মুক্তিযুদ্ধের নাটক ও বাংলা নাটকের ইতিহাস
মলয় বিকাশ দেবনাথ
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হলো মহান স্বাধীনতা। বাঙালী জাতি পেল একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখ-, পেল সাম্প্রদায়িকতামুক্ত প্রেক্ষাপট, স্বাধীন শিল্পচর্চার অনুকূল পরিবেশ। এর নেপথ্যে নাটক ও নাট্যকর্মীদের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। নাট্যকর্মীরা জনগণকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করেছিলেন পথনাটকের মাধ্যমে । এ ছাড়া শরণার্থীদের জন্য তহবিল গঠনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ক্যাম্পে নাটক মঞ্চায়ন হতো। পথে পথে ট্রাকে করে নাট্যকর্মীরা নাটক পরিবেশন করে এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন কলকাতার শরণার্থী শিবিরে মামুনুর রশীদ ‘পশ্চিমের সিঁড়ি’ নাটকটি মঞ্চায়ন করেছিলেন। তবে উল্লেখ্য যে মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকে স্বাধীনতা আন্দোলনের কাঠামো পাওয়া গিয়েছিল।যা ১৯৫৩ সালে বন্দী অবস্থায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রাজবন্দীদের সহযোগে তিনি মঞ্চস্থ করেছিলেন। প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা কাজ শুরু করেন মঞ্চ নিয়ে। নিয়মিত মঞ্চায়িত হতে থাকে নাটক, নান্দনিকতায় বিকশিত হতে থাকে নাট্যজগত। যুক্ত হতে লাগল তরুণ ছাত্র সমাজ।মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনায় শুরু হলো নাট্যরচনা, মঞ্চে ফুটে উঠল সমাজের প্রতিচ্ছবি। নাট্যকর্মীদের দ্বায়বদ্ধতাও বাড়ল, শুরু হলো দর্শনীর বিনিময়ে মঞ্চায়ন, গড়ে উঠল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, আরণ্যক নাট্যদল, থিয়েটার, নাট্যচক্র, ঢাকা থিয়েটার, বহুবচনসহ ঢাকাকেন্দ্রিক কিছু নাট্যদল। এছাড়া চট্টগ্রামের থিয়েটার ‘৭৩’ অরিন্দম নান্দিকার, গণায়ন, অঙ্গন, রাজশাহীর সাংস্কৃতিক সংঘ নাটোরের সাকাম, খুলনা থিয়েটার ফরিদপুরের সুনিয়ম, বরিশালের খেয়ালি বরিশাল নাটক, কুমিল্লার জনান্তিক ময়মনসিংহের বহুরূপী, কুষ্টিয়ার চারণিক, ইত্যাদি। এই দলগুলো স্বাধীনতা উত্তর মঞ্চনাটককে এগিয়ে নিয়ে যায়।
১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা উত্তর মঞ্চনাটক চর্চা আবার নতুন পথ দেখতে শুরু করে। সেই প্রতিযোগিতার একটি বড় শর্ত ছিল নাটকের পান্ডুলিপি হতে হবে দলের অভ্যন্তরীণ নাট্যকারের লেখা। তৈরি হয়ে যায় বেশ কিছু নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা। যেমন সেলিম আল দীন, আল মনসুর, হাবিবুল হাসান, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, ম হামিদ, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পিযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ নাট্যজন। অন্যদিকে স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই যারা নাটকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, নাট্যচর্চাকে নাট্যধারায় অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবদুল্লাহ আল মামুন, মমতাজউদ্দিন আহমেদ, মামুনুর রশীদ, আলী যাকের, ফেরদৌসী মজুমদার। এই গুণী নাট্যব্যক্তিত্বদের নিরন্তর প্রচেষ্টায় মঞ্চনাটকের জৌলুস ফিরে আসতে থাকে। নাটকের নির্মাণ, অভিনয় প্রয়োগে প্রতিনিয়ত নতুনত্বের ছাপ দেখা দেয়। সামাজিক, বৈপ্লবিক নাটকের পাশাপাশি নাটকে স্থান পায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাস্তবতা, রোমান্টিকতা কমেডি। তবে লক্ষণীয় যে যুদ্ধপরবর্তী নাট্য জগতের রথী, মহারথীদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তাই তৎকালীন নাটকগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট বিশেষভাবে লক্ষণীয়। পাকসেনাদের এক দোসরকে কেন্দ্র করে সৈয়দ শামছুল হক রচনা করেন ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। এটিকে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম কাব্য নাটকও বলা হয়ে থাকে। এছাড়া ‘এখানে এখন’ নাটকেও তিনি ফুটিয়ে তোলেন মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়। ‘জয়জয়ন্তী’ নাটকে মামুনুর রশীদ তুলে ধরেন মুক্তিযুদ্ধকালীন গ্রাম্যজীবন ও শিল্পীদের জীবন সংগ্রাম। ড. এনামুল হক রচনা করলেন ’সেই সব দিনগুলো।’ এসএম সোলায়মানের ’এ দেশে এ বেশে’ নাটকের বিষয়বস্তু ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ও প্রাপ্তি। নাট্য নির্দেশক নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু রচনা করলেন, ‘একাত্তরের পালা’ ও ‘টিটোর স্বাধীনতা’। মমতাজউদ্দিন আহমেদের ‘সাতঘাটের কানাকড়ি’ ‘কি চাহো শঙ্খচিল’, ’স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’ ও ’বর্ণচোরা’ নাটকে উঠে আসে স্বাধীনতার ইতিহাস। সে সময় মঞ্চের পাশাপাশি পথনাটকও হয়ে ঊঠে জনপ্রিয়। এসএম সোলায়মান তার ‘ক্ষ্যাপা পাগলার প্যাচাল’ পথনাটকে মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরেছিলেন। মান্নান হীরার ‘একাত্তরের ক্ষুদিরাম’ একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উল্লেখযোগ্য পথনাটক।
স্বাধীনতা উত্তর দশ বছরে মঞ্চ নাটকে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। সে সময় স্ব স্ব দলের প্রযোজনার পাশাপাশি নাট্যকর্মীগণ একটি ছাতার নিচে আসার তাগিদ অনুভব করলেন। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকার উল্লেখযোগ্য নাট্যদলগুলো আলোচনায় বসে এবং তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তেই বাংলাদেশে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন গঠনের পরিকল্পনা হাতে নেয় যা বাস্তবায়ন হয় ১৯৮১ সালের আগস্ট মাসে। ফেডারেশনের প্রথম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে নির্বাহী পরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সভাপতিম-লীর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন রামেন্দুমজুমদার ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। নাট্য আন্দোলন আরও বেগবান হলো, সংযোজিত হলো নাট্যবিষয়ক শিক্ষাগ্রহণকারী পেশাদারী নাট্যকর্মী। দিল্লী ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা (এনএসডি) থেকে সদ্য বের হওয়া কিছু নাট্যকর্মী তাদের শ্রম এবং শিক্ষাকে প্রয়োগ করতে লাগলেন মঞ্চ প্রযোজনায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রভাবে মঞ্চনাটক নতুন মাত্রা পেল। আশির দশকের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনাগুলোর মধ্যে সেলিম আল দীনের কীর্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, চাকা, মামুনুর রশীদের ওরা আছে বলেই, ইবলিশ, এখানে নোঙর, খোলা দুয়ার, গিনিপিগ, আব্দুল্লাহ আল মামুনের সেনাপতি, এখনও ক্রীতদাস, মমতাজউদ্দিনের বিবাহ, কি চাহ শঙ্খচিল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বাংলা নাট্য ইতিহাসে অপর এক মাইলফলক হচ্ছে ‘মুক্ত নাটক’। নগরকেন্দ্রিক নাট্যচর্চাকে মধ্যবিত্তের বলয় থেকে বের করে বৃহত্তর শ্রমজীবী ও কৃষিজীবী মানুষের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরণ্যক নাট্যদলের নেতৃত্বে ১৯৮৪ সালে শুরু হয় মুক্ত নাটক আন্দোলন। বাংলাদেশের মঞ্চনাটক মঞ্চ ছেড়ে রাজপথে জায়গা করে নিল, নাট্যচর্চা মঞ্চের পাশাপাশি জনপ্রিয়তা পেতে থাকে শহীদ মিনার, উদ্যান, পার্ক, ময়দানে। বাংলাদেশে পথনাটকের গোড়াপত্তন ঘটে ঢাকা থিয়েটারের চর কাঁকড়া ডকুমেন্টারি নাটকটির মাধ্যমে। সেলিম আল দীনের রচনায় ও নাসির উদ্দিন ইউসুফের নির্দেশনায় টিএসসির সড়ক দ্বীপে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। তৎকালীন স্বৈর সরকারের পুলিশ বাহিনী নাটকটির ওপর হামলা চালায়। তবে নব্বইয়ের স্বৈরসরকারের পতন ও গণআন্দোলনে গ্রুপ থিয়েটারের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতি, স্বৈরাচারের কীর্তিকলাপ ও গণতন্ত্রের মুক্তি নিয়ে প্রচুর নাটক মঞ্চস্থ হয়। মমতাজউদ্দিন আহমেদের সাতঘাটের কানাকড়ি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে উৎকৃষ্ট প্রমাণপত্র। ’৯০-এর দশকে ঢাকা থিয়েটার তাদের চিন্তাভাবনাকে একটু ভিন্ন দিকে নিয়ে গিয়েছিল। হাজার বছরের বাঙালীর ঐতিহ্য ও নিজস্ব সংস্কৃতিকে পুনরুদ্ধার করার প্রচেষ্টায়। সেলিম আল দীনের রচনায় ও নাসির উদ্দীন ইউসুফের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় যৈবতি কন্যার মন, হাতহদাই বনপাংশুল প্রভৃতি। এর মাধ্যমে নাট্যরীতি বহুমাত্রিকতা লাভ করে যেমন বর্ণনাত্মক নাট্যরীতি, পাঁচালী রীতির প্রবর্তন হয়।
গ্রুপ থিয়েটারের প্রযোজনায় এই উপমহাদেশীয় নাটকের পাশাপাশি সংযোজিত হয় পাশ্চাত্যের অনুবাদ নাটক। যেমন সফোক্লিসের ‘রাজা ইডিপাসের’ মতো ধ্রুপদী নাটক থেকে শুরু করে স্যামুয়েল বেকেট, ইউজিন আয়ানেস্কা, বার্টল্ট ব্রেখট, জ্যাঁ পল সার্ত, এলবেয়ার ক্যামু, এডওয়ার্ড এলবি, হেনরিক ইবসেন, শেক্সপিয়ার, হাইনার ম্যূালার, হ্যারল্ড পিন্টার, আর্থার মিলার, মলিয়ের প্রমুখ নাট্যকারদের নাটক উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে মলিয়েরের কমেডি বিশেষভাবে দর্শক জনপ্রিয়তা পেয়েছে যেমন লোকনাট্যদলের কঞ্জুস, কুশীলবের গিট্টু, নাট্যকেন্দ্রের বিচ্ছু অন্যতম। বলতে দ্বিধা নেই যে, মলিয়েরের কমেডি নাটক দিয়ে দর্শক ধরে রাখার একটা প্রচেষ্টা ছিল নাট্যাঙ্গনে। জনপ্রিয়তা পেয়েছিল বার্টল্ট ব্রেখটের অনুবাদ নাটকগুলো যেমন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের গ্যালিলিও, সৎ মানুষের খোঁজে, দেওয়ান গাজীর কিস্সা, নাগরিক নাট্যাঙ্গনের ‘জনতার রঙ্গশালা’ অন্যতম। এপিক থিয়েটারের যে ধারা ব্রেখট সৃষ্টি করে গেছেন তা দর্শকদের নাটকের সঙ্গে যুক্ত রাখার চমৎকার উদাহরণ। বিদেশী নাটকের মধ্যে আরেক অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডি ও কমেডি। ঢাকা থিয়েটারের মার্চেন্ট অব ভেনিস, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের দর্পণ, থিয়েটারের ম্যাকবেথ। ঢাকার মঞ্চে নিরীক্ষাধর্মী নাটক স্যামুয়েল বেকেটের ‘ওয়েটিং ফর গডো’ সফল মঞ্চায়নও হয়েছে। স্বাধীনতা উত্তর মঞ্চে অভিনয়ের পাশাপাশি আলোক পরিকল্পনা ও মঞ্চসজ্জা, রূপসজ্জা ও পোশাক পরিকল্পনায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রভাব পড়েছে নাটকের এই শাখাগুলোতে। আলোক পরিকল্পনার আধুনিকায়নে যারা শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার তারা হচ্ছেন ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ, কামরুজ্জামান। জামিল আহমেদের আলোক পরিকল্পনায় প্রযোজিত হয়েছে ফণিমনসা, কিত্তনখোলা, কেরামত মঙ্গল, ইনস্পেক্টর জেনারেল, ইডিপাস, গিনিপিগ, অচলায়তন, বিসর্জন, বিষাদ সিন্ধু। ড. জামিল আহমেদ প্রথম বাংলা নাটককে দেশের গ-ি ছেড়ে বিদেশের মাটিতে মঞ্চায়িত করেন। সেলিম আলদীনের রচিত চাকা নাটকটি ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করে ডেনি প্যাট্রেজের সঙ্গে যৌথভাবে নির্দেশনা দেন আমেরিকায় এবং এটি তাকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেন। এরপর ১৯৯১ সালে ঢাকার মঞ্চে নাটকটির নির্দেশনা দেন। এ ছাড়া তিনি বিষাদ সিন্ধু নাটকের নির্দেশনা দিয়েছিলেন যার পান্ডুলিপি রচনা করেছিলেন ড. বিপ্লব বালা। নাটকটির স্থিতিকাল ছিল ৬ ঘণ্টা। এ ছাড়া তার নির্দেশনায় মঞ্চায়িত হয় লোকনাটক কমলা রানীর সাগরদীঘি, বেহুলার ভাসান, সংভংচংয়ের মতো প্রযোজনা যা দর্শককে আকৃষ্ট করেছিল দারুণভাবে। কিন্তু এ ধরনের কাজের অপ্রতুলতা মঞ্চনাটক থেকে দর্শকবিমুখতা তৈরি হয়েছে। ২০১০ সালে তিনি পুনরায় এনএসডিতে নির্দেশনা দেন ম্যাকবেথ নাটক এবং ২০১২ সালে কলকাতায় শ্যামার উড়াল। তার রচনায় রয়েছে প্রথম গ্রন্থ ‘হাজার বছর বাংলাদেশের নাটক ও নাট্যকলা’, ৭০টি লোকনাট্যরীতি নিয়ে গ্রন্থ অচিন পাখি এবং উন্নয়ন নাট্য নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী গ্রন্থ তৃতীয় বিশ্বের বিকল্প নাট্যধারা : উন্নয়ন নাট্য : তত্ত্ব ও প্রয়োগ। নিরীক্ষাধর্মী নাটক নিয়ে কিছু কাজ হচ্ছে কিন্তু অনিয়মিত মঞ্চায়নের ফলে এগুলোর সম্প্রসারণ বা প্রচার হচ্ছে না। ড. ইস্রাফিল শাহীন ম্যাকবেথ নাটকটিতে প্রচলিত প্রসেনিয়াম রীতি ভেঙ্গে পরীক্ষণমূলকভাবে একটি সফল প্রযোজনা করেছিলেন। গ্রুপ থিয়েটারের বদৌলতে নাট্যচর্চা এ ভূখ-ে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছে। এখন ছোট- বড় মিলে দুই শতাধিক নাট্যদল রয়েছে, প্রযোজনাও হচ্ছে নিয়মিত। মঞ্চের অপ্রতুলতা যদিও এর অন্তরায়, আরও মঞ্চের প্রয়োজন। এলাকাভিত্তিক নাট্যমঞ্চ এখন যুগের চাহিদা। তবে পেশাদারিত্বের অভাব এখনও মঞ্চনাটকে পরিলক্ষিত হয়। মঞ্চ নাটকে পেশাদারিত্ব এনে দিতে না পারলে এ শিল্পের ধারাবাহিকতায় যথেষ্ট টান পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পেশাদার নাট্যদল গঠনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল বাংলা থিয়েটার (১৯৯১) থিয়েটার আর্ট ১৯৯২ এবং সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (সিএটি) ১৯৯৪। সিএটি ছাড়া বাকি দুটি দল ব্যর্থ হয়েছে। কামালউদ্দিন নিলুর উদ্যোগে বিদেশী কিছু পেশাদারী নাট্যকর্মীর সহযোগিতায় ঢাকার মঞ্চে নাট্যচর্চা শুরু করেন।
এখন দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বাংলা নাটক ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের নাটকও প্রযোজিত হচ্ছে এ বাংলায়। এপারের সঙ্গে ওপারের তৈরি হয়েছে সেতুবন্ধন। ২০১৪ সালের ১৪ জুলাই কমনওয়েলথ গেমসের উদ্বোধনী সন্ধ্যায় স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে মঞ্চস্থ হয়েছে থিয়েট্রেক্সের প্রযোজনায় শাহমান মৈশানের রচিত ও সুদীপ চক্রবর্তী নির্দেশতি নাটক দক্ষিণা সুন্দরী। দেশের মঞ্চে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব। বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর উদ্যোগে দেশের সুবিধাবঞ্চিত শিশু ও যুবকদের নিয়ে তার পিপলস থিয়েটার একটি যুগান্তকারী প্রয়াস।
বাংলা মঞ্চনাটকের এই পথচলার পেছনে রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস। অনেক ত্যাগ আর বির্সজনে এই পথচলা। মঞ্চনাটকের ইতিহাস তো প্রায় সভ্যতার সমান্তরাল। সেই শুরু থেকেই মঞ্চনাটক যেমন ছিল বিনোদনের মাধ্যম তেমনি আলো ফেলেছে সমাজের নানান অসংঙ্গতিতে। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকে নগরাঞ্চলে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের লক্ষ্যে শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। সংস্কৃত নাট্যচর্চা তৎকালীন বিত্তবানদের সাংস্কৃতিক জীবনে মনের খোরাক যোগাত, যার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘চন্দ্রগোমী’ রচিত সংস্কৃত নাটক ‘লোকানন্দ’তে। এই নাট্যধারা ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে জনগণের সঙ্গে যুক্ত হতে লাগল যা পরবর্তীকালে দেশজ নাট্যরীতি বলে আখ্যায়িত হলো। এই রীতিতে গদ্য সংলাপের সঙ্গে যুক্ত হলো নৃত্য, যন্ত্রসঙ্গীত, গীতিকাব্য, পুতুলনাচ ইত্যাদি। এই দেশজ নাটককে পরিভাষায় বলা হয়ে থাকে লোকনাট্য। আধুনিক যুগের ঊষালগ্নে লোকনাট্যের মধ্যে ভারতীয় নাট্যরীতির শিকড় ছিল যেমন : লোকগান, কবিগান, রামযাত্রা, আখড়াই, মঙ্গলকাব্য ইত্যাদি। কিন্তু ঔপনিবেশিকতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে এই সমৃদ্ধ সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও আমাদের নাটক বা মঞ্চ পায়নি কোন শক্তিশালী ভিত্তি। এরপর দীর্ঘ সময় পথপরিক্রমার পর ১৭৯৫ সালের ২৭ নবেম্বর বাংলা থিয়েটার ও বাঙালীর প্রথম নাট্যাভিনয়ের সূচনা হলো। তখন কলকাতায় নগরায়ন শুরু হয়েছে ধীরগতিতে। বিদ্যুতের আলো তখনও অপরিচিত, সংবাদপত্র দূরে থাক, ছাপার যন্ত্রও আসেনি। বাংলা গদ্য তখনও অপরিচিত। তাই স্বাভাবিকভাবে বাংলা ভাষায় নাটক লেখা বা অভিনয় করার চিন্তাও কারও মাথায় আসেনি। কিন্তু এসেছিল রুশ পর্যটক গেরেসিম স্তিফানোভিচ লেবেদেফের মাথায়। তিনিই প্রথম শুরু করেন বাংলা ভাষায় নাট্যাভিনয়। লেবেদেফ ছিলেন একজন ভাল বেহেলা বাদক। ১০ বছর কলকাতায় থেকে তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এ দেশের মানুষের আচার আচরণে, ভালবেসেছিলেন বাংলা ভাষাকে। তাই তিনি জনৈক শিক্ষক গোলকনাথ দাসের কাছে বাংলা ভাষা শেখেন এবং ১৭৯৫ সালের ২৫ নবেম্বর ‘দ্য ডিসগাইস’ –এর বাংলা অনুবাদ ‘কাল্পনিক সংবদল’ মঞ্চায়ন করেন। মাঁচা বেঁধে কলকাতার ডোমোটোলায় প্রতিষ্ঠা হলো বেঙ্গলী থিয়েটার। তিনিই গোলকনাথের সহযোগিতায় তিনজন বারাঙ্গনা কন্যাকে নিয়ে এসে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অভিনয়ও শুরু করেন একই মঞ্চে। সেই সঙ্গে তিনি শিখিয়ে ছিলেন বিনোদন শুধু বিত্তশালীদের জন্য নয় এটি সর্বসাধারণের উপভোগের বস্তু। ইতিহাস সৃষ্টি হলো ঠিকই কিন্তু ইংরেজ বণিক আর সমাজপতিরা এটা ভালভাবে নিতে পারেনি। তাই তাকে দেনায় জড়িয়ে, তার থিয়েটারে আগুন জ্বালিয়ে তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেন। কলকাতা থেকে ফিরে গিয়ে তিনি তার বন্ধু সাম্বারাস্কিকে একটি চিঠিতে কিছু বিবরণ লিখে গিয়েছিলন। দলিল বলতে সেটুকুই। এ ছাড়া ওই নাটক বা অভিনয় বা গোলকনাথ নিয়েও আর কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। অন্ধকারে কেটে গেল আরও ৬৩ বছর। ১৮৫৮তে রামনারায়ণ তর্করতœ অভিনয়ের নিমিত্তে প্রথম নাটক লিখলেন ‘কুলীন কুলসর্বস্ব’। জমিদার বাবুরা তাদের বাড়ির আঙ্গিনায় নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করলেন, সাধারণের প্রবেশাধিকারে এলো নিষেধাজ্ঞা। উনিশ শতকের প্রথম দিকে স্কুল-কলেজে শেক্সপিয়ার প্রবর্তিত শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গৃহীত হয় এবং ইউরোপীয় নাট্যরীতি আধুনিকতার নিদর্শনরূপে বিবেচিত হয়। অভিজাত জমিদার বাবুদের পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু নাট্যদল গড়ে ওঠে যার মধ্যে ‘বেলগাছিয়া থিয়েটার’ উল্লেখযোগ্য। এই নাট্যশালার মঞ্চ, অর্কেষ্ট্রা আলোকসজ্জা ছিল নাট্যশিল্পে আধুনিকায়নের মাইলফলক। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইউরোপীয় নাট্যনির্মাণ কৌশল সাফল্যের সঙ্গে আত্তীকরণের পর মাইকেল মধুসূদন দত্ত নাটকে নতুন মাত্রা যোগ করেন। তার রচিত নাটকগুলোর মধ্যে শর্মিষ্ঠা (প্রথম মঞ্চায়ন ১৮৫৯ সালে বেলগাছিয়া থিয়েটার), পদ্মাবতী (১৮৬০) ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১)। ১৮৬৫ সালে মঞ্চায়িত ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসনে তিনি তৎকালীন আধুনিক যুব সমাজকে কটাক্ষ করেন। তার আরেকটি সার্থক প্রহসন ‘বুড়ো শালিকের ঘাঁড়ে রোঁ’ (মঞ্চায়ন ১৮৬৭)তে সমাজের মুখোশধারীদের মুখোশ উন্মোচন করেন। এরপর ১৮৭২ সালে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মঞ্চায়নের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলো সাধারণ রঙ্গালয় ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’। সর্বসাধারণের সম্পৃক্তার সুযোগ সৃষ্টি হলো, বাংলা নাট্য ইতিহাস পেল নতুন মাত্রা। তৎকালীন নীলকরদের অথ্যাচার-অনাচার-শোষণের তীব্র প্রতিবাদই ছিল এই নাটকের মূল প্রয়াস। যা সেই সময়ে মধ্যবিত্তদের কাছে পেয়েছিল চরম জনপ্রিয়তা।
পেশাদারী মঞ্চ ও নাট্যাভিনয়ে ধারাবাহিকতা তৈরি হয় নাট্য ইতিহাসে। অর্ধেন্দু শেখর, অমৃতলাল, গিরিশচন্দ অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, বিনোদিনী, তারাসুন্দরী, প্রভাদেবীর পর নাটককে এগিয়ে নিয়ে যায় মধুসূদন দত্ত, দীনবন্ধু মিত্র, ক্ষীরোদ প্রসাদ, বিদ্যাবিনোদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, মন্মথ রায়, বিধায়ক ভট্টাচার্য প্রমুখ নাট্যকারগণ। এরপর শিশির কুমার ভাদুরী একাই তরীর মাঝি। শুরু হয় আবার পেশাদারী মঞ্চের অবক্ষয়। এলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যার পরোক্ষ প্রভাব পড়ল ভারত উপমহাদেশে। কালোবাজারি, সুদ ব্যবসায়ী, মজুদদারি অন্যদিকে হতাশা, বেকারত্ব ও দারিদ্র্যতায় নিষ্পেষিত সাধারণ মানুষ। পেটে নাই ভাত-তায় শিল্পচর্চা! ১৯৪৩-এ দেখা দিল মন্বন্তর, ৩৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারাল। মানুষ মুক্তির সন্ধানে দিশেহারা আর তখনই সঙ্কট নিরসনের লক্ষ্যে গড়ে উঠল গণনাট্য সংঘ। সামাজিক অবক্ষয় আর লাখ লাখ মৃত্যু শোককে শক্তিতে পরিণত করে গণনাট্য সংঘের নেতৃত্বে শুরু হলো গণনাট্য আন্দোলন। এই ক্রান্তিলগ্নে গণনাট্য সঙ্গের প্রযোজনায় বিজন ভট্টাচার্য্য আবির্ভূত হলেন ‘নবান্ন’ নাটক নিয়ে। ১৯৪৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বিজন ভট্টাচার্য্য এবং শম্ভুমিত্রের যৌথ পরিচালনায় মঞ্চস্থ হলো নবান্ন। পূর্ববতী সমস্ত নাট্যরীতি, সনাতনী নাট্যধারা ভেঙ্গে ‘নবান্ন’ মঞ্চস্থের পর এটি বাংলা নাট্য ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক হয়ে গেল। আধুনিকতার সর্বোৎকৃষ্ঠ উদাহরণ তৈরি হলো শিল্প যে মানুষের কথা বলতে পারে তা প্রতিষ্ঠিত হলো।
আজকের মানুষের কল্যাণের জন্য শিল্পচর্চা মূলত এই নাট্য ধারারই অবদান। সাধারণ মানুষের ভেতর তৈরি হতে লাগল সচেতনতাবোধ । অন্যায়, অত্যাচার শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে লাগল সমগ্র বাঙালী জাতি, বুঝে নিতে চাইল নিজেদের অধিকার।এরপর ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে যখন পাকিস্তানী শোষকেরা রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করে তখন থেকেই সাংস্কৃতিক আন্দোলন আরও জোরদার হতে থাকে।
নাটকে স্বাধীনতা বা স্বাধিকারের কথা বলার জন্য অনুকূল পরিবেশ তখন ছিল না।তারপরও নাট্য কমীরা সোচ্চার ছিলেন প্রতিবাদ প্রতিরোধের আন্দোলনে, সংগ্রামে।