মনমাতাল

Reading Time: 2 minutes

।।পূর্ণপ্রভা ঘোষ।।

 

স্টেশনের ডানদিকে পুরনো মহুয়া গাছটা একাই দাঁড়িয়ে থাকত। এই স্টেশনে হুড়োহুড়ি ব্যস্ততা থাকে না। সারাদিনে মেরেকেটে গুটিকয়েক প্যাসেঞ্জার ট্রেন। মেলট্রেন কয়েকটা হুস ছুটে যায় পলক ফেলার আগেই। মালগাড়িগুলো ঘটর ঘটর শব্দে অনিচ্ছে নিয়ে দীর্ঘ শরীরকে টেনে টেনে এগোয়, যেতে যেতে দাঁড়িয়েও পড়ে।

সূর্যের আলো ফুটতে না ফুটতেই কাশীনাথ হাজির। সকলের হুকুম তামিল করে হাসিমুখে। “কাশীনাথ দুটো চা”, “কাশীনাথ জল ভরে আন”। এমনকী কখনও কখনও মেল ট্রেন পাস করানোর জন্য সবুজ ঝান্ডাও দেখাতে হয়। যখন যেমন, কাশীনাথের কিছুতেই আপত্তি নেই। বরং হাত খালি থাকলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাসিমুখে এগোয় যাত্রীদের সাহায্যে।

কী করবে। ক্রোশ পাঁচেক উজিয়ে তার গাঁ। সেখানে তার বাপ-চোদ্দোপুরুষের ভিটে। একচালা গোয়ালঘরের লাগোয়া দাওয়াতে ঠাঁই। তিন ভাইয়ের পরিবার আছে, তারা ঘরের ভিতরে থাকে। বুড়ো বাপ স্বর্গে গেছে থেকে কোনওরকমে দিনগুজরান। ডানপায়ে খুঁত নিয়েই জন্মেছে সে। অজগাঁয়ে নিতান্ত ছাপোষা সংসারে চিকিৎসা হয়নি। ছেলেবেলায় ওঝাবদ্যির জলপড়া, শিকড় বাকড় দিয়ে যতটুকু প্রচেষ্টা হয়েছে তাতে অবস্থা আরও বেগতিক। দূরের স্কুলে পড়াশোনা কিংবা চাষবাসের কাজকর্ম সম্ভব হয়নি। তার বিয়ে হবে, কিংবা হতে পারে সেই কথাও কেউ কল্পনা করেনি কস্মিন্কালে, উচ্চারণ তো দূর-অস্ত!

ত্রিশবছর বয়স হল। চারপাশে লোকের মুখে খোঁড়া ডাক শুনতে অভ্যস্থ কাশীর জীবনে হঠাৎ একদিন পরিবর্তন। কাশীর ভাইপো কলেজে পড়ত। ট্রেনে করে দূরের টাউনে যায়, গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা সেই কারণে পড়াশোনার সুযোগ হারায়। একদিন, বাড়ি ফেরেনি। রাত যত বাড়ে, দুশ্চিন্তা বাড়ে ততোধিক। একসময়ে কান্নাকাটি শুরু। সেইসময় কেরলে রাজমিস্ত্রির কাজ নিয়ে গিয়েছে বড়ভাই। মেজোভাই তেমন গা করল না। অতঃপর কাশীনাথ কোনওক্রমে হ্যাঁচোড় প্যাচোড় করে পাঁচ ক্রোশ উজিয়েছিল। সেই প্রথমবার।

এসে শোনে, লাইনের অসুবিধাতে ট্রেন বন্ধ। একঘণ্টার পথ বহুকষ্টে তিনঘণ্টায় তো এসেছে, আবার ফেরার কথা ভাবনাতেও অসম্ভব। সেদিন স্টেশনেই রাত্রিবাস। আর চোখের সামনে এক আশ্চর্য জগতের উদ্‌ঘাটন। এতদিন লোকমুখে শুনত, তা কল্পনাসাধ্য ছিল না। তাছাড়া জন্ম থেকেই হতচ্ছেদ্দাতে তার বাস! স্বপ্ন দেখার কথাও কল্পনায় আসেনি আগে।

ক্রমশ রাত বাড়ে, টিকিট ঘরের সামনে বসে হাউমাউ কতকিছু বকেছিল সেদিন। স্টেশনমাস্টার ছিলেন লোক ভাল। তাঁরও দিনরাত একাই থাকা। এই দুঃখীর সঙ্গ খুব ভাল লাগে। সেদিন মাস্টারবাবুও অনেক কথা বলেছিলেন। দু’টি অপরিচিত মানুষ সেদিন কেমন করে যেন একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। সেই রাতে মাস্টারবাবুর হরিমটরে কাশীও প্রসাদ পেয়েছিল।

সকালে ভাইপোকে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল আনন্দে। তারপর কেমন করে রোজ আসা অভ্যাস হয়ে গেল। যে-দু’চারজন এইপথে যাতায়াত করে সবাই কাশীনাথের আপনজন হয়ে গেল। আর মাস্টারবাবু তো দেবতা। সাতবছর পেরলো। শীত-গ্রীষ্ণ-বর্ষা কখনও অন্যথা হয় না।

মানুষের কষ্ট, মানুষের অক্ষমতাও কখন যেন অভ্যাসবশে আয়ত্তে এসে যায়। কাশীনাথেরও।

বুড়িমাটা তার জন্য বসে থাকে। সেই টানে প্রতিদিনই বাড়ি ফিরত। স্টেশনে দুটোচারটে পয়সা রোজগারও হয়, মা ব্যাটার দিন চলে যায়।

বাড়ির টানটা গেছে এইবছর। মা চলে গেল হঠাৎ। একদিন ফিরে দেখে মা ঠান্ডা হয়ে পড়ে। অন্য ভাইয়েরা টেরও পায়নি। মা কি শুধু তার একার?

শীত পড়েছে, মহুয়াগাছের নীচে এক অন্ধ ভিখারি বাপমেয়ে ঠাঁই গেড়েছে কিছুদিন হল। মাস্টারবাবু মজা করছিলেন। কাশীনাথেরও কেমন মায়া স্বপ্ন জাগে হঠাৎ।

ওরা এখন তিনজনে এই মহুয়াগাছের নীচেই নতুন স্বপ্ন বিছিয়েছে। টুপটাপ ঝরে পড়ে মহুয়াফুল দিনে রাতে। গন্ধে মাতাল হয় স্টেশন চত্বর। বুড়োভিখারি খঞ্জনিতে বোল তোলে ঠিন্ ঠিন্। মেয়ে মালতীর গলায় কৃষ্ণপ্রেমকথা সুরে প্রাণ পায়, কাশীনাথও আজকাল গলা মেলায় স্বচ্ছন্দে। কে জানত তার গলাতেও সুর ছিল।

মাস্টারবাবু তো রয়েছেন, আশেপাশে আরও মুগ্ধ শ্রোতা জড়ো হয়।

তিনজনের পেট চলে যায় কোনওমতে। আনন্দে থাকে একসাথে।

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>