| 29 মার্চ 2024
Categories
গদ্য সাহিত্য

আমার প্রতিবেশী রবীন্দ্রনাথ

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

 

 

রবি ঠাকুরের বাড়ি আমাদের পাশের কোন গ্রামে। তার বাড়ির নাম কুঠিবাড়ি। যার চিলেকোঠায় বসে তিনি কবিতা লেখেন। যেখান থেকে পদ্মা নদী দেখা যায়। ছোটবেলায় এমন একটি ধারণা নিয়েই আমি বড় হয়েছি। আমার বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তিনি তার ছাত্রদের নিয়ে সাইকেল চালিয়ে রবি ঠাকুরের বাড়ি যেতেন। ফিরে এসে এমন ভাবে গল্প করতেন যেন এই মাত্র তিনি রবি ঠাকুরের সাথে কথা বলে এলেন। সেখানে বাবার মত লালন শাহ এবং কাঙাল হরিনাথ নামে আরও দুজন দেখা করতে এসেছিল। রবি ঠাকুরের বাড়িতে একটা শান বাঁধানো পুকুরঘাট আছে।যার পাশেই আছে বকুল ফুলের গাছ। সেই বকুল গাছের তাজা ফুল দিয়ে বানানো সুগন্ধি মালা নিয়ে আসতেন। সেই ফুলগুলোর মত বাবার গল্পগুলো এমন তাজা ছিল যে আমি রীতিমত দেখতে পেতাম পদ্মা নদীটা রবি ঠাকুরের বাড়ি থেকে দুরে চলে যাচ্ছে। উপেনের জমিটা শেষ পর্যন্ত রবি ঠাকুর নিয়েই নিলেন। আর বলতেন তাল গাছের কথা। যে তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি আমাদের বাড়ির পেছনে তাল গাছের নিচে গিয়ে তার পা খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি। কখনও নিজেই এক পায়ে দাঁড়িয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করছি তাল গাছ কিভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে দুয়েকবার বাবার কাছে বায়না ধরেছি রবি ঠাকুরের বাড়ি যাওয়ার জন্য। বাবা বলতেন সাইকেল চালানো শিখলেই নিয়ে যাবেন। ছোটবেলায় সাইকেল চালাতে শেখার একটি বিশেষ আগ্রহ ছিল রবি ঠাকুরের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া।

রবি ঠাকুরকে নিয়ে এই ধরণের যাদুবাস্তবতার ভেতরেই কেটেছে আমার শৈশবের অনেকটা সময়। হাইস্কুলে পড়ার সময় যখন জানলাম রবি ঠাকুর আমার জন্মের আরও ২৩ বছর আগেই মারা গেছেন তখন আমার রীতিমত কান্না পেয়েছিল। এখন ঠিক মনে নেই, এইট অথবা নাইনে পড়ার সময় ১২ মাইল সাইকেল চালিয়ে বাবার সাথে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি গিয়েছিলাম। শৈশবে বাবার গল্প শুনে স্বপ্নে আঁকা ছবির ওপরে বাস্তব একটি ছবি বসিয়ে নিয়ে ছিলাম।
তখন বই পড়া শুরু করেছি। হঠাৎ একদিন জানলাম লালন শাহ মারা গেছেন ১৮৯১ সালে। মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম রবীন্দ্রনাথ জমিদারি দেখাশুনা করতে কুষ্টিয়ায় আসা শুরু করেন ১৮৯০ সালের শেষদিকে। তাহলে রবীন্দ্রনাথের সাথে কি লালান শাহ’র সত্যি দেখা হয়েছিল? এই প্রশ্ন আমি কলেজে পড়ার সময় আমার শিক্ষক বিশিষ্ট লালন বিশেষজ্ঞ ড. আনোয়ারুল করীম স্যারকেও করেছিলাম। তিনি সাক্ষাৎ লাভের পক্ষেই অভিমত দেন। ঘটনা যাই হোক, রবীন্দ্র রচনায় লালনের গানের প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন ফকিরের ২০টি গান প্রবাসী পত্রিকায় হারামনি বিভাগে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া বক্তৃতায় লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গানের ইংরেজি অনুবাদ বিদেশি শ্রোতাদের শুনিয়েছিলেন। তাছাড়া ঠাকুর পরিবারের সাথে লালনের সম্পর্কের বড় প্রমান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা লালনের ছবিটি। লালনের জীবিত অবস্থার একমাত্র প্রতিকৃতি।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার এক লেখায় বলেছেন ‘লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কী যেন একটা বলতে চেয়েছেন আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।’

কলেজে পড়ার সময় কুষ্টিয়া মিলপাড়ায় মহিনী মিলের সামনে একটি মেসে থাকতাম। তরুণ মেস।সেখান থেকে এক দেড় কিলোমিটার দূরে ছেঁউড়িয়া লালনের মাজার। একদিন বিকেলে মেসে শুয়ে একটা বই পড়ছিলাম।এখন ঠিক মনে নেই, সেটা হতে পারেকলেজ লাইব্রেরি থেকে তোলা রবীন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতি অথবা কুষ্টিয়ার ইতিহাস। হঠাৎ আবিস্কার করলাম আমার মেসের খুব কাছেই যে লাল ইটের রেনউইক যজ্ঞেশ্বর প্রতিষ্ঠান তার মলিক ছিলেন ঠাকুর পরিবার।তার পাশেই টেগর লজ নামে একটি বিল্ডিং ছিল। রবীন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে শিলাইদহ যাওয়া আসার সময়ে এখানে এসে থাকতেন। এখানে বসে অনেক লেখালেখিও করেছেন যা পরবর্তিকালে ক্ষণিকা, কথা ও কাহিনীতে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি টেগর লজের কাছেই কুষ্টিয়া রেলস্টেশন-সংলগ্ন বসন্তের ফুলে ভরা একটি কুরচি গাছ নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। এই কবিতা পরে বনবাণী বইয়ে গ্রথিত হয়।

আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বেরিয়ে পড়লাম টেগর লজের খোঁজে। পেয়েও গেলাম। মহিনী মিলের ১নং গেটের সামনে দিয়ে রেল ষ্টেশনের দিকে একটু আগালেই বাম দিকে লাল রঙের দোতলা বিল্ডিং। ক্ষয়ে নষ্ট হয়ে গেলেও বেশ বোঝা যায় বিল্ডিংএর ওপরের দিকে ইংরেজীতে লেখা টেগর লজ। খোঁজ নিয়ে জানলাম ওখানে কেউ একজন পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। মনে হল কিছু একটা করা দরকার। হাঁটা দিলাম লালনের মাজারের দিকে। উদ্দেশ্য ড. আনোয়ারুল করীম স্যারের সাথে কথা বলা। তিনি তখন কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের ইংরেজীর শিক্ষক তবে বিকেলের দিকে লালনের মাজার এলাকার ভেতরে ফোকলোর সোসাইটির অফিসে বসতেন।স্যারকে টেগোর লজের কথা বলতেই তিনি বললেন ওটা বেদখল হয়ে আছে আমরা চেষ্টা করছি উদ্ধার করে একটি যাদুঘর তৈরী করার। মনে পড়ে আমি বিষয়টি নিয়ে আবু জাফর স্যারের সাথেও আলাপ করেছিলাম। যিনি তখন কুষ্টিয়া কলেজের বাংলার শিক্ষক এবং ফরিদা পারভিনের স্বামী ছিলেন। যার লেখা দুটি গান তখন অত্যন্ত জনপ্রিয়, ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদী তটে’ ও ‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদি’র নাম’। আমি স্থানীয় জাগরনী পত্রিকায় টেগর লজের ওপর একটি প্রতিবেদন লিখলাম। যে পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন শহরের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড: আবুল আহসান চৌধুরী।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারীর দায়িত্বভার গ্রহণের পর শিলাইদহে আসেন ১৮৯২ সালে। সম্ভবত সে সময়েই ঠাকুর এস্টেটের জমিদারী ও ব্যবসা দেখাশোনার জন্য কুষ্টিয়া শহরের মিলপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘টেগর এ্যান্ড কোম্পানি’। আর টেগর এ্যান্ড কোম্পানির ব্যবসায়িক অফিস ছিল ‘টেগর লজ’। ১৮৯৫ সালে টেগর এ্যান্ড কোম্পানির অফিস হিসেবে টেগর লজ ব্যবসায়িক কাজ শুরু করে। তখন এর সদর দফতর ছিল কলকাতায়। এই ব্যবসার মূল ভূমিকায় ছিলেন কবির দুই ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ পরে এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন এবং এক পর্যায়ে তিনি ব্যবসার মূল দায়িত্ব বুঝে নেন। কোলকাতা থেকে শিলাইদহ কুঠিবাড়ীতে যাওয়া আসার পথে তিনি এই লজে বিশ্রাম নিতেন।

স্বাধীনতার পর কবির স্মৃতিধন্য বাড়িটিকে রক্ষার উদ্যোগ নেন কুষ্টিয়া পৌরসভার প্রথম নির্বাচিত চেয়াম্যান মোঃ আবদুর রহিম। বাড়িটি পৌরসভার নামে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য তিনি উচ্চমহলে দেন-দরবার করতে থাকেন। এরই একপর্যায়ে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুষ্টিয়া সফরে এলে তিনি টেগর লজ পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করার আবেদন জানান। বঙ্গবন্ধু কবিগুরুর স্মৃতিধন্য বাড়িটির মর্যাদা ও গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিতে তৎকালীন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন। কিন্তু বাড়িটির মালিকানা যেহেতু ব্যক্তি পর্যায়ে, তাই পৌরসভাকে হস্তান্তর করা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর টেগর লজ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।

একজন কলেজ পড়ুয়া ছাত্র হিসাবে আমি যখন কুষ্টিয়া শহরের নানা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সাথে আলাপ করে টেগর লজ উদ্ধারের প্রক্রিয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি তখন দেশে আরেক দফা পট পরিবর্তন হল ১৯৮২ সালে। লে জে হো মো এরশাদ ক্ষমতা দখল করলেন। সামরিক শাসন জারি করা হল। সবার সব উদ্যোগ চাপা পড়ে গেল। আমি কলেজ পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়। কিছুদিন ঢাকায় চাকরি তারপর দীর্ঘ প্রবাস জীবন। কুষ্টিযায় আর ফেরা হয় না। বন্ধু স্বজনদের সাথে টেলিফোনে কথা হয়। পত্রিকান্তরে জানতে পারি টেগর লজ এখন একটি দর্শনীয় স্থান।

২০০৪ সালে পৌরসভার পক্ষে পাঁচ লাখ টাকায় হাতবদল ও বেদখলের কবল থেকে ভবনটি পুনরুদ্ধারের পর কুষ্টিয়া পৌর কর্তৃপক্ষ মিউজিয়াম স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। কুষ্টিয়া পৌরসভার তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত এই ‘টেগরলজ’কে ঘিরে এখন উন্মুক্ত পরিবেশে শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার একটি বলয় গড়ে উঠেছে। এখানে নিয়মিত রবীন্দ্রচর্চা সহ নানারকম সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। রবীন্দ্রজয়ন্তীসহ বিভিন্ন উপলক্ষে সেখানে আয়োজন করা হয় গীতিনাট্য, আবৃতি উৎসব, সঙ্গীত সন্ধ্যার।কবির ভক্তরা ফুলের ডালি সাজিয়ে টেগর লজে হাজির হন। মাথা নিচু করে কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। লজের প্রবেশ দুয়ারে স্থাপন করা কবির আবক্ষ ভাস্কর্যে ফুলের মালা পরিয়ে দেন। প্রবাসে বসে যখন চোখ বন্ধ করে এই দৃশ্যপট কল্পনা করি তখন মনে হয়-

ফিরে চল্‌ মাটির টানে
যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে।।

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত