মান্টোর গল্প ‘মুতরি’

Reading Time: 2 minutes

উর্দু সাহিত্যের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক সাদাত হাসান মান্টো দাঙ্গা ও দেশভাগের রক্তাক্ত ক্ষত যার প্রতিটি আখ্যানকে করেছে উজ্জ্বল। শৌভিক দে সরকার অনূদিত তার বিখ্যাত গল্প মুতরি


কংগ্রেস হাউস আর জিন্না হল থেকে খানিকটা দুরেই একটা পেচ্ছাবখানা ছিল যেটাকে বোম্বের মানুষরা মুতরি বলত। আশেপাশের মহল্লার সমস্ত নোংরা পেচ্ছাবখানাটার সামনে    ডাঁই করে রাখা থাকত। পেচ্ছাবের ফেনা,কালো কাদায় থিকথিক করত চারপাশ।সারাদিন এমন ভয়ানক দুর্গন্ধ বের হত যে নাকে রুমাল না দিয়ে ঐ মুতরির পাশ দিয়ে কোনমতে যাওয়াই যেত না।

পেচ্ছাব করার জন্য একদিন ওকে ঐ মুতরিটাতেই ঢুকতে হল। নাকে রুমাল চেপে,দম বন্ধ করে কোনমতে ভেতরে ঢুকল ও। থকথকে গাদ আর পেচ্ছাবের ফেনায় ভরে ছিল মেঝেটা। চলটা ওঠা দেওয়ালে মানুষের গোপন অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির ছবি বিকটভাবে আঁকা ছিল।আর ঐ ছবিগুলির মধ্যেই কাঠকয়লা দিয়ে বড় বড় করে লেখা ছিল, ‘মুসলমানদের বোনের পাকিস্তানকে চুদি।’

ঐ লাইনটা যেন ভেতরের দুর্গন্ধটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।ছিটকে বেড়িয়ে এল ও ওখান থেকে।

জিন্না হল আর কংগ্রেস হাউস, দুটোই সরকারের কব্জায় ছিল। কিন্তু ওখান থেকে একটু দুরেই মুতরিটার ওপর কারও কোনও অধিকারই ছিল না। একটা বেওয়ারিশ জায়গা হিসেবে দিন দিন জায়গাটায় শুধু নোংরার পাহাড় জমে উঠছিল।এত ভয়ংকর দুর্গন্ধ যে পাশ দিয়ে আর যাওয়াই যাচ্ছিল না।

আরেকদিন পেচ্ছাব করার জন্যই ওকে আবার ভেতরে ঢুকতে হল।নাকে রুমাল বেঁধে,দম বন্ধ করে নরকটার ভেতর ঢুকল ও। দরজার সামনেই কেউ পায়খানা করে রেখেছিল। শুকিয়ে কালো হয়ে গিয়েছিল সেটা আর গোটা দেওয়ালটাই মানুষের বাচ্চা পয়দা করার ছবিতে ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। ‘মুসলমানদের বোনের পাকিস্তানকে চুদি’,লাইনটার নীচে কেউ পেন্সিল দিয়ে লিখে রেখেছিলঃ ‘হিন্দুদের মায়ের গোটা হিন্দুস্তানকে চুদি।’

ঐ লাইনগুলো মুতরির ভেতরের অ্যাসিডের ঝাঁঝালো গন্ধটাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল। খুব তাড়াতাড়ি ওখান থেকে বেড়িয়ে এল ও।

এর মধ্যে বিনা শর্তেই মুক্তি পেয়ে গিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী আর পাঞ্জাব প্রদেশে জিন্না সাহেবও হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু জিন্না হল আর কংগ্রেস হাউস, কোনটারই অবস্থার কোন পরিবর্তন ঘটল না। আর মুতরিটাও ওভাবেই রয়ে  গেল। থকথকে নোংরা আর মহল্লার আবর্জনার ঢিবিটা শুধু বেড়ে যাচ্ছিল।

আবার একদিন মুতরিটার ভেতর ঢুকল ও। না,এবার অবশ্য পেচ্ছাব করার জন্য নয়। দম আটকে, নাক রুমাল দিয়ে ঢেকে ভেতরে ঢুকল ও। মেঝের ওপর থিকথিক করছিল পোকা। দেওয়ালে নোংরা কোন ছবি আঁকার জন্য কোন জায়গাই ফাঁকা ছিল না আর।

‘মুসলমানদের বোনের পাকিস্তানকে চুদি’ আর ‘হিন্দুদের মায়ের গোটা হিন্দুস্তানকে চুদি।’ ঐ লাইনদুটোও ক্রমশ ফিকে হয়ে গিয়েছিল।

মুতরি থেকে ও যখন বাইরে বেড়িয়ে এল,তখন ঐ লাইনদুটোর নীচে সাদা চক দিয়ে লেখা আরও একটা লাইন জ্বলজ্বল করছিল, ‘হিন্দু-মুসলমান দুজনের মায়ের ভারতবর্ষকেই চুদি।’

এক মুহূর্তের জন্য ঐ লাইনটা পেচ্ছাবখানার সমস্ত দুর্গন্ধই গায়েব করে দিয়েছিল।

ও যখন বাইরে বেড়িয়ে আসছিল তখন মনে হচ্ছিল, ঐ মুতরিটার সব দুর্গন্ধই যেন এক মুহূর্তের জন্য বেমালুম উবে গিয়েছে ওখান থেকে।

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>