এলিস মানরোর আত্মজৈবনিক লেখা: প্রিয় জীবন

Reading Time: 19 minutes

নোবেলজয়ী লেখক এলিস মানরোর এই আত্মজৈবনিক লেখাটি Dear Life শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিলো দ্য নিই ইয়র্কার পত্রিকার ২০১১, ১৯ সেপ্টেম্বর সংখ্যায়। নুসরাত সুলতানার অনুবাদে প্রকাশিত হলো।


আমার ছোটবেলা কেটেছে একটা লম্বা রাস্তার শেষ মাথার একটা বাড়িতে। রাস্তাটা হয়তো সত্যিই অত লম্বা ছিল না, কিন্তু আমার অমনই লম্বা মনে হত। পেছনে ছোট একটা শহর ফেলে রেখে আমি রোজ হেঁটে বাড়ি ফিরতাম স্কুল থেকে। শহরের সীমানা বলে দিত মেইটল্যান্ড নদীর উপর দাঁড়িয়ে থাকা দুটো ব্রিজ। একটা ব্রিজ ছিল লোহার, এতই সরু যে দুপাশ থেকে দুটো গাড়ি একসঙ্গে চলে আসলে কে যে এগুবে আর কে যে পিছিয়ে পথ করে দেবে তা নিয়ে দ্বন্দ্ব লেগে যেত প্রায়ই। অন্য ব্রিজটা ছিল কাঠের, শুধু পায়ে হেঁটে চলার জন্য।

কখনও-সখনও দেখা যেত ব্রিজের কোনো একটা তক্তা ভেঙে তৈরি হয়েছে ফাটল। সোজা নিচে তাকালেই ভীষণ বেগে ছুটে চলা ঝলমলে পানির সঙ্গে সাক্ষাৎ। খুব ভালো লাগত দেখতে। কিন্ত এ সুযোগ বেশিদিনের জন্য আসত না। ভাঙা তক্তা সারাই হয়ে যেত দ্রুত।

ব্রিজ পেরিয়ে খানিকটা প্রায়ফাঁকা জায়গা। সেখানে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ভগ্নপ্রায় বাড়ি। বসন্ত এলেই বাড়িগুলোতে দলবেঁধে কারা যেন থাকতে আসত। প্রতি বসন্তে আলাদা আলাদা দল। বাড়িগুলো পেরিয়ে একটা খালের উপর আরও একটা ব্রিজ। ব্রিজ পেরিয়ে পথটা দুভাগ হয়ে দুদিকে চলে যেত। একটা যেত দক্ষিণে, পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গিয়ে পড়ত বড় রাস্তায়। আর অন্যটা বড় মাঠটার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে শেষমেষ পশ্চিমে বাঁক নিত।
পশ্চিমের এ পথটাই ছিল আমার নিত্যদিনের ফেরার পথ।

আরও একটা রাস্তা কিন্তু ছিল। রাস্তাটা উত্তরদিকে খানিকটা এগিয়েই শেষ হয়ে যেত। সে রাস্তার উপর বাড়িগুলোর গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ানো ভঙ্গি আর রাস্তার সাথে লাগোয়া ফুটপাথ দেখে মনে হত, এ যেন পিছনে ফেলে আসা শহরেরই একটা অংশ। এ রাস্তার উপর একটা স্কুলও ছিল যেখানে আমি দুবছর পড়েছি। তিক্ততায় ভরা দুটো বছর।
একসময় মা আমার বাবাকে দিয়ে এক রকম জোর করেই শহরে একটা ছোট বাড়ি কেনায়। এর ফলে বাবা বনে গেল শহরের করদাতা। আমার সুযোগ মিলে গেল শহরের স্কুলে পড়ার। কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেল এতসবের কোনো প্রয়োজন ছিল না।

 

 

সে বছর, একেবারে যে মাসে আমি নতুন স্কুলে ভর্তি হলাম সে মাসেই জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষিত হল। আর আমার সে স্কুলটা, যেখানে রোজই আমার টিফিন কেড়ে অন্য কেউ খেয়ে নিত, যেখানে ভীষণ হৈ-হট্টগোলের মধ্যে লেখাপড়া খেই হারিয়ে ফেলত, সে স্কুলটা রাতারাতি এক কামরা আর এক শিক্ষকের ছোট্ট একটা স্কুল বনে গেল। ছাত্রছাত্রী প্রায় সব উধাও হয়ে গেল। যে ছেলেগুলো সবসময় আকারে-ইঙ্গিতে এবং ভীতিপ্রদভাবে জানতে চাইতো আমি যৌনকর্মে আগ্রহী কিনা, তাদের অগ্রজদের মতো চাকরীর জন্য হন্যে হয়ে ওঠা এই তারাই সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশ উদ্ধার করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল।

স্কুলের টয়লেটগুলোও ছিল ভয়ংকর নোংরা। গা গুলাত আমার। এখন কী অবস্থা কে জানে! তবে শহরের স্কুলে মানিয়ে নেওয়াও আমার জন্য একেবারে সহজ ছিল না। একে তো একমাত্র আমি ছাড়া বাকি সবাই ক্লাস ওয়ান থেকে একসঙ্গে পড়ছিল সেখানে তারপরও এমন অনেক বিষয় ঐ স্কুলে পড়ানো হত, যা আমি আগে কখনও পড়িনি। তবে পরিষ্কার টয়লেট দেখে আর ফ্লাস টানার শহুরে আওয়াজটা শুনে কোথায় যেন একটা স্বস্তি পেতাম।

আমার প্রথম স্কুলের অভিজ্ঞতা তিক্ত হলেও ওখানে কিন্তু আমার একটা বন্ধু ছিল। মেয়েটার নাম, ধরা যাক ডাইয়্যান। ডাইয়্যান স্কুলে আসা শুরু করেছিল স্কুলের দ্বিতীয় বছরের মাঝামাঝি। আমার সমবয়সীই ছিল। ওরা থাকত সেই ফুটপাতওয়ালা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোর একটাতে। একদিন স্কুল শেষে ডাইয়্যান প্রস্তাব দিল ওর বাড়ি গিয়ে হাইল্যান্ড ফ্লিং (স্কটিস নাচের বিশেষ কায়দা) শেখার। খুশি মনে চললাম আমি। হাইল্যান্ড ফ্লিং-এর জন্য বিশেষ এক ধরনের কাঠের জুতো পরতে হত। বলা বাহুল্য, সে জুতো আমার ছিল না। ডাইয়্যানের ছিল। আমাদের পায়ের মাপ প্রায় একই ছিল বলে আমরা একজোড়া জুতোই বেশ পালা করে পরে চালিয়ে নিচ্ছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই ‍কিছুক্ষণ নেচে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম আমরা, তৃষ্ণাও পেয়ে গিয়েছিল। ডাইয়্যানের নানি আমাদের জন্য পানি নিয়ে এলেন। পানিটা মুখে দিয়েই টের পেলাম তার বিস্বাদ। হাতেখোঁড়া অগভীর কুয়ার পানি। ঠিক আমাদের স্কুলের পানির মতো। আমি নানিকে আমাদের বাড়ির কুয়ার কথা বললাম। যন্ত্র দিয়ে খোঁড়া গভীর কুয়ো থেকে কেমন স্বাস্থ্যকর পানি পান করি আমরা। উনি কিন্তু একটুও বিব্রত হলেন না আমার অমন কথায়। শুধু বললেন, “আমাদেরও অমন একটা কুয়ো থাকলে খুব ভালো হত।”

ওদিকে আমার মা কিন্তু ততক্ষণে স্কুলে গিয়ে আমার হদিস পেয়ে গেছে। মা ডাইয়্যানদের বাড়ির সামনে এসে জোরে জোরে হর্ন বাজিয়ে আমাকে যেন রীতিমতো শাসাতে লাগল বেরিয়ে আসার জন্য। ডাইয়্যানের নানির হাত নেড়ে সৌজন্য প্রকাশের দিকে ভ্রুক্ষেপও করল না। মা সাধারণত গাড়ি চালাত না। যখন চালাত তখন তার অতিসতর্কতা ভীষণ এক নৈশব্দ তৈরি করত গাড়ির ভেতর।

সে নৈশব্দ ভেঙে মা কঠিন গলায় আমাকে নির্দেশ দিলেন ও বাড়িতে আমি যেন আর কখনও না যাই। (নির্দেশ পালন করাটা ডাইয়্যানই সহজ করে দিল আমার জন্য। স্কুলে আসা বন্ধ করে দিল ও। ওকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।)
মাকে বললাম, “জান, ডাইয়্যানের মা নেই?”
মা বলল, “জানি।”
আমি মাকে হাইল্যান্ড ফ্লিং শেখার কথা বললাম।
মা বলল, “এসব তুমি পরেও শিখতে পারবে। ঠিকঠাক মতো শেখায় এমন কোথাও। ও বাড়িতে নয়।”
আমি তখনও জানতাম না ডাইয়্যানের মা ছিলেন গণিকা। এ পেশায় থাকলে যে সমস্ত রোগ হয় সে রকমই কোনো এক রোগে মহিলা মারা যান। উনার ইচ্ছেতেই নিজ বাড়িতে তার কবর হয়। আমাদের চার্চের পুরোহিতই সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছিলেন। অনেকেই বলেন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন পুরোহিত যেসব কথা বলেছিলেন তার সবটুকু না বললেও চলত। কিন্তু আমার মা মনে করত পুরোহিত ঠিক কাজটাই করেছিল।

পাপের মূল্য মৃত্যু দিয়েই চুকাতে হয়।

মা আমাকে এসব কথা বলেছিল অনেক পরে। কিংবা আসলে হয়তো অত পরে নয়, কিন্তু আমার সময়টাকে অমনই লম্বা মনে হয়েছিল। ততদিনে মায়ের বলা অনেক কথাই আমি অপছন্দ করতে শুরু করেছি। মা কথা বলত নিরুত্তাপ গলায় আর কেঁপে কেঁপে উঠত মাঝে মাঝে। সারাক্ষণই বিভিন্ন বিষয়ে একে তাকে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করত মা। আমার একদমই ভালো লাগত না ব্যাপারটা। মায়ের কাঁপুনিটাও যেন দিন দিন বেড়েই চলেছিল। দেখে মনে হত, ব্যাপারটার উপর নিয়ন্ত্রণ নেই মায়ের।

আমি কিন্তু মাঝেমধ্যেই যেতাম ডাইয়্যানের নানির সঙ্গে দেখা করতে। তার থোবড়ানো হাসিটা আমার জন্য তোলাই থাকত যেন। নানি আমার খুব প্রশংসা করতেন, নিয়মিত লেখাপড়াটা চালিয়ে যাচ্ছি তাই। তিনি ডাইয়্যানের খবরও দিতেন আমাকে। ডাইয়্যানও বেশ অনেকদিন লেখাপড়াটা ধরে রেখেছিল। পরে টরেন্টোর এক রেস্তোরাঁয় কাজ নিতে হয়েছিল ওকে। নানির কাছে শুনেছিলাম, সে রেস্তোরাঁয় নাকি খুব ঝলমলে সব পোশাক পরে কাজে যেতে হত।

বেশ বড় তখন আমি, মনটাও বেড়ে উঠেছে। শিশুদের মতো উদার আর সরলভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা আর ছিল না। ঝলমলে পোশাক পরা যেখানে রেওয়াজ, প্রয়োজনে পোশাক খুলে ফেলেটাও সেখানে কাজেরই অংশ, বুঝে নিতে কষ্ট হল না আমার।

ডাইয়্যানের নানি মনে করতেন স্কুল পাশ করে বের হতে আমি অনেক বেশি সময় লাগিয়ে ফেলছি। এ দলে আরও কেউ কেউ ছিল, উনি একা নন। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে হাতের দুপাশে সাধারণ গোছের কিছু বাড়ি পড়ত। সেগুলোর মধ্যে ছোট্ট টিলার উপর একটা বাড়ি ছিল ওয়েটি স্ট্রিটস নামে এক সাবেক সৈনিকের। ভদ্রলোক তার একটা হাত হারিয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। বেশ কয়েকটা ভেড়া পালতেন তিনি। তার স্ত্রীকে আমি একবারই দেখেছিলাম পাম্প থেকে বালতি ভরে পানি তোলার সময়। আমি স্কুল পাশ করে বের হতে ঠিক কতগুলো বছর লাগাচ্ছি, সেটা নিয়ে ওয়েটি প্রায়ই আমার সঙ্গে রসিকতা করত। আমিও ঠাট্টা করে পাল্টা জবাব দিতাম। মনে মনে ভদ্রলোক আমার সম্পর্কে ঠিক কী ভাবতেন তা কখনও ভালো বুঝতে পারিনি। এ রকমই ছিল আমাদের জানাশোনা। চলতি পথে শুভেচ্ছাবিনিময়, তারপর সেদিনের আবহাওয়া নিয়ে দু-চারটা কথা। আবার গাড়ি থামিয়ে হেঁটেচলা প্রতিবেশীকে তুলে নিত কেউ কেউ। কেউ কারও হাঁড়ির খবর জানার চেষ্টা করত না। জীবিকার পথটাও সবাই বেছে নিয়েছিল যে যার মতো। সবমিলিয়ে অন্যসব গ্রামের চেয়ে এসব দিক থেকে একটু আলাদাই ছিল আমাদের গ্রামটা।
alice-munro-e1381891864131.jpg
স্কুলপর্ব শেষ করতে আমি কিন্তু মোটেও বেশি সময় নিচ্ছিলাম না। অনেকেরই বেশ লম্বা সময় লাগত বটে। সে সময় কেউ আশাই করত না যে ক্লাস নাইনে ভর্তি হওয়া সব ছাত্রছাত্রীই কলেজ পাস করে এক একজন বিদ্বান হয়ে বের হবে। লেখাপড়ার ফাঁকে অনেকেই ঢুকে যেত পার্টটাইম চাকরিতে। চাকরিগুলো একসময় ফুলটাইম হয়ে যেত। অন্যদিকে মেয়েদের মধ্যে অনেকেই বিয়ে করে সংসারে মন দিত। টেনেটুনে চারভাগের একভাগ ছাত্রছাত্রী হয়তো কলেজ পাশ করে বের হত। আর এসব কলেজ পাশ করা ছেলেমেয়েগুলোর সে কী দম্ভ! যেন সামনে পড়েথাকা জীবনের বিচিত্র পথটা পাড়ি না দিয়েই সাফল্যটা নিশ্চিত করে ফেলেছিল ওরা।

ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে পড়ে কলেজ পাস করা সহপাঠীদের খুব অচেনা মনে হতে লাগল আমার। যেন এক জীবনের দূরত্ব ওদের সঙ্গে আমার।

আমাদের খাবার ঘরের কোনায় রাখা একটা জিনিস দেখে প্রতিবারই আমি একটু অবাক হতাম। যতবারই মেঝে পরিষ্কার করার জন্য ভ্যাকুয়্যম ক্লিনারটা বের করতে যেতাম, ততবারই অবাক হয়ে ভাবতাম আমাদের বাড়িতে এ জিনিস কী করে এল!

জিনিসটা ছিল একটা গলফ ব্যাগ, ভেতরে গলফ খেলার সব সরঞ্জাম। গলফ খেলা বিষয়ে আমি বিশেষ কিছুই জানতাম না। তবে কী ধরনের মানুষেরা সাধারণত গলফ খেলে সে বিষয়ে আমার ভালোই ধারণা ছিল। আমার বাবা শহরে যাওয়ার সময় বেশ কেতাদুরস্ত পোশাকআশাক পরলেও ওভারঅলই ছিল বাবার নিত্যদিনের পোশাক। যারা আমার বাবার মতো ওভারঅল পরে তারা কখনও গলফ খেলে না। বরং আমার মাকে গলফ খেলার পোশাকে কল্পনা করাটা সহজ ছিল।

গলায় সিল্কের স্কার্ফ, বাতাসে চুল উড়ছে। কিন্তু এ পর্যন্তই। মামুলি একটা বল ছোট্ট একটা গর্তে ফেলার জন্য লাঠি হাতে বিভিন্ন কসরত করা ব্যাপারটা মায়ের সঙ্গে একদমই যেত না। এসব ছেলেমানুষী ব্যাপার-স্যাপার মায়ের চরিত্রে ছিলই না।

কোনো একটা সময় বোধহয় ছিল, যখন আমার মা স্বপ্ন দেখত, অন্যরকম একটা জীবনযাপন করার স্বপ্ন। যে জীবনে থাকবে অবকাশযাপন, থাকবে নৈশভোজ আর গলফ। সম্ভবত নিজের মনের মধ্যে একটা জগত তৈরি করে নিয়েছিল যেখানে শ্রেণিভেদ বলে কোনো ব্যাপার নেই। কানাডিয়ান মালভূমির এক খামারবাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে মা আর বাবা বসত গড়েছিল এখানে। শুধু তাই নয়, মা স্কুলে চাকরি নিয়ে বনে গিয়েছিল স্কুল-শিক্ষক। মায়ের কথা বলার ভাষাও দিনে দিনে বদলে এমন হয়ে গেল যে তার আত্মীয়-স্বজনরাও তার সঙ্গে কথা বলার সময় সহজ ও স্বাভাবিক ছন্দটা আর খুঁজে পেত না। কোনো কারণে মায়ের মনে হয়েছিল প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজেকে বদলে ফেলতে পারলে সব শ্রেণিতে সে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে।

বাবার ধ্যানধারণা কিন্তু অন্যরকম ছিল। নিজেকে বাবা শহুরে মানুষ কিংবা অন্য যে কোনো মানুষের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে করত না। বরং বাবা ভাবত শহুরে মানুষগুলো অযথাই নিজেদের প্রগতিশীল মনে করে। বাবা তার সামনে নিজেকে জাহির করার সুযোগই দিত না কাউকে।

গলফ ব্যাগ কেনাটা বাবারই কাণ্ড হবে।

আমার দাদা-দাদির ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের খামারটা দেখাশোনা করতে বাবার যে খুব আপত্তি ছিল তা নয়। ছোট, ছিমছাম একটা খামার ছিল ওদের। বাবা আর মা মিলে যখন ছোট্ট শহরটার কাছে রাস্তার একেবারে শেষ মাথার এ জমিটা কিনেছিল তখন তারা কল্পনাও করতে পারেনি কতটা উন্নতি করবে খামারটা। প্রথমে সিলভার ফক্স, এরপর মিঙ্ক পালতে শুরু করল তারা। সে বয়সে বাবা খামারে কাজ করার চেয়ে ফাঁদ পেতে এসব পশুপাখি ধরতেই বেশি পছন্দ করত। আয় উপার্যনও ভালোই হচ্ছিল। বাবা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল তার নতুন খামার নিয়ে। সব সঞ্চিত টাকা খাটিয়ে ফেলল এই খামারে। মাও তার মাস্টারি করে জমানো সব টাকা দিয়ে দিল বাবাকে।

অনেকগুলো খোঁয়ার তৈরি করা হল। খামারের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া লাগানো হল। পাঁচ একরের খামারটায় গরু আর ঘোড়া চরে বেড়ানোর জায়গার কোনো অভাব ছিল না। ঘাসও হত প্রচুর। বড় ঘাসে ঢাকা মাঠটা গিয়ে শেষ হত একদম নদীর পাড়ে। বারটা এলম গাছ ছায়া দিয়ে ঢেকে রাখত মাঠটাকে।

এখন সে দিনগুলোর কথা ভাবলে মনে হয় কী পরিমাণ রক্তপাতই না হত আমাদের খামারটায়। বুড়ো ঘোড়াগুলোকে মেরে ফেলা হত শেয়ালদের খাওয়ানোর জন্য। শরত আসলেই শেয়াল আর মিঙ্কগুলোকে বেছে বেছে মেরে ফেলা হত ফার সংগ্রহ করার জন্য। আমি কিন্তু দিব্যি মানিয়ে নিয়েছিলাম। এসব আমার চোখেই পড়ত না। নিজের জন্য একটা জগত তৈরি করে নিয়েছিলাম আমি। আমার পছন্দের বইগুলোর মতো নিষ্কলুষ একটা জগত। এলম গাছের ছায়ায়, নদীর কাছে বসে আমি বই পড়তাম। কাছেই একটা ঝরনা বয়ে চলত। গরু আর ঘোড়াগুলো পানি খেত সে ঝরনাটা থেকে, আমিও খেতাম। কুড়িয়ে পাওয়া একটা টিনের মগে পানি নিয়ে বই পড়তে বসে যেতাম গাছের ছায়ায়, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা টাটকা গোবর অগ্রাহ্য করে।

আমার ভাই তখনও বেশ ছোট। তাই বিভিন্ন কাজে আমারই বাবাকে সাহায্য করতে হত। খাবার পানি তোলা, খোঁয়াড়গুলোর দেখাশোনা করা, পানির পাত্র পরিষ্কার করা, নতুন করে পানি ভরে দেওয়া। টুকরো টুকরো আনন্দ মিশে থাকত কাজগুলোর মাঝে। এক তো ছিল ভারি ভারি দায়িত্ব পালন করার আনন্দ আর যখন তখন একা হয়ে যেতে পারার আনন্দ। ভীষণ ভালো লাগত আমার। চিত্রটা পালটে গেল কিছুদিনের মধ্যেই। মাকে সাহায্য করার জন্য আমাকে বাড়িতেই বেশি থাকতে হত আর আমার মনটা ভরে থাকত বিষাদে আর অপমানে। আমাকে সবচেয়ে বেশি যে কথাটা শুনতে হত তা হল, ‘মুখে মুখে কথা বলা হচ্ছে!’

আমার কথায় প্রায়ই মা মনে আঘাত পেত আর সে কষ্ট বুকে নিয়ে মা ছুটত গোলাঘরে, বাবার কাছে নালিশ করতে। ফলে বাবাকে কাজ থেকে একটা সাময়িক বিরতি নিতেই হত, বেল্ট খুলে আমাকে পেটানোর জন্য। আমি বিছানায় শুয়ে কাঁদতাম আর ভাবতাম কী করে বাড়ি থেকে পালানো যায়। একসময় জীবনের এই অধ্যায়টাও পার হয়ে গেল। একরোখা ভাবটা হারিয়ে বরং হাসিখুশি একটা মেয়েই হয়ে উঠলাম আমি। বেশ জমিয়ে মজা করে গল্প করতে পারতাম বলে বেশ জনপ্রিয়তাও ছিল আমার।

আমাদের বাড়িটা বেশ বড়ই ছিল। ঠিক কবে বাড়িটা তৈরি হয়েছিল তা আমরা কেউ জানতাম না। ১৮৫৮ সালে প্রথম বডমিন নামে এক জায়গা থেকে কেউ একজন একটা ভেলায় করে নদীপথে এখানে এসে, গাছপালা কেটে পরিষ্কার করে বসতি গড়ে তুলেছিল।ধীরে ধীরে একটা আস্ত গ্রামই গড়ে উঠল এখানে।

প্রথমেই তৈরি হল একটা করাত কল, একটা হোটেল, তিনটা চার্চ আর একটা স্কুল। এই স্কুলেই আমি প্রথম দুবছর পড়েছিলাম। ভয়াবহ দুটো বছর। স্কুলের পর তৈরি হল নদীর উপর একটা ব্রিজ। ব্রিজটা তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন সবাই হঠাৎ করে বুঝতে পারল, নদীর ওপারে বাস করার সুবিধা অনেক বেশি। ধীরে ধীরে গ্রামটা ছোট হয়ে যেতে যেতে কেমন অদ্ভুত একটা ছন্নছাড়া লোকালয়ে পরিণত হল।

একদম প্রথম তৈরি বাড়িগুলোর মধ্যে আমাদের বাড়িটা পড়ে না। কারণ আমাদের বাড়িটা ইটের। প্রথমদিকের বাড়িগুলো কাঠের তৈরি। খুব সম্ভবত বাড়িটা কাঠের বাড়িগুলোর পরপরই বানানো। পশ্চিমমুখী আমাদের বাড়িটা গ্রামের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ানো। বাড়ির সামনে মাঠটা ঢালু হয়ে নামতে নামতে একটা খাঁজ তৈরি করে থামত গিয়ে ঠিক নদীটার বড় বাঁকটার সামনে। নদীর ওপারে ছিল এক দঙ্গল চিরসবুজ গাছ। কী গাছ তা অবশ্য এতদূর থেকে বোঝার উপায় ছিল না। ওই গাছগুলোর ওপারে একটা টিলার উপর ছিল আমাদের বাড়ির দিকে মুখ করা একটা ছোট বাড়ি। এতদূর থেকে বাড়িটাকে খুব ছোট্ট দেখাত। ও বাড়িতে আমরা কখনও যাইনি। জানতাম যাবও না কখনও। বাড়িটা আমাদের কাছে ছিল গল্পে পড়া বামণদের বাড়ির মতো। তবে আমরা জানতাম ওটা কার বাড়ি।

লোকটার নাম রলি গ্রেইন। নামটা শুনতে রূপকথার কোনো চরিত্রের মতো শোনালেও এই লেখায় লোকটার আর কোন উল্লেখ থাকবে না। কারণ, এ লেখাটা কোন গল্প নয়, নির্জলা জীবনের কথা মাত্র।

আমার জন্মের আগে দুবার গর্ভপাত হয়েছিল মায়ের। তাই আমার জন্মানোটা যতটা না আনন্দের ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল স্বস্তির। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বস্তির মাত্রাটা কমে আসছিল ক্রমশ। ফারের ব্যবসাটা আরও কয়েক বছর আগে শুরু করতে পারলে জমজমাট ব্যবসা করতে পারত বাবা। ফার খুব জনপ্রিয় ছিল তখন। মানুষের হাতে টাকাও ছিল প্রচুর। ঠিক সময়ে শুরুটা করতে পারেনি বাবা। তার ফলে যে ব্যবসা একেবারে বসে গেছে তা নয়। আমাদের বেশ ভালোই চলে যাচ্ছিল। যুদ্ধের পুরোটা সময় ঠিকঠাক চলে গিয়েছিল। এমনকি যুদ্ধ যখন শেষের পথে তখনও একবার আশার আলোটা যেন একটু জোরেসোরেই জ্বলে উঠেছিল।

সেই গ্রীষ্মেই বাবা আমাদের বাড়িটা ঠিকঠাক করাল, পুরনো লাল ইটের উপর পড়ল বাদামি রংয়ের প্রলেপ। বাড়িটার ইট আর কাঠের তক্তাগুলোর ফাঁক দিয়ে ভীষণ ঠাণ্ডা ঢুকত। বাবা ভেবেছিল এক প্রলেপ রং পড়লে হয়তো ফাঁকাগুলো বন্ধ হয়ে ঘরের ভেতরের ঠাণ্ডাটা কমবে। তবে রংয়ে কোনো কাজ হয়েছিল বলে মনে পড়ছে না। খাবারঘরের আদলটা প্রায় পুরোটাই বদলে ফেলা হয়েছিল। এই খাবারঘরেই বাবা আমাকে বেধড়ক পেটাত। আর অপমানে, লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছা করত। খাবারঘরটা বদলে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে আমার স্মৃতিও যেন খানিকটা বদলে গেল। এই ঘরটার ভেতরে এসব ঘটনা কখনও ঘটেছিল তেমন আর মনেই হত না। আমার জন্য ভালোই হয়েছিল। যে সময়টার কথা বলছি, সে সময় আমি হাইস্কুলের মেধাবী ছাত্রী। ঠিকঠাক নিয়মে কলম ধরা আর হেম সেলাই ছেড়ে আমার মনযোগ তখন ইতিহাস কিংবা ল্যাটিনের মতো ভারি ভারি বিষয়ে।

সেই যে আশার আলোটা জ্বলে উঠেছিল বাড়িটা মেরামতের সময়, সেটা কিন্তু নিভে গেল। আর কোনোদিন সে আলো জ্বলেনি। বাবা প্রথমে সবগুলো শেয়ালের ফার, পরে মিঙ্কগুলোর ফারও বিক্রি করে দিল। দাম পেল অবিশ্বাস্য রকম কম। এরপর থেকে দিনের অংশটা বাবা ব্যয় করত খোঁয়াড়গুলো গুটিয়ে ফেলার কাজে। বিকেল পাঁচটা থেকে এক ঢালাই কারখানায় কাজ করা শুরু করল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাঝরাত।

হাইস্কুলের শেষ বছরে তখন আমি। স্কুল থেকে ফিরেই লেগে পড়তাম বাবার দুপুরের খাবার তৈরি করতে। একটা কটেজ রোল ভেজে উপরে একগাদা টমেটো কেচাপ ছড়িয়ে দিতাম। ফ্লাস্কটাতে ভরে নিতাম কড়া করে তৈরি চা। একটা মাফিনও নিতাম উপরে জ্যাম লাগিয়ে। আবার কখনও বা ঘরে তৈরি পাই থেকে পুরু একটা টুকরো কেটে নিতাম। কোনো কোনো শনিবারে আমি পাই বানাতাম। মাও বানাত মাঝে মাঝে। মায়েরটা সবসময় ভালো হত না।

তখনও আমরা জানতাম না, আরও খারাপ কিছু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। পারকিনসন্স রোগ। মায়ের বয়স চল্লিশ ছুঁতে ছুঁতেই তার শরীরে পারকিনসন্সের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করল।

প্রথম প্রথম ব্যাপারটা খুব একটা গুরুতর ছিল না। হঠাৎ হঠাৎ চোখ উল্টে যেত আর ঠোঁটের চারপাশে থুতু জমে উঠত শুধু। সকালে পোশাক পাল্টানোটা মা নিজেই করে নিতে পারত। ঘরের টুকটাক কাজও করত মাঝেমধ্যে। কোথাও যেন একটা শক্তির উৎস ছিল মায়ের। সবাইকে অবাক করে দিয়ে অনেকগুলো বছর সে শক্তি নিয়ে বেঁচে ছিল মা।

পড়তে পড়তে আপনাদের নিশ্চয় মনে হচ্ছে, কী ভীষণ খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। বাবার আয় রোজগারের দুরাবস্থা, মায়ের এখন কঠিন অসুখ। জানলে আপনারা হয়তো অবাকই হবেন, আমার স্মৃতি কিন্তু অন্য কথা বলে। বাড়িতে সে সময় কখনও মন খারাপ করা পরিবেশ থাকত না। হয়তো তখনও কেউ বুঝে উঠতে পারেনি যে মা আর কখনও সুস্থ হবে না, দিন দিন আরও খারাপই হবে তার স্বাস্থ্য।

বাবা কিন্তু বেশ সুস্থ সবল ছিল দীর্ঘদিন। ঢালাই কারখানার সহকর্মীদের সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল তার। তারাও সবাই বাবারই মতো। হয় আগের রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গেছে, নয়তো কিছু বাড়তি উপার্জন দরকার। পাহারাদারের কাজটা শেষ করে বাবা আরও একটু বাড়তি কাজ করত। গলানো লোহা ছাঁচে ঢালার কাজ। কাজটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু বাবা বলত এ কাজে নিজের সতর্কতাটাই সবচেয়ে জরুরি।তাই নিজে সতর্ক থাকলে আর কোনো ভয় নেই। তার উপর ওরা বেশ ভালো পয়সা দিত এই কাজটার জন্য। বাবার জন্য সেটা ছিল একরকম বাড়তি পাওনা, খানিকটা বিলাসিতাও। কাজটা বাবা ভালোবাসত।

আমার বিশ্বাস, বাবা বাড়িটা থেকে পালিয়ে বাঁচত। এত ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেও বাবা স্বস্তি খুঁজে পেত ওই ঢালাই কারখানায়, যেখানে তার সময় কাটত এমন কিছু মানুষের সঙ্গে, যাদের সবার জীবনই সমস্যায় ভরা। কিন্তু এরমধ্যেই তারা জীবনকে উপভোগ করতে জানত পরোপুরি।

বাবা কাজে বেরিয়ে গেলেই আমি রাতের খাবার তৈরি করতে শুরু করতাম। আমার ধারণা ছিল মজার মজার সব খাবার বানাতে পারি আমি। স্প্যাগেটি, ওমলেট এসব। শুধু খরচের ব্যাপারটা একটু মাথায় রাখতে হত। খাওয়ার পর থালাবাসন ধুয়ে-মুছে তুলে রাখার দায়িত্ব ছিল আমার বোনের। আর অনেক অনুরোধের পর ভাইটা থালাবাসন ধোয়া পানিটা বাইরে ফেলে দিয়ে আসত। এরপর আমি বসতাম বই পড়তে। বুঝে হোক আর না বুঝে হোক হাজারো রকমের বই পড়তে আমার ভালো লাগত। স্কুলের পড়া পড়ে এই সময়টুকু নষ্ট করার আমি কোনো মানে খুঁজে পেতাম না। স্কুলের পড়া আমি পড়তাম শুধুমাত্র পরীক্ষার আগে, সারারাত জেগে। মাথাটা নেহাত খারাপ ছিল না। একরাতের মধ্যেই মাথায় ঢুকিয়ে নিতাম পরীক্ষার জন্য যা যা প্রয়োজন সব।

নানা অসংগতি মধ্যেও নিজেকে ভাগ্যবান মনে হত আমার।

মাঝেমধ্যে মায়ের সঙ্গে আমার কথাবার্তা হত। মায়ের সঙ্গে আর তর্ক করতাম না আমি। মায়ের কথার বড় একটা অংশ জুড়ে থাকত তার ছেলেবেলার বিভিন্ন গল্প। দৈহিক সম্পর্ক নিয়ে কথা বলত মা। বলত, কী ভীষণ পবিত্র বিষয়টা। এর ফলেই না সন্তানের মতো অমূল্য সম্পদ মেলে। এসব বলতে বলতে শিহরণ খেলে যেত তার গলায়। সে শিহরনও আমি সহজেই অগ্রাহ্য করতে পারতাম।

একটা গল্প মা আমাকে অনেকবার বলেছে। যে বাড়িতে ওয়েটি স্ট্রিটস থাকত সে বাড়িটার গল্প। গল্পটা ওয়েটিকে নিয়ে নয়। গল্পটা মিসেস নেটারফিল্ডকে নিয়ে। এক পাগলাটে মহিলা যে ঐ বাড়িটাতে থাকত অনেক বছর আগে। গ্রামের অন্য সবার মতোই মিসেস নেটারফিল্ডও তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র শহরের মুদি দোকান থেকে অর্ডার করে আনিয়ে নিত।

একবার নাকি দোকানদার মাখন পাঠাতে ভুলে গিয়েছিল, অথবা হয়তো মিসেস নেটারফিল্ডই অর্ডার করতে ভুলে গিয়েছিলেন। ডেলিভারি বয় এসে মাল নামানোর জন্য ট্রাকের পেছনটা খুলতেই মিসেস নেটারফিল্ড লক্ষ করলেন মাখন পাঠানো হয়নি। ভীষণ রেগে গেলেম মহিলা। উনি একরকম তৈরিই ছিলেন। ছোট্ট একটা কুড়াল হাতেই ছিল তার। কুড়ালটা এমনভাবে উঁচু করে তাক করলেন যেন তক্ষুনি ছুড়ে মারবেন ছেলেটার দিকে। ছেলেটা এক দৌড়ে সোজা ড্রাইভিং সিটে পৌঁছে জান নিয়ে পালাল। ট্রাকের পিছনের দরজাটা পর্যন্ত বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল বেচারা।

গল্পটার বেশকিছু তথ্য গোলমেলে। যদিও গল্পটা শোনার সময় আমার গোলমেলে ঠেকেনি একবারও। মাও মনে হয় খেয়াল করেনি বলার সময়। প্রথমত, মিসেস নেটারফিল্ড কীভাবে ট্রাকের দরজা খোলামাত্র বুঝে ফেললেন যে মাখন আসেনি?

দ্বিতীয়ত, উনার হাতে কুড়াল ছিল কেন? কোনো বিপদের আশংকা তো ছিল না। তাহলে উনি কি কুড়ালটা সঙ্গেই রাখতেন সবসময়, যখন তখন কাজে লাগতে পারে ভেবে? মা তো বলত মিসেস নেটারফিল্ড তরুণ বয়সে বেশ ভদ্রস্থ একজন মহিলাই ছিলেন।

আরও একটা গল্প আছে মিসেস নেটারফিল্ডকে নিয়ে। এ গল্পটার ব্যাপারে আমার আগ্রহ ছিল আরও বেশি। কারণ এ গল্পের একটা চরিত্র স্বয়ং আমি। ঘটনাটা ঘটেছিল আমাদের বাড়িতেই।

দিনটা ছিল শরতের একটা ঝকঝকে সুন্দর দিন। মা আমাকে রান্নাঘরের পাশের ছোট্ট উঠোনটায় দোলনায় ঘুম পাড়িয়ে রেখে ঘরের ভেতরে কাজ করছিল। বাবা বাড়িতে ছিল না। সম্ভবত দাদাদের খামারে গিয়েছিল। মা সিংকের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাপড় ধুচ্ছিল। প্রথম বাচ্চার জন্য যত্ন করে বানানো লেইস কিংবা ক্রুস কাঁটার জামা, যত্ন করে হাতে ধুতে হত সেগুলো। মায়ের সামনে কোনো জানালা ছিল না। বাইরে নজর বুলানোর একমাত্র উপায় ছিল রুমের একেবারে অন্যপাশে উত্তরের জানালায় গিয়ে দাঁড়ানো। ওখান থেকে পুরো ড্রাইভওয়েটাই দেখা যেত, গেইট থেকে একদম বাড়ির দরজা পর্যন্ত।

এ রকম সময় হঠাৎ কী এমন ঘটেছিল যে, মা কাপড় ধোয়া ফেলে ড্রাইভওয়ের দিকে চোখ রাখতে ছুটে গিয়েছিল? কারও তো আসার কথা ছিল না তখন। এমনও নয় যে বাবার ফিরতে দেরি হচ্ছিল। তাহলে? মা কি বাবাকে ফেরার পথে কোনোকিছু কিনে আনতে বলেছিল রাতের খাবার রান্না করার জন্য? মা হয়তো ভাবছিল, বাবা ঠিক সময়ে না ফিরলে রান্নাটা সময়মতো করা যাবে না। মা সে সময় বেশ ডাকসাইটে রাঁধুনি ছিল। বিশেষ করে তার শ্বাশুড়ির তুলনায় তো ডাকসাইটে বলতেই হয়। বাবার পরিবারের অন্য মহিলারা বলাবলি করত, “খরচের বহরটা দেখলেই তো বোঝা যায়!”

আবার এমনও হতে পারে যে ব্যাপারটার সঙ্গে রান্নার কোনো সম্পর্কই ছিল না। বাবার হয়তো মায়ের নতুন পোশাকের জন্য কাপড় কিনে আনার কথা ছিল, কিংবা একেবারেই অন্য কোনোকিছু।
মা কোনোদিনই বলেনি ঠিক কী কারণে মা সেদিন জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

মায়ের রান্না ছাড়াও তার আরও কিছু বিষয় নিয়ে শ্বশুরবাড়ির নারীমহলে বেশ সমালোচনা হত। পোশাক-আশাক নিয়ে তো নিশ্চয় হত। মা সিংকে সামান্য ধোয়ামাজার কাজ করতে নামলেও ইভনিং ড্রেসটা পরে নিত। আবার রোজই দুপুরে আধঘণ্টা ঘুমিয়ে উঠে পোশাক পাল্টে নিত। পুরনো ছবিগুলো দেখে আমার মনে হত, সে সময়ে হালফ্যাশনের পোশাকগুলো মাকে একদম মানাত না, কাউকেই মানাত না আসলে। কেমন অদ্ভুত ছাঁটের সব পোশাক।

ছোট করে ছাঁটা চুলটাও মায়ের গোলগাল মুখের সঙ্গে বেমানান লাগত। তবে এসব ব্যাপার নয়, সবাই সমালোচনা করত অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে। মায়ের নিজেকে প্রকাশের ভঙ্গিটা নাকি ছিল ভীষণ আরোপিত। চালচলন দেখে নাকি মনে হত না মা খামার বাড়ির মেয়ে, এমনকি খামারে জীবনটা কাটিয়ে দিতেও বেশ আপত্তি ছিল তার।
যাই হোক, মিসেস নেটারফিল্ডের গল্পে ফেরত যাই। সেদিন বাবার গাড়ি আসতে দেখে মা জানালার কাছে ছুটে যায়নি। মা দেখতে পেয়েছিল মিসেস নেটারফিল্ডকে। মহিলা নিশ্চয় তার বাড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বাড়ি পর্যন্ত চলে এসেছিলেন। সেই বাড়িটা থেকে যেখানে পরে যুদ্ধে এক হাত হারানো ওয়েটি স্ট্রিটস আর তার বউ থাকত। আজ থেকে অনেক বছর আগে এই বাড়িটা থেকে মহিলা কুরাল হাতে ডেলিভারি বয়কে তাড়া করেছিল।
মায়ের সঙ্গে মিসেস নেটারফিল্ডের আগেও দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল নিশ্চয়। হয়তো কথাও হয়েছিল কখনও। হওয়াটাই স্বাভাবিক, প্রতিবেশীই তো ছিল তারা। তার সঙ্গে কথা বলার জন্য মা হয়তো কোনো একটা অজুহাতও দাঁড় করিয়েছিল বাবার সামনে। বাবা হয়তো আগেই এ মহিলার ব্যাপারে মাকে সতর্ক করে দিয়েছিল। মায়ের আবার পাগলাটে মানুষদের প্রতি বেশ সহানুভূতি ছিল। একেবারে উন্মাদ হলে অবশ্য ভিন্নকথা।

কিন্তু সে মুহূর্তে মায়ের মনে সহানুভূতি বা ওই ধরনের কোনো অনুভূতি কাজ করছিল না মোটেই। মা এক ছুটে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিল। দোলনা আর দোলনায় আমার কাঁথা-কাপড় পরে রইল। ঘরে ঢুকেই রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে দিল মা। বাইরের দরজাটা সবসময় বন্ধই থাকত। সেটা নিয়ে চিন্তা ছিল না।

চিন্তা ছিল অন্য কারণে। রান্নাঘরের দরজাটার একতা খুঁত ছিল। দরজাটা ঠিকমতো বন্ধ করা যেত না, কোনো তালা ছিল না দরজাটায়। প্রতিরাতে একটা চেয়ার টেনে দরজার গায়ে কাত করে ঠেস দিয়ে রাখা হত। এমনভাবে চেয়ারটা রাখা হত যেন বাইরে থেকে কেউ ঢোকার চেষ্টা করলে বিকট আওয়াজে চেয়ারটা পড়ে যায়। বাড়ির নিরাপত্তা রক্ষার বেশ হাস্যকর উপায় বটে। তবে বাড়িতে একটা রিভলবার ছিল, ড্রয়ারের ভেতরে। আবার ঘোড়া শিকার করতে হত বলে অন্য সব খামারিদের মতো আমার বাবারও একটা রাইফেল আর একটা শর্টগান ছিল। সেগুলো লোড করা থাকত না অবশ্য।

আচ্ছা, দরজাটা চেয়ার ঠেলে বন্ধ করার সময় মায়ের কি বন্দুকগুলোর কথা মনে ছিল? মা কি কোনোদিন বন্দুক হাতে ধরেছিল? মা কি জানত, কী করে গুলি ভরতে হয়?
মায়ের কি একবারের জন্যও মনে হয়নি যে মহিলা স্রেফ প্রতিবেশীর বাড়িতে সৌজন্য সাক্ষাতে এসেছিলেন? মনে হয় না। মহিলার হেঁটে আসার ভঙ্গিতে নিশ্চয় কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল, খুব দৃঢ় কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে হেঁটে আসছিলেন তিনি।

সম্ভবত মা মনে মনে প্রার্থনা করছিল তখন। যদিও মা নিজে এমন কিছু বলেনি তার গল্পে।
রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করার সময় মা দোলনায় রাখা আমার কাপড়গুলোর একটা উড়ে এসে মাটিতে পড়তে দেখেছিল। বোঝা গেল দোলনাতে কাপড় চোপড় সরিয়ে কিছু একটা খোঁজা হচ্ছে। ভয়ে মা জানালার পর্দাগুলো টেনে দিতেও গেল না আর। আমাকে বুকে নিয়ে একটা কোনায় লুকিয়ে রইল।
দরজায় কোনো টোকা পড়ল না। রান্নাঘরের চেয়ারটাও নড়ল না। বাইরেও আর কোনো শব্দ শোনা গেল না। মা ভেবে নিল, কোথাও কোনো শব্দ না হওয়ার একটাই মানে– মহিলা চলে গেছেন।
ব্যাপারটা মোটেই তা ছিল না। মিসেস নেটারফিল্ড বাড়িটার চারপাশ দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। সময় নিয়ে, প্রতিটা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে, ঘুরে দেখছিলেন বাড়িটা। প্রতিটা জানালার কাচে মুখ চেপে ভেতরে চোখ বুলাচ্ছিলেন মহিলা। দিনটা খুব সুন্দর ছিল বলে পর্দাগুলো সব সরানো ছিল। খুব বেশি লম্বা ছিলেন না মিসেস নেটারফিল্ড। তাই বলে জানালা দিয়ে বাড়ির ভেতরে দেখতে কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না।

কিন্তু আমার মা এতকিছু জানল কী করে? মা তো আমাকে বুকে নিয়ে ঘরের এক কোনায় লুকিয়ে ছিল। এমন তো নয় যে মা আলমারির কোনা থেকে সোফার পিছনে, সোফার পিছন থেকে শেলফের পাশে ছুটে বেড়াচ্ছিল আর ভয়ার্ত চোখে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছিল মহিলা কী করছেন।

মা তো আলমারির কোনাতেই ঠায় বসে ছিল পুরোটা সময়। এর চেয়ে বেশি আর কিই-বা করতে পারত মা।
বাড়িতে একটা তলকুঠুরি ছিল বটে। সেটার জানালাগুলোও খুব ছোট ছিল। চাইলেও কেউ জানালা দিয়ে ঢুকতে পারত না। কিন্তু দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মহিলা যদি কোনোভাবে বাড়ির ভেতরে ঢুকে যেত আর তলকুঠুরির সিঁড়ি বেয়ে মেনে আসত তাহলে তো পরিণতিটা আরও ভয়াবহ হত।
উপরের তলাটাও ছিল। তবে উপরে যাওয়ার সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছুতে হলে মাঝের বড় ঘরটা পার হয়ে যেতে হত। সেই বড় ঘরটা যেখানে আর কিছুদিন পর, আমি বড় হওয়ার পর আমাকে পেটাত বাবা। বাড়ি মেরামত করার সময় ঘরটার আদল বদলে ফেলার ফলে সে স্মৃতিগুলো আর খুব একটা মনে পড়ত না।

প্রথম কবে মায়ের মুখে গল্পটা শুলেছিলাম মনে নেই। যদ্দূর মনে পড়ে, প্রথম প্রথম মা গল্পটা এখানেই শেষ করে দিত। মিসেস নেটারফিল্ড জানালার কাচে দুহাত আর মুখ চেপে ভেতরে দেখার চেষ্টা করছেন। ব্যস, এটুকুই। কিন্তু পরের দিকে মা গল্পটা শেষ করত আরেকটু লম্বা করে। সেখানে মহিলা ভয়ংকর রেগে যেতেন। তারপর শুরু হত এটাসেটা ছুঁড়ে ফেলার দুদ্দাড় শব্দ। মায়ের গল্পে মহিলার রেগে গিয়ে চিৎকার করার কোনো উল্লেখ ছিল না। বৃদ্ধার মনে হয় চিৎকার করার মতো দম ছিল না।

শেষমেষ হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন মিসেস নেটারফিল্ড। দরজা জানালাগুলোতে উঁকিঝুঁকি মেরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের বাড়ির সীমানা ছেড়ে। মাও শেষ পর্যন্ত কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে চারপাশটা দেখেশুনে নিশ্চিত হয়েছিল যে এখানে সুবিধা করতে না পেরে মহিলা অন্য কোথাও হানা দিতে গেছেন।
রান্নাঘরে ঠেস দেওয়া চেয়ারটা তেমনই রইল বাবা না ফেরা পর্যন্ত।

এ গল্পটা যে প্রায়ই মায়ের মুখে শোনা যেত তা কিন্তু নয়। বরং অন্য অনেক গল্প ছিল তার ঝুলিতে, যেগুলো বারবার বলতে মা পছন্দ করত। যেমন তার হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার গল্প, বন্ধুদের গল্প, তাদের সঙ্গে ঠাট্টা তামাশা করার গল্প, এলবার্টার যে স্কুলে সে কাজ করত সেখানকার গল্প – সেখানে নাকি ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসত।
munro-alice.gif
মায়ের কথাগুলো, মা ঠিক কি বলতে চাইছে আমি খুব ভালো বুঝতে পারতাম। আমিই অন্যদের বুঝিয়ে দিতাম মায়ের কথা। সময় সময় কাজটা খুব কঠিন হয়ে যেত আমার জন্য। বিশেষ করে মা যখন খুব বিশদ বর্ননা দিত কোনোকিছুর কিংবা যখন রসিকতা করার চেষ্টা করত। আমি টের পেতাম, শ্রোতারা পালিয়ে বাঁচার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠত ভেতরে ভেতরে।

মিসেস নেটারফিল্ডের গল্পটা নিয়ে বেশি কথা বলা মা পছন্দ করত না। কিন্তু গল্পটা দীর্ঘদিন আমার মনে গেঁথে ছিল। আমার মনে আছে অনেক বছর পরে কোনো একসময় আমি মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মিসেস নেটারফিল্ডের কথা।

“ওরা মহিলাকে নিয়ে গেছে।” মা বলেছিল। “এখানে ফেলে রাখলে তো একা একা মরে পড়ে থাকত একদিন।”
বিয়ের পর আমি ভ্যানক্যুভারে চলে আসি। যে ছোট্ট শহরে আমার বেড়েওঠা তার সাপ্তাহিক পত্রিকাটা আমি ডাকে পেতাম প্রতি সপ্তাহে। বাবা আর তার দ্বিতীয় স্ত্রী মিলে সম্ভবত আমাকে পত্রিকাটার নিয়মিত গ্রাহক করে দিয়েছিল। বেশিরভাগ সময় আমি পত্রিকাটা খুলেও দেখতাম না।

কিন্তু একদিন পাতা উল্টাতে গিয়ে একটা নাম দেখে চোখ আটকে গেল। নেটারফিল্ড। এই নেটারফিল্ড আমার ছোট্ট শহরটার অধিবাসী নয়। এই মহিলা অরেগন প্রদেশের পোর্টল্যান্ডে থাকেন। পত্রিকায় উনার একটা চিঠি ছাপা হয়েছিল। আমার মতো উনিও এখনও পত্রিকাটার নিয়মিত গ্রাহক। তার শৈশব কেটেছে যে শহরে তাকে নিয়ে একটা কবিতাও লিখেছেন তিনি।
চিরচেনা সেই সবুজ পাহাড়ি ঢাল
স্বচ্ছ নদীর ঠিক ওই পাড়ে দাঁড়িয়ে
শান্তি সুখে মিলেমিশে একাকার
মায়াময় স্মৃতি ডাকে আজ হাত বাড়িয়ে।

বেশ কয়েকটা স্তবকে লেখা ছিল কবিতাটা। যতই পড়ছিল ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল– এ কবিতা সেই একই নদীর তীর নিয়ে লেখা যে নদীর তীরকে আমি মনে করতাম শুধুই আমার একার।
“ছোটবেলার স্মৃতিতে জড়িয়ে থাকা পাহাড়ি ঢালটাকে নিয়ে কবিতাগুলো লিখেছিলাম।” মহিলা তার চিঠিতে লিখেছেন, “যদি লেখাটা ছাপার যোগ্য হয় তাহলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করব। ধন্যবাদ।”
সূর্যের আলো নদীর জলের ‘পরে
ঝিকিমিকি খেলে চলেছে নিরন্তর
ওপাড়ে বিছানো সবুজ জংলাজুড়ে
বুনোফুলে ছাওয়া স্বপ্নিল প্রান্তর।

আমাদের নদীর তীর, আমার নদীর তীর। আরেকটা স্তবক ছিল মেপলগাছের সারি নিয়ে। আমার ধারণা মহিলার খানিকটা স্মৃতিভ্রম হয়েছিল। গাছগুলো মেপল নয়, এলম ছিল। গাছগুলো সব ‘ডাচ এলম’ নামে একটা রোগে মরে গিয়েছিল পরে।

চিঠির বাকি অংশটা পড়ে ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হল। মহিলার বাবার নাম ছিল নেটারফিল্ড। উনি ১৮৮৩ সালে সরকারের কাছ থেকে এক খণ্ড জমি কিনেছিলেন। তখন জায়গাটার নাম ছিল ‘লোয়ার টাউন’। ভদ্রলোকের জমিটা শেষ হত একদম মেইটল্যান্ড নদীতে গিয়ে।
আইরিসে ঘেরা নদীটার পার ঘেঁষে
মেপল গাছের ছায়াঢাকা মাঠখানি
রাজহাঁসগুলো দলে দলে সব এসে
ভেজা ভেজা মাঠে খুঁটে খায় দানাপানি।

বাস্তবে সবকিছু কিন্তু কবিতার মতো এত নির্মল সুন্দর ছিল না। ঘোড়াগুলো ঝরনার পানিটা ঘোলা করে ফেলত। আর ছিল গোবর। মহিলা সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছেন এ ব্যাপারগুলো। আমি হলেও তা-ই করতাম।
সত্যি বলতে কি, আমার নিজেরও কয়েকটা কবিতা ছিল। মোটামুটি এ ধরনের কবিতাই। আমারগুলো অবশ্য হারিয়ে গেছে সব। হয়তো কাগজে লেখাও হয়নি কোনোদিন। সে বয়সে প্রকৃতির রূপ বর্ণনা করে লেখা কবিতা গুছিয়ে শেষ করা খুব সহজ ছিল না আমার জন্য। কবিতাগুলো আমি লিখেছিলাম যে সময়টাতে, আমি মাকে একদম সহ্য করতে পারতাম না তখন। বাবাও তখন মায়ের নালিশ শুনে আমাকে বেদম মার মারত। মেরে শয়তানির ভূত ছাড়ানো যাকে বলে আর কি।

মহিলা লিখেছেন তার জন্ম ১৮৭৬ সালে। বিয়ের আগ পর্যন্ত মহিলা বাবার বাড়িতেই কাটিয়েছেন –শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের খানিকটা সময়ও। বাড়িটা ছিল ঠিক শহর আর গ্রামের সীমানায়। খুব সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা যেত সেখান থেকে।

তার মানে, আমাদের বাড়িটা।
মা কি তথ্যটা জানত না? জানত না যে আমাদের বাড়িটা একসময় নেটারফিল্ডের বাড়ি ছিল? আর সেদিন ওই বৃদ্ধা আসলে জানালায় মুখ চেপে তার বাড়ির ভেতরটাই দেখছিল, একদিন যে বাড়িটা ছিল তার নিজের বাড়ি?
সম্ভব। বয়স বাড়ার কারণেই মনে হয় এখন আমার পুরনো নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে ভালোই লাগে। বিভিন্ন তথ্য খুঁজে বেড়াই কাগজপত্রের মাঝে। দলিলগুলো বলে নেটারফিল্ডের কাছ থেকে বেশ কবার হাত বদল হয়ে বাড়িটা আমাদের দখলে এসেছিল। ভাবতে অবাক লাগে, এমন একটা বাড়ি মহিলা বিক্রি করে দিয়েছিলেন খুব কম বয়সেই।

আরও তো অনেকদিন বেঁচে ছিলেন তিনি। তাহলে কেন বিক্রি করে দিলেন বাড়িটা? খুব কম বয়সেই কি মহিলা স্বামী হারিয়েছিলেন? টাকাপয়সা দরকার ছিল তার? কে জানে। আর… শেষ পর্যন্ত কারা নিয়ে গিয়েছিল তাকে, শেষ দিনগুলো একা একা থাকতে দেবে না বলে? তার মেয়ে? যে এই কবিতাগুলো লিখেছে? হয়তো এই মেয়েই বড় হয়ে দূরের কোনো শহরে চলে গিয়েছিল। তাহলে কি তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন মহিলা– সেদিন দোলনার সব কাঁথা-কাপড় সরিয়ে? হায়! মা তো ততক্ষণে আমাকে জাপটে ধরে পালিয়ে এসেছিল ঘরের ভেতরে, জীবন বাঁচাতে।

বিয়ের পর আমি যে শহরে থাকতাম, মিসেস নেটারফিল্ডের মেয়ে তার কাছেই একতা শহরে থাকত। আমি তার সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ করতে পারতাম। হয়তো দেখা করাও সম্ভব ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা করে কী বলতাম? আমি যা বলতাম সেসব শুনে কি তার ভালো লাগত? যার সঙ্গে এই মুহূর্তে কথা বলতে পারলে সবচেয়ে ভালো লাগত, সে হল আমার মা। কিন্তু ততদিনে মা আর বেঁচে নেই।

মা যখন শেষবারের মতো অসুস্থ হয়ে পড়ল তখন আমি যাইনি। এমনকি মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতেও নয়। তখন আমার বাচ্চা দুটো একদম ছোট। আশপাশে এমন কেউ ছিল না, যার কাছে ওদের রেখে যাওয়া যেত। টাকাপয়সার ব্যাপারটাও চিন্তা করতে হয়েছিল– অত দূরের পথ, অনেক খরচের ব্যাপার। তার উপর আমার বর এসব সামাজিকতা একদম পছন্দ করত না। তবে ওকেই-বা দোষ দিচ্ছি কেন? আমার নিজেরও তখন ঠিক একই রকম মনে হত। আমরা ভাবতে ভালোবাসি যে জীবনে এমন কিছু ভুল থাকে, যা কখনও ক্ষমা করা যায় না, আমরা নিজেরা নিজেদের ক্ষমা করতে পারি না। আসলে কিন্তু আমরা নিজেদের ক্ষমা করে দেই, মুক্ত করে দেই অপরাধবোধের শিকল থেকে, প্রতিনিয়ত।

আমার মা যখন খুব অসুস্থ, তার মৃত্যুর ঠিক আগে, একরাতে সে কী করে যেন হাসপাতাল থেকে বের হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কেউ একজন, সম্পূর্ণ অচেনা কেউ একজন, মাকে দেখতে পেয়ে হাসপাতালের ভেতরে পৌঁছে দিয়ে এসেছিল। এটা গল্প হলে হয়তো বলা যেত, ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি। কিন্তু জীবনটা সত্যিই বড্ড বাড়াবাড়ি করে।

 

 

 

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>