Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,kali-kalam-mon-nabaneeta-dev-sen

স্মরণ : পথিকৃৎ নবনীতা

Reading Time: 3 minutes

সাহিত্যিক বাবা মায়ের ছোট্ট মেয়েটি ক্লাস ফোরে খুঁজে পেয়েছিলেন ভ্রমণ কাহিনীতে নবনীতা দেবসেন কে,তারপর কৈশোর যৌবন পেরিয়ে সেই ছোট্ট মেয়েটি আজ ডাক্তার এবং সাহিত্যিক। নিজের প্রথম পান্ডুলিপি নিয়ে ছোট্টবেলায় লেখার প্রেমে পড়া নবনীতার কাছে গিয়ে কেমন ব্যবহার পেয়েছিলেন কিংবা তারপরে বন্ধুর বাড়িতে বা আড্ডায় কেমন দেখেছিলেন নবনীতা দেবসেন কে তাই জানাচ্ছেন ইরাবতীর পাঠকদের- সোনালি


আনন্দমেলা পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকে আমি তার পাঠক। সে বছর আমি ক্লাস ফোর। শারদীয়ায় কালো সাদা ছবি দেওয়া ভ্রমন কাহিনী দেখে পাতা উল্টে গেলাম। পল্লবগ্রাহী মানুষ,  অত তথ্যসমৃদ্ধ জ্ঞান দেখলে গায়ে চাকা চাকা হয়ে আমবাত ফুটে ওঠে। প্রবন্ধ দেখলে কান্না পায়। মানে মা যতই বলেন কমিকস পড়বে না, ওতে মাথা হাল্কা হয়ে যায়, চিন্তার গভীরতা নষ্ট হয়, আমি ততই গল্প গিলি। কাজেই ভূগোল  ইতিহাস সমন্বিত মানে আজকের ভাষায় ডাটায় ভর্তি লেখাকে সন্তর্পণে এড়িয়ে চলি আর কি। কিন্তু একটা শারদীয় সংখ্যা, তাতে কয়টা আর পাতা?  পুজোর ছুটি কত লম্বা। কোন যুগে গল্প উপন্যাস, ধাঁধা শব্দজব্দ ও শেষ। ভাত খেতে বসে ভাবলাম দেখি উলটে,  এই পর্বত আরোহনকেই কামড়ে দেখা যাক। সেই শুরু। তাকে আর ছাড়া গেল না।  

দুই খুকির লম্বা বেনুনি দুলিয়ে  স্কি করার এবং শেষে ক্রাচ নিয়ে সগর্বে ঘুরে বেড়ানোর সে গল্প আজ উনচল্লিশ বছর পরেও প্রায় লাইন বাই লাইন মনে আছে। এই শব্দ চুম্বকের ম্যাজিশিয়ানের নাম নবনীতা। এত অনাবিল সরস লেখা কি অনায়াসে সদাহাস্যময়ী মানুষটি   লিখে ফেলতেন,  আজও মুগ্ধ হয়ে আছি। 

ভালো কিছু পড়লেই আমরা মানে বাবা মা আমি ভাগ করে নিতাম। তাই বিকেল বেলা অফিস ফেরত মা বাবাকে যেই বললাম, জানো কি মজার, কি ভাল ম্যাটারহর্ন,  মা বললেন, আরে হ্যাঁ,  ওনার বাবা মাও যে সোনার কলম। জানো কে তাঁরা? 

জানলাম, নবনীতার উত্তরাধিকার। জানলাম তিনি শ্রী নরেন দেব ও রাধারাণী দেবীর আদরের  একমাত্র খুকি। জানলাম তাঁর বাড়ির নাম ভালবাসা। বাংলা করা ওমর খৈয়ামের রুবায়েত বাড়িতে ছিল। ক্লাস সেভেন এইটের মধ্যে সেটি পড়ে অকালপক্ব আমি ডায়েরিতে টুকে রাখতাম তার থেকে।  বাবার ছিল বইখানা। তিনি জানতেন।

মুচকি হেসে বললেন ,  ওই যে বইখান, যার থেকে চুপিচুপি টোকো, ওইটে নবনীতার বাবামশাইয়েরি অনুবাদ।তো, সেই থেকে বন্ধুত্ব নবনীতার সাথে। আমি একটু সেকেলে হাবা প্যাটার্ন পাঠক। ঝড়জল অ্যাকশন ইত্যাদির থেকে নিরীহ মিষ্টি রূপকথা পড়তে ভালবাসি। এখনো। ক্রমশ নবনীতার লেখা আধুনিক রূপকথার গল্পদের পেতে থাকলাম পত্রিকার পাতায় পাতায়। শুরু হল। খুঁজে খুঁজে তাঁর বই কেনা।

পাশের ঘরে থাকতেন কবি অপরূপ উকিল আর তাঁর বাবা মা। তিনিও তখন ইস্কুলের খোকা,  আমি বুবুদা ডাকি তাঁকে। ওঁদের বাড়িতে মা গল্প করতে গেলে ওবাড়ির দেশ পত্রিকার পাতা ওল্টানোটা আমার কাজ ছিল।সেইখানে খুঁজে পেলাম ; নবনীতা। ভ্রমণের ধারাবাহিক। পাশ্চাত্যের কোন দেশ নিয়ে লেখা আজ মনে নেই।  দাগ কেটেছিল অন্য কিছু। সেই সংখ্যায় লেখিকা এক স্ট্রিপটিজ দেখার অভিজ্ঞতার কথা লিখেছিলেন। পাতা ওল্টাতে ভয় লাগছিল। এখুনি যদি বড়রা দেখে বলেন,  কি পড়ছ, এটা তোমার জন্য  নয়।

কৈশোরের অপরাধবোধ আর আতংকে গোগ্রাসে গিলছিলাম লেখাটা। স্ট্রিপটিজের বর্ণনা সেরে লেখিকা লিখে চলেছেন, তারপর তিনি গ্রীনরুমে কি ভাবে ঢুকে পড়লেন সে কথায়। তিনি সে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করতে গেছেন, কি ভাবে, কেন সে এত লোকের মাঝে রোজ বিবস্ত্র হয়।পুংখানুপুংখ বর্ণনা পেলাম সে কলমে ছবির মত,  কি ভয়ে নিজেকে চাদরে জড়িয়ে নিল সে বিব্রত  মেয়ে,  আর মুখের রং তুলতে তুলতে তার ক্লান্ত ফ্যাকাসে বিবরন,  কত কষ্ট করে অসুস্থ বাচ্চাকে বুঝিয়ে রেখে এসেছে একলা ঘরে। আজকের শোয়ের পয়সাটা  পেলে ক’টা কমলা লেবু কিনে নেবে,  বাচ্চাটা বড্ড আবদার করেছে।

নবনীতা বসে আছেন ছাতাপড়া সাজঘরে। এক হয়ে যাচ্ছে তাঁর মাতৃত্বের সংগে এক বিদেশিনী জনপদবধুর মাতৃত্ব। আর সেই মুহুর্তে এক কিশোরী নারীর দীক্ষা হল বিশ্বনারীত্বে। মায়েদের পৃথিবীব্যাপী লড়াইকে কুর্নিশ জানাতে শিখল সে। শিখল মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান করতে। কাজ দিয়ে কাউকে খাটো করা যায় না যে, সেটা মর্মে মর্মে বুঝে গেল সেই মেয়েটা। ইংরেজিতে যাকে ডিগনিটি অফ লেবার এবং ননজাজমেন্টাল হওয়া বলে, সেই কঠিন দর্শনকে এক লহমায় মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেবার নাম নবনীতা।  

অনেক বছর পরে,  নিজের ডাক্তারি পেশার গল্প নিয়ে লেখা বই,  স্টেথোস্কোপের পান্ডুলিপি,  হাতে নিয়ে বাড়িতে গেলাম যখন, বললেন, বটে,  পড়ব,  কিন্তু পড়া ধরবে না তো?

অনবদ্য বাচনভংগিমা।

হেসে না ফেলে উপায় নেই।

বড় হবার সাথে সাথে নবনীতার নানা দিক উন্মোচিত হয়েছিল। তিনি মানুষের মনুষ্যত্ব নিয়ে ভাবিয়ে ছিলেন।  মেয়েদের অধিকার নিয়ে ভাবিয়ে ছিলেন। প্রেম অপ্রেম,  আবার প্রেমের কতখানি সত্যি  ভালবাসা আর কতখানি শুধুই অধিকারবোধ সে প্রশ্নের সামনেও দাঁড়াতে বাধ্য করেছেন।

তাঁর শব্দদের সংগে নিয়েই নিজের দাম্পত্য, মাতৃত্ব,  পেশাগত ক্ষেত্রে মেয়েদের নানান পরিস্থিতির মোকাবিলায় ব্যস্ত থেকেছি । প্রিয় সাহিত্যিক বান্ধবী শ্রীমতী ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের পারিবারিক উৎসবে গিয়ে আল্লাদে আটখানা হলাম। খাবার ছোট্ট টেবিলের আড্ডায় পাশের আসনেই ভালবাসার কলম বসে আছেন,  নবনীতা।

একটু প্রনাম ইত্যাদি করতেই হই হই, আরে আড্ডা হোক। এসব কেন ?সে যে কি কল কল করা কিশোরীর উচ্ছ্বাস! শাড়ি,  সাজগোজ, খাওয়া দাওয়া,  আর মজা , আর মজা। এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, আর লিখছি কি না?  কি লিখছি? কিন্তু তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ,  পেশাগত ক্ষেত্রে কেমন কাজ করছি?    

বললাম ,  সেই যে, ছোটবেলায় আপনার সেই লেখায় সেই স্ট্রিপ টিজারের গল্প পড়েছিলাম,  বড় বেশি দাগ কেটেছিল ভিতরে । মানুষকে নাড়িচাড়ি যখন চেষ্টা করি ননজাজমেন্টাল হবার।

সব হাসি থামিয়ে,  একেবারে গভীরে ডুব দিয়ে বললেন,  সেইটাই সবার চেয়ে কঠিন,  কিন্তু সেই চেষ্টাটাই সকলের প্রতি মুহুর্তে করা উচিৎ। সোনালি,  এইটা কখনো ভুলো না।

নির্ভীক মানুষটি শেষ লেখায় মৃত্যুকে হেলায় উপহাস করে চলে গেছেন।  আমার কাছে সেই গভীর  মুহূর্তটির দাম কোহিনূর হীরের চেয়েও বেশি। প্রতিদিন এইটেই মনে রাখার চেষ্টায় থাকি। 

জীবনের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে  মনে রাখতে হবে,  মনুষ্যত্বকে সম্মান দাও। নিজেকে সম্মান দাও। মৃত্যুকেও ভয় পেও না।     

 

 

 

                                                            

                                                                                                                 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>