| 19 এপ্রিল 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্য দ্বিতীয় সংগ্রামের শিল্পরথ

আনুমানিক পঠনকাল: 5 মিনিট

রফিকউল্লাহ খান



বাঙালি জীবনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা বৈপ্লবিক যুগান্তরের সম্ভাবনায় তাত্পর্যবহ ও সুদূরপ্রসারী। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি স্বৈরশাসন-বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ও চেতনা আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের মতো শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও  যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। স্বাধীনতাসংগ্রামকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গণজাগরণ ও বৈপ্লবিক চেতনার স্পর্শে এক অপরিমেয় সম্ভাবনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে বাঙালির সৃষ্টিশীল মানস। সেই উজ্জীবনী শক্তি একাত্তরের রক্তস্নাত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে ক্রমাগত মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্যতা নির্দেশ করেছে। আমরা জানি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জাতীয় জীবনে অপরিমেয় ত্যাগ, প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সাফল্যের সূর্যোদয়ে গৌরবময়। ইতিহাসের যে গতিশীল ও দ্বন্দ্বময় ধারা পলাশীর বিপর্যয় (১৭৫৭), সিপাহি বিদ্রোহ (১৮৫৭), কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি ও বিভেদের রাজনীতি, পাকিস্তান আন্দোলন, ১৯৪৭-এর অসঙ্গত রাজনৈতিক মীমাংসা, ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান প্রভৃতি ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জীবনে সেই ঐতিহাসিক নিয়মেরই চরম পরীক্ষা।  স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধোত্তরকালে বাংলাদেশের সামগ্রিক জীবনকাঠামোতে গুণগত পরিবর্তন ছিল প্রত্যাশিত, প্রয়োজনীয়; কিন্তু রক্তাক্ত যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ জাতীয় জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তনের গতি অল্প কিছুকালের মধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়ে। সচেতন সমাজমানস অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করে: কেবল পরিমাণগত পার্থক্য ছাড়া পাকিস্তানি আমলের আর্থ-সামাজিক কাঠামোর কোনো গুণগত পরিবর্তন বাঙালির জাতীয় জীবনে ঘটেনি। স্বাধীনতা-উত্তর কয়েক বছরের মধ্যেই, ১৯৭৫-পরবর্তীকালে, জাতিশোষণ রূপ নিল শ্রেণিশোষণে, নতুন কৌশলে সামরিক শাসন নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্টযন্ত্র, স্তব্ধ করা হয় মুক্তচিন্তা ও সত্যকণ্ঠ। জাতিসত্তা পুনরায় নিক্ষিপ্ত হলো অতীতের উপনিবেশিত মানসিকতা ও ধর্মান্ধতার নষ্টগর্ভে। স্বাধীনতাবিরোধী বিশ্বশক্তিসমূহের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদদে গড়ে উঠল কিছু সশস্ত্র গেরিলা সংগঠন। ফলে, শান্তিকামী গ্রামজীবন পুনরায় হলো রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক শক্তির অনৈক্য, আপোষকামিতা ও সুবিধাবাদ বৃহত্তর জনজীবনে নিয়ে এল হতাশা, অনিশ্চয়তা ও আত্মশক্তিতে অনাস্থা।
জাতীয় জীবনের এই বিদীর্ণ পটভূমিতে বাংলাদেশের সৃষ্টিশীল মানুষেরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী কবিতা, উপন্যাস, গল্প ও নাটক রচনার পরিবর্তে পুনরায় আত্মজিজ্ঞাসার ঘূর্ণাবর্তে নিক্ষিপ্ত হলেন। তেইশ বছরের পুরোনো প্রশ্নই যেন মুক্তিযুদ্ধকালীন উপকরণে নতুন পরিস্থিতিতে প্রকাশ পেতে থাকল। ফলে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের সাহিত্য প্রধানত হয়ে থাকল মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডচিত্র, মুক্তিযোদ্ধার অস্তিত্বহীনতা এবং ব্যক্তি ও সমষ্টির আত্মসন্ধানের যোগফল।

২.
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের কবিতার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তনসম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে—এটা স্বভাবিক ও প্রত্যাশিত ছিল। দীর্ঘ রক্তাক্ত সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, স্বাধীন মানচিত্র, নিজস্ব পতাকা সর্বোপরি সমাজের গুণগত পরিবর্তনের সমূহ সম্ভাবনায় সংবেদনশীল কবিচৈতন্য স্বভাবতই নবতর কাব্যবস্তু সন্ধানে তত্পর হবে। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা লক্ষ করলাম, বাংলাদেশের কাব্যস্বভাবে সূচিত হয়েছে এক জটিল জঙ্গম, যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় পূর্ববর্তী সময়-পরম্পরায় কবিগোষ্ঠীসমূহ কাব্যোপকরণের প্রশ্নে প্রায় অভিন্ন বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে। একটা সামাজিক চরিত্রও বাংলাদেশের কবিতা এ-সময়ে অর্জন করে। ভাষা আন্দোলনের অব্যবহিত পরে অনেকটা এইরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও ব্যক্তিসত্তার নব্যবিকাশের সম্ভাবনায় অনেক কবিই সামাজিক বক্তব্য প্রকাশের প্রশ্নে ব্যক্তিরুচিকেই প্রাধান্য দিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সংরক্ত চেতনা, গণতন্ত্রায়ণ ও শিল্পায়নের অবাধ বিকাশের সম্ভাবনায় নবগঠিত রাষ্ট্রসত্তায় ব্যক্তির আকাশচুম্বী স্বপ্ন একটা সামষ্টিক চরিত্র নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে ষাটের দশকের শেষার্ধে উদ্ভূত অনেক কবি এবং সমকালীন সামাজিক রাজনৈতিক জঙ্গমতার মধ্যে আত্মপ্রকাশকামী তরুণ কবিদের মধ্যে কখনো কখনো চেতনাগত ঐক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুদ্ধোত্তরকালের নবোদ্ভূত কবিদের রক্তিম জীবনাবেগ, সদ্য স্বাধীন দেশের বাস্তবতায় সীমাতিরিক্ত প্রত্যাশা ও অবশ্যম্ভাবী ব্যর্থতাবোধ, প্রেম ও নিসর্গভাবনায় প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা প্রভৃতি একটা সামাজিক রূপ লাভ করে। ষাটের দশকের অনেক কবি স্ব-উদ্ভাবিত পরিণত আঙ্গিকে অভিন্ন কাব্যবস্তুকেই যেন প্রকাশ করলেন। ফলে তরুণ কবিদের স্বতন্ত্র কাব্যস্বর অনেকের কাছেই অনুক্ত থেকে গেল। এমনকি, পঞ্চাশের দশকের শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী এবং ষাটের দশকের অধিকাংশ কবিই নিজস্ব কাব্য-অবয়বে সমকালের সংরক্ত চেতনা ধারণ করলেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর চল্লিশ, পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের কবিরা আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব কাব্যবস্তুর সন্ধান পেলেন। সৃজন-মননের যৌথ রাগে অভিজ্ঞতা ও অভিজ্ঞানকে তাঁরা নিজ নিজ বোধের মাত্রা অনুযায়ী রূপদান করলেন। কিন্তু এত বড় একটা সামাজিক-রাজনৈতিক পটপরিবর্তন কাব্যস্বভাবের যতটা রূপান্তরের সম্ভাবনা জাগিয়েছিল, অল্পসংখ্যক কবি ছাড়া অধিকাংশই তা অনুধাবনে ব্যর্থ হলেন। উল্লেখ্য যে, বাঙালির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের যে তাত্পর্য, কেবল কাব্যবিষয়ের মধ্যে তাকে সীমায়িত করে দেখা ঠিক হবে না। জীবনের সামগ্রিক পরিবর্তনে বস্তুজগত্ ও চেতনার বৈপ্লবিক রূপান্তরে কবিতার রূপ, রীতি, শব্দ অর্থাত্ সামগ্রিক প্যাটার্নেরই পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়ে। যেমন দেখেছি ইউরোপীয় রেনেসাঁসের কবিতা, ফরাসি বিপ্লবের সাহিত্য-শিল্প, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কিংবা রুশ বিপ্লবের কবিতা এবং বিপ্লবমন্থিত লাতিন আমেরিকার কবিতা। পঞ্চাশের দশকে উদ্ভূত কবিদের চেতনা ও সৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের আবেদন বহুমাত্রিক।
যুদ্ধোত্তর প্রথম পর্বের কবিদের মধ্যে আবেগ ও যন্ত্রণার যে তীব্রতা, সেখানে নিকট-অতীতের সংগ্রামশীল সংরক্ত চেতনা বিস্ময়করভাবে অনুপস্থিত। মনে হয়, সমাজ ও জীবনের অব্যাহত ভাঙন কবিতার সংহত নিপুণ আবয়বেও এনে দিয়েছে বিস্রস্ত, এলোমেলো ভাব। জীবনের এক পাড় ভেঙে অন্য পাড় গড়ে উঠবে, সভ্যতা শিল্পের ইতিহাসে এ-রূপ দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ-বৈষম্য কেবল ভাঙনের অব্যাহত প্রক্রিয়াকেই ত্বরান্বিত করছে। সংগ্রামের ফল ব্যর্থতার কালো রঙে অবগুণ্ঠিত, প্রেম ও নারী সান্নিধ্যে নেই স্বস্তি—চিরপরিচিত নিসর্গলোকের শুশ্রূষার পরিবর্তে ক্ষুণ্নিবৃত্তির সর্বগ্রাসী ছোবল মানুষকে টেনে নিচ্ছে উদ্বাস্তু স্বপ্নের মোহে।


অগ্নিময় ও রক্তরঞ্জিত পশ্চাত্ভূমি আর সম্ভাবনাদীপ্ত সম্মুখকল্পনা—যার মাঝখানে তরঙ্গমুখর জাতীয় পরিস্থিতির বিচিত্রমাত্রিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। জীবনাবেগের এই সংরক্ত, তীব্র ও গভীর অন্তর্লক্ষণকে ধারণ করবার মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যকর্মের সাফল্যসূত্র। একজন মহত্ শিল্পীর কাছে সেই মানচিত্র বঙ্কিম-সরল রেখা ও কিছু নামের সমষ্টিমাত্র নয়, সামূহিক অস্তিত্বের বিরলদৃষ্ট সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, রক্তক্ষরণ এবং সাফল্যের চৈতন্যময় প্রকাশ।
১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমাজ সংগঠনে যে রূপান্তর সাধিত হয়েছে, জাতীয় চেতনার গুণগত বিকাশের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা নিঃসন্দেহে তাত্পর্যপূর্ণ। আর্থ-সামাজিক কাঠামো এবং চেতনার এই বিবর্তনের পটভূমিতেই বিবেচ্য আমাদের কথাসাহিত্যের গতি-প্রকৃতি, স্বাভাবধর্ম। একটা প্রলয়ঙ্করী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পরীক্ষিত শিল্পীর পক্ষেই কেবল সম্ভব মুক্তিযুদ্ধের রক্তোজ্জ্বল চেতনার শিল্পরূপ নির্মাণ। কিন্তু মর্মন্তুদ হলেও সত্য যে, যুদ্ধরত সমগ্র জাতিসত্তার প্রাণস্পন্দনকে শিল্পমণ্ডিত করতে গেলে যে গভীর জীবনাশক্তি এবং শৈল্পিক নিরাসক্তি প্রয়োজন, দু-একটি ব্যতিক্রম ব্যতীত আমাদের সাহিত্যে সেই অনিবার্য সমন্বয় তেমন লক্ষ করা  যায় না।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত উপন্যাসের সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু অভিজ্ঞতা, অভিজ্ঞান ও জীবনবোধের সংশ্লেষ সেখানে দুর্লক্ষ। সম্ভবত বাস্তব অভিজ্ঞতার দৈন্য অথবা মধ্যবিত্তের যুদ্ধোত্তর স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ এই সীমাবদ্ধতার অন্যতম কারণ। তবে ঔপন্যাসিকের জীবনচেতনা ও সমাজবোধের গভীরতা কোনো কোনো উপন্যাসকে তীব্র, তীক্ষ, গূঢ়ভাষী শিল্পকর্মে পরিণত করেছে।

৪.
সংখ্যাগত দিক থেকে বাংলাদেশে মুক্তিযুুদ্ধের পটভূমিতে রচিত গল্প নিঃসন্দেহে প্রাচুর্যের সাক্ষ্যবাহী। মনে করা সঙ্গত যে, কবিতা কিংবা উপন্যাস অপেক্ষা ছোটগল্পের অবয়বেই বাংলাদেশের কথাশিল্পীরা মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য শিল্পরূপ নির্মাণে বেশি মাত্রায় সমর্থ হয়েছেন। এর কারণ সম্ভবত জীবনের পূর্ণরূপ অপেক্ষা খণ্ড রূপের প্রতি শিল্পী-চৈতন্যের অধিকতর আকর্ষণ। অবশ্য এ কথাও সত্য যে, ছোটগল্পের সীমিত আয়তনে যে জীবন প্রতিবিম্বিত হয় তা খণ্ড খণ্ড হলেও সমগ্রের অংশ—ব্যক্তির স্বতন্ত্র শিল্প-অন্বেষা সেখানে সামগ্রিক জীবন-চৈতন্যের অন্তর্ময় অণু-পরমাণু। এজন্যেই বলা যায়, জাতীয় চৈতন্যের খণ্ড খণ্ড শিল্প-রূপায়ণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের এক অখণ্ড চেতনাকে নির্মাণ করেছেন আমাদের গল্পকাররা।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল আবদুল গফ্ফার চৌধুরী সম্পাদিত ‘বাংলাদেশ কথা কয়’ (১৯৭১) সংকলন। সঙ্গত কারণেই মুক্তিযুদ্ধের তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার তীব্র, তীক্ষ, রক্তাক্ত অনুভবই সংকলনভুক্ত গল্পসমূহের বৈশিষ্ট্য।
বাংলাদেশের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পগ্রন্থের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। ‘আমাদের গল্পকারদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার পীড়ন, নির্যাতন ও গণহত্যার মধ্যে বাঙালির সশস্ত্র প্রতিরোধ ও যুদ্ধ ছিল আমাদের গল্পকারদের অনুপ্রেরণার উত্স।’ প্রবীণ নবীন—উভয় ধারার গল্পকাররাই মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ অনুষঙ্গবাহী প্রচুর গল্প রচনা করেছেন। এবং শিল্পমানের দিক থেকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গল্প কালোত্তর মহিমায় অভিষিক্ত।

৫.
সমবায়ী শিল্পমাধ্যম নাটকে মুক্তিযুদ্ধ বিচিত্র রূপে অভিব্যক্ত। যুদ্ধের অব্যবহিত আগেই আমাদের নাট্যকাররা চেতনা প্রসারিত করেছিলেন রক্তগর্ভা সময়ের বেদীমূলে। যুদ্ধকালীন সময়ে রচিত মমতাজউদ্দীন আহমদের নাটকের বিষয় ও প্রকরণে সময়স্বভাব গভীরভাবে বিধৃত হয়েছে। তাঁর এ সময়ে (১৯৭১) রচিত নাটকগুলো হচ্ছে : ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘এবারের সংগ্রাম’, এবং ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ১৯৭২ সালে তিনি রচনা করেন ‘বর্ণচোর’। তাঁর এইসব নাটকে যুদ্ধের নির্মম বস্তুময় সত্য চরিত্র-পাত্রের আচরণ ও সংলাপে রূপায়িত হয়েছে। ‘কি চাহ শঙ্খচিল’ (১৯৮৫) নাটকে পাকিস্তানি হানাদারদের নারী নির্যাতনের মর্মন্তুদ চিত্র রূপায়িত হয়েছে। এ ধারার উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হচ্ছে : আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘নিঃশব্দ যাত্রা’ (১৯৭২) ও ‘নরকে লাল গোলাপ’ ( ১৯৭৪), জিয়া হায়দারের ‘সাদা গোলাপে আগুন’ (১৯৮২) ও ‘পঙ্কজ বিভাস’ (১৯৮২), নীলিমা ইব্রাহিমের ‘যে অরণ্যে আলো নেই’ (১৯৭৪) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ-অবলম্বী মঞ্চসফল কাব্যনাট্য সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ( ১৯৭৬)। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাটক হচ্ছে : কল্যাণ মিত্রের ‘জল্লাদের দরবার’ (১৯৭২), সাঈদ আহমদের ‘প্রতিদিন একদিন’ (১৯৭৮), আল মনসুরের ‘হে জনতা আরেক বার’ (১৯৭৪) এবং রণেশ দাশগুপ্তের ‘ফেরী আসছে’ প্রভৃতি।
মুক্তিযুদ্ধের প্রতিবাদী ও সংরক্ত চেতনা আমাদের নাটকের ক্ষেত্রে যে যুগান্তকারী পালাবদল ঘটিয়েছে, সাহিত্যের অন্যান্য আঙ্গিক অপেক্ষা তার প্রভাব অনেক বেশি দূরসঞ্চারী এবং ইতিবাচক। আবদুল্লাহ আল মামুন, মামুনুর রশীদ, সেলিম আল দীন, হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন প্রমুখ সেই ধারাকেই পরিপুষ্ট ও সমৃদ্ধ করেছেন।

৬.  
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতি ও আর্থ-উত্পাদন কাঠামোর রূপ-রূপান্তরের বহুকৌণিক অভিঘাত গ্রাম ও নগরজীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। বিশেষ করে উদ্ভিন্নমান মধ্যবিত্ত ও সংবেদনশীল চৈতন্য এই সব অভিজ্ঞতায় আন্দোলিত ও আলোড়িত হয়েছে। জিজ্ঞাসায়-বেদনায়-আর্তনাদে, সংকটে-সংগ্রামে-দ্বন্দ্বে ও দ্বন্দ্বোত্তরণের জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বাঙালির সমাজমানস। আমাদের লেখকরা সমাজজীবনের এই বহুমুখী সত্যকেই রূপ দিয়েছেন তাঁদের সৃষ্টিকর্মে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী জীবনের দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ও গতির রূপায়ণে আমাদের লেখকরা কালোপযোগী চেতনা ও শিল্পরীতিকে আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্রে  গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। কিন্তু জীবনসংকটের তীব্রতা জীবনবোধের তীব্রতাকেই বারবার ক্ষতবিক্ষত করেছে।

কৃতজ্ঞতা ঃ ইত্তেফাক

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত