| 28 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

খুকুর গল্প

আনুমানিক পঠনকাল: 4 মিনিট

১৯৩৮ সালের ৭২ নং হিন্দুস্তান পার্কের ‘ভালো-বাসা’ তে জন্ম হয় ‘খুকু’র। বাবা ছিলেন বিখ্যাত সাহিত্যিক নরেন্দ্র দেব। আর মাতা ছিলেন সেই সময়ের নারী সাহিত্যিক হিসেবে রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলা রাধারাণী দেবী; যার ছদ্মনাম ছিল অপরাজিতা দেবী। এই দুই সাহিত্যিকের ছোট্ট খুকুর নাম ঠিক করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নবনীতা নামে।

অপরদিকে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুশয্যায় শুয়েও স্নেহের রাধুর (রাধারাণী দেবী) সন্তানের নাম দিয়েছিলেন অনুরাধা। নামকরণের ঠিক তিনটে দিন পর ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেয়া নামটাই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় খুকু তথা নবনীতা দেব সেনের কাছে।

শান্তিনিকেতনের সঙ্গে নবনীতার নাড়ির টান বোধহয় তৈরি হয়েছিল জন্মের অব্যবহিত পরেই। রবীন্দ্রনাথ নাম রেখেছিলেন নবনীতা। বয়স তখন মাত্রই তিন মাস। কবি দম্পতি রাধারাণী এবং নরেন্দ্র দেবের কাছে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি আসে, তাতে লেখা— ‘যেহেতু তোমার উপহার প্রত্যাখ্যানের বয়স হয়নি তাই এই নামটি তুমি গ্রহণ কোরো…’। ভারী আশ্চর্যের বিষয় হল, যৌবনে যাঁর সঙ্গে বিবাহসূত্রে ‘ভালবাসা’র কন্যেটি হয়েছিলেন ‘প্রতীচী’র আহ্লাদী বধূ, তাঁর অমর্ত্য নামটিও বিশ্বকবিরই দেওয়া (অমর্ত্য সেনের সঙ্গে যখন সবেমাত্র বাগদান হয়েছে, তখন থেকেই ‘দাদু’ ক্ষিতিমোহন সেন নবনীতাকে ‘আদরের নাতবউ’ সম্বোধনে চিঠি লিখতেন)। এহেন মেয়ের প্রথম শান্তিনিকেতন দর্শন তিন বছর বয়েসে।

রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে অমিয় দেব সস্ত্রীক, সকন্যা বোলপুরে আসেন। দুপুরে আশ্রমের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং সেখানে উপস্থিত। পাতে সাদা ভাত পড়তেই একরত্তি মেয়ে ফুঁসে উঠল… ‘এ কেমন নেমন্তন্ন! পোলাও নেই কেন?’।
উপস্থিত সবাই বিব্রত। দেব দম্পতি লজ্জায় অধোমুখ। মুশকিল আসান হয়ে এগিয়ে এলেন প্রতিমা দেবীর ‘বাবা মশাই’।

পুত্রবধূকে চুপিচুপি পরামর্শ দিলেন কমলা লেবুর কোয়া ছাড়িয়ে ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে। সেই হলদে রঙা ভাত পোলাও ভেবে খেয়ে অবশেষে মেয়ের মন ভরল। এ ভাবেই শান্তিনিকেতনের সঙ্গে ‘দেবকন্যা’র মনবীণার তারটি বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তাঁর রক্তে। পেয়েছিলেন ‘মা’ রাধারানী দেবীর কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে।

১৯৫৯ সালে সাহিত্যে পদার্পণ ঘটে ‘প্রথম প্রত্যয়’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের মাধ্যমে। এরপর বছরের পর বছর ধরে, তিনি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন তার রচনার মাধ্যমে। প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, রম্যরচনা, আত্মজৈবনিক, ভ্রমণকাহিনী এবং নাটক মিলিয়ে প্রায় আশিখানেক গ্রন্থের রচয়িতা নবনীতা দেব সেন। সাহিত্যের এমন কোনো দিক ছিল না, যেখানে অবাধ বিচরণ ছিল না এই গুণী মানুষটির।

মা রাধারানী দেবীর প্রভাবে আদ্যন্ত গড়ে ওঠা নবনীতাও প্রথম থেকেই চ্যালেঞ্জ করেছিলেন স্টিরিওটাইপকে। ফেমিনিস্ট লেখক হয়েও নিজের লেখার গায়ে কোনও লেবেল সেঁটে দেওয়ায় ঘোর আপত্তি ছিল তাঁর। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি ফেমিনিস্ট লেখক, তবে আমার লেখার গায়ে কোনও বিশেষ লেবেল সেঁটে দেওয়া হোক, তা চাই না। অনেক পুরুষও নারীবাদী। কই, তাঁদের তো ফেমিনিস্ট বলে দাগিয়ে দেওয়া হয় না!“

পদ্মশ্রী ও সাহিত্য অ্যাকাডেমি জয়ী নবনীতার প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটেছে জীবনের একাধিক ক্ষেত্রে। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গবেষণা, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, অনুবাদসাহিত্য, শিশুসাহিত্যে এক উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল তাঁর। দীর্ঘসময় অধ্যাপনা করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়েও ভিজ়িটিং অধ্যাপক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন তিনি। ৮০টির বেশি বই লিখেছেন, তার মধ্যে অনেকগুলি অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। নিজেই সম্প্রতি একটি কলামে জানিয়েছিলেন, শিগগিরই পাঁচটি বই প্রকাশিত হতে চলেছে তাঁর। তার মধ্যে দুটি বাংলা বই প্রকাশিত হবে বইমেলায়, আর তিনটি বিদেশে। জানিয়েছিলেন, স্টকহোম থেকেও পাঁচটি উপন্যাস প্রকাশিত হবে অডিও বুক আকারে। নবনীতা অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন নিজের ২০ বছর ধরে ফেলে রাখা চন্দ্রাবতী রামায়ণের অনুবাদ প্রকাশ নিয়ে। নিজের কলামে লিখেওছিলেন সে কথা। কিন্তু বইটি নিজের চোখে দেখে যাওয়া হয়ে উঠল না তাঁর।

প্রথাগত ‘‘নারীবাদী লেখক“ তকমার বিরোধী হলেও মেয়েদের কথা বারবার উঠে এসেছে নবনীতার লেখনীতে। মেয়েদের চোখে রামায়ণের বিশ্লেষণ তাঁকে আকৃষ্ট করেছে দীর্ঘদিন ধরে। নবনীতা বাংলা (পূর্ববঙ্গ), মৈথিলী, মারাঠি আর তেলুগু ভাষায় বেশ কিছু গান সংগ্রহ করেছিলেন যা ‘সীতার গান’ নামে পরিচিত ছিল। গ্রাম-গ্রামান্তরে মেয়েরা সে সব গান গেয়ে আসছেন বহু যুগ ধরে। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ আর দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতের নানা প্রত্যন্ত প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা এ সব গানে রামের প্রতি রাশি রাশি বিদ্বেষ আর অভিযোগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ফেমিনা-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নবনীতা বলছিলেন, ‘‘মেয়েরা এ সব গানে নিজেদের মতো করে মহাকাব্যকে ব্যাখ্যা করেছেন এবং রামের কাজকর্মের প্রতিবাদে সকলেই সমান তীব্রতায় গর্জে উঠেছেন।“ এই বক্তৃতাগুলি একত্রে সংকলিত হয়ে বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। রামায়ণের মতো মহাকাব্যকে প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরা কী চোখে দেখেন, তার উজ্জ্বলতম প্রকাশ এই বইটি।

নবনীতা মনে করতেন মেয়েদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সেই অধিকারকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে তাঁদের প্রয়োজনীয় সাহায্য জোগানোটাই ফেমিনিজ়মের নির্যাস। সারা জীবন অসংখ্য বিষয়ে কলম ধরেছেন, তার মধ্যে সামাজিক সমস্যা, দেশভাগের যন্ত্রণা যেমন আছে, তেমনই আছে সমকাম, এইডস বা বার্ধক্যের মতো বিষয়। তাঁর একাধিক রূপকথার গল্পের কেন্দ্রেও রাজপুত্র নয়, থেকে গেছেন রাজকন্যারাই!

নবনীতার নারীবাদ কখনওই উচ্চকণ্ঠ ছিল না। ছোটখাটো অভিজ্ঞতার মাধুর্য বেয়ে তা পাঠকের কাছে পৌঁছে যেত। এই সরসতার আড়ালে ছিল হাসিমুখ এক তেজস্বিতা। অক্সফোর্ডে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর বাড়িতে গিয়েছেন নবনীতা। ‘কোথায় পড়াও’ প্রশ্নের উত্তরে নবনীতার জবাব, যাদবপুর। নীরদবাবু তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললেন, ‘‘ওটা একটা ধাপ্পা। কী পড়াও?’’ নবনীতার উত্তর, ‘‘তুলনামূলক সাহিত্য।’’ নীরদবাবুর ফের মন্তব্য, ‘‘ওটা আর একটা ধাপ্পা।’’ নবনীতা শান্ত স্বরে বললেন, ‘‘আমি ওটা পড়াই তো! ফলে জানি, ওটা ধাপ্পা নয়।’’

এই আলোচনায় সারাক্ষণ উপস্থিত ছিলেন অক্সফোর্ডবাসী ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরী। নবনীতা উঠে আসার পরে নীরদবাবুর জিজ্ঞাসা, ‘‘মেয়েটা খুব দজ্জাল, না?’’ তপনবাবু হেসে বলেছিলেন, ‘‘বিলক্ষণ! সে আর বলতে!’’ নীরদবাবু, তপনবাবু কেউই আজ আর নেই। বাঙালিকে সরস বৈদগ্ধ্যে হাসিয়ে সেই ‘দজ্জাল’ মেয়েটিও চলে গেল।

প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় অমর্ত্য সেনের সঙ্গে নবনীতার প্রেম নিবিড় হয়ে ওঠে সেখানে মেয়ের প্রতি মায়ের নির্দেশ ছিল: ‘তিনটি জায়গায় যাওয়া যাবে না। পর্দা টাঙানো কেবিনওয়ালা রেস্তরাঁয়, সন্ধ্যার পরে লেকের ধারে আর সিনেমায়।’

সেই প্রেম বিবাহে গড়ায় ১৯৫৯-এ এবং সতেরো বছরে ১৯৭৬-এ বিবাহবিচ্ছেদও ঘটে। অথচ সেই আঘাত নবনীতাকে নারীবাদী বিদ্রোহে সক্রিয় করেনি। বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ অটুট ছিল আজীবন। ১৯৯৮-এ অমর্ত্য সেনের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তিতে নবনীতার আনন্দোচ্ছ্বাসে অভাব ছিল না। অমর্ত্য সেনকে নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। আবার সে-সময়ের প্রেক্ষিতে একটি স্মরণীয় ছোটগল্পও লেখেন ‘জরা হটকে, জরা বাঁচকে, ইয়ে হ্যায় নোবেল মেরি জান’। অন্য দিকে, সেই সময়ে তাঁর সমসাময়িক বলিষ্ঠ নারীকণ্ঠ কবিতা সিংহের মৃত্যুতেও শোকপ্রকাশে এগিয়ে গিয়েছেন। সর্বত্র তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ, স্বাধীনচেতা মনের প্রকাশ, বিদ্রোহহীন বিপ্লবের প্রয়াস আজীবন সচল ছিল।

দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা এই সব্যসাচী সাহিত্যিকের বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। শরীরে ক্যান্সার থাকা সত্ত্বেও মাথা নোয়াবার পাত্রী ছিলেন না নবনীতা দেব সেন। দীর্ঘ একটা সময় ধরে এই ক্যান্সারটাকে ভুলিয়ে রেখেছিলেন নিজের হাস্যোজ্জ্বল চেহারার গহীনে। এমনকি মৃত্যুর কিছুদিন আগেও কলকাতার এক সংবাদপত্রে লিখেছিলেন, কীভাবে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে ছিলেন।

নবনীতা দেব সেনের দুই কন্যাসন্তান- অন্তরা দেব সেন এবং নন্দনা দেব সেন। সদ্য নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জী মাত্র একদিনের জন্য কলকাতা সফরে এসেও সময় নিয়ে দেখা করেছেন নবনীতা দেব সেনের সাথে। আর ঘরে ঢোকা মাত্রই অভিজিতের মাসী খ্যাত নবনীতা দেব সেন বলেছিলেন,

কি যেন একটা প্রাইজ পেলিরে তুই?

সাহিত্য থেকে শুরু করে সমস্ত ক্ষেত্রেই তার প্রভাব ছিল লক্ষনীয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, যশোধরা বাগচী, সুবীর রায় চৌধুরী, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত সহ প্রখ্যাত সব সাহিত্যিক ছিলেন নবনীতা দেব সেনের বন্ধু-বান্ধব।

সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র নবনীতা দেব সেন। তিনি অপরাজিতা। তাঁর জীবনবোধের জ্যোৎস্নায় স্নিগ্ধ হয় এ বিশ্ব চরাচর। আর তাঁর ভুবন ভোলানো মায়ার টানে ভুলেছি সক্কলেই।

নবনীতা দেব সেনের একজন সাহিত্যিক হিসেবে জীবনের সবচাইতে বড় অর্জন এটাই যে, তার কলমের কালি কখনো ফুরোয়নি তবে ফুরিয়ে গেল তার জীবনের মেয়াদ। ৮১ বছর বয়সে নিজের জন্মস্থান কলকাতার ৭২ নং হিন্দুস্তান পার্কের সেই ‘ভালো-বাসা’ বাড়িটিতেই নিজের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহীয়সী সাহিত্যিক।

ফারাক করতে দেননি নবনীতা নিজেই, নিরন্তর বাঙালির হাতখরচ জুগিয়েছেন সেই অবিকল্প আনন্দের পুঁটুলিটি থেকে। ব্যক্তিজীবনের প্রবল বিপর্যয়ের মধ্যেও অসুস্থ মা’র আদেশ হুকুমের প্রতি সজাগ তটস্থ থেকে, তা নিয়ে মজা করে, হিন্দুস্থান পার্কের বাড়িটির দরজা অকৃপণ স্নেহদাক্ষিণ্যে ছাত্র, আত্মীয়, প্রার্থী, আশ্রিত সবার জন্য সবসময় খোলা রেখে, নিজের অসুস্থতার মধ্যেও অবিশ্রান্ত লেখালিখিতে ঝরে পড়া সেই আনন্দঝর্ণার স্রোতধ্বনিটি তিনি বজায় রেখেছেন অবিরল। উত্তরকালের বাঙালি যদি আজ তাঁকে দেখে বিস্মিত না হয়, তা বাঙালিরই জাতিগত অক্ষমতা।

এখানেই জিত নবনীতার। মৃত্যু ছুঁয়ে ফেলেছে তাঁর নশ্বর দেহকে। কিন্তু অমর হয়ে রয়েছে নবনীতার সৃজনশীলতা, প্রাণশক্তিতে ভরপুর তাঁর মেধা ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর প্রতিটি লেখার প্রতিটি অক্ষরে।

নবনীতা দেব সেন থাকছেন।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত