Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

আবর্তন

Reading Time: 5 minutes

Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.comওয়ার্ক ফ্রম হোম কথাটার প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে কল্পনার।‌ এর চেয়ে ঢের ভালো ছিল অফিস। ঢের ভালো ছিল ঘেমে নেয়ে ছুটতে ছুটতে সময়ের মধ্যে পৌঁছানো। এই সারাদিন জুম কলে ছোট ছোট খুপড়ির মধ্যে মানুষ দেখার চেয়ে তো ভালো।‌ সারাদিন জুড়ে কল। একটার পর একটা। কী রকম জম্বির মতো আজকাল নিজেকে লাগে কল্পনার। মগজ বলে কিছু নেই, যন্ত্রের মতো কাজ করে যাচ্ছে। সব ওয়েব সিরিজ দেখা শেষ। আর সারাক্ষণ রক্ত, খুন ওরকম ওয়েব সিরিজ দেখতে পারেনা ও। বেশ কয়েকটা দেখে আরো শরীর খারাপ করেছে ওর। যে কটা ভালো সিনেমা ছিল, দেখে ফেলেছে।‌একটা বিড়াল দুটো বাচ্চা নিয়ে উঠেছে ওর বাড়িতে, তাদের দুষ্টুমি, খেলা দেখতেও ওর আর ভালো লাগে না। ‌ওর অজয় নদের ধারে যেতে ইচ্ছে করছে।ওর সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। ওর এই ঘরটা, চারটে দেওয়াল, রোজ হুইস্কির গ্লাস, কিচ্ছু ভালো লাগছে না। ওর উন্মুক্ত একটা আকাশের নিচে চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। সারাদিন কথা বলতে হয় জুম কলে।আর ভালো লাগেনা কোন কথা। সারাদিন বিজনেস ড্রাইভ ছাড়া মিনিংফুল কিছু নেই ওর জীবনে।গান গাইতে ইচ্ছে করছে না, কবিতা বলতে ইচ্ছে করছে না, লিখতে ইচ্ছে করছে না।‌ অদ্ভুত একটা না-ভালো লাগা ঘিরে আছে। কাজ শেষ করে ঘড়িতে দেখলো সাতটা চল্লিশ।

তড়িঘড়ি একটু খেয়ে বেরোতে বেরোতে আটটা বেজে গেল।‌এইটুকু না হাঁটলে ওর আরো দম বন্ধ লাগে। সিঁড়ি দিয়ে নামছে, এমন সময় অনুরাগের ফোন।
-বলো
-তুমি কি হাঁটতে বেরিয়েছ?
-না। সিঁড়ি দিয়ে নামছি।
-দাঁড়াও একটু। আমি একটা জিনিস নিয়ে আসছি, একটু ধরতে হবে।
-কী জিনিস?
-আসলেই দেখতে পাবে।
-বলতে পারবে না?
-একটু পরেই দেখতে পাবে।
-চোরাই মাল নাকি? বলতে পারছো না?
-দেখো
নির্ঘাত এমন‌ কিছু আনছে যা কল্পনার অপছন্দ। তিন চারবার মাঝখানে ফোন হয়ে গেল, তারপরে তিনি এলেন, হাতে একটা সাউন্ড বার, স্মার্ট টিভির সঙ্গে লাগানো যাবে।
-এমনিতেই ওটা গাঁক গাঁক করে চালাও, তার ওপর এটা?
-তুমিই তো কালকে শুনতে পাচ্ছিলে না ওই ওয়েবসিরিজটার ডায়লগ, তোমার জন্যই তো আনলাম।
-ওহ্‌! কী মিষ্টি তুমি, ভালোবেসে আমার জন্য একটা বাঁশ আনলে।
-যাক গে, এবার আমি হাঁটতে যাই?
-গাড়ি রাখতে যাবো তো, চলো কিছুটা।
-এক কাজ করি, একটু পার্লার টা ঘুরে যাই যদি খোলা থাকে। আটটা দশ বাজে তো, কে জানে খোলা আছে কিনা!

পার্লারে থ্রেডিং, ঘাড় আর মাথা ম্যাসাজ করালো কল্পনা, তারপর হাঁটতে শুরু করলো। একটা কফিশপে গিয়ে এক কাপ কফি খেয়ে টাকা তুলে এটা ওটা দরকারি জিনিসপত্র বাজার করে বাড়ি ঢুকলো। ঢুকেই দেখে অনুরাগের মেজাজ সপ্তমে।
-কটা বাজে? কল্পনা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, কটা বাজে?
-পৌনে দশটা একটা বাড়ি ফেরার সময়?
-কেন? পৌনে দশটায় কী সমস্যা?
-কী সমস্যা তুমি বোঝনা?
-না। সত্যি ই বুঝিনা। কোন সময়টা বেঞ্চমার্ক বাড়ি ফেরার জন্য? গিয়েছি কোথায় যে ফিরব?
-ঘন্টার পর ঘন্টা বাড়ির বাইরে থাকবে রাতে?
-কাজ শেষ হল সাতটা চল্লিশে, তুমি এলে আটটায়, ঘন্টার পর ঘন্টা?‌ পার্লারে সময় লাগলো খানিকটা। 
-তবে তুমি হাঁটতে গেলে কেন?
-আমার দরকারি মনে হয়েছে তাই
-ঘড়ি দেখবে না?
-না। ‌কারণ আমার একবার ও মনে হয় নি আমাকে এক্ষুণি বাড়ি ফিরতে হবে। তুমি রাত তিনটে অবধি প্রায়ই বাড়ির বাইরে থাকো।কেন থাকো? কোন কাজ থাকে তিনটে অবধি? কে বলল তুমি পুরুষ বলে তোমার বাড়ি ফেরার সময়ের কোন নির্দিষ্ট সময় নেই?
-আমি কোথায় থাকি তুমি সব জানো।
-ও, আর আমি কোথায় ছিলাম তুমি জানো না?

-চুপ করো। তুমি খুব ভালোই জানো, তুমি কোথায় ভুল করেছ, কিন্তু স্বীকার করবে না।
-একদমই আমার একবার ও মনে হচ্ছে না, বিশ্বাস করো আমি ভুল করেছি, তাই স্বীকারের তো‌ প্রশ্নই নেই।
-ছেড়ে দাও।‌ এত উদ্ধত মহিলার সঙ্গে আমি কথা বলিনা।
-ধন্যবাদ।
কল্পনা খেয়ে ঘুমাতে যায়। ফালতু কথা বাড়ানোর মানে হয়না। মেজাজ খারাপ করা।

এত বছরে কল্পনা‌ একটাই জিনিস নিজের ভিতরে ডেভেলপ করেছে। উত্তেজনা দেখাবে না, কিন্তু যা ভুল তাকে ভুলই বলবে, কিছুতেই তা মাথা পেতে গ্রহণ করবে না। আর তার জীবনের রশি সে নিজেই টানবে, অনেক বছর পরে সে সেই রশি নিজে হাতে তুলে নিয়েছে।

ঘুমানোর আগে কল্পনা‌ রোজ সুতীর্থর কথা ভাবে। রোজ ওকে ‘ভালোবাসিইই’ বলে আর মনে মনে আদর করে ঘুমায়।

একটা সিডেটিভ খেয়ে নেয় কল্পনা। বয়স বাড়ছে তো, বাইরে উত্তেজনা না দেখালেও ভিতরে হয়। শুয়ে শুয়ে ও সুতীর্থ আর তার বউয়ের গানের অনুষ্ঠানের লাইভ এর রেকর্ডিঙটা খোলে।

অনুরাগ ড্রয়িঙ রুমে টিভি দেখছে।কল্পনা এগিয়ে নিয়ে যায় কিছুটা, গান শোনে একটা, ‘চঞ্চল মন আনমনা হয়’, আরেকটু এগিয়ে নিয়ে যায়, “ইয়ে রাতে ইয়ে মৌসম নদীকা কিনারা ইয়ে চঞ্চল হাওয়া।”

কল্পনা খুশি হয়ে যায়। ‌কী ভালো গাইছে দু’জনেই। মনে মনে ভাবে একটা চাঁদনি রাত, কুলকুল করে নদী বয়ে যাচ্ছে আর সুতীর্থ ওকে এই গানটা শোনাচ্ছে, আর ও মাঝেমাঝে গুনগুন করছে। হঠাৎই একটু পিছিয়ে নিয়ে আসে, সুতীর্থ বলছে, আজ একটি বিশেষ দিন, একজনের জন্মদিন, বলে বেশ কায়দা করে তাকিয়ে বউকে বলছে, “তুমি কি আমাকে উত্তম কুমার বলবে?”

বউ হাসছে মিষ্টি করে। ওই চিন্ময় রায় যেমন বলেছিল? সুতীর্থ বলছে, থাক উত্তম কুমার একজনই, একজনই থাকবেন, বরং আমরা তার জন্মদিনে তার লিপে গাওয়া শঙ্খবেলা ছবির গান গাই। আচ্ছা, আমাদের দুজনের মধ্যে কে প্রথম কাছে এসেছিলাম, তুমি না আমি?
-এতদিন পরে আর মনে নেই, মনে হয় দুজনেই।একজন তো একা কাছে আসতে পারে না।

কল্পনা জানে না, ওর কেন এত কান্না পাচ্ছে? ও কোনদিন সুতীর্থর স্ত্রীকে নিয়ে ভাবেনি, হিংসে করেনি, বরং এত ভালো গান‌ গায় বলে শ্রদ্ধার চোখেই দেখেছে, ওদের দুজনের কোন অনুষ্ঠান হলে সবসময় ও দেখে। আজ চোখের জল ভিজিয়ে দিচ্ছে গাল, বালিশ।
ও নিজে পারফর্মিং আর্টিস্ট, ও জানে মঞ্চে কত কী নাটকীয়তা তৈরি করা হয় দর্শকের সঙ্গে কানেক্ট করার জন্য, তবুও ও বেরোতে পারছে না মন খারাপ থেকে।

ওর বিয়ের এক বছর পর যখন‌ অনুরাগ বলতে জীবন বুঝতো, তখন চোখের সামনে হঠাৎই একদিন আসে ইয়াহু চ্যাট, যা একজন পরিচিত মহিলার সঙ্গে অনুরাগ করেছে। পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছিল কল্পনার। একে কম বয়স, তারপর এক বছর মাত্র বিয়ে হয়েছে, ও ভাবতেই পারছিলনা। কিন্তু বিশ্বাস ভঙ্গের চেয়েও বেশি কষ্ট দিয়েছিল যে ঘটনা, তা হল, ওদের আদরের সময় একটি বিশেষ কথোপকথন ছিল, সেই কথোপকথনের অনুরাগের কথাগুলো ও ওই মহিলাকে বলেছে। যা ছিল শুধুমাত্র ওদের, ওদের দাম্পত্যের; তার ভাগীদার অন্য কেউ হয়ে গেল! ওই বিশেষ কথাটি শেয়ার করার জন্য ও অনুরাগকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারে নি।

আজ দুপুরে কল্পনা উত্তম কুমারের একটি খুব নরম রোমান্টিক চাহনির ছবি পাঠিয়ে বলেছিল, “এরকম করে তাকাও আমার দিকে, সেটা চাই একবার। উত্তর এসেছিল,

-আমি কারো মতো তাকাতে পারবো না ডিয়ার, আমি আমার মতোই তাকাবো।”

-চেষ্টা করো, গভীর প্রেম থেকে তাকাও, ঠিক এরকম তাকাতে পারবে, তুমি তোমার মতোই তাকাবে। তারপর ফোনে একটু মজা করে কথা হয়, কল্পনা বলে,

-আমি তো‌ ভাবলাম, এই রিকোয়েস্ট টা শুনে তুমি ঠাস করে পড়ে যাবে।
-ও, বলতে পারতে, আমার অবাক হওয়া উচিৎ ছিল। তবে হতাম।
-তবে ভাবো, নিজেকে উত্তম কুমার আর তাকাও, চিন্ময় যদি বলতে পারেন, তুমি ও পারো।” বেশ কিছুক্ষণ মজা করা হলেও, ওসব আমার দ্বারা হবে না’র কমন ডায়লগে ফোন শেষ হয়।

তারপর সন্ধেবেলা এই লাইভেরই দুটো গান শুনে কল্পনা ফোন করে ফেলেছিল সুতীর্থকে আনন্দে।‌ বলল,

-আমি তো ভাবলাম তোমাকে বলি, ‘ শুরু হল কবে, একই চাওয়া পাওয়া, একই অনুরাগে একই গান গাওয়া।’ তোমার বউয়ের সঙ্গে গাইছিলে, একটু হিংসে করবো না?

-করো, গাও‌।
-থাক, তুমি না হয় আজ বলেই দাও কবে শুরু হল এই অনুরাগ? বলেই দাও। বলেই দাও কত ভালোবাসো। কল্পনা মজা করে হাসছে, আর বলছে। পলিটিক্যালি কারেক্ট উত্তর সুতীর্থর “কাশ…।”
সবসময়ই বলে, কাশ… কল্পনার এই এক্সপেকটেশন টা সত্যি হত, এই আর কী!আর সেই ও-ই বলল এখন

-তুমি কি আমাকে ডাকবে উত্তম কুমার? বলো, ডাকবে? সেই ও-ই বলছে,

-“কে প্রথম, কবে প্রথম…”, কত সুন্দর করে তাকাচ্ছে, অন্য কথা বলতে পারতো, এটা তো ‘ওদের কথা’ বলে ভেবেছিল কল্পনা। ঝাপসা চোখ কল্পনার। আঠেরো বছর ভেসে যাচ্ছে এক অপমানে। অনুষ্ঠানের দরকারে তো অনেক নাটকীয়তার আশ্রয় নিতেই হয়! জীবনের প্রয়োজনে সব নাটকীয়তা কে বাদ দিয়ে খটখটে শুকনো উঠোনে দাঁড়াতে হয়।কাল সকালে অনেক কাজ, আঠেরো বছর ধরে অনেক ভুল-ঠিকের হিসেব গুলিয়ে ফেলে ও বেঁচে আছে।

আরেকটা সিডেটিভ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে কল্পনা, স্বপ্নে দেখে অজয় নদ, জলের উপরে পড়া জ্যোৎস্না আর টলটলে একটা মায়াবী চাঁদ।

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>