গল্প: স্কুল মাস্টার মামাতো ভাই ও নানার ভিটে । মনিজা রহমান

Reading Time: 10 minutes

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,irabotir glpo anjana

`বড় আপু-ছোট আপু, তোমরা আইছ!’

স্কুল ঘরের সামনে আফসানাদের রিক্সা থামতেই হাফ শার্ট আর প্যান্ট পরা মামাতো ভাই মানিক এসে হাসিমুখে দাঁড়ায়। বোঝা যায় ও বহুক্ষণ পথের দিকে তাকিয়ে ছিল। মানিকের মুখ বোঝাই আন্তরিক হাসি, ওদের দেখে বড় বড় দাঁতগুলি সব বেরিয়ে পড়েছে। কথা বলা আর হাসির সময় ও এক ধরনের শ্বাসের শব্দ করে। মানিকের মা মেজ মামানিও কথা বলেন একদম এভাবে। আফসানা মনে মনে ভাবে-মানিকের গায়ের রঙ আর চেহারাও মামানির মত। মেজ মামার লাল টকটকে ফর্সা রঙ আর ধারালো মুখের গড়ন পায়নি।

আফসানা নিজেও নানা বাড়ির মানুষদের মত সুন্দর দেখতে হয়নি। ছোটবেলা থেকে শুনেছে ওর গায়ের রঙ ‘ময়লা’। মানে কালো গায়ের রঙ। অথচ সাধারণভাবে ময়লা বলতে নোংরা বোঝানো হয়। আসলে কালো মানুষদের নিয়ে এমন নেতিবাচক শব্দ বাঙালির মত কেউ ব্যবহার করে বলে ওর মনে হয় না।

‘বড় আপু হাঁটতে পারবা তো?  কতদিন বাদে গ্রামে আসলা তুমি!’ মানিকের পুরো অবয়বে একটা আন্তরিকতার বিচ্ছুরণ। ওর দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসে আফসানা। মানিকের ধারণা বিদেশে যারা থাকে তারা সারাদিন পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকে। নিউইয়র্কের যে ঘর থেকে বের হয়ে রিক্সা বা গাড়ি নেই সেটা ওরা বুঝতে চায় না।

আফসানার চেয়ে  ঢাকাতে অনেক বেশী আরাম আয়েশের জীবন ছোট বোন আলভিরার । ওর দামী পোশাক আর হাই হিল জুতার দিকে তাকিয়ে ভাবে আফসানা।  গাড়ি নিয়ে গ্রামে আসতে চেয়েছিল পর্যন্ত আলভিরা। বহু কষ্টে ওকে বিরত করা গেছে। সমস্যা হল গাড়ি রাখা হবে কোথায়? কারণ নানা বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি যাবে না।

স্কুল ঘরের উঠান থেকে নানা বাড়ির দরজায় যেতে আঠারোটা চার পার হতে হয়। আহারে চার! শব্দটা মনে হতে আফসানার আবার হাসি পেল।  ছোটবেলায় যখন নানাবাড়ি আসতো এই চার শব্দটা নিয়ে কত হাসাহাসি করত ওরা দুই বোন। যেন পৃথিবীতে এরচেয়ে হাসির শব্দ আর কিছু নাই!  সাঁকোকে কেন চার বলে বরিশালের মানুষ ওর মাথায় ঢুকত না। মাঠকে বলত কোলা, হাহাহা! ঢাকায় গিয়ে স্কুলের বন্ধুদের কাছে এসব বলতে গিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ত ওরা দুই বোন।

‘বড় আফু… ওই দিহে দ্যাহেন.. ওই যে মোর স্কুল। ডাইন দিকের বিল্ডিংটা দ্যাখতে পাইতেছেন, সামনে একটা ছোডমোড নিমগাছ, মুই ওই খানে বসি।’  আফসানা স্কুল দেখার আগে মামাতো ভাইকে দেখে। হাজার বাতির আলো জ্বলছে মানিকের মুখে, আমেরিকা থেকে আগত বড় বোনকে নিজের কাজের জায়গা দেখাচ্ছে, গর্বে ওর মুখ জ্বলজ্বল করে।

পঁয়ত্রিশ কি চল্লিশ বছর হবে,  আফসানার নানা জোবেদ আলী জীবনের লম্বা সময় ছিলেন- গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার। শৈশবে গ্রামে আসলে দেখতো গ্রামের সবাই নানাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে। এমনকি মানিকের মা মেজমামানিও নাকি বিয়ের আগে নানাকে স্যার বলতো। বিয়ের পরে মুখ থেকে স্যার চলে আসা থামাতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছিল ওনাকে। নানার ছেলেমেয়েরা কেউ শিক্ষকতায় না গেলেও চার নাতি এখন স্কুলে চাকরী করে। এক নাতি ইশতিয়াক ঢাকায় একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে উচ্চ বেতনে কাজ করে। আরেক নাতনি সানাইয়া আমেরিকার টেক্সাসে এক স্কুলের শিক্ষক। আফসানাও পাবলিক স্কুলে কাজ করে, তবে মূল শিক্ষক হিসেবে নয়, সহকারী শিক্ষকের ভূমিকায়। নিউইয়র্কের মতো শহরে পাবলিক স্কুলে সহকারী শিক্ষকের চাকরীও কম নয়। ওখানে এত বেশী প্রতিযোগিতা যে বলার নয়। তবে সবার সেরা তো মেজ মামার ছেলে মানিক।

আফসানা গভীর আনন্দের সঙ্গে দাসেরকাঠি সরকারী প্রাইমারী স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ভাইয়ের মুখে চুইয়ে পড়া আনন্দের বিচ্ছুরণ দেখে। সেই ছোটবেলায় নানার সঙ্গে ওদের ঢাকার বাসায় আসতো মানিক। বরাবরই ও শান্তশিষ্ট। মফস্বলে থাকলেও ভাইবোনদের প্রতি ওর খুব টান। একদম মেজ মামার স্বভাব পেয়েছে। মেজ মামা কখনও সেভাবে ঢাকায় আসতেন না। তবে সব বোনদের খোঁজ খবর রাখতেন। সবাইকে ফোন করে বলতেন, শ্বশুরবাড়িতে কোন সমস্যা হলে গ্রামের বাড়ি চলে আসবি। মনে রাখবি তোর ভাই এখনও মরে নাই। অন্য মামারা এভাবে কেউ বলত না। তারা যার যার পরিবার নিয়ে ব্যস্ত থাকতো।

মেজ মামা অন্য মামাদের মত আধুনিক ছিলেন না। উপজেলা শহরে ছোট্ট একটা মুদিখানা ছিল ওনার। প্রতিদিন তিন মাইল করে পায়ে হেঁটে সেখানে যেতেন ও আসতেন। নানার নয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা সন্তানটিই শেষ জীবনে তাঁকে দেখে রেখেছেন। মেজ মামার মতো মেজ মামানী, মানিক, শরিফা, আসমা, নাদেরও একই স্বভাব পেয়েছে। শেষ দিকে এসে নানার স্মৃতি লোপ হয়েছিল। হঠাৎ হঠাৎ এদিক ওদিক চলে যেতেন। তখন ওরা সবাই মিলে ওদের দাদাজানকে খুঁজতে বের হত। এভাবে যেন কোথাও চলে না যায়, তাই চোখে চোখে রাখত সবাই। কিন্তু গ্রামের বাড়ির এত খোলামেলা পরিবেশের মধ্যে চোখে চোখে রাখাটাও সহজ ছিল না।

আফসানার মনে হয় এই যে শিকড়ের কাছে থেকে পরিবারের আদর্শকে বহন করে চলাই যেন মানিকের অবয়বের আলোক বিচ্ছুরণের উৎস। মামাতো ভাইয়ের সুখী ও পরিতৃপ্ত চেহারা দেখে ওর হিংসা মত হয়। আফসানা কেমন আনমনা হয়ে যায়। আসলে কজন পারে পুরনো জুতায় পা গলাতে, সবাই তো পুরনো যে কোন কিছুকে ছুড়ে ফেলে দেয় নর্দমায়। মানিক তার দাদাজান জোবেদ আলীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার হয়েছে।

‘বড় আফু নাও তোমার চা’। সাদা চেক লুঙি আর নীল হাফ শার্ট পরা একটা লোক প্ল্যাস্টিকের ট্রেতে করে চা নিয়ে এসেছে। মানিক সেখান থেকে কাপ নিয়ে বাড়িয়ে ধরে প্রথমে আফসানা, তারপর আলভিরার উদ্দেশ্যে। চায়ের জন্য প্রস্তুত ছিল না ওরা। তবে খুশী হয় দুজনেই, চা আনা লোকটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। লোকটার পান খেয়ে লাল মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘আসসালামু আলাইকুম আফা মনিরা। আফনারা বিদেশ থেইকা আইছেন হুনছি, থাইকবেন কতদিন?

‘পরশুদিন চলে যাব।’ গুড়ের চা, তাতে এলাচ দেয়াতে অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ। চা শেষ করেও আফসানা মুখের মধ্যে এলাচ দানাটা রেখে দেয়।

আফসানার উত্তরে আবার সেই নাক মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নেবার মত করে হাসতে হাসতে মানিক উত্তর দেয়, ‘বড় আফু তো আমেরিকা থাকেন। কিছুদিনের জন্য আইছেন। এরিমধ্যে নানাবাড়ি বেড়াতে আইছেন।’

লোকটা সালাম দিয়ে চলে যাওয়ার সময় আলভিরা ব্যাগ খুলে বিশ টাকার একটা নোট দেয়। টাকাটা পেয়ে লোকটা আবার সালাম দেয়।

নানাবাড়ির এই গ্রামের প্রাণকেন্দ্র বলা যায় স্কুল ঘরের আশপাশটা। বহু পুরনো হাইস্কুল আছে এখানে, পাশে প্রাইমারি স্কুল। আফসানা মায়ের কাছে শুনেছে, এই হাইস্কুলে পড়ার জন্য বহু দূর-দূরান্ত থেকে ছেলেমেয়েরা আসতো। ছেলেরা অনেকে গ্রামের কারো বাড়িতে জায়গীর থাকতো।

আফসানা তাকিয়ে দেখে, বৃষ্টির দিনে সামনের অংশটা কর্দমাক্ত না হয়ে যায়, স্কুল ঘরের সামনে ইট ফেলে আধপাকা উঠান তৈরী করা হয়েছে!  এই এলাকায় নারিকেল গাছ বেশী হওয়াতে খালের পাশ ঘেঁষে তাদেরই প্রাধান্য বেশী। কিছু কিছু লম্বা এক হারা সুপারী গাছ, খেঁজুর গাছও আছে। আফসানা অত গাছ না চিনলেও গাছের গায়ের গন্ধটা উপভোগ করে। সময় পেলে প্রকৃতির নিবিড়তায় সময় কাটায়। বড় বেশী স্পর্শকাতর মন ওর, যখনই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়, ছুটে যায় প্রকৃতির মাঝে।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে মানিক কথা বলছে আলভিরার সঙ্গে। কথা শেষ করে ওরা দুজনে ভাগাভাগি করে স্যুটকেস আর ব্যাগ হাতে নেয়। আফসানা ওদের অনুসরণ করতে থাকে। স্কুলঘরটা চওড়া খালের পাড়ে, সপ্তাহে দুই দিন এখানে হাঁট হয়। দূরদূরান্ত থেকে বিক্রেতারা তাদের পসরা নিয়ে এসে সাজায় এখানে। আফসানার মনে আছে, ছোটবেলায় যেদিন নানা হাট থেকে আসতো খুশীতে ওরা সবাই নানাকে ঘিরে ধরত।

খালের ওপর এই চারটাকে ছোটখাটো কাঠের সেতু্ বলা যায়। দুই পাশে ধরার জিনিষ থাকলেও গ্রামের লোকজন হনহন করে চার পার হয়ে যায়। কিন্তু আফসানার কথা আলাদা, আশেপাশের মানুষদের চোখের দৃষ্টি সেটা বলে দেয়।

গ্রামের লোকজনের দিকে তাকালে আফসানার পুরনো একটা মন খারাপ ভাব সৃষ্টি হয়। কি সাদামাটা গ্রামের লোকজন, পুরুষরা বেশীরভাগ লুঙি-হাফ শার্ট পরা,মহিলাদের পরনে বোরকা-এক প্যাচে শাড়ি কিংবা থ্রিপিস, আফসানার মনে হয় এই মানুষগুলো কখনও কোথাও যায়নি। একটা গ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ ওদের জীবন। খুব প্রয়োজনে কালেভদ্রে হয়ত উপজেলা শহরে যায় কেউ কেউ। কিন্তু খুব বেশী দূর যাওয়া হয় না। বিশাল বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে সামান্য অতি ক্ষুদ্র এক গ্রহের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক গ্রামের মানুষ হিসেবে তারা পুরো জীবন কাটিয়ে দেয়।

‘ছোট আফু, তুমি এই হাইহিল নিয়া হাঁটতে পারবা না। সামনে কি অবস্থা দ্যাখছো? আছাড় খাইয়া পড়বা!’ মানিককে খুব চিন্তিত দেখায় আলভিরার জন্য। কিন্তু যাকে নিয়ে এত চিন্তা তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে নাকি এভাবে হেঁটে অভ্যস্ত। এরচেয়েও খারাপ রাস্তা দিয়েও নাকি সে হাইহিল পরে হেঁটেছে।

প্রথম চারটা পার হবার পরে পুরনো একটা কবরস্থান। শ্যাওলা পড়তে পড়তে কেমন সবুজ হয়ে গেছে চার পাশের দেয়াল। চারদিকে আগাছা, ঢেঁকি শাকের মতো একটা পাতা চোখে পড়ে আফসানার। কবরস্থান দেখলে বুকের মধ্যে কেমন যেন হিম হয়ে যেত আগে। আফসানার মনে আছে কখনও ভুলেও একা কবরস্থানের পাশ দিয়ে যেত না ও। অথচ মেজ মামা গভীর রাতেও টর্চ জ্বালিয়ে বাড়িতে ফিরতেন একা একা। শৈশবে মেজ মামার মত এত সাহসী মানুষ কেউ থাকতে পারে আফসানার বিশ্বাস হত না!

‘ওইটা শরীফ বাড়ি না? আলভিরা আঙ্গুল তোলে এক পুরনো সিমেন্ট পলেস্তারা খসে পড়া বাড়ির দিকে।

‘ছোট আফু, তোমার তো দেহি মনে আছে। যাবা ভেতরে? ঘরে ঢোহার দরকার নাই। দরজার কাছ দিয়া দ্যাখতে পার।’ মানিক প্রস্তাব দেয়।

একদম ছিরিছাদবিহীন বাড়িতে আম গাছ, কাঁঠাল গাছগুলিও কেমন যেন বিবর্ণ দেখা দেয়। সিমেন্ট খসে গিয়ে বেরিয়ে পড়া লাল ইটগুলিও সৌন্দর্য্যবিহীন। অথচ একদিন এই বাড়ি মানুষে মানুষে আর হাস্য কলরবে গমগম করতো। তবে সেই দিনগুলি আফসানারও দেখা হয়নি। অবশ্য আগে যখন আসতো এতটা ভগ্নদশা ছিল বলে মনে পড়ে না ওর।

বাড়ির জানালাগুলিও দরজার সমানই লম্বা, ছাই রঙা কপাট দুটি খোলা। ওদের উকিঁ ঝুঁকি মারতে দেখে জানালার পাশে মলিন একটা শাড়ি পরা ততোধিক মলিন চেহারার এক মহিলা এসে দাঁড়ান। ’ কেডা ওইহ্যানে?’

‘ফুপু, মুই মানিক। মোগো মাহমুদা ফুফুর মাইয়্যারা আমার লগে! এই যে আফসানা আপু আমেরিকায় থাইক্যা আইছে। আর এই হল আলভিরা আফা। চেনছেন? তারপর ফুফু আমনে ক্যামন আছেন?’  

আফসানা তাকিয়ে দেখে, আরে! উনি আম্মার সেই হিনু বুয়া না!

আগে বিকেলে বা সন্ধ্যাবেলা চায়ে টোস্ট বা বিস্কুট ভিজিয়ে খাওয়ার সেই দিনগিুলিতে ওরা গোল হয়ে শুনতো আম্মার শৈশব আর কিশোরীবেলার কথা। হিনু খালার বিয়ে হয়েছিল ওনার বাবার আপন ফুফাতো ভাইয়ের সঙ্গে। সারাজীবন যাকে চাচা ভেবে এসেছে, তার সঙ্গে বিয়ে হওয়াতে মনের দিক থেকে অসুখী ছিলেন তিনি। বয়সের ব্যবধানও ছিল বিস্তর। যে কোন কারণে ছেলেমেয়ে না হওয়াতে বাপের বাড়িতে পড়ে থাকতেন। ভাইবোনদের কারো ছেলেমেয়ে হলে কিংবা কেউ অসুস্থ হলে কয়েকমাস কাটিয়ে আসতেন সেখানে, তারপর আবার নিঃস্ব-শীর্ণ ঘরে ফিরতেন।

‘কেমন আছেন খালা? মম খালা কেমন আছে?’ আফসানা জানতে চায়।

‘মুই ভালো আছি মা। মম তো এহন কাডাইল্যা থাহে। তোমরা আস ঘরে মা, বস। তোমার মায়ের খবর হুনছি।

কাডাইল্যা মানে কাঁঠালিয়া, ঝালকাঠির একটা উপজেলা, আফসানা জানে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ওর ষোড়শী মা নৌকায় করে লুকিয়ে চলে গিয়েছিল ওখানে।

‘আমরা এখনো নানা বাড়ি যাইনি। যাবার পথে থামলাম খালা। আবার পরে আসব।’ আলভিরা মৃদু হেসে উত্তর দিয়ে বেরিয়ে আসে। ওরাও হাত নেড়ে ওকে অনুসরণ করে।

গ্রামের মাটির সমান রাস্তা হলেও সাবধানে চলতে হয়। কয়েকদিন আগে বৃষ্টি হয়েছিল বোঝা যায়। এখনও অনেক জায়গায় পানি জমে আছে। মাটির রাস্তার একপাশে ধানের ক্ষেতে সোনালী শস্য ডানা মেলেছে। ধানের শীষ দেখে আফসানার মনে পড়ে, নানার ভিটের পাশে এক ছোট্ট ঘরে থাকা নানী-নাতনীর কথা! দুরসম্পর্কের গরীব আত্মীয় বুড়ির জন্য বাড়ির মধ্যে একটা আলাদা ঘর তৈরী করে দিয়েছিল নানা। ভাড়া দেওয়া তো দূরের কথা, দুই বেলা খাওয়ার মত অবস্থা ছিল না তাদের। কখনও ঘরে চাল না থাকলে অন্য বাড়িতে গিয়ে গৃহস্থের কাছে ফ্যান চেয়ে নিয়ে আসত।

নাতনির নাম ছিল রুমা, কথা বলতে পারত না। তবে বুদ্ধি ছিল জবর, সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াতো। ভর দুপুরে ধানক্ষেতে গিয়ে ধানের ছড়া টোকাতো। আফসানাও বহুদিন সাহায্য করেছে রুমাকে ধানের ছড়া টোকানোর কাজে। মেজ মামার দুই মেয়ে শরীফা ও আসমারা থাকতো একসঙ্গে। সবাই মিলে ছাবি দিয়ে খালে ছোট মাছ ধরতো। নদীর পাড়ে গিয়ে শাক টোকাতো। নাতনির কুড়িয়ে আনা খাদ্যবস্তু নানী রান্না করতো শেষ দুপুরে মাটির চুলায়।

‘রুমা আর ওর নানী কি এখনও থাকে বাড়িতে?’ হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করে আফসানা। বেশ হাওয়া দিচ্ছে আজ। নিউইয়র্কের মতো হিম শীতল হাওয়া নয়। বেশ মিষ্টি মধুর। ধানগাছগুলি নুয়ে যাচ্ছে মাটিতে হাওয়ার বেগে, আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। আফসানার হঠাৎ করে খুব ভালো লাগতে শুরু করে। ওর কাছে মনে হয় স্মৃতিগন্ধী হাওয়া।

‘রুমার নানী তো মইরা গেছে কয়েক বছর আগে। ওর বাপ-মা আইসা নিয়ে গেছে। ওর বাপ তো পুলিশে চাকরী করে জানতো!’ মানিক কথা বললেও ওর চোখ থাকে পথের দিকে। কিছু পড়ে থাকলে পা দিয়ে সরাতে সরাতে যাচ্ছে।

চলার পথে ঘাস উঠে গেছে বেশীরভাগ জায়গায়। অনেক জায়গায় ঘাস শুকিয়ে বাদামী রঙ ধারণ করেছে। পায়ে চলার পথের পাশে ছোট্ট চিকন খালে তেমন পানি নেই। স্কুল ঘরের সামনে যে বড় খালটা, সেখান থেকে এর শাখা বের হয়েছে। বর্ষাকালে হলে খালে নৌকা চলত, এখন প্রায় হাঁটুজল পানি। আফসানা জানে ঘোর বর্ষাকালে নানা-মামা-খালারা এই খাল দিয়ে নৌকা করে স্কুলে আসা-যাওয়া করতো। নিজেদের নৌকা নিজেরা বাইতো। নিউইয়র্কে যেমন ওদের নিজেদের গাড়ি নিজেদের চালাতে হয়।

‘রুমার আব্বার কথা মনে আছে, ঢাকায় আসলে আমাদের পুরান ঢাকার বাসায় আসতো। বিশাল গোফওয়ালা লোক ছিল।’ আফসানা স্মৃতি হাতড়ে বলে, ‘রুমা সম্ভবত অটিস্টিক ছিল। কথা স্পষ্ট করে বলতে না পারলেও সব বুঝত। হাতের ইশারায় আ আ করে করে বোঝাতে চেষ্টা করত! আহারে তখন তো আমরা অটিজম সম্পর্কে জানতাম না! ওর বাবা-মাও নিজেদের মেয়েকে বয়স্ক নানীর কাছে ফেলে রাখতো।’ আফসানা কথা বলার সময় খেয়াল করে আলভিরা ও মানিক অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনে প্রায় সমস্বরে বলে ওঠে, ‘আপু, তোমার এত কিছু মনে আছে! রুমার বাবার গোফের কথাও!

আফসানা নিশ্চিত,  চারপাশের বাতাসে ভেসে আসা ঘ্রাণ যেন বুদবুদ করে বের করে আনছে পুরনো সব স্মৃতি। একটার পর একটা চার পার হয়ে ওরা চলেছে নানা বাড়ির দিকে। আফসানা চারপাশে তাকিয়ে দৃশ্যগুলো মনের মধ্যে ছবি তুলে নেয়। নিউইয়র্ক শহরে ব্যস্ততম জীবনে ফিরে যাবার পরে সবকিছু ছায়াছবির মত মনে হবে। আগে স্কুল ছুটির পরে যখন নানাবাড়িতে আসতো অনেকদিন থাকার সুযোগ ঘটত। যে চারগুলি এখন পাড় হতে হাতল ধরতে হচ্ছে, সেগুলো তরতরিয়ে পাড় হয়ে যেতে পারতো কিছুদিন থাকার পরে। সরু খালের ওই পাশে বাড়িগুলির মানুষের ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে। আগে সব বাড়ির নাম জানতো। এখন বেশীরভাগ মনে পড়ছে না।

আফসানাকে চার পাড় করিয়ে এই পাশে রেখে মানিক গেছে আলভিরাকে আনতে। আফসানা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, আলভিরা সরু হিল ঠিকভাবে বসছে না বাঁশের চারের ওপর। মানিক শক্ত করে ধরে রেখেছে বোনের হাত। এত কষ্ট করেও কি যে খুশী মানিক, কত আনন্দ তাঁর শহর থেকে দুই বোন এসেছে। এক পা এগোচ্ছে আর আলভিরাকে সতর্ক করছে মানিক। আফসানার ভারী সুন্দর লাগে দৃশ্যটা। ওর মধ্যে অপরাধ বোধ হয় এই ভেবে- নতুন জীবনে নতুন বন্ধুদের পিছনে দৌড়াতে গিয়ে আপন আত্নীয়দের কত দ্রুত বিস্মৃত হয়েছি, অথচ তাদের হৃদয়ের কতখানি জায়গা জুড়ে থাকি আমরা!

আলভিরার চিৎকারে বাস্তবে ফিরে আসে আফসানা। সামনে তাকিয়ে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারে না। চারের একদম শেষ মাথায় এসে আলভিরা পা হড়কে পড়ে গেছে বাঁশের ওপর। আর হালকা পাতলা মানিক বাঁশের হাতল ধরে প্রায় বানরের মত ঝুলে আছে। আলভিরার জন্য ও পা ফেলতে পারছে না। আফসানা এগিয়ে এসে কোনক্রমে হাত ধরে ডাঙায় নিয়ে আসে আলভিরাকে। মানিক তারপর পা নীচে নামিয়ে এগিয়ে আসে আলভিরাকে সাহায্য করতে। জামা কাপড়ে কাঁদা না লাগলেও ওর জুতার হিল ভেঙ্গে গিয়ে বাঁকা হয়ে গেছে। পায়েও সামান্য ব্যথা পেয়েছে ও।

আলভিরাকে একটা গাছের গুড়ির ওপর বসানোর পরে বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে ও। আফসানা আর মানিক তো অবাক। এমন কিছু ব্যথাতো পায়নি যে এভাবে আকুল হয়ে কাঁদতে হবে। ওরা বুঝতে পারে না কি হয়েছে! মানিক বার বার প্রশ্ন করে, ‘ছোট আপু, কোথায় ব্যথা পাইছ বল … বল…’। আফসানা পাশে বসে বোঝার চেষ্টা করে, হঠাৎ কি হল!

বেশ কিছুক্ষণ কান্নার পরে মুখ খোলে আলভিরা। ‘আম্মা এই রাস্তা দিয়ে প্রতিদিন স্কুলে আসা যাওয়া করতো। কত কষ্ট করে লেখাপড়া করেছেন। কলেজে পড়েছেন আরো দূরে গিয়ে। এত কষ্ট করে পড়াশুনা করেও আম্মা আমাদের বড় করতে গিয়ে নিজের জন্য সারাজীবনে কিছুই করেননি।’ প্রবল কান্নার ফাঁকে ফাঁকে কথাগুলো বলে ও।

গত বছর মাত্র তেষট্টি বছরে বলা নেই কওয়া নিয়ে ঘুমের মধ্যে চলে গেছে আম্মা। আব্বা মারা গিয়েছিল আরো তের বছর আগে। আব্বার মৃত্যুর সময় আফসানা ঢাকাতেই থাকতো। তবে আম্মার মৃত্যু ও দেখেনি। প্রবাস জীবনের সবচেয়ে বড় বেদনার নাম প্রিয়জনের মৃত্যুর সময়ে থাকতে না পারা। শেষ জীবনে আম্মার সার্বক্ষনিক সঙ্গী হয়ে গিয়েছিল আলভিরা। ওকে ছাড়া কোথাও নড়তে পারত না আম্মা।

এই জন্য আলভিরা অনেকটা অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল আম্মার মৃত্যুর পরে। আফসানা এসে একমাস কাটিয়ে গিয়েছিল ওর সঙ্গে। এ বছর আবার এসেছে আম্মার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে। বড় হওয়ার পরে নানাবাড়িতে তেমন আসা হতো না ওদের, আম্মা একাই আসতেন। আজ যখন আম্মা নাই, তখন ওরা দুই বোন এসেছে আম্মাকে খুঁজতে।

আলভিরার সরব কান্নার বিপরীতে নীরবে কেঁদে চলে আফসানা। চার পার হয়ে পাশের বাড়ির কয়েক জন মানুষ এসে জড়ো হয়। ওদের দেখতে থাকে। কেউ কেউ প্রশ্ন করে মানিককে, কেডা এরা? মানিক সবাইকে অক্লান্তভাবে বলে চলে, মাহমুদা ফুফুর মাইয়্যা। একজন আমেরিকা, আরেকজন ঢাকা থেকে আইছে।

আফসানার হঠাৎ মনে পড়ে, সামনের এই বাড়িটার নাম মাঝিবাড়ি। ঘরের উঠানে বড় একটা নৌকা। শৈশবে কতবার যে নৌকায় উঠে খেলেছে! কোন এক সময়ে এই বাড়ির লোকজন পেশায় মাঝি ছিল। এখন দিন পাল্টেছে। ছেলেরা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে টাকা পাঠিয়ে বাড়ির চেহারা পাল্টে দিয়েছে। তবু নৌকাটা তারা স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছে। এই বাড়িটা আম্মার সই কুলসুমের বাড়ি, ছোটবেলায় বড় পাকা কুল বরই খাওযার জন্য এই বাড়িতে আসতো ওরা। আম্মার সঙ্গে কত জায়গায় যে যেত ওরা!

আফসানার নীচের ঠোটজোড়া কাঁপতে থাকে। গাল বেয়ে পানি নামতেই থাকে। ‘কেন মানুষ বড় হয়ে যায়! কেন সে চিরকাল মায়ের হাত ধরে থাকতে পারেনা!

আলভিরা ধীরে ধীরে উঠে খালি পায়ে হাঁটতে আরম্ভ করে। ওর জুতা জোড়া নেয় মানিক, দুই একজন এগিয়ে আসে ওদের ব্যাগগুলো নেবার জন্য। আরেকটু এগোলেই ওদের নানার ভিটে।

ওরা আঠারো নম্বর চারটা পার হয়। আফসানা কয়েক গজ দূরে নানা বাড়ির সামনের বিশাল পুকুর দেখতে পায়। এই পুকুরে ওরা গোসল করতো নানাবাড়ি এলে। লাল শাপলা তুলে জোলাবাতি খেলতো।  শাপলার বদলে পুকুর ভর্তি কচুরিপানা দেখতে পায় আফসানা। বাঁধানো ঘাটটা ভেঙ্গে আগের সেই সৌন্দর্য্য নেই।

বাড়িতে ঢোকার মুখে লম্বা বাঁশের ওপর শুকনা কলাপাতা পর্দার মতো ঘিরে রাখা হয়েছে। শুকনা কলাপাতা সরানোর সময় মচমচ শব্দ হয়। ওরা পাতা সরিয়ে নানা বাড়ির দরজায় পা দেয়। শরীফা, আসমা, নাদের- সবাই আনন্দে চিৎকার করতে করতে ছুটে আসে। মামানি ঘরের সামনে চোখ ‍মুখ উজ্জ্বল করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।

আফসানা দেখে ওর নানার ভিটেকে। এই ভিটেতে বহুকাল আগে এক ফাগুন মাসে জন্ম হয়েছিল ওর।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>