ কোন সম্পর্কই নেই। তাছাড়া..
তাছাড়া কি? একই সঙ্গে জানতে চায় নূপুর ও তিন্নি।
ভদ্রলোক স্মার্ট আর হ্যান্ডসাম আছেন ঠিকই, তবে মানসিকতায় আমাদের মতো না। মফস্বলের কলেজে পড়াশুনা শেষ করেছেন।
রেস্টুরেন্টে অনেক লোক ঢুকছে। তিনজন সুশ্রী মেয়েকে বসে থাকতে দেখে অনেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। ফারিয়া উঠেগিয়ে চিলি সস নিয়ে আসে। আসার সময় এক তরুণের সঙ্গে সামান্য ধাক্কা খায়। টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর বন্ধুরা সেটা খেয়াল করেছে। ফারিয়ার সত্যি খুব বিরক্ত লাগে ওদের বন্ধুদের রহস্যময় হাসিতে।
ওমর সাহেবের যখন কাছেই মটর পার্টসের দোকান, তাহলে তাকে একদিন দাওয়াত কর না এখানে! নুপুর প্রস্তাব দেয়। ওর কথায় তিন্নি মাথা দুলিয়ে সমর্থন জানায়।
দেখ, দাওয়াত করে বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার মতো কেউ নন তিনি। উনি গ্রামের স্কুলে পড়ে বড় হয়েছেন। ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে তিন মাইল হেঁটে স্কুলে যেতেন। এমন একটা লোককে দাওয়াত দেবার কি আছে!
সসের প্যাকেট খুলতে খুলতে বলে সাদিয়া।
যদি লোকটা তেমন কেউ নাই হবে। তবে গত রাতে ফোন কেটে দেবার পরে এত কেন ভাবছিস ? তিন্নি প্রম্ন করে।
ভাবছি, কারণ লোকটা আমাকে অপমান করেছে। সে বলেছে- আমার নাকি কখনই কাশবন দেখতে যাওযা হবে না।
ফারিয়া লক্ষ্য করল ওর মনে সেই তিক্ত অনুভূতি আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে।
তাহলে তুই একটা কাজ কর না, ওমরকে বল তোর সঙ্গে কাশবন দেখতে যেতে!
তিন্নির প্রস্তাবে ফারিয়ার মুখে কয়েক মুহূর্ত কথা সরে না।
৪.
ওমর কখনই বিকালে ঘুমায় না। আজ কিভাবে যেন ঘুমিয়ে পড়ল। দুপুরে রোদের মধ্যে বাইরে ঘোরাঘুরি করে খুব মাথা ধরেছিল। বাসায় এসে দুটি মাথা ধরা ছাড়ার ওষুধ খেয়েছিল। তার প্রভাবে ঘুমিয়ে পড়েছে কিনা বুঝতে পারছে না।
মাথার ভার ভার ভাব দূর করার জন্য সময় নিয়ে গোসল করল। গোসলের পরে শরীরটা ফুরফুরে লাগলেও মনটা আগের মতোই তিক্ত। করোনা মহামারীর কারণে ব্যবসাপাতি কিছুই নেই। ঢাকার বাইরে থেকে মালের যোগান আগের মতো আসছে না। ফ্লাইট সমস্যার কারণে বাইরের দেশেও পাঠানো সমস্যা। বাংলামটরে মটর পার্টসের দোকানেরও একই অবস্থা। বেশীরভাগ দিন দোকান বন্ধ থাকে।
বাসার গৃহকর্মী ফজলু এসে চা রেখে গেছে। চুমুক দিতে গিয়ে দেখে ঠান্ডা। চা ঠান্ডা খাওয়ার কোন মানে হয় না। কাপ নামিয়ে রাখতে গিয়ে ছলকে উঠে সামান্য চা গিয়ে পড়ে ওর টিশার্টে। বিরক্তির একশেষ। এখন আবার টিশার্ট পাল্টাতে হবে।
ফজলুকে আরেক কাপ চা দিতে বলে টিশার্ট পাল্টে দোতলার ব্যালকনীতে এসে দাঁড়ায় ওমর। উঠানে ছোট্ট এক সবজির বাগান আছে। মা সেখানে আরো চারা লাগাচ্ছেন।
মোহাম্মদপুরের আদাবরের এই জায়গাটা বাবা কিনেছিলেন। কিন্তু বাড়ি করে যেতে পারেননি। ওমর দুবাই থেকে ফেরার পরে এখানে দোতলা বিল্ডিং তুলেছে। দোতলায় মা আর ভাইকে নিয়ে থাকে। নীচতলা এক কোচিং সেন্টারকে ভাড়া দিয়েছে। করোনা মহামারীতে এখন সেটাও বন্ধ।
ওমর বারান্দা দিয়ে ফজলুকে ডাকে। মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে ও। ফজলুকে এ বাসার গৃহকর্মী বলা যাবে না। দুই ছেলের অতি ব্যস্ততার কারণে ওই এখন মায়ের সার্বক্ষনিক সঙ্গী। ফজলুকে সিগারেট কিনতে পাঠিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে মোবাইল বাজছে। ফারিয়ার ফোন। ওমর ধরেনা।
একটু টেনশনে থাকুক মেয়েটা। ফারিয়ার ওপর রাগ করেনি ওমর। এত দ্রুত কারো ওপর রাগ করার মতো আবেগপ্রবণ ছেলে নয় ও।
ফজলু সিগারেট নিয়ে এলে ধরিয়ে আয়েশ করে টান দেয়। নিজের ঘরে শুয়ে জানালা দিয়ে আকাশ দেখে। বৃষ্টি হবে নাকি? কেমন যেন গুমোট ভাব।
ফোন না ধরাতে ফারিয়া ভাবতে পারে ওমর রাগ করেছে। নাহ সেটা হতে দেয়া যাবে না। রাগ করা মানে এক ধরনের পরাজয়। তাছাড়া ফারিয়ার মতো সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে রাগ করে সম্পর্ক নষ্ট করার কোন মানে নেই। ফারিয়াকে ফোন করার জন্য ওমর মোবাইল হাতে নেয়। নেবার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ সেটা আবার বেজে ওঠে। চমকে উঠে হাত থেকে মোবাইলটা বিছানায় ফেলে দেয় ওমর। এভাবে চমকে যাবার কারণ বুঝতে না পারে না ও।
হ্যালো। গম্ভীর গলায় বলে ওমর।
হ্যালো। কি ব্যাপার ফোন করলাম। ধরলেন না যে!
ফারিয়ার কথায় বিরক্ত হয় ওমর। ও কি সারাদিন মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকে নাকি!
কি ব্যাপার কিছু বলছেন না! আমার ওমর রাগ করেছেন?
এবার কথাগুলো খুব ধীরে ধীরে ধরে ধরে বলে ফারিয়া।
রাগ করার মতো বিলাসিতা আমার জীবনে নেই। ওমর বলে।
ও আচ্ছা, আপনার তো সংগ্রামের জীবন।
সংগ্রাম তো আপনিও করেন। ব্যাঙ্কে চাকরী করেন। এখন এমবিএ তে ভর্তি হতে চাইছেন। তবু তো আপনি রাগ করেন। কারণ বিষয়টা আপনাকে মানায়।
ফারিয়ার মনে হয়, ওমর কোন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। যে কারণে তার মনটা খুব বিষন্ন। ফারিয়া কি ওমরের মন ভালো করার চেষ্টা করবে?
হ্যালো কথা বলছেন না কেন? লাইনে আছেন তো ? ওমর প্রশ্ন করে।
হুম। অপরপ্রান্ত থেকে নিজের উপস্থিতির জানান দেয় ফারিয়া।
আমি ভাবলাম সেদিনের মতো লাইন কেটে দিয়েছেন।
আপনি তো সেটা ভাববেনই। কিন্তু মিষ্টার অক্টোপাস পল, আপনার সব ভাবনাই মিলবে না। ফারিয়া উত্তর দেয়।
তাহলে তো উল্টাপাল্টা কিছু বলতে হবে। যাতে তার বিপরীত কিছু ঘটে।
শুনুন আপনি তো বলেছিলেন, আমার কোনদিন কাশবন দেখতে যাওয়া হবে না। আমি কিন্তু আপনার ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যা করে যাচ্ছি কাশবন দেখতে।
তাই? দারুণ তো! দেখলেন আমার দেয়া ভবিষ্যৎবাণী খন্ডন করার জন্য আপনি কি রকম বিপ্লবী হয়ে গেলেন। ওমরের কণ্ঠে হাসি।
কার সঙ্গে কাশবন দেখতে যাচ্ছি, জানেন?
কার সঙ্গে?
হুম… আরেকদিন বলব। এবার ফারিয়া বেশ জমিয়ে বলে।
আরেকদিন কেন? আজ বলতে সমস্যা কি! নাকি কার সঙ্গে যাবেন এখনও ঠিক করে উঠতে পারেননি। ওমর হো হো করে হাসতে হাসতে বলে।
অন্য সময় হলে এভাবে ওমরের মজা নেয়াতে রেগে যেত ফারিয়া। আজ হল না। বরং উল্টো প্রশ্ন করল ও।
আপনি কখনও বিশেষ কারো সঙ্গে কাশবন দেখতে গিয়েছেন?
আরেকদিন বলব। ওমর উত্তর দেয়।
আপনি আমাকে নকল করছেন কেন? ব্যাপার কি!
হঠাৎ ওমর দেখতে পায় ঘরের দরজায় মা দাঁড়িয়ে আছে। মাগরেবের আজান দিচ্ছে মসজিদে। নামাজ পড়ার প্রস্তুতি না গিয়ে এভাবে ছেলের ঘরে পাহাড়া দেবার মানে কি!
শোয়া থেকে উঠে বসল ওমর। ‘ আজান দিচ্ছে। পরে কথা হবে আপনার সঙ্গে। এখন রাখি।’
অপর প্রান্ত থেকে ফারিয়া বলে, ‘বাই’।
কার সঙ্গে কথা বলছিলি? মায়ের কণ্ঠে কৌতুহল যেন উপচে পড়ছে।
এই তো এক ফ্রেন্ডের সঙ্গে। ওমর বিছানা ছেড়ে উঠে দ্রুত বাথরুমে ঢোকে। মায়ের প্রশ্ন নয়ত চলতে থাকবে।
বাসা থেকে বের হবার সময় আবার মায়ের প্রশ্নবান।
তখন কি কোন মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিলি?
মেয়েদের তো খেয়েবসে কাজ নেই যে আমার সঙ্গে কথা বলবে।
মেয়েটা কি করে ? বাসা কোথায়?
ওমর বুঝতে পারে একটা কিছু শুনতে চাইছে মা। শু র্যাক থেকে কেডস নিয়ে পায়ে ঢোকায়।
মেয়েটা নয় মা, উনি একজন ভদ্রমহিলা। ব্যাংকে চাকরী করেন। আমার ওনার ব্রাঞ্চে একাউন্ট আছে। ইমপোর্টাররা টাকা পাঠায়। তাই প্রায়ই যেতে হয়।
মেয়েটার ফ্যামিলি কেমন জানিস?
মায়ের কথা শুনে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারেনা ওমর। কেডসের ফিতা লাগাতে লাগাতে বলে, ‘জানি না মা। জানার দরকার নেই। ভদ্রমহিলা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশুনা করেছে। আমাদের মতো ছেলেদের আড়ালে বলে গাইয়া।’
৫.
সন্ধ্যার পরে বাংলা মটরের দোকানে যায় ওমর। পার্টনার মিজানের মুখ গম্ভীর। মিজান খুব ধুরন্ধর লোক। নিশ্চয়ই কিছু একটা বলার জন্য এমন ভাব ধরেছে।
ওমর কিছু বলে না। অপেক্ষা করে আছে মিজানের মুখ খোলার জন্য।
আমান ভাই এসেছিলেন। ওমরের দিকে না তাকিয়ে বলে মিজান।
কেন?
কেন আবার? চাঁদা চাইতে!
ওনার মতো টপ মাস্তানদের কি চাঁদা চাইতে নিজের আসতে হয়? ফোন করলেই তো চলে।
এবার চাঁদার অঙ্কটা আগের তুলনায় বড়।
কত টাকা?
দশ লাখ।
দশ লাখ! কি বলিস! এমনিতে করোনার কারণে বেচাকেনা নাই।
কোন উপায় নেই। আমান ভাই যখন নিজের মুখে এসে বলে গেছে তখন না দিয়ে উপায় নেই। হাতে পায়ে ধরে যদি টাকার অঙ্কটা কিছুটা কমানো যায়। তাতেই লাভ।
আমি চাঁদা দেব না। আমাদের ব্যবসায়ে কোন দুই নম্বরী নেই। চল রমনা থানায় জিডি করে আসি।
আমার তো তোর মতো মাথায় সমস্যা দেখা যায়নি। থানায় জিডি করা মানে সেধে নিজের মৃত্যু যেকে আনা। মাত্র দুই মাস হল বিয়ে করেছি। এত তাড়াতাড়ি বউকে বিধবা করার শখ নাই।
আমার একটাই কথা- চাঁদা দেব না। দরকার হলে ব্যবসা বন্ধ করে দেব।
ওমরের উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলে না মিজান। ব্যবসা বন্ধ করে দিলে চলবে কিভাবে? আবার নতুন ব্যবসা শুরু করতে হবে। সেখানেও কি চাঁদাবাজরা হামলা করবে না!
৬.
এবার শাঁখারিবাজারে দুর্গা মূর্তি দেখতে যাচ্ছি তো আমরা?
তিন্নির কথায় নূপুর মাথা নাড়ে। চা আর বিস্কিট খেতে খেতে কথা হচ্ছিল ফারিয়ার বাসার বেডরুমে।
কোভিডের কারণে এবার দুর্গাপুজা উদযাপন আগের মতো হবে কিনা কে জানে! ফারিযা চায়ে চুমুক দিয়ে মন্তব্য করে।
আমরা মাস্ক পরে যাব। নূপুর সমাধান দেয়।
এক সাথে হলে ওরা শুধু বেড়ানোর পরিকল্পনা করে। জীবনটা ওদের কাছে আনন্দময় এক উৎসবের মতো। কখনও কখনও বেদনায় সিক্ত হয় ওরা। তবে সেটা অনেক সময় ওদের নিজের জীবনের নয়।
সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর তদন্তের সর্বশেষ খবর কিরে? নূপুর জানতে চায় তিন্নির কাছে। দিন নেই রাত নেই অনলাইনে তিন্নি শুধু সুশান্ত সিংয়ের খবর পড়ে। আর অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বন্ধুদের কাছে পরিবেশন করে।
তিন্নি মুখ খোলার আগে ফারিয়ার বড় ভাবীর গৃহকর্মী মেয়েটা ট্রেতে করে তিনজনের জন্য নুডলস নিয়ে আসে। ফারিয়া রহস্যময় ভঙ্গীতে হাসে। গৃহকর্মী মেয়েটা চলে যাবার পরে ফারিয়া বলে, ‘এখন অপেক্ষা কর। দেখ ছোট ভাবী কি পাঠায়।’
তোদের বাসার পরিবেশ তো দেখি স্টারপ্লাস সিরিয়ালের মতো। তিন্নি ভ্রু কপালে তুলে মন্তব্য করে।
তিন্নির কথায় তিনজন প্রাণখুলে হাসে অনেকক্ষণ।
এই তোর না ওমর শরীফের সঙ্গে কাশবন দেখতে যাওয়ার কথা! তার কি হল? হাসি থামিয়ে হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এমন ভঙ্গীতে বলে নূপুর।
এখনও বলিনি ওনাকে। ফারিয়া উত্তর দেয়।
ওনাকে টেনশনে রাখ সমস্যা নেই। তবে কবে যাবি ঠিক করেছিস? তিন্নি জানতে চায়।
শুক্রবার যেতে পারি। নয়তো শনিবার। ফারিয়া খুব চেষ্টা করে নিজেকে নিরুত্তাপ রাখতে।
আজ দুপুরের ওর অফিসে এসেছিল ওমর। বেশীরভাগ সময় ওমর ব্যাঙ্কে আসে ফিটফাট হয়ে। আজ কেমন এলোমেলো, উস্কুখুস্কু ভাব। শ্যামলা একহারা গড়নে কেমন যেন পরাজয়ের ছাপ। মায়া লাগছিল ফারিয়ার। ওমরের অবয়বের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হল দৃঢ় ঋজু ভাব। সেটা যেন কোথাও খুঁজে পাচ্ছিল না ফারিয়া।
অন্যদিন ওমর ব্যাংকে ঢুকে প্রথমে ফারিয়াকে এসে সালাম দেয়। আজ এল সবার শেষে। হাসিটাও কেমন প্রাণহীন।
ফারিয়ার অন্যমনস্কতা বন্ধুদের চোখ এড়ায় না।
শোন, ওমর ভাইকে কাশবনে গিয়ে কিটসের ‘ওডে টু অটাম’ কবিতাটি পড়ে শোনাবি। হাউ বিউটিফুল দ্যা সিজন নাউ… হাউ ফাইন দ্যা এয়ার। নূপুর বলে মজা করে।
ওরা তিন বন্ধু নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজীতে মাস্টার্স করেছে। সময় পেলেই শেলি-কিটসের কবিতা আবৃত্তি করে।
শেলির কবিতাও শোনাতে পারিস। তিন্নি যোগ করে।
উনি তো গ্রামের স্কুলে পড়াশুনা করা মানুষ। এসব কবিতার অর্থ কি বুঝবেন তিনি! ফারিয়া উত্তর দেয়।
তাহলে বাংলা কোন কবিতা পড়ে শোনাবি। অটাম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোন কবিতা নেই? নূপুর জানতে চায়।
অনেক আছে। তবে জীবনানন্দ দাশের কবিতা বেশী। তিন্নি মন্তব্য করে। ইংরেজী সাহিত্যের পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যেরও বেশ খোঁজ খবর রাখে ও।
তিন্নির কথার মধ্যে ট্রে নিয়ে ঢোকে ছোট ভাবীর গৃহকর্মী। পায়েস রান্না করে পাঠিয়েছেন তিনি। মেয়েটা চলে যাবার পরে হাসতে হাসতে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে তিনজন।
৭.
কি হয়েছে আপনার? সারাদিন এতবার ফোন করলাম। ধরলেন না? ফারিয়া প্রশ্ন করে উদ্বিগ্ন স্বরে।
আমি মেসেজ পাঠিয়েছিলাম। পাননি? ওমর উত্তর দেয়।
হ্যাঁ পেয়েছি। রাত আটটার পরে ফোন করবেন বলেছিলেন।
এখন তো মাত্র আটটা বেজে তিন মিনিট। একটু পরেই ফোন করতাম।
ওমরের কণ্ঠটা কেমন যান্ত্রিক শোনাচ্ছে। কৌতুকের সুরে কথা বলতো বলে আগে সব সময় রাগ করতো ফারিয়া। এখন মনে হচ্ছে সেটা অনেক ভালো ছিল।
আপনি যেন কেমন হয়ে গেছেন?
কি রকম?
বুঝতে পারছি না। আপনাকে একটা জরুরী কথা বলার ছিল।
কি বলেন?
আপনি কোনদিন ফ্রি থাকেন? শুক্রবার না শনিবার?
কেন বলেন তো?
আপনি না খুব বিরক্তিকর মানুষ। শুধু প্রশ্ন করেন। আগামী শুক্রবার আপনার কোন কাজ আছে?
হ্যাঁ আছে।
শনিবার?
শনিবারও আছে।
বাব্বাহ এত কাজ! কি করবেন শুনি?
গ্রামের বাড়িতে যাব। ওমর উত্তর দেয়।
গ্রামের বাড়ি মানে ময়মনসিংহে ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর ধারে!
হ্যাঁ।
কবে আসবেন?
তিন চারদিন লাগবে। কেন?
ফারিয়া কোন উত্তর খুঁজে পায় না। কাশবনে যাবার তারিখ কি তাহলে পিছিয়ে দেবে?
গ্রামের বাড়িতে কেন যাবেন?
মা আর ভাইকে ওখানে রেখে আসব।
মানে?
আপনাকে বলা হয়নি। আমি আবার দুবাই চলে যাচ্ছি। এদেশে ব্যবসা করা আমার পোষাচ্ছে না।
দুবাই চলে যাবেন! মানে? ফারিয়ার কণ্ঠে অপার বিস্ময়।
হ্যাঁ চলে যাচ্ছি। আমি ঢাকায় থাকব না বলে আম্মা গ্রামে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এত লোক এদেশে ব্যবসা করছে না? ফারিয়ার কণ্ঠের বিস্ময়ভাব কাটছে না।
যারা করছে তাদের মতো হবার যোগ্যতা আমার নেই।
আপনাদের যে বাড়িটা সেটা কি করবেন?
ডেভলপারকে দিয়ে দেব।
তারা তো আপনার করা বাড়ি ভেঙ্গে ফেলবে।
কিছু করার নেই। বাড়ির উঠানে মা নানা রকম সবজির গাছ লাগিয়েছিলেন। সব সাফ করে ফেলবে ওরা।
ফারিয়া বুঝতে পারে এত বছর বিদেশে থাকার পরে আবার সেখানে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়া ওমরের জন্য সহজ ছিল না। কেন যে সবকিছু এভাবে ওলট পালট হয়ে গেল।
ফোনের ওপাশে ফারিয়ার নীরবতা খেয়াল করে ওমর। ফারিয়ার সঙ্গে ওর অনেক কিছু মেলে না। কিন্তু প্রকৃতি রহস্য করতে ভালোবাসে। অমিলের মধ্যে মিল করিয়ে দিতে চায় সে।
ফারিয়া কথা বলতে গিয়ে থেমে যায়। ওর মনে হয় গলা কেঁপে উঠতে পারে।
আপনার বাড়ির কাছে কাশবন আছে না? বাড়িতে গিয়ে কাশবনের সামনে আপনার একটা ছবি তুলে আমাকে পাঠাবেন। ঠিক আছে?
আপনার না কার সঙ্গে কাশবন দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। পরে তো আর তার নাম বললেন না! ওমর জানতে চায়।
ওমরের প্রশ্নের উত্তর দিতে সময় নেয় ফারিয়া। মনে হয় অনেক দূর থেকে কণ্ঠ ভেসে আসছে, এমন ভঙ্গীতে বলে-
আমি জাস্ট ফান করেছিলাম। কারো সঙ্গেই কাশবন দেখতে যাবার কথা ছিল না। আপনি ঠিক মি; পল অক্টোপাস। আমার আসলে কখনই কাশবন দেখতে যাওয়া হবে না।
লেখক ও সাংবাদিক।
জন্ম ৯ মার্চ, বরিশালের পিরোজপুরে, নানাবাড়িতে। শৈশব, কৈশোর ও তারুণ্যের পুরো সময় কেটেছে পুরনো ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। বিয়ের পরে দীর্ঘদিন থেকেছেন ঢাকার নিউ ইস্কাটন রোডে। দেশান্তরী জীবনে বাস করেছেন শুরুতে নিউইয়র্কর সিটির জ্যাকসন হাইটসে ও বর্তমানে এস্টোরিয়ায়। লেখকের লেখায় ঘুরে ফিরে এসেছে এসব স্থানের স্মৃতি। গেন্ডারিয়া মনিজা রহমান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পরে বেছে নেন ক্রীড়া সাংবাদিকতার মতো নারীদের জন্য অপ্রচলিত এক পেশা। দীর্ঘ সময় কাজ করেছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন, দৈনিক জনকণ্ঠ ও দৈনিক মানবজমিনে। নিউইয়র্কে আসার পরেও নিজেকে যুক্ত রেখেছেন লেখালেখির সঙ্গে। প্রথম আলো উত্তরের নকশার বিভাগীয় সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি শিক্ষকতা করছেন এস্টোরিয়ার একটি স্কুলে। গেন্ডারিয়া কিশলয় কচিকাঁচার আসর, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, কণ্ঠশীলন ও বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘদিন। ২০০৮ সালে প্রথম বই প্রকাশিত হবার পরে এই পর্যন্ত তাঁর বইয়ের সংখ্যা তেরটি।