Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com

নজরুলকাব্যে পুরাণের ব্যবহার

Reading Time: 4 minutes

সমাজের আদিম অসংলগ্ন অবস্থার সবচেয়ে প্রাচীন কাব্য পুরাণ৷ পুরাণ কাহিনী ও ধর্মকাহিনীর উদ্ভব থেকে, প্রকৃতি ও সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের মনের প্রতিক্রিয়া কিন্তু পরবর্তী কালে,কাব্য সাহিত্যে পূরাণ বেঁচে রইল নতুন অর্থ ও তাৎপর্য নিয়ে৷ আধুনিক কালে বাংলা সাহিত্যে পুরাণকে আমরাপাই রূপক ও প্রতীক হিসাবে৷ রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে পুরাণ কাহিনী অতীতের বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে আধুনিক ভাবের বাহন হয়েছে৷ রবীন্দ্রকাব্যে পুরাণের ব্যবহার অপেক্ষাকৃত কম হলেও তাঁর পরবর্তী নজরুলের কাব্যে পুরাণের ব্যবহার সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ নজরুল কাব্যে পুরাণের ব্যবহার পুরাণ হিসাবে নয়৷ আধুনিক কাব্যের ভাবের বাহন ও প্রতীক হিসাবে৷ কাহিনী গুলো প্রাচীন ধর্মগতগণ্ডী থেকে মুক্তি পেয়ে একটা সার্বজনীন রূপে সাধারণ ভাব প্রকাশের মাধ্যম রূপে ব্যবহৃত হয়েছে৷ আমরা ধর্মান্ধতার দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে পৌরাণিক কাহিনীর ব্যবহারকে একমাত্র পৌরাণিক অর্থেই সংকীর্ণ ভাবে বিচার করি৷ নজরুল কাব্য থেকে দেখাযায় হিন্দু ও মুসলিম দুই সমাজের এমনকি বাইবেল গ্রীক প্রচলিত কাহিনী কবি অসংকোচে গ্রহণ করেছেন৷ এদেশের দুটি প্রধান সমাজের পূরাণ কাহিনী কে সমান ভাবে ব্যবহার করা একমাত্র নজরুল ইসলামের পক্ষেই সম্ভব হয়েছে এবং সার্থক ও সুন্দর হয়েছে৷

বিজ্ঞান যেমন আমাদের ধারণাকে বিশ্বাসে স্থাপন করায় তেমনি কবিতায় পূরাণের ব্যবহার চেতনাকে প্রাণদেয়,উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যোগায়৷ কবির ছিলো হিন্দু ইসলাম বাইবেল গ্রীক পূরাণের প্রতি অগাতজ্ঞান, আর সেই জ্ঞানকে প্রয়োগ করে,অপূর্ব ছন্দে অলংকারে আলোকিত করেন বাংলার কাব্যজগৎ৷ তিনি কাব্যে পুরাণ প্রয়োগ করে অতীত জীবন সত্যের সঙ্গে বর্তমানের সত্যকে এক করে পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছে দিয়েছেন এক অচেনা সৌরভ৷

পুরাণ প্রসঙ্গ প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর কবিতায় দেখায়ায় সুনির্দিষ্ট কিছু নাম, ঘটনা, এবং পটভূমি৷ এ গুলোই হলো তাঁর মিথ-মস্কতার স্থায়ী উদ্দেশ্য নজরুলের কবিতায় পূরাণের উল্লেখ  কতখানি মেলে? এমন প্রশ্ন উঠলে শুরুতেই যেটা মনে আসে তা হল বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতার সুপরিচিত পংক্তি৷ “আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন”৷ এই কবিতায় আরও একবার এই চরণটি পুনরায় এসেছে—শুধু সেখানে ‘দিই’ পরিনত হয়েছে ‘দেব’ এ৷

যে কবিতা গুলির মধ্যদিয়ে কবির পুরাণের প্রতি অভিব্যক্তি ফুটে  উঠেছে
______’বিদ্রোহী’,’পূজারিণী’,’মানুষ’,
‘বারাঙ্গনা’,’সব্যসাচী’,’ইন্দ্রপতন’,—এই ৬টি কবিতায় পুরাণপ্রসঙ্গ প্রয়োগের পরিমান খুব বেশি৷
তাছাড়া আছে ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’, ‘অবেলার ডাক’,’ শায়ক বেঁধা পাখি’, ‘ছাত্রদলের গান’,’সাম্যবাদী’,’পাপ’,’নারী’,’কুলি-মজুর’, ‘দ্বীপান্তরের বন্দিনী’, ‘সত্য কবি’, ‘সত্যেন্দ্র প্রয়াণ গীতি’, ‘অন্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত’, ‘পথের দিশা’, ‘হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধ’, ‘সিন্ধু’,’অনামিকা’, ‘দারিদ্র্য’, ‘চাদনী রাতে’, ‘সান্ত্বনা’, ‘অগ্রপথিক’, ‘চিরঞ্জীব জগলুল”, ‘এ মোর অহংকার’,’জীবনবন্দনা’, ‘ফরিয়াদ’, ৷

এই সমস্ত কবিতার মধ্যে রামায়ণ, মহাভারত, শিবপ্রসঙ্গ, বিষ্ণুকথা, কৃষ্ণকথা, অমৃতমন্থনবৃতান্ত, দধীচির আত্মদান, গ্রীক, খৃষ্টীয়, মুসলিম পুরাণতত্ত্বের প্রকাশঘটে তার কবিতায়৷ ব্যপকতম ব্যবহার ঘটেছে রামায়ণ ও মহাভারতের  চরিত্র,ঘটনা ইত্যাদির৷

পুরাণ অনুষঙ্গের পাশে বন্ধনীতে কবিতার নামের তালিকা উল্লেখিত:—
রামায়ণ প্রসঙ্গ:— ( কবির কাব্যের চরিত্র ও ঘটনা)

অনাদৃতা সীতা(পূজারিণী), লঙ্কাসায়ারে কাঁদে বন্দিনী ভারতলক্ষ্মী সীতা(সব্যসাচী), সীতারাম সতী(বারাঙ্গনা), রামরাজা দিল সীতারে বিসর্জন,তাঁরাও হয়েছিলো যজ্ঞে জানকীর প্রয়োজন(ইন্দ্রপতন),অসুর-নাশিনী জগন্মাতার অকাল উদ্বোধনে,আঁখি উপাড়িতে গেছিলেন রাম(ইন্দ্রপতন), লঙ্কাকাণ্ডে(সব্যসাচী), জ্বলিবে তাহার আঁখির সমুখে কাল রাবণের চিতা(সব্যসাচী), জনক(মানুষ), মন্দোদরী(মানুষ)৷

মহাভারত প্রসঙ্গে:—(কবির কাব্যের চরিত্র ও ঘটনা)
সব্যসাচী
—————
কুরুক্ষেত্রে, জাগিছে সব্যসাচী, বিরাট কালের অজ্ঞাতবাস ভেদিয়া পার্থ জাগে, দানিতে দীক্ষা আসিতেছে ফাল্গুনী, যুগে যুগে হল শ্রীভগবান তাঁহারি রথ-সারথি, যুগে যুগে আসে গীতা উদ্গাতা, ন্যায় পান্ডব সৈন্যের ত্রাতা, বাজিছে বিধান, পাঞ্চজন্য, গাণ্ডীব ধনু রাঙিয়া উঠিল, লক্ষ লাক্ষারাগে, রথের সমুখে বসায়ো চক্রী চক্রধারীরে টানি, দুর্মতি কুরুসেনা, দুর্যোধনের পদলেহী ওরা, দুঃশাসনের কেনা, দ্বাপর যুগের মৃত্যু ঠেলিয়া, আসে নৃসিংহ ৷

ইন্দ্র পতন
——————
অকল্যাণের কুরুক্ষেত্র, কৃষ্ণের মহাগীতা, সত্যের পাঞ্চজন্য, কুরু-মেদ-ধূমে জ্বলে অত্যাচারের চিতা, যুধিষ্ঠিরের সম্মুখে রণে পড়িল সব্যসাচী, কৌরব সেনা ওঠে উল্লাস নাচি, স্বরাজ-রথের চক্র করিল গ্রাস, দাতাকর্ণের সম নিজ সুতে কারাগার-যুপে ফেলে ত্যাগের করাতে কাটিয়াছ, হে যুগ ভীষ্ম! নিন্দার শরশয্যায় শুয়ে, তুমি নব-ব্যাস, নব যুগের হরিশচন্দ্র, নব-নৃসিংহ অবতার, আর্ত-মানব-হৃদি প্রহ্লাদ ৷

বারাঙ্গনা
—————
স্বর্গবেশ্যা ঘৃতাচীপুত্র হল মহাবীর দ্রোণ, কুমারীর ছেলে বিশ্বপূজ্য কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ণ, কানীনপুত্র কর্ণ হইল দানবীর মহারথী, শান্তনু রাজা নিবেদিল প্রেম পুনঃ সেই গঙ্গায়—তাঁদেরি পুত্র অমর ভীষ্ম, কৃষ্ণ প্রণমে যাঁয়৷

শিব-প্রসঙ্গে:—(কবির কাব্যের চরিত্র ও ঘটনা)
মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি ধূর্জটি, কৃষ্ণকন্ঠ, মন্থন বিষ প্রিয়া, বোমকেশ, ধরি বন্ধনহারা ধারা গঙ্গোত্রীর, মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে, ধরি পিনাকপানির ডমুর ত্রিশূল।
(বিদ্রোহী)
এলো ভোলানাথ, শ্মশানের শিব
(মানুষ)
ব্যাথাবিষে নীলকন্ঠ, পরশু ত্রিশূল,
মহাকাল ভৈববর নেত্র, হারা-সতী উমা হয়ে ফিরে ডেকেছিল ভোলানাথে,
(পুজারিণী)

বিষ্ণু-প্রসঙ্গে:—
আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে একে দিই পদচিহ্ন, ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু বক্ষ হইতে যুগলকন্যা,চক্র মহাশঙ্খ
(বিদ্রোহী)
অবতার, কল্কি(সান্ত্বনা) ভৃগুর মতন যখন দেখেছ অচেতন নারায়ণ, পদাঘাতে তাঁর এনেছ চেতনা, নর-নৃসিংহ অবতার, শতদল নারায়ণ পদতলে, শঙ্খ-চক্র গদা যাঁর হাতে, পায়ের পদ্ম হাতে ওঠে, বিষ্ণু দিলেন ভাঙনের গদা(ইন্দ্রপতন)

কৃষ্ণ প্রসঙ্গে:—
কারার কেশব, বংশীধারী, অনাগত বৃন্দাবনে মা যশোদা শাঁখ বাজায়, মিলনরাস, মৃত্যু বাসদেবের কোলে
(সান্ত্বনা)

কংসকারায় কংসহন্তা, যুগে যুগে আসে গীতা উদগাতা, যুগে যুগে হন শ্রীভগবান তাঁহারি রথ সারথি, বাজিছে বিষাণ পাঞ্চজন্য

(সব্যসাচী)
                 
        ~: ইসলামীয় পুরাণ :~ 

মোহম্মদ (মানুষ), ফেরেশতা (অবেলার ডাক,পাপ), হারুত-মারুত (পাপ),
জোহরা (পাপ), হাবিয়া দোজখ (বিদ্রোহী), জাহান্নামের আগুন (বিদ্রোহী), জিব্রাইলের আগুনের পাখা (বিদ্রোহী), ইস্রাফিলের শৃঙ্গার (বিদ্রোহী)

          ~:বাইবেলীয় পুরাণ:~

আদম, দাউস, মুসা, ইসা, ইব্রাহিম, যত নবী ছিলো মেষের রাখাল (মানুষ)
জনমিল মুসা,রাজভয়ে মাতা শিশুরে ভাসায় জলে (চিরঞ্জীব জগলুল)
যীশু, মেরী (বারাঙ্গনা)

           ~:গ্রীকীয় পুরাণ:~

আর্ফিয়াসের বাঁশরি (বিদ্রোহী)

        প্রাসঙ্গিক তালিকা থেকে নজরুলের মিথমনস্কতার কতগুলি লক্ষণ নজরে পড়ে৷
পুরাণ কাব্যের মধ্যে মহাভারতের কাহিনী তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা দিয়েছিল৷ উল্লেখযোগ্য বিষয় সীতা সম্পর্কে নজরুল প্রবল সংবেদনশীল হলেও, তাঁর কবিতায় ভারতীয় পুরাণের আর একটি সমান হয়তো বেশি,গুরুত্ব সম্পন্ন নারী চরিত্র দ্রৌপদীর একবারও উল্লেখ মেলেনা৷ যেখানে গান্ধারী, গঙ্গা, মন্দোদরী, অহল্যা, শকুন্তলা, অশোকবনের চেড়ীরা অবধি এক বা একাধিকবার উপস্থিত সেখানে দ্রৌপদীর মতো আকর্ষণীয় এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের অনুপস্থিতির কোন ব্যাখ্যা নেই৷ যেখানে কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধ কবির মনে প্রবল ভাবে অভিঘাত সৃষ্টিকরেছিলো, সে ক্ষেত্রে যুদ্ধের অন্যতম মূখ্যচরিত্র অনুপস্থিত৷ কবির ভাবনার গভীরতম স্তরে কৃষ্ণ-কংস-বৃত্তান্ত এবং মোজেস-ফারাও একই ভাবব্যঞ্জনায় প্রকাশ পেয়েছে৷ সত্য রক্ষার জন্য নিজের সন্তানকে হত্যা করেছিলেন কর্ণ এবং আব্রাহাম দুজনেই৷ বহু ক্ষেত্রেই নজরুল নিজেকে পুরাণের কোনো চরিত্রের সাথে তুলনা করেছেন৷ কখন তিনি দধীচি,কখন ভৃগু, কখন অগস্ত্য, আবার কখন অর্জুন৷ মনো বিজ্ঞানে যাকে ” Identification of the self with imaginary sequences” হিসাবে গণ্য করা হয়৷ তার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি নজরুল দেখিয়েছেন বিদ্রোহী কবিতায়৷ পুরাণ চরিত্রে, নিজেকে সেই চরিত্রে ভেবে নেওয়ার আড়ালে কবি এতটাই মগ্নছিলেন যে, নিজের মন সম্বন্ধে সচেতন না থাকার প্রবণতা অবশ্যই ছিলো৷ হয়ত,কবির পুরাণ ব্যবহারের সুবিশাল ফর্দ থেকেই তা পাওয়া যায়৷

       তাঁর পুরানকাব্য থেকে বোঝা যায় তিনি তাঁর মনের গভীরের অর্থাৎ অন্তর্কাঠামোর বাইরের দিকে পুরাণ রেখেছেন৷ সচরাচর ব্যপারটা ঠিক উল্টো হয়, পুরাণ থাকে ভাবনার ভেতরে ৷

তিনি মাইকেলর মত পুনরায় ব্যাখ্যা করেননি কিংবা রবীন্দ্রনাথের মত পুনরায় সৃষ্টি করেননি যেমন “মেঘনাদবধকাব্য” এবং “কর্ণ-কুন্তী” সংবাদ৷ ভৃগুপদ লাঞ্ছিত নারায়ণের যে বিবরণী বিষ্ণুপূরাণে আছে,সেখানে ভৃগুর দুঃসাহসকে ভক্তির অভিব্যক্তি হিসাবে প্রকাশ করা হয়েছে৷ নজরুল নিজের মনের গভীরতায় পূরাণের ভৃগুকে প্রকাশ করেছে বিদ্রোহী রূপে৷

পুরাণ মতে স্বর্ণলঙ্কাদহন,ধর্মের প্রতিষ্ঠাকল্পে৷ কিন্তু নজরুলের কবিতায় এই ছবি তে এসেছে দেশপ্রেমের সঙ্কেত৷ নজরুল নিজেকে দধীচি রূপে বারংবার যে কল্পনা করেছেন৷ এ যুগের দধীচি শুধু ভাঙনের বজ্রই জোগান না,সৃষ্টির গানও বাজে৷ কবির পূরাণের প্রতি উপলব্ধি র এটাই সম্ভবত চূড়ান্ত সীমা৷
নজরুল পুরাণবিদ নন কিম্বা পূরাণভিত্তিক সৃষ্টিও করেননি৷ কিন্তু পুরাণকথা—স্বদেশের, বিদেশের—তাঁকে প্রেরণা জুগিয়েছে অবিরাম৷

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>