আমার শিক্ষকগণ (পর্ব-৩)

Reading Time: 3 minutes

 বাবা আর পাঞ্জা লড়া

১) আমাদের এক ভাই ছিল। আমার বয়েস ছয়। তার চার। আফ্রিকার এক দেশে সে বড়ো হয়েছে। আমাদের সেখানেই শৈশবের চার বছর কাটল। তার খুব ছোটোবেলায় যুদ্ধের স্মৃতি ছিল, সেই জন্য তার কিছু ডেভেলপমেন্টাল সমস্যা ছিল, যা শুধু তার মা-বাবা বুঝতেন।

আমরা দেখতাম সে একই সঙ্গে জেদী, মারকুটে, ম্যানিপুলেটিভ — আবার মিষ্টি, শান্ত, লক্ষ্মী বাচ্চা।

প্রথম প্রথম ওই খুদে ভাইয়ের কাছে আমি খুদে মানুষটা মার খেতে লাগলাম। আমরা কখনো মারামারি করিনি, দেখিওনি। বাবার কাছে গিয়ে রিপোর্ট করলাম। বাবা বললেন, ‘দুই বছরের ছোটো ভাই মারে, সেটা বলতে এসেছ?’

এই হল বাবার স্টাইল। যা বলবেন বলবেন। কথা কম। শান্ত চেহারা। একগাদা হাঁকডাক নেই। আমি চুপচাপ শুনে চলে এলাম।

যারা বাবাকে ভালোমানুষ মনে করেন, তারা জানেন না বাবার আত্মসম্মান কী প্রকার লোহা বেঁকিয়ে ফেলা টাইপ।

তো, যা বোঝার বুঝে গেলাম। কেউ নেই এই ছোটো শিশুর কাছ থেকে আমাদের উদ্ধার করবে। অথচ সে ছোটো ভাই। মারব কী করে? মারামারিতে আমার বরাবর খুব আপত্তি – যদিও একবার মার্শাল আর্টস শিখতে গিয়েছিলাম আর আমার তৎকালীন শিক্ষক আর তাঁর সহকারী (আমাদের এক বন্ধু আর ভাইস্থানীয়) কে এইসা কিলঘুষি মারতে হত যে সে বলেই রেখেছিল আগের জন্মের অনেক শত্রুতা ছিল আমাদের!

এই ছাড়া মারামারিতে আমাদের মোটেই আগ্রহ নেই। সাইকোলজিকাল ওয়ারফেয়ারে আগেই হেরে বসি। ফ্লাইট অর ফাইট? আমরা ফ্লাইটের পক্ষে।

তো — ব্রাদার মারধোর করতে এলে তার দুই হাত শক্ত করে ধরে থাকতাম। এরকম এক মাস চলার পরে ব্রাদার স্বগতোক্তি করেছিল, ‘ আ যখন এসেছিল, তখন বোকা ছিল। এখন চালাক হয়ে গেছে।’

২) দেখলাম bullyদের এই এক ব্যাপার। সরল ব্যক্তিদের বোকা মনে করে। আর তারা ঘুরে দাঁড়ালে রুষ্ট হয়। কেউ কেউ সেটা নিতেই পারে না। নিন্দেমন্দ করতে শুরু করে। ছোটোরা আবার নিন্দেমন্দকে তেমন গা করে না। আমরাও করলাম না।

ভাই অবশ্য ছোটো ছিল। তাই জেদী চেহারা অন্তর্হিত হয়ে লক্ষ্মী বাচ্চার চেহারাটা দেখা গেল। আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়েছিলাম।

সেই ভাই শেয়ার করতে পারত না। ওকে পরে আরো শিখিয়েছিলাম – যে একা একা সাইকেল চালালে আমরা তার সঙ্গে খেলতে নারাজ। সে একবার চালাবে। আমরা একবার। সেইসব দিনে সাইকেল জিনিসটা ঘরে ঘরে থাকত না। আমার যেমন ছিল না। তাই ব্রাদারেরটা দিয়ে খেলা হত।

৩) পরে হস্টেলে দেখলাম টেবিল টেনিস আমাদের এমন কিছ আসে না, তবে পাঞ্জা লড়ার প্রতিযোগিতায় আমরা জিতে যেতাম। আমার বন্ধুগুলো বেশি ভালো ছিল। তারা আমাদের পাঞ্জা জেতার জন্য খুব আশকারা দিত, যা কলেজ জীবনেই সম্ভব। আশকারা জিনিসটা ভালো, কখনো কখনো। যারা শাদা মনে দেয়, তারাই তো বন্ধু। আমি মনে মনে এর জন্য বাবাকে আর ব্রাদারকে ধন্যবাদ দিয়ে ফেলতাম।

৪) বাবা যে আমাদের আত্মসম্মানজনিত সেলফ-ডিফেন্স শিখিয়েছেন, সেটা এর আগে জানালাম। অথচ এক কথায় তিনি মাটির মানুষ। একটা মাছি বা মশা মারেন না বলতে যা বোঝায়। নিয়মিত অভ্যেস করে ক্রোধ রিপুকে ছোটোবেলায় জয় করেছেন। ক্রোধ নেই এমন কোনো ব্যক্তি নেই, কিন্তু ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন’ জাতীয় মণিহারী দোকানের বিজ্ঞাপন দেখে আমরা মোটামুটি গড়পড়তা সম্মত। পুড়ে যাওয়া মরুভূমির চেয়ে সবুজ বনভূমি কে না পছন্দ করে? আর রাগী রাগী থাকতেই বা কে উপভোগ করে?

৫) উগান্ডার পাঠক্রমে যীশু খ্রিষ্ঠের সম্পূর্ণ জীবনী ছিল। আমাদের শিশুতরল মন এই জীবনী দ্বারা প্রভাবিত ছিল। যেমন শেখানো হত, যীশু মানে ক্ষমাশীল চরিত্র। জেনেবুঝে মানুষের জন্য আত্মদান করেছেন। অনুতাপে দগ্ধ করে মানুষকে মানবতা শিখিয়েছেন। যীশুর গল্পে ছিল, কেউ এক চড় মারলে নাকি অন্য গাল এগিয়ে দিয়ে বলতে পারা যায়, এখানেও মারো।

৬) এই সবের গভীর ত্বত্ত্ব যাই থাক বাবা কিন্তু আমাদের ওল্ড টেস্টামেন্টের জনের কথা বলেছিলেন, ‘an eye for an eye, a tooth for a tooth’। তারপর থেকে আমরা খুব তেজে থাকতাম।

৭) আমাদের যেখানে পড়াশুনোর শুরু, উগান্ডা, সেখানে ছেলেগুলো ডানপিটে হলেও তেমন পাজী না। ইভস টিজিং কাকে বলে আমি এগারো বছর পর্যন্ত ওখানে কাটিয়ে জানতে পারিনি।

ইস্কুলে ছেলেগুলো নেহাত নিরীহ টাইপের ছিল। জ্বালাত, কিন্তু সেটা বড়োজোর ফিচলেমি। একবার দুটো ডানপিটে খেলতে খেলতে গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল। বুঝতে না পেরে আমিও কষে বসিয়ে দিলাম এক দাবড়। ছেলেটা এমন কান্না জুড়েছিল যে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরে বাবার কাছে গিয়ে থতমত হয়ে সব বলে ফেললাম, আর ছেলেটা হয়ত মরে গেছে এই ভয়ে পরদিন ইস্কুল গেলাম না।

৮) ইস্কুল আর কলেজে কড়া-মিঠে নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে bullied হওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদেরও হয়েছে। কখনো সিনিওরিটির আড়ালে, কখনো বন্ধুত্বের আড়ালে। প্রতিবার বুলি-দের যে স্বভাব সেটাই সামনে আসে – তারা নিজেদের চালাক চতুর মনে করে, আর অন্যদের ইস্টুপিড। আমরাও কি কখনো বুলি হয়েছি? ফেলুদার ভাষায় বলি, মা গঙ্গাই জানেন।

৯) যত বোকা হই না কেন, এটা কে না বোঝে যে সরলতা সহজতা আকাশ থেকে পড়ে না — সেসব হীরেপান্নার মত যত্ন করে রাখতেও হয়।

১০) ইস্কুলে বুলিদের কীভাবে মোকাবেলা করতে হবে এই নিয়ে একবার বলেছিলাম আমাদের ভয়-খাওয়া শিশুকে। ক্লাসে পাশের বেঞ্চিতে বসা একজন বুলি রোজ পেন্সিল ইরেজার শারপনার ইত্যাদি নিয়ে নিত। শিশু আমাদের টেকনিক ব্যবহার করে আর বুঝি সফলও হয়। পদ্ধতিটা ছিল বারবার শান্তভাবেই বুলিকে জিনিসগুলো ফেরত দিতে বলতে হবে। বলতে থাকতে হবে। এখানে ‘ক্ষেপে গেলেন তো হেরে গেলেন’ জাতীয় ব্যাপার। বুলি চায় চেতিয়ে দিতে। না পারলে মুষড়ে খেলা বন্ধ করে।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>