২০২০ সালের বাংলাদেশ বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষণা অনুযায়ী ১০ বিভাগে ১০ জন এবার বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পাচ্ছেন। কবিতায় এবার একাডেমি পুরস্কার পাচ্ছেন কবি মুহাম্মদ সামাদ। কবির কবিতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই এই আয়োজন।
মুহাম্মদ সামাদ-এর জন্ম ময়মনসিংহ জেলার জামালপুরে ১৯৫৬ সালে। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইনোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন। ২০০৯ সালে সমাজকর্ম শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ওয়াশিংটনস্থ সিএসডব্লিউই পরিচালিত ‘ক্যাথেরিন ক্যান্ডাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল ওয়ার্ক এডুকেশন’ এর ফেলো হিসেবে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্মের উচ্চশিক্ষার উপর তুলনামূলক গবেষণা করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে অধ্যাপক । ড. মুহাম্মদ সামাদ বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিএস)-এর উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে: আমার দু’চোখ জলে ভরে যায়, আজ শরতের আকাশে পূর্ণিমা, চলো, তুমুল বৃষ্টিতে ভিজি, পোড়াবে চন্দন কাঠ, আমি নই ইন্দ্রজিৎ মেঘের আড়ালে, একজন রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো, প্রেমের কবিতা, কবিতাসংগ্রহ ইত্যাদি। কাব্যক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি সৈয়দ মুজতবা আলী সাহিত্য পুরস্কার, কবি সুকান্ত সাহিত্য পুরস্কার, কবি জীবনানন্দ দাশ পুরস্কার, কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার, ত্রিভূজ সাহিত্য পুরস্কার, কবি বিষ্ণু দে পুরস্কার [২০০৯, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত]সহ অনেক সম্মাননা লাভ করেন। তিনি জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠকদের অন্যতম এবং তিন মেয়াদে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
কবির মৃত্যুতে
চারুমুখী মেয়ে– না, ভয় পেও না আমি তোমাকে ছোঁব না। তোমার আঙুলে রাখবো না আমার আঙুল তোমার কপালে বাড়াবো না হাত ওষ্ঠে ছোঁয়াবো না ওষ্ঠ আলিঙ্গনে কখনো নেবো না বুকে টেনে তোমাকে জড়াবো না আমার কোনো কবিতায়, গানে; রাখব হৃদয়ে ভরে, প্রাণে প্রাণে।
তুমি আগের মতোই চলে যাবে তাকাবে পিছন ফিরে তোমার চোখের মণি থেকে ঠিকরে পড়বে আলো; আলোর বিভায় আমি জ্বলে পুড়ে মরে যাবো!
আমি তো তোমাকে ছোঁবো না, হায়! তবু পথ চেয়ে রবো প্রতীক্ষায়।
প্লুটোর জন্যে এলিজি
ছোটবেলা আকাশে জোনাকপোকা আর তারাদের ছুটোছুটি দেখলে ওদের যে-কাউকে প্লুটো নেপচুন অথবা মঙ্গল গ্রহ ভেবে খুব আনন্দ পেতাম পিঠাপিঠি ভাই-বোনের মতোই গলাগলি করে বেড়ে উঠেছি আমরা প্লুটো আমাদের সঙ্গে কতো লুকোচুরি খেলেছে সন্ধ্যায়!
এখন জোতির্বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ অনর্থক প্লুটোর পেছনে উঠে-পড়ে লেগেছে; তাদের অজুহাত— প্লুটো তার প্রতিবেশীদের গ্রাস করতে অক্ষম; সে বিশ বছর পর-পর একবার নেপচুনের কক্ষপথের মধ্যে ঢুকে যায়; এবং সে নাকি আকারে বামন; তাই, গ্রহের মর্যাদা তার আর নেই!
আমরা তো ছেলেবেলা থেকেই দেখছি— প্লুটো কারো পাকাধানে মই কিম্বা বাড়াভাতে ছাই দিতে পছন্দ করে না। প্রতিবেশী বলতে তো ক্যারন, হাইড্রা আর নিক্স ওরা তো অনেক ছোট এবং প্লুটোর পুত্র-কন্যা তুল্য প্রীতিময় ভালোবাসাময় এই সহজাত মমতা কি খুবই দোষের?
আমরা কি মামা-খালাদের বাড়ি বেড়াতে যাই না গোবেচারা প্লুটো নেহাৎ পুরনো আত্মীয়তাসূত্রে বিশ বছর অন্তর একবার নেপচুনের আঙিনা ভ্রমণ করলে কার কী এমন ক্ষতি, শুনি?
গ্রহ-নক্ষত্রেরাও তো পরষ্পর ছোট-বড় ভাই-বোন। প্লুটো বয়সেও ছোট আমি বলি, আমরা তো ছোট ভাই-বোনদের জুতোর ফিতেয় ফুল তুলে দিই লাল টুকটুকে রিবনের ঝুটি করে স্কুলে পাঠাই, বেড়াতে নিয়ে যাই পার্কে, নদীতীরে … তাহলে কি ইরাকযুদ্ধের মতো খোঁড়া যুক্তির আড়ালে প্লুটোর প্রতি এ নির্দয়তা আমাদের সাজে?
এই ক’টা দিন থাকি-না আমরা মিলেমিশে মাটিতে আকাশে
এ বড়ো আশ্চর্য দেশ
এ বড়ো আশ্চর্য দেশ সেলুকাস! এখানে নদীরা বড়ো বেশি ক্ষণস্থায়ী- আজ নদী কাল বালুরেখা; এ বড়ো আশ্চর্য দেশ সেলুকাস, এখানে মানুষ অকস্মাৎ ভুলে যায় এই নদী দিয়েছে জীবিকা;
তৃষ্ণার বাটিতে জল, নদী ছিলো গঞ্জের উৎস; এসেছে জাগ্রত বিশ্ব, কেনাবেচা মৌল মমতায় সভ্যতার পদক্ষেপ, অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি ও বিস্তার; এমন আশ্চর্য দেশে লোকে ভোলে বড়ো সহজেই-
আত্মদান গ্রাস করে উগ্রতার বিহ্বল দস্যুরা। ভাস্বর জীবন যাঁর, শতাব্দীর দীর্ঘ রূপবান আমাদের বাংলার সেই বন্ধুকে নিতে হয় ক্রুশ, অথচ ঘাতক বাঁচে, জনারণ্যে প্রতিবাদ নেই।
আমার পরিচয়
আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি। আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি। চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে। তেরোশত নদী শুধায় আমাকে, “কোথা থেকে তুমি এলে “?
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে। আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে। আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে। এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারো ভূঁইয়ার থেকে আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘি’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে। আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে। আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।
এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্যসেনের থেকে এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে। এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।
আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে। এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে শুধাও আমাকে ‘এতোদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে?
তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই, “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”। একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।
পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের- কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের। শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস; অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ; একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস; আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।
এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান? যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান; তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি- চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।
মুজিব
মুজিব আমার স্বপ্ন-সাহস মুজিব আমার পিতা মুজিব আমার শৌর্যে-বীর্যে নন্দিত সংহিতা।
মুজিব আমার শিরায় শিরায় রক্তে রক্তে প্রেম মুজিব আমার ভালোবাসার সূর্য-সবুজ হেম।
মুজিব আমার স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি মুজিব আমার হৃদয়পটে চিরসবুজ ছবি।
মুজিব আমার পরশপাথর পবিত্র নিষ্পাপ মুজিব আমার বাংলা জুড়ে একটি লাল গোলাপ!!
তুমি ভূমিকন্যা
আমাদের স্বপ্নগর্ভা গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় তোমার জন্ম। জন্মগ্রামের প্রতিটি ধুলিকণা কাদামাটি গায়ে মেখে বাইগার নদীতে সাঁতার কেটে বৃষ্টিজলে হেঁটে হেঁটে রাজপথে সংগ্রামে মুক্তির মিছিলে মিশে আশৈশব তুমি আছো মানুষের পাশে; এই বাংলা তোমাকে ভালোবাসে।
আবহমান বাংলার শ্যামল রমণী তুমি পাখিরা তোমাকে দেখে ঘুম জাগানিয়া গানে মুখরিত করে আকাশ বাতাস; মাছেরা তোমার ডাকে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে; তোমার শাড়িতে লেগে থাকে শস্যের সুষমা ধান দূর্বা তিল তিসি… তোমার সর্বাঙ্গ জুড়ে বাংলার ষড়ঋতু: গ্রীষ্মে দাবদাহে বটবৃক্ষের ছায়ায় বরষার ভরা জলে নৌকার রঙিন পালে শরতের নদীতীরে শুভ্র কাশবনে হেমন্তের সোনাঝরা পাকাধানে শীতের কুয়াশাভেজা মিঠে রোদে বসন্তের কচি নতুন পাতায় বাংলাদেশ তোমাকেই খুঁজে পায়।
ঘাতকের রক্তচক্ষু মৃত্যুবাণ তুচ্ছ করে স্বজনের রক্তেভেজা এই বাংলায় বুকে কষ্টের পাথর চেপে চোখে অশ্রুর সমুদ্র নিয়ে ক্লান্তিহীন তুমি ছুটে যাও গ্রাম থেকে গ্রামে শহরের পোড়া বিধ্বস্ত বস্তিতে; মায়ের মমতা দিয়ে বুকে নাও দুখিনীরে। মুজিব-অভয়পুষ্ট তোমার প্রশান্ত আঁচলের ছায়া প্রতিদিন দীর্ঘতর হয়ে সমতলভূমি আর লামার পাহাড় ছুঁয়ে সস্নেহে ছড়িয়ে পড়ে জাপানের ফুকুশিমা থেকে সোমালিয়া-সুদানের খরাপীড়িত শিশুর মুখে। জাতিসংঘে, অগণিত বিশ্বসভায় তোমার সাহস আর শৌর্যের প্রভায় সাম্য মুক্তি শান্তির আকাক্সক্ষায় এশিয়া-আফ্রিকা ল্যাটিন আমেরিকায় সংগ্রামরত মানুষেরা জেগে ওঠে।
শেখ হাসিনা, জনগণমননন্দিত নেত্রী আমাদের শাশ্বত ফিনিক্স পাখি তুমি অগ্নিস্নানে শুচি হয়ে বারবার আসো তুমি ভূমিকন্যা তুমি প্রিয় মাতৃভূমি।
আমার নন্দিতা বাড়ি নেই
ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে এথেন্সের পথে মেঘের উপরে ভাসতে ভাসতে আমি চোখ বুজে নন্দিতাকে দেখি :
[ছোটোবেলা যে মেয়ে আমার জামা, জুতো ছোটো গায়ে ছোটো পায়ে গলিয়ে হাসতো খিলখিল করে]
এই শীতে- গায়ে ডাউন জ্যাকেট, পায়ে গামবুট মাথায় উলেন টুপি আর জিনসের প্যান্ট পরে ব্যাগ পিঠে সে লন্ডনের পথে পথে হাঁটে; বাস থেকে বাসে ওঠে, ট্রেন থেকে ট্রেনে চড়ে, ওভারব্রিজের সিড়ি ভেঙে প্ল্যাটফর্ম বদলায়; বাসভর্তি ট্রেনভর্তি ব্যস্তসমস্ত মানুষ সাদা কালো আর বাদামি মানুষ- তবুও এখানে কেউ যেনো কারো নয়; নন্দিতাও কাউকে চেনে না!
কখনও বা খুব ঠান্ডায় কফিশপে ঢুকে যায় এক কোণে বসে একা একা কফি খায়। আমি দেখি, সামারে সবুজ ঘাসে গাছে প্রজাপতির রঙিন দোলা; কাঠবিড়ালির ছুটোছুটি; মৌমাছিদের সুরে মশগুল ফুলের বাগান; আর, নন্দিতা কফির মগ হাতে করে
ইস্ট লন্ডন ইউনিভার্সিটির সবুজ চত্বরে পাখিদের মতো ওড়ে, ঘোরে, আড্ডা দেয়; ব্রিটিশ মিউজিয়ামে, মাদাম তুসোতে যায়; লন্ডন ব্রিজের রেলিঙে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেয়;
ফেসবুকের দেয়াল জুড়ে লাইক, লাইক…
রীমা আর আমি প্রতিরাতে ভাইবারে কথা বলি ওর ছোট্ট ঘরের নানান ছবি দেখি- বই ল্যাপটপ ফ্রাইপ্যান রাইসকুকার ডিপফ্রিজে ডিম মাছ বেরিফল…
হাসিমুখে কত না বাহবা দিই!
কোনো কোনো দিন বাড়ি ফিরে অভ্যেসবশত ডাক দিই- মা, কী করো? এসো খাই। ওর ঘর থাকে পাথরের মতো নিরুত্তর; আমার বুকের ভিতর মুহূর্তে বয়ে যায় শূন্যতার ঝড়…
বিশ্বের সর্বশেষ খবর, প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, সাক্ষাৎকার, ভিডিও, অডিও এবং ফিচারের জন্যে ইরাবতী নিউজ ডেস্ক। খেলাধুলা, বিনোদন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং স্বাস্থ্য সহ নানা বিষয়ে ফিচার ও বিশ্লেষণ।