| 28 নভেম্বর 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

ন হন্যতে (পর্ব-৬)

আনুমানিক পঠনকাল: 20 মিনিট

সকাল হচ্ছে, রাত্রি আসছে, কী অমোঘ নিয়মে চাকা ঘুরছে। সেই ঘূর্ণমান চক্র আমাদের ভিতরে সুখ দুঃখ, শোক আনন্দকে পরিস্তুত করে এক ভাবকে অন্য ভাবে পরিণত করছে। মা বলেন, শোকের দাহ থাকে প্রথম তিন দিন, তখন আগুনে পোড়ায়, তারপর আস্তে আস্তে কমে আসে। মাতা পুত্রশোক ভোলে—বিধবা উঠে দাঁড়ায়। ক্ষয় হচ্ছে প্রতিদিন আবার ক্ষতিপূরণও হচ্ছে। সবাই জানে একথা, কানে শুনে কিংবা বইয়ে পড়ে—সে জানা জানাই নয়, এই দুঃখদহন আমাকে শেখাচ্ছে কি করে সত্যকে জানতে হয়। আমি ভেবেছিলাম চুল কেটে ফেলব—পারি নি—এখন আর ইচ্ছেও নেই। আমার অন্য মন বলছে চুল কেটে কি হবে, বিশ্রী দেখাবে। এটাই তো জীবনলিপ্সা। আমি তা জানি।

মা আমার কাছে বসে নানা গল্প করছেন—কাকা কি রকম খারাপ ব্যবহার শুরু করেছে, ওরা অন্য বাড়িতে চলে যাবে। বৌটি সুবিধের নয়। বাপের বাড়ি গিয়ে বাবার নামে মার নামে লাগাচ্ছে। আমার নামেও। আমি কিছু শুনছি নাবালিশে মুখ গুঁজে আছি। এসব কথা শুনে কি হবে? এরা যা খুশি করুক। এ সংসার আমার কাছে নিতান্ত পর হয়ে গেছে।

মা আঙ্গুল চালিয়ে চালিয়ে আমার চুলের জট ছাড়িয়ে দিয়েছেন, চুলে বিনুনী করে দিয়েছেন, মা আস্তে আস্তে বলছেন, “রু দুঃখ পাওয়াটারও দাম আছে—সব জ্ঞানীগুণীরাই তাই বলে গেছেন, তুমি ভগবানকে ডাক, তিনিই তোমার মন ঠিক করে দেবেন। শান্ত করে দেবেন। দুঃখ পেলেই তবে মানুষ তার শরণাগত হয়, অমনি তো হয় না—বাণ খেয়ে যে পড়ে সে যে ধরে তোমার চরণকে।”

মা ঘরের আলো নিবিয়ে দিয়ে চলে গেলেন—গানের কলিগুলি ঘুরে ফিরে মনের মধ্যে আসছে কিন্তু আমার আচ্ছন্ন আবিষ্ট মনে তার অর্থবোধ হচ্ছে না। আরামে যার আঘাত ঢাকা, কলঙ্ক যার সুগন্ধ’, ‘কলঙ্ক যার সুগন্ধ আমার কলঙ্ক হয়েছে? নিশ্চয়। পাশের বাড়ির বৈদ্যনাথবাবু বলেছেন, “এই সব বড় ঘরের কীর্তি! বাড়ির মধ্যে একটা খেস্টান ঘোড়াকে রেখে ঢলাঢলি ব্যাপার।” বাবা ভীষণ রেগে গেছেন, এ বাড়ি আমরা ছেড়ে দেব। এ অসভ্য পাড়ায় আর থেকে দরকার নেই। সবাই নিন্দা করছে…আমার আচ্ছন্ন মন অদ্ভুত তন্দ্রায় জড়িয়ে আসছে—‘কলঙ্ক যার সুগন্ধ’,… ‘ধরে তোমার চরণকে’…‘দেহি পদপল্লবম্’…‘দেহি মুখকমলমধুপানম্’…ধরে তোমার চরণকে…ধরে তোমার চরণকে—গানের কলিগুলি পিনাকীর হাতের পিনাক হয়ে গেছে, সোজা এসে আমার মাথার মধ্যে লাগছে তার টঙ্কার–ঝনননন, ঝনননন, তোমার চরণকে…আমি বিছানায় গড়াগড়ি দিচ্ছি, হঠাৎ আমি খাট থেকে পড়ে গেলাম।

সেদিন যখন আমার জ্ঞান ফিরে এল ঘরের মধ্যে সবাইকে দেখলাম, বাবাকেও। মির্চা চলে যাবার পর এই আমার বাবার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা। বাবা মাকে বলছেন— “দুধের সঙ্গে একটু ব্রাণ্ডি খাইয়ে দাও।”

“কালকে শ্যামাদাস কবিরাজকে ডাক–”

কাকা কতকগুলো কড়া কড়া কথা বলে ঘর থেকে চলে গেল। এই প্রথম আমি তাঁকে বাবার সামনে, উদ্ধত হতে দেখলাম। আমার কাকার উপর রাগ হচ্ছে। আস্পর্ধা দেখ, বাবাকে ওরকম বলবে-বাবা ওকে মানুষ করেছেন না! আমি নির্বাক তাকিয়ে আছি ঘরে দুটো আলো জ্বলছে কিন্তু মানুষগুলো যেন অন্ধকারে ছায়ামূর্তি—এমন কি বাবাওবাবার ছায়াটা আমার বইয়ের তাকের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা খুঁজে খুঁজে বই বার করছেন। প্রথম বইটা একটা জাপানী রূপকথার বই, উজ্জ্বল নীল কাপড়ে বাঁধান তার উপর সোনালী রঙের ছাপ দেওয়া একটা অদ্ভুত জানোয়ারের ছবি। বাবা আস্তে আস্তে পাতা খুলে উপহারের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেললেন। ঐ বই ও আমাকে দিয়েছিল। তারপর ‘হাঙ্গার’ বইটার থেকেও ছিড়লেন। একটা একটা করে বই বের করছেন আর উপহারের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে ফেলছেন–গ্যেটের জীবনীখানা বের করে উপহারের লেখাটা খুঁজে পেলেন না—ওটা প্রথম পাতাতেই ছিল, মলাটের সঙ্গে লেগে রইল। ঐটুকুই ওর হাতের লেখা এবং একমাত্র চিহ্ন সারাজীবন আমার সঙ্গে আছে আর কিছু নয়-একখানা ছবি পর্যন্ত নয়!

বাবা আস্তে আস্তে কাগজগুলো কুচি কুচি করে জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দিলেন—অন্য বাড়ি হলে হয়ত বইগুলোই নষ্ট করা হত। এ বাড়িতে তা হতে পারে না—এ বাড়িতেও চেঙ্গিস আছেন কিন্তু তিনি বই নষ্ট করতে পারেন না—মানুষ পোড়াতে পারেন কিন্তু বই নয়–বই তাঁর ঈশ্বর।

মধুপুরে বাবার বন্ধু সপরিবারে যাচ্ছেন পূজার ছুটিতে—আমাদেরও হাওয়া বদলান দরকার বাবা বলছেন নূতন জায়গায় গেলে শরীর মন ভালো হবে।

মন কিন্তু আমার ক্রমে খারাপ হচ্ছে—অন্য সব কারণ ছাপিয়ে একটা কথা তীক্ষ ছুরির ধারের মত আমার বুকের ভিতরটা খুঁচিয়ে দগদগে করে ফেলেছে—একবার যদি ওকে জিজ্ঞাসা করতে পারতাম—চিঠির উত্তর দাও না কেন? কিন্তু কি করে হবে? কে আমাকে রিপন স্ট্রীটে নিয়ে যাবে? আমি কলকাতার রাস্তা চিনি না যে তা নয়, কিন্তু একা বেরুনো তো অসম্ভব এবং বিপজ্জনক। একলা কলকাতার রাস্তায় আমি কখনো হাঁটি নি। ড্রাইভারটাকে পাঠান যায় কিন্তু ও লোকটাকে ভালো লাগছে না—ওর চোখ দুটো শাপদের মতো, ও আমাদের লক্ষ্য করে। ওকে তাই আমার ভয় করে।

খোকা তো আর আসেই না।

আমরা যেদিন মধুপুরে যাব সেদিন সে এল। আমাদের সঙ্গে স্টেশনে যাবে। জিনিসপত্র তুলতে সাহায্য করবে।

আমি ওকে একটু একা পেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—“খোকা তুমি আর আস না কেন ভাই? অন্তত তোমার সঙ্গে একটু ওর কথা তো বলতে পারি।”

খোকা নীরব। “কেন আস না, বল না?”

“আমি তোমার এত কষ্ট দেখতে পারি না রু, মানুষের তো সহ্যশক্তির একটা সীমা আছে।”

“কিন্তু তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে আমার কষ্ট তো কমে। ও কি করছে এখন?”

“ও তো এখানে নেই, হিমালয়ে চলে গেছে।”

“হিমালয়ে! দার্জিলিং বল?”

“না না হিমালয়ে, দার্জিলিং নয় ঋষিকেশ—ও সন্ন্যাসী হয়ে গেছে।”

“সন্ন্যাসী হয়েছে? সে আবার কি? সন্ন্যাসী হওয়া কাকে বলে? তাই জন্যই কি চিঠির উত্তর দিচ্ছে না?”

ট্রেনে উঠে আমি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছি। এই অদ্ভুত খবরটার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছি না। কোথায় আমায় চিঠি লিখবে—একটা পরামর্শ করবে—তা নয় হিমালয় চলে গেল। আমি কাঁদছি। বাবা মা দুজনেই বুঝতে পারছেন আমি কাঁদছি। নিজেরা আস্তে আস্তে কথা বলছেন—ভাইবোনদের খাওয়াচ্ছেন শোয়াচ্ছেন, অবশ্য এ সব কাজ মা একলাই করছেন বাবা তো একেবারে শিশু, জীবনে বোধহয় নিজে এক গ্লাস জলও গড়িয়ে খান নি। কাঁদতে কাঁদতে আস্তে আস্তে আমার চোখের জল শুকিয়ে গেছে—যন্ত্রণা কমে এসেছে—দুঃখদহনের একটা অলৌকিক তৃপ্তি আছে তা আমার মনকে ঘুম পাড়িয়ে ফেলছে—আমি সেই স্তিমিত জগতে হঠাৎ শুনতে পেলাম বাবা মাকে বলছেন, “ওর দিকের জানালাগুলো বন্ধ করে দাও, যদি লাফ দিয়ে পড়ে।” তখন জানালায় রেলিং থাকত না। আমি মনে মনে ভাবছি অমন কাজ কখনো করব না—জীবন সুন্দর ও দুঃখও সুন্দর—এই জীবন আলোর মত জ্বলবে—‘বিরহানলে জ্বালোরে তারে জ্বালো’—এইবার এই গানটার অর্থ বুঝতে পেরেছি।

মধুপুরের বাড়িটা সুন্দর, চারদিকে খোলা প্রকৃতি, এখানে এসে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। ওরও হয়ত হিমালয়ে গিয়ে ভালই লাগছে। প্রকৃতি আমাদের সেবা করে নিঃশব্দে—প্রকৃতি মার মতো। আমার সঙ্গে মাও আছেন। ওর কেউ নেই, ও একেবারে একা। একদিন পুকুরের ঘাটে বসে মা আমাকে আস্তে আস্তে বললেন—“মনটাকে ঠিক করে নাও রু——ওরসঙ্গে তোমার আর কোনো দিনও দেখা হবে না।”

“কেন মা, কেন মা?”

“তোমার নিষ্ঠুর বাবা ওকে দিয়ে ভীষণ করে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছেন যে তোমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবে না।”

আমি তো মিশনারীদের স্কুলে পড়েছি—’নান’-দের ‘ভাউ’ নেবার কথা শুনেছি, আমার তাই হাসি পেল—“ও প্রতিজ্ঞা রাখবে কেন? ও কি ‘নান’ নাকি?”

কিন্তু কোনোদিনও দেখা হবে না, কথাটা মনের ভিতর ঘুরতেই লাগল একটা দীর্ঘশ্বাসকে পাক দিয়ে দিয়ে—যার নাম হাহাকার।

আমরা মধুপুরে থাকতে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের গল্প খুব হত, সম্ভবত সেই সময়ে ঘটনাটা ঘটল, তাছাড়া যাদের বাড়িতে ছিলাম তাঁরা এবং আমরাও ঐ ঘটনার স্থানটির সঙ্গে এবং পাত্রদের সঙ্গে বিশেষ পরিচিত। যে পাহাড়তলীতে যুদ্ধটা হল সে আমাদের চেনা জায়গা—ঐ সব ছেলেরা আমাদের বয়সী। তাই তাদের এই অসম সাহসে আমরা গর্বিত। বাবা যখন বলতে লাগলেন এরকম পাগলামির কোনো অর্থ হয় না, তখন আমরা খুব তর্ক করলাম। এর ফলাফলে স্বাধীনতা কতটা এগুবে তা কে জানে কিন্তু ওরা নিজেরা তো এগোল, এত বড় একটা কাজ করাই কি কম কথা? আমি ভাবছি এরকম একটা বড় কাজের মধ্যে যদি আমি যেতে পারতাম তাহলে আমার দুঃখটা নিশ্চয় চলে যেত। কিন্তু আমার যে কোনো উপায় নেই নিজের কোনো পথ খুঁজে নেবার। ওরা দেশকে স্বাধীন করতে চায়, মানুষকে স্বাধীন করবে কে? আমাকে, আমার মাকে? পুকুরের ধারে বসে আমি ভাবতাম যদি কোনোদিন সুযোগ পাই এই সমাজের সব সঙ্কীর্ণ নিয়মগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। আমি না হয় ছোট, মার পরাধীনতাই আমার খারাপ লাগছে বেশি। নিজের মেয়ের সম্বন্ধে তার কোনো অধিকার নেই। আমি জানি মার কতটা খারাপ লেগেছে। মা এই প্রেমকে সম্মান করছেন কিন্তু তাঁর উপায় নেই।

আমি যখন উনিশ শ ত্রিশ সালের কথা ভাবি তখন জানি বলেই ঐ বিশেষ বছরটা চিহ্নিত করতে পারি, নৈলে আমার অনুভূতিতে সাল তারিখ নেই। দিন বছর মাস সব অর্থহীন, আকাশে যেমন দিকচিহ্ন নেই, সীমাবদ্ধ পৃথিবীকে দিয়েই দিকের অর্থ বুঝতে হয়, তেমনি মহাকালে প্রবিষ্ট যে সব অনুভূতি তারও সন তারিখ, সকাল সন্ধ্যা নেই। তার বিপুল ব্যাপ্তি নিয়ে সে তখন ক্ষণকালিক উপস্থিতিকে অতিক্রম করে যায়, তখন দূরেও যা কাছেও তা। চলাও যা, না চলাও তাই—তদূরে তদ্বন্তিকে তদেজতি তন্নৈজতি।

আমি তাই ঠিক বলতে পারব না সেটা কবে এবং কোনদিন, মধুপুরে যাবার আগে কি পরে—কারণ আমি যেন একটা পড়া বইয়ের পাতা উল্টাতে গিয়ে যে ঘটনাটা পাতার ডান দিকে দেখব ভেবেছিলাম সেটা বয়ে দেখেছি। এরকম তো হয়।

আমার ঘরে আমি শুয়ে আছি। মা বসে বসে গল্প করছেন, গল্পের বিষয়বস্তু বাবার অসুখ। বাবার অসুখটা যে কত সাংঘাতিক তাই বলে মা আমার মনটাকে তার প্রতি অনুকূল করতে চাইছেন। বাবার প্রতি আমার শ্রদ্ধা একটুও কমে নি, ভালোবাসা তো নয়ই। তবু বাবার অসুখ নিয়ে মা এত ব্যস্ত কিন্তু মার অসুখ হলে বাবাও গ্রাহ্য করেন না, মাও না, এটা কি রকম? কাজেই আমি মার কথায় সায় দিচ্ছি না। মা আমার বিমুখ মনের ভাব বুঝতে পেরে বিপন্ন বোধ করছেন, এমন সময় বাবার পায়ের শব্দ শোনা গেল, তিনি দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। বাবার চোখ খুব বড় বড়, খঙ্গনাসা, রং উজ্জ্বল তাম্রবর্ণ, রাগ হলে তা লাল হয়ে যায় আরো বেশি। এখন বাবার মুখ লাল।

“এই রকম করে পড়ে পড়ে কাঁদলেই চলবে? পরীক্ষা দেওয়া হবে না? ছুটকি পর্যন্ত পরীক্ষা দিচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার! এত শোকের হয়েছেটা কি!” বাবা খুব জোরে জোরে বকছেন রীতিমত চীৎকার করে।।

মা তাড়াতাড়ি উঠে গেলেন। দরজার কাছ থেকে বাবাকে সরিয়ে বন্ধ দরজার দিকে নিয়ে গেলেন। ও দরজাটাও বন্ধ নয়, একটু ফাক আছে—আমি সব শুনতে পাচ্ছি। কারণ আমি উৎকর্ণ। মা বলছেন, “সব কিছু নিয়ে কি জবরদস্তি করা যায়? নিষ্ঠুরতার একটা সীমা আছে?”

“তাই বলে এরকম করে আমাদের চোখের সামনে জীবনটা নষ্ট করবে। পরীক্ষা দেবে না?”

“পরীক্ষা দেওয়াটা যদি অত দরকার মনে কর তবে স্কুল ছাড়ালে কেন? এ বছরেই হয়ে যেত পরীক্ষা।”

“বাঃ স্কুলে পড়াশুনো হয় নাকি—স্কুল গেলে ও এত সাহিত্য পড়তে পারত? সমস্ত রবীন্দ্রকাব্য ওর মুখস্ত। এম. এ. ক্লাসের ছেলেরাও অত পড়ে নি—এত কবিতা লিখতে পারত? হোম ওয়ার্ক দ্যান মাস্টারনীরা, হোম ওয়ার্ক! লাল কালি দিয়ে ‘গুড্‌’ ‘ব্যাড্‌’ অশ্বডিম্ব!”

“তাহলে তো হয়েছেই। পড়াশুনো তো করেছে। পরীক্ষা না হয় পরেই দেবে।” “না না তা হয় না, পরীক্ষা দিতে হবে-বাঃ, আমার মেয়ে পাশ করবে না? কি যে সর্বনাশ হয়ে গেল, কিছু হবে না, এত করে আমি ওকে তৈরী করছিলাম। সব আমার নষ্ট হয়ে গেল, ও আর কবিতা লিখবে না, পড়াশুনো করবে না, আমার আশা ভরসা সম্পূর্ণ নিমূল, তাহলে দেখে শুনে একটা বিয়েই দিয়ে দাও”, বাবা হাহাকার করে উঠলেন।

মা যেন ছোট শিশুকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, “আমায় একটু সময় দাও লক্ষ্মীটি। একটু সময় লাগবে। তোমার সব যেমন ছিলে আমি তেমনি করে দেব।”

“তুমি তো ঠিক ভাবে চলছ না। তুমি ওর মনটাকে বিমুখ কর! মেয়েকে বল, ওরা ইয়োরোপের নাগরিক, ওরা মৃগয়াপটু।”

“তা আমি কিছুতেই পারব না। বেচারা পরের ছেলে সন্ন্যাসী হয়ে বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার জন্য কিছু করতে না পারি অপবাদ দিতে পারব না।”

“ওকে এ কথা বললে তার কি ক্ষতি হবে? সে তো টেরও পাবে না। তার সঙ্গে কি আমি খারাপ ব্যবহার করতে বলছি? যুদ্ধ জিততে হলে বুদ্ধির ব্যবহার কর, খালি ভাবালুতায় হবে—nothing is wrong in love and war”

“আমার সে মত নয়। মন্দ যা তা মন্দই, বিবেকের বিরুদ্ধে আমার বুদ্ধি বড় হবে না।”

মা বাবার সঙ্গে কঠিন তর্ক করছেন। মা সব সময় তা করেন। মার নিজস্ব মত আছে কিন্তু তা প্রয়োগ করতে পারেন না। স্নেহের কাছে পরাভূত হয়ে যান।

মা বাবার তর্ক শুনছি কিন্তু কি আশ্চর্য আমার যন্ত্রণাবিদ্ধ মন বাবার কথাই গ্রহণ করেছে। ‘মৃগয়া’ ঠিকই বটে! নৈলে চিঠির উত্তর দিল না কেন? আমাকে জানালো না কেন আমি কি করব। ও তো পুরুষ মানুষ। আমার চেয়ে বড়। ও যদি না বলেকে আমার পথ ঠিক করে দেবে? তার মানে ও চায় না আমাকে আর। খেলা শেষ হয়ে গেছে। মৃগয়া!

একদিন বাবা আমাদের শকুন্তলা পড়াচ্ছিলেন, আমরা মাটিতে মাদুরে বসে আছি মাঝখানে বাবা। আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি। বাবার মুখে সংস্কৃত পড়া যে শোনে নি সে জানবে না কি তার অপূর্ব সৌন্দর্য। সংস্কৃত ভাষা তার সমস্ত মাধুর্য, ঐশ্বর্য নিয়ে কাব্যের অর্থকে শব্দার্থের থেকে ছাড়িয়ে মনের পর্বে পর্বে ঝঙ্কার তুলছে। বাবা বলছেন,—“ন খলু ন খলু বাণঃ সন্নিপাতেহয়মস্মিন্ মৃদুনি মৃগশরীরে তুলারাশাবিবাগ্নিঃ–”

“মৃগয়াপটু নাগরিক দুষ্মন্ত এসেছেন বনে শিকার করতে। বনের মৃগয়া সরল অসহায়, মৃদু অর্থাৎ কোমল—দুষ্মন্ত রথের উপর থেকে উদ্যতধনু, এখনই তিনি বাণ ছুঁড়বেন। বনবাসীরা এই নিষ্ঠুরতা করতে নিষেধ করছেন—তারা দুই হাত তুলে বলছেন, মেরো না, মেরো না বাণ—তুলার রাশিতে আগুন দিও না!’ এই বাণ কার? মদনের! এই মৃগ কে? শকুন্তলা। কুসুমতুল্যকোমলা, বলেও মনোজ্ঞা পুষ্পভরণা শকুন্তলা, অনভিজ্ঞ, সরলা-নাগরিকদের আচার আচরণ তিনি কিছুই জানেন না। তিনিই মৃগ। দুষ্মন্ত একটু পরেই তাকে শরবিদ্ধ করবেন। পুষ্পরাশিতে আগুন দেবেন। এখানে তারই পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে, এটা suggestive, যে ঘটনা পরে ঘটবে তারই আভাস দেওয়া হল।”

আমি ভাবছি, ভাবছি, ভাবছি, বাবা ঠিকই বলেছেন ‘মৃগয়া কিন্তু আমি সরলা তো নই নিশ্চয়ই। অভিজ্ঞতাও তো অনেক হল। এ শর আমি তুলে ফেলবই ফেলব।

পরের দিন আমি মাকে বললাম, “মা তুমি বাবাকে বল আমি পরীক্ষা দেব, এখনও তো তিন মাস আছে। সিলেবাস এনে দিন, যথেষ্ট সময় আছে।”

“যথেষ্ট বৈকি। ইচ্ছা হলে তোমার আর কতক্ষণ লাগবে।”

মার খুব আনন্দ হয়েছে—আমাকে খোশামোদ করছেন, “তোমার বাবা বলেন–কত সাধ করে নাম রেখেছি, ও জ্ঞানের অমৃত পান করবে, ব্রহ্মবাদিনী হবে। তোমার বাবার আশাটা পূর্ণ কর মা। সামান্য কারণে জীবনটা তছনছ করে ফেল না।”

প্রথম যেদিন বাবার কাছে পড়তে বসলাম সে দিনের অভিজ্ঞতা দুঃখজনক তো বটেই, আজকালকার দিনে অবিশ্বাস্য। বাবা আমাকে বলছেন, ‘অভূততভাবে ছির” কতকগুলি দৃষ্টান্ত লেখ। আমি মন দিতেই পারছি না। বাবা ঘোরাফেরা করে এসে বসলেন। আমি শূন্য খাতা হাতে নিয়ে শূন্যদৃষ্টিতে বসে আছি—যাকে ব্ৰহ্মর জ্বলে যাওয়া বলে বাবার হয়েছে তাই, এতটুকু একটা মেয়েকে বশে আনতে পারছেন না?

“কি হয়েছে কি? সব কি গুলে খেয়েছ? লিখছ না কেন? লেখা লেখ।” আমার হাত আরো অনড় হয়ে গেছে, কিছু তো মনে পড়ছেই না। হঠাৎ বাবা আমার গালের উপর প্রকাণ্ড এক চড় মারলেন। পঁচ আঙ্গুলের দাগ বসে গেল কিন্তু কি আশ্চর্য আমার ব্যথা লাগল না। মা ছুটে এলেন, “কি, ব্যাপার কি? এত বড় মেয়েকে তুমি মারলে?”

বই ফেলে বাবা উঠে পড়েছেন, “অসহ্য, অসহায় ওর এই গোয়ার্তুমি, ইচ্ছে করে পড়বে না।”

মা চুপ করে রইলেন। সেদিন বাবার উপর নয়, মার উপরই আমার অভিমান হয়েছিল। কারণ, বাবা যা ঠিক মনে করেছেন তাই করেছেন। মা যা ঠিক মনে করেছেন তা তো করতে পারছেন না। মা জবরদস্তির কাছে মাথা নিচু করেন, এ ভুলের খেসারত তাকে দিতে হয়েছিল। বাইরে বেরিয়ে অর্থাৎ বসবার ঘরে যেখানে আমি পড়তে বসেছিলাম সেখান থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে দেখি শান্তি দাঁড়িয়ে আছে। সে আমার দিকে জল ভরা চোখে চাইল—“দেখ রু আমি আর এ বাড়িতে থাকব না।”

আমি ভাবছি আমাকে তো থাকতেই হবে কারণ সে তো আর আমার খোঁজই করল। আমি আর যাব কোথায়?

মধুপুরে গিয়ে কারুরই শরীর ভালো হল না। সেখানে পুকুরের জলে স্নান করে প্রত্যেকেই এক একরকম ব্যাধি সংগ্রহ করল, ভাইটির বয়স চার, তার সাংঘাতিক টাইফয়েড। সাবির যৌবনে প্রবেশের অসুখ, সেই সময়ে ও মানসিক আঘাত পেয়েছে আমার জন্য। তারপর আমি তো মাকে হয়রাণ করে ফেলেছি। মার কষ্টের চুড়ান্ত হচ্ছে—এর মধ্যে বাবা বললেন তার সব রকম পরীক্ষা করান দরকার সেজন্য হাসপাতালে কেবিন নিয়ে থাকবেন। মেডিকেল কলেজে কেবিন নেওয়া হল—বিরাট ঘর, তখনকার হাসপাতাল কি পরিচ্ছন্নই না ছিল, পাথরের মেঝে, ধপধপ করছে বিছানা, আসবাব চমৎকার। বাবার সব রকম পরীক্ষা হচ্ছে, শরীরে তো কষ্ট নেই, রাশি রাশি বই আসছে—পড়া হচ্ছে—সন্ধ্যেবেলা অগুনতি ভক্ত শিষ্য সমাবেশ—আড্ডা, গল্প, আলোচনা। খাবার হাসপাতালে যা দেয় ও বাড়ি থেকে যা নেওয়া হয় তা প্রচুর, অতিথিদের খাওয়ান চলে। কেবিনে আত্মীয়স্বজনকে থাকতে দেয়, মা তো আসতে পারেন না, আমি সারাদিন থাকি। মা এক টাইফয়েডের রুগী নিয়ে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন—তখনকার দিনে টাইফয়েড বড় ভয়ঙ্কর অসুখ ছিল। মাকে সাহায্য করবার কেই নেই শান্তি ছাড়া। আমি তো বাবার কাছে সারাদিন তার পরিচর্যা করছি।

একদিন হাসপাতালে বাবা আমাকে আস্তে আস্তে বললেন, “রু তুই আর কবিতা লিখবি না?” আমি চুপ করে রইলাম। আসলে আমি তখন কবিতা লিখছিলাম কিন্তু যা লিখতে চাই তা এত স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে তাতে কোনো আড়াল থাকে না। অমন লেখা কি কাউকে দেখান যায়? সবাই যে মনের ভিতরটা দেখে ফেলবে। প্রায় একটা বই লেখা হয়েছিল—আমি শুনেছি ব্যক্তিগত জিনিসকে নৈর্ব্যক্তিক করে ভোলাই সাহিত্যের কাজ। আমার যা, তা সকলের হল, কিন্তু তা হচ্ছিল নাবড় নির্লজ্জ রকম আমার কথা হয়ে যাচ্ছিল। ঐ সময়কার একটা কবিতা আমার মনে আছে, আমি শেক্সপীয়রকে জিজ্ঞাসা করছিলাম—“তখন তুমি কোথায় ছিলে শেক্সপীয়র যখন আমি বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম? ওটা জানালা নয়, বারান্দা, তাতে তফাৎ কি? সে বাড়ি সামান্য একটা দোতলা ভাড়াটে বাড়ি, ধনীগৃহের অলিন্দ নয়, আর সে নিচে ছিল, রাস্তার উপরে, বাগানে নয়, সেখানে কোনো প্রাচীর ছিল না, কিন্তু একটা মাধবীলতা তো ছিল, বাগানে না হয় নাই হল। পাশে রাস্তা ছিল, কলকাতায় ঐ মলিন রাস্তায় ফুল ফোটে নি, তা নাই বা ফুটল—তাতেই কি ঘটনাটা তুচ্ছ হয়ে গেল? মহাকবি! আমি তো আশা করেছিলাম যে মুহূর্তে সে বিদায় নিচ্ছিল তুমি তাকে দেখেছ—তুমি আমার পিছনে ছিলে মণ্ডলীকৃত—প্রতিমার পিছনে যেমন চালচিত্র থাকে—আমি তো ভেবেছি আমার ঐ আহত প্রেমকে তুমি আবার প্রাণ দেবে! স্বর্ণমূর্তি কি জুলিয়েটকে অমর করতে পারে? আমি তাকে অমর করেছি বলে তুমি আমার ভক্ত হবে—আমার বন্দনা কর মহাকবি—আমার ঘরে এস—”

এ সব কবিতার চার-পাঁচ বছর পরে আমি ব্যুৎসব করেছি, কিন্তু আমি এখন জানি বাবাকে যদি তখনও দেখাতাম তিনি রাগ করতেন না, যে বস্তু লেখা হয়েছে তা যদি ভালো হয়ে থাকে তাহলে তা ঈশ্বর হয়ে গেছে—তখন কে লিখল, কেন লিখল তা নিয়ে তিনি মাথা ঘামাবেন না। আমার প্রেমে পড়ায় তার আপত্তি ছিল কিন্তু প্রেমের কবিতা লেখায় নয়! তখন বলবেন—“নানা অভিজ্ঞতা হওয়া ভালো। এ তো সব অবিদ্যা, মায়া, এই অবিদ্যার জগতের ভিতর দিয়েই তো জ্ঞানের জগতে পৌঁছতে হবে—অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীৰ্বা, বিদ্যয়াহমৃতণুতে”—জ্ঞানের অমৃত পানে বাবা সতত উন্মুখ—অবিদ্যার—জগতে সুখ-দুঃখকাতর যে মানুষ বাস করে তাদের জন্য তিনি তত ভাবিত নন—সবার উপরে মানুষ সত্য, এ তার জীবনের বাণী নয়।”

হাসপাতালে রুগী পরিচর্যা করতে যেতাম, করতামও। সারাদিন বাবাকে পড়ে শোনান, বিকালে যে সব অতিথি অভ্যাগত আসবে স্টোভে তাদের জন্য খাবার তৈরী করে রাখা ইত্যাদি কাজ করতাম। বাইরে থেকে এখন আমি স্বাভাবিক কিন্তু ভিতরটা কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না—সন্ন্যাসী হয়ে বনে বাদাড়ে বেড়াবার কথা ভাবলেই আমার বুক ভেঙে কান্না আসে—অনুশোচনায় জ্বলতে থাকি। আমার মনে হয় সাপে কামড়ে দেয় যদি তাহলে ওকে আমিই খুন করলাম। ও কি করে জঙ্গলে রয়েছে, ও তো সাহেব। ওদের কত ভালোভাবে থাকা অভ্যাস। বাবা সব সময় আমায় বলতেন, “একদিন অন্তর খাবার টেবিলের চাদর বদলে দিও রু যেন ঝোলের দাগটা না থাকে, ওরা ইয়োরোপে কত পরিচ্ছন্ন থাকে জানো?” এ সব কথা যখন মনে পড়ত তখন বাইরেটা স্বাভাবিক রাখতে হত বলেই ভিতরটা রক্তাক্ত হয়ে যেত। বাবার সামনে দুর্বলতা প্রকাশ করতে আমার লজ্জা বোধ হত। আত্মসম্মানে লাগত। তাই আমি খুব হাসিখুশি থাকতে চেষ্টা করতাম, তা সত্ত্বেও একদিন হাসপাতালেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। ঠিক অব্যবহিত কারণটা কি ছিল মনে পড়ছে না, হয়ত ছিলই না কিছু। ডাক্তার বললেন, নার্ভাস ব্রেকডাউন হবার উপক্রম হয়েছে। মা তো ভেবেই অস্থির। বাবা বলতে লাগলেন, একটু মনের জোর করলেই ঠিক হয়ে যায়, তা করবে না তো কি হবে! ইচ্ছে করে এরকম করছে—আমায় জব্দ করবে। ডাক্তার যদি অন্য কেউ হতেন তবে বাবা তাকে ডাক্তারী বিষয়েই প্রশ্ন-প্রতিপ্রশ্ন করে ডাক্তারী শাস্ত্রে তার অজ্ঞতা প্রমাণ করে তার মাথা হেঁট করে দিতেন। কিন্তু ডাক্তার তো আর কেউ নয়, চিকিৎসক-শ্রেষ্ঠ নীলরতন সরকার যিনি রুগীর গন্ধ পেয়ে টাইফয়েড বা নিউমোনিয়া চিনে ফেলেন—যিনি ঘরে ঢুকলে মৃত্যুভীত অভয় পায়, আমাদের চিরশুভানুধ্যায়ী সেই ডাক্তার আমাকে আরোগ্য করলেন। সাত আট মাসের মধ্যে আমি সেরে উঠলাম। পরীক্ষাও দেওয়া হল, ফলও ভালই হল। রোগটা যখন সেরে গেল তখন আমার ভারি দুঃখ হতে লাগল, যেন যুদ্ধের প্রধান অস্ত্রটাই ভোতা হয়ে গেছে, আর লড়ব কি দিয়ে।

সেবারে আমার পরীক্ষার বিষয় বলতে গেলে একটা কথা আজকের দিনে বিশেষ করে মনে হয় যখন দেখি মা বাবাও সন্তানের জন্য প্রশ্নপত্রের সন্ধানে ঘোরেন, জালজুয়াচুরিতে দ্বিধাহীন হন।

আমি যে পরীক্ষা দেব সেটা আগে থেকে ঠিক ছিল না বলে বাবা সংস্কৃত প্রশ্নপত্র করেছিলেন কিন্তু পরে আমি পরীক্ষা দেওয়ায় পরীক্ষকের পদ ছেড়ে দিলেন। প্রশ্নপত্র বাবাই করেছিলেন, আমাকে পড়িয়েছিলেনও তিনিই, কিন্তু কিছুমাত্র বুঝতে পারিনি প্রশ্নে কি আছে–। পরীক্ষা দিয়ে আসার পর বাবা খুব হাসছেন-“কি আগেকিছু বুঝতে পারিস নি তো?” আজকের দিনে এটা হয়ত অসম্ভব আষাঢ়ে গল্প শোনাবে। তখনকার দিনে বাপ-মা’রা চাইতেন যে ছেলেমেয়েরা যেন লেখা-পড়া শেখে, এখন চান শুধু ডিগ্রী! দেশের এ একটা পরিবর্তন বটে!

নয় দশ মাস কেটে গেছে কিম্বা এক বছর, এর মধ্যে আমি ওর কোনো খবর পাইনি। খোকাও আসে না। ওর বইয়ের দোকানে গিয়েও আর ওকে ধরা আমার হয় না। আমার ছোট একটি বোন হয়েছে। কাকারা চলে গেছে, বাবার সঙ্গে খুব ঝগড়া করেছে—মুখোমুখি নয়, সে সাহস তার হয় নি, সে মাকে বকাবকি করেছে—মা স্বামীর পক্ষ নিয়ে ঝগড়া করেছেন। আমারও কাকার উপর রাগ হয়েছে, আমিও ঝগড়া করেছি। কাকীমা তো বাপের বাড়ি গিয়ে বসে আছে নাগালের বাইরে। কাকার রাগের ভিতরের কারণটা কি তা আমি বুঝতে পারি নি কিন্তু এরকমভাবে চলে যাওয়ায় আমার দুঃখ হয়েছে খুবই। কাকাকে এত ভালোবাসতাম, প্রতিজ্ঞা করেছি কোনদিন আর তার মুখ দেখব না।

মা বললেন, সংসারটা ভাঙতে শুরু করল। আত্মীয় পরিজন আশ্রিত অতিথি সবাইকে নিয়ে যে সাজান সংসারটা গল্পে হাসিতে কবিতায় উল্লাসে গত একবছর ঝলমল করছিল মা তো সেখানে রাজেন্দ্রাণী, একে একে যেন এক একটা বাতি নিবে যাচ্ছে।

একদিন আমি সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আছি, বাবা বসবার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন—“কাল মির্চা এসেছিল?” আমার ভিতরটা ধ্বকধ্বক করে উঠেছে–হা ঈশ্বর কি শুনব এখন? “দাড়ি রেখেছেন, একমুখ দাড়ি। সন্ন্যাসী হয়েছেন, আমি তো চিনতেই পারি না। হাঃ হাঃ হাঃ।” আমি কোনো উত্তর না দিয়ে বাবার দিকে মুখ না ফিরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। বাবা ডাকলেন—“রু, রু, সে দেশে চলে যাবে তার যে কিউরিওগুলো পড়ে আছে গাড়িতে তুলে দিস।” আমি ভাবছি কেন ও দাড়ি রাখল, এটা কি শোক? আমি তো কিছুই করতে পারলাম না। চুলও কাটা হল না। স্বার্থপর আমি স্বার্থপর।

মির্চা যখন একবার দার্জিলিঙে গিয়েছিল তখন সেখান থেকে খুব সুন্দর সুন্দর বড় বড় তিব্বতী কিউরিও এনেছিল, সেগুলো এখানেই সিঁড়ির তাকে সাজান ছিল—সে চিহ্নগুলো আমি দেখতাম। আজ নিজের হাতে সেগুলো গাড়িতে তুলে দিলাম। যাক, তাতে আমার দুঃখ নেই। কোনোও দিনই অর্থাৎ ছোটবেলা থেকেই আমি মূর্তিপূজক নই। অর্থাৎ কোনো বস্তু আমার কাছে ভাবের প্রতীক হয় না। ওর যে একটাও ছবি নেই আমার কাছে সেজন্য আমার দুঃখ হয় না। ছবি দিয়ে কি হবে? ছবি তো মানুষকে দেবে না।

বাবা যখন ওর একমুখ দাঁড়ির কথা বলছিলেন তখন আমার বুকের ভিতরটা থেঁতলে যাচ্ছিল—আমি ভাবছি বাবা হাসছেন কেন? তাহলেই কি ব্যাপারটা আমার কাছে হাস্যকর ছেলেমানুষী বলে মনে হবে? মনে দুঃখ পেলেই কি এভাবে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো সোজা কথা। মনে দুঃখ তো ছিলই, তার সঙ্গে আবার শরীরের দুঃখও যোগ হল। কিন্তু এ কাজে সে পারঙ্গম—নিজেকে কষ্ট দিতে তার জুড়ি নেই—নিজেকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই—হয়ত সেটা বোকামি, তবুও মানুষ সে কাজকে সম্মান করে, সতীদাহের মত ভয়াবহ জিনিস আর নেই তবু যখন ঠাকুমা বলতেন তাদের পূর্বপুরুষে একজন সতী হয়েছিলেন, তখন তাঁর মুখটা আলো হয়ে যেত। নিরাভরণ উপবাসজর্জর বৈধব্য ঠাট্টার বস্তু নয়। কিউরিওগুলো গাড়িতে তুলছি আর ভাবছি বাবা পারবেন কার জন্য নিজেকে কষ্ট দিতে, নিজেকে একটু বঞ্চিত করতে? অসম্ভব। কেন ওকে বিদ্রুপ করলেন—he jests at scars who never felt a wound! মহিমাময় শেক্সপীয়রের জ্ঞানচক্ষু আমার মধ্যে উন্মীলিত হল।।

আমাদের করুরই শরীর ঠিকমত ভালো হয়নি—তাই আবার আমরা বাইরে যাব। কাশীতে যাওয়া হবে। আমাকে তো আমি দেখতে পাচ্ছি না, আমার ধারণা আমি খুব স্বাভাবিকভাবে চলেছি, আর কেউ আমার মনোবিকার বুঝতে পারছে না। মনোবিকার! আবার কি! প্রেম-ট্রেম সব বাজে কথা। কিন্তু মার মনে শান্তি নেই—শান্তি না থাকার প্রধান কারণ মার নিজের ভিতরে! মা ভাবছেন তিনি আমায় বিয়ে দেবেন কি করে? আমি কি আর কোনো মানুষকে ভালোবাসতে পারব? না সেটা উচিত হবে? ভালোবাসা যে একটা বস্তু নয়, তা একজনের কাছ থেকে অপহরণ করে তবেই অন্যকে দিতে হয় তাও নয়, একথা তখন বোধ হয় ঠিকমত জানা ছিল না। মানুষ নিশ্চয় জানত, সমাজ জানত না। মা একদিন আমাকে বললেন, “রু তোরা কি কোনো বিবাহের মন্ত্র পাঠ করে কোনো অনুষ্ঠান করেছিলি?”

“মা তুমি আর একবারও জিজ্ঞাসা করেছিলে, আমি বলেছি তো তোমাকে ওসব আমাদের মনেও আসে নি।”

“তবে হাসপাতালে যে দিন পড়ে গিয়েছিলি, সেদিন ঐ মন্ত্র বলবি কেন?”

“কি মন্ত্র? মমব্রতে তে হৃদয়ং দধান?”

“না, না, ইংরেজী মন্ত্র।”

“ইংরেজি মন্ত্র! ওদের বিয়ে কি আমি দেখেছি কোনো দিন যে সে মন্ত্র জানব? কেন আমায় মিছিমিছি অপবাদ দেওয়া।”

“অপবাদ নয় রু, যদি বলেই থাকি আমায় বল না।”

“কি মন্ত্রটা কি?”

“আমি তো ঠিক বুঝলাম না ওটা মন্ত্র কি করে হবে—কোনো মন্ত্রর মত তো শোনাচ্ছে।, কিন্তু তোর বাবা বললেন, ওটা বিবাহের মন্ত্র—অবশ্য তিনি যখন বলছেন—”

“কথাটা কি?”

“–in sickness and in health…”

“এ আবার কি মন্ত্র—এ আমি কোনো দিন শুনিই নি।” মা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। অনেক পর আমার মনে পড়েছে আমি একটা সিনেমায় ঐ মন্ত্রটা লেখা দেখেছিলাম—তখন নীরব সিনেমা ছিল। তার অর্থ—সুখে দুঃখে রোগে স্বাস্থ্যে পরস্পরকে অতিক্রম করব না till death do us part—সেইটা হয়ত অজ্ঞাতসারে বলে থাকব। জ্ঞাতসারে ঐ মন্ত্র আমি কখনো ভাবি নি। ব্যাপারটা কিছুই তাই গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু মা ঐ কথাটার আশ্রয় চেয়েছিলেন—আমার এত কষ্ট-মির্চার এত কষ্ট সেটা উপেক্ষা করা যায় কিন্তু একটা যদি মন্ত্র পাঠ হয়ে থাকে সেটা অনতিক্ৰমণীয়—মানুষ কিছুই নয়, অনুষ্ঠানই সব। এই ছিল আমাদের দেশ। হয়ত এখনও আছে।

কিন্তু মা যে সত্যই অনুষ্ঠানের এত মূল্য দেন বা গোড়ামীতে ভরা এ কথা ভাবলে তার প্রতি অবিচার করা হবে, তা নয়–কিন্তু এ ক্ষেত্রে বাবার সঙ্গে লড়াই করবার একটা হাতিয়ার খুঁজছিলেন, এই মাত্র।

যখন আমার সাত বছর বয়স আর সাবির দুই-তখন ঠাকুমা, মা, আমরা দুই বোন ও চাপাপিসি আমরা দু বছর পুরীতে ছিলাম, বাবা তখন বিলাতে। একদিন জগন্নাথের মন্দিরে গর্ভগৃহের সামনে দাঁড়িয়ে আছি—সেদিন কোনো পুণ্য দিবসলোকের ভীড়— চারিদিকে ঠেলাঠেলি—হঠাৎ একজন মধ্যবয়সী বিধবা ও তার সঙ্গে পনের-ষোল বছরের একটি ছেলে আমাদের দিকে এগিয়ে এল-সোজা আমাদের কাছে এসে সাবির হাতে একটা মিষ্টি ও আমার গলায় একটা ফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে বললে, জগন্নাথ সাক্ষী তোমাকে মাল্যদান করলাম তারপর ভীড়ের মধ্যে দ্রুত চলে গেল মাতা পুত্র। ঠাকুমা চিৎকার করে উঠলেন, “কেডারে, কেডারে” —তারপর ভিড়ের মধ্যে খুঁজতে গেলেন। মা আমার গলা থেকে মালাটা টান মেরে ফেলে দিয়ে খুব শান্তভাবে বাড়ির দিকে এগিয়ে চললেন আমাদের নিয়ে। ঠাকুমা কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসেছেন, উদ্ভ্রান্ত—“ও বৌমা, কি সর্বনাশ হইল, জগন্নাথ সাক্ষী কইল যে!”

“চুপ করুন। কোন্ পাগলে কি বলেছে তাতে কি হবে, জগন্নাথ কারু প্রলাপ শোনে না।”

“ও বৌমা”, ঠাকুমা কপালে করাঘাত করছেন, “আজ যে অমুক তিথি”—

“আপনি একেবারে চুপ করুন। আর একটিবারও একথা বলবেন না। আমি তাহলে কালই কলকাতা চলে যাব।” পরে মা আমাকে বলেছিলেন, ওদের হয়ত কোনো মানত ছিল জগন্নাথের সামনে অমুক তিথিতে কোনো কুমারী কন্যাকে মাল্যদান করবে। অদ্ভুত এই দেশ! বিচিত্র তার সংস্কার যা বুদ্ধিমান মানুষকেও নির্বোধ করে তোলে।

অন্তরের দিক থেকে মা কতখানি সত্যাশ্রয়ী ও সংস্কারমুক্ত ছিলেন তার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। তার একটি কাজে তা বোঝা যাবে। এরকম কাজ আজও এদেশে কম মেয়েই পারবে।

১৯২৪ বা ২৫ সালে আমার বয়স তখন দশ, আমরা কালীঘাটে একটা বড় বাড়িতে ছিলাম। সে বাড়ির দুপাশে দুটো দারোয়ানের ঘর ছিল। একটা ঘরে আমাদের দুর্দান্তপ্রতাপ দারোয়ান সুরজপাল থাকত। একদিন দেখি সে বিমর্ষভাবে তার জিনিসপত্র বার করে অন্য ঘরে যেখানে দুটি ভৃত্য থাকে—তাদের সঙ্গে রাখছে। “দারওয়ান এ ঘর খালি করছ কেন?”

“মাজি কা হুকুম।”

“কেন? কার জন্য?”

“মহারানীকা বাস্তে।” অনেক জিজ্ঞাসার পর জানলাম পঁচি হচ্ছে সেই মহারানী। পঁচি আমাদের বাসন মাজার ঠিকা-ঝি। কয়েক দিন আগে মাকে দেখেছি তাকে খুব বকছেন আর সে মার পা ধরে কাঁদছে। সেই পাচির জন্য দারোয়ানকে ঘর ছাড়তে হল—আমি ভাবছি ও হয়ত কান্নাকাটি করে আদায় করেছে। অবিচারের বিরুদ্ধে আমি সর্বদাই সংগ্রামী তাই আমার রাগ হচ্ছে, আশ্চর্যও লাগছে—দারোয়ান এ রহস্যভেদ করতে নারাজ। তাই আমার সমস্ত রকম জ্ঞানদায়িনী ঠাকুমার কাছে গেলাম—ঠাকুমারও সমস্ত অভিযোগ জানাবার জায়গা আমি—তার ধারণা বাড়ির মধ্যে কেবল আমিই আঁকে ভালোবাসি। “ঠাকুমা তুমি কাঁদছ কেন?”

“এ বাড়িতে আর থাকব না খুকি—এ বাড়ি অপবিত্র হয়ে গেছে—”।

“কি হয়েছে ঠাকুমা, কি হয়েছে?” আমি তার গলা জড়িয়ে ধরলাম, “তুমি চলে গেলে আমিও চলে যাব।”

“ঐ পাচি-সাত বাড়ি কাজ করে বেড়ায়, কোথা থেকে পাপ এনেছে—ওটা পাপিষ্ঠা, ওর সঙ্গে এক বাড়িতে থাকলে চৌদ্দ পুরুষ নরকে যায়—তা তোর মা দয়ায় গলে গেছেন—ওকে দারোয়ানের ঘরে রাখবে—ওর সেবা করবে। আর তোর বাবা হয়েছে বৌয়ের ভেড়য়া। বৌ যা বলবে তাই-মা কেউ নয়।”

বাবাকে হঠাৎ ভেড়া কল্পনা করে আমার খুব হাসি পেল…কিন্তু পঁচি কেন পাপিষ্ঠা, কি কি পাপ করেছে তা জানবার জন্য ঠাকুমাকে অতিষ্ঠ করে তুললাম। ঠাকুমা মার ভয়ে বলতে নারাজ—তা আমার সঙ্গে পারবেন কেন—আর তার নিজেরও যথেষ্ট বলার ইচ্ছা। “ওর যে সন্তান হবে—বিধবার সন্তান হওয়া মহাপাপ, তার ছায়া মাড়ানোও পাপ।” আমি মার কাছে গিয়ে বললাম, “মা পাচির কেন সন্তান হবে? বিধবার সন্তান হওয়া মহাপাপ—তাকে তুমি এ বাড়িতে রাখবে কেন?”

মা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছেন, “তোমাকে এসব বলল কে? ঠাকুমা নিশ্চয়।” খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মা বললেন, “রু, ছেলে হওয়া তো মানুষের হাতে নয়, তাই না? ভগবানের কাজ। মানুষ কি মানুষ বানাতে পারে? বিধবার সন্তান না হওয়াই উচিত কিন্তু ভগবানও মাঝে মাঝে ভুল করে ফেলেন, তখন মানুষের বড় কষ্ট হয় মানুষের কষ্ট হলে, বিপদ হলে, মানুষকে সাহায্য করতে হয়। সেটা কখনো অন্যায় নয়।”

আত্মীয়স্বজন, ছেলেমেয়ে, ভৃত্যকুল নিয়ে একটি বিরাট দল আমরা কাশী গেলাম। সেখান থেকে মা, বাবা, আমি ও আমার সদ্যজাত শিশু ভগ্নীটিকে নিয়ে দিল্লী, আগ্রা হয়ে ঋষিকেশ লছমনছোলা যাব। ঋষিকেশ যাব ভেবেই আমার মনটা আনন্দে ভরে গিয়েছে। মনে হচ্ছে যেন ওখানে গেলেই ওর সঙ্গে দেখা হবে—অথচ আমি তো জানি, ও দেশে চলে গেছে। তবে এমন মনে হচ্ছে কেন? যুক্তির নাগালের বাইরে যেসব ভাব আমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে এও তার একটি। আমাদের ভ্রমণের অন্য কোনো অংশ আমার মনে নেই শুধু হরিদ্বার ও ঋষিকেশ ছাড়া। হরিদ্বার থেকে একটা মোটর ও একজন গাইড যোগাড় করে আমরা স্বর্গদ্বারের দিকে রওনা হলাম। এই প্রথম হিমালয়ের আশ্রয় পেয়েছি—দেবতার আশ্রয়ের মতো তার নিশ্চিন্ত শান্তি। সমুদ্রের বাতাসের প্রভাব আছে মনের উপরে কিন্তু পাহাড়ের মতো নয়। চারধারে বড় বড় সোজা সোজা গাছ, এদের নাম জানি না। নদীর এত গতি কখনো দেখি নি—বাতাসের এমন সুখস্পর্শ আগে কখনো পাই নি। আমার বুকের ভিতর সবগুলি ফুলিঙ্গের উপর ঠাণ্ডা বাতাস লাগছে, মনে হচ্ছে আগুনটা নিবে যাবে! মির্চা এখানে এসে ভালোই করেছিল। বাতাস শুধু তো ঠাণ্ডা নয়–বাতাসে আরো কিছু আছে। কি আছে? হিমালয় নামে নগাধিরাজের কি মহিমা আমি কি জানি? আমি তো আগে কখনো ভাবতেই পারিনি প্রকৃতি মানুষের মনকে শান্ত করতে পারে। শকুন্তলা পদ্ম-পাতায় শুয়েছিল—আমি ভাবতাম কবিত্বের মধ্যেও একটা সম্ভবপরতা থাকা চাই—আমাকে পদ্মফুল দিয়ে কবর দিলেও শান্তি পাব না।

আমরা একটা সমতলভূমি দিয়ে চলেছি। দুধারে শণবন, গাড়ির মাথার চেয়েও উঁচু, সেটা ঠিক কোন্ জায়গা পরে আর চিনতে পারি নি। হঠাৎ গাড়ি বিগড়ে গেল। মা আর আমি তো রোরুদ্যমান শিশুটিকে নিয়ে বিব্রত—এমন সময় গাইড হঠাৎ বললে, এই শণের বনে শের থাকে। আমি আবার হিন্দী বিদ্যায় একেবারে অজ্ঞ—আমি ভাবছি ‘সের তো ওজন, এখানে যে ‘শের’ থাকে, সে বস্তুটা কি? বাবা আঁতকে উঠেছেন—“কি সর্বনাশ। শের, থাকে। তবে এখানে আনলি কেন রে হতভাগা।” বাবা যত রেগে উঠছেন গাইড তত নির্বিকার মুখে বলে যাচ্ছে—“মৎ ঘাবড়াইয়ে” শেরেরও তো প্রাণের ভয় আছে—আমরা হর্ন বাজালেই পালিয়ে যাবে।

আমি মনে মনে ভাবছি-দেখ আমরা এতজন আছি তবু ভয় পাচ্ছি—এখানে একলা একলা ঘুরতে লাগবে কেমন? হাসির কথা নয় মোটেই। স্বর্গদ্বারে গিয়ে আমরা নৌকায় ওপারে গেলাম—এই প্রথম আমি পার্বত্য নদী দেখলাম, এর পরে তো তারই তীরে জীবন কাটিয়েছি। ঢালুর উপর দিয়ে বয়ে আসছে বলে সে প্রবলা, পাথরে পাথরে ঘা খেয়ে খেয়ে তার স্বচ্ছ জলরাশি ঘূর্ণমান, কখনো ঊর্ধোঙ্খিত চূর্ণীকৃত। মুখে চোখে এসে বিন্দু বিন্দু ঠাণ্ডা জল লাগছে। বাবা এক অঞ্জলি ভরে পান করলেন। আমরাও করলাম, কি অপূর্ব স্বাদ! অমন মিষ্টি প্রাণ জুড়ানো জল আগে কখনও খাই নি, এ যে অলকানন্দা! আমরা তো স্বর্গে পৌঁছে গেছি—স্বর্গের দরজা পার হলাম—আমি মুখে চোখে জল দিয়ে নদীর বন্দনা করলাম—সুরনর-নিস্তারিণী পাপতাপনিবারিণী পতিতপাবনী সাগরগামিনী গঙ্গে—স্বাভাবিকভাবে স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে কবিতা বলায় বাবা খুশি—“বল বল সবটা বল”—আমরা ওপারে এসে পৌঁছেছি। পাহাড়ে পায়েচলা পথ দিয়ে আমরা এগুচ্ছি—ছোট্ট বোনটাকে একবার মা নিচ্ছেন, একবার আমি। পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছোট ছোট গুহার মতন আছে—গাইড বললে ওখানে বসে সাধুরা তপস্যা করেন। এক একটা গুহায় এক একজন বসে আছেন–নানা রকম আসনে পদ্মাসনেই বেশি। কেউ ছাইমাখা জটাধারী, কেউ মুণ্ডিতমস্তক—দু’একজন সন্ন্যাসী হাতে কমণ্ডলু ঝুলিয়ে, কেউ বা ত্রিশূল নিয়ে পথ ধরে এদিক ওদিক যাচ্ছে। এদের খাবার দিয়ে যায় কালীকম্বলিওয়ালার ধর্মশালা থেকে, বিনা মূল্যে। পুণ্যলোভী ধনী ব্যক্তিরা চমৎকার ব্যবস্থা করেছেন, যারা ঘোরাফেরা করেন তাঁরা গিয়ে খেয়ে আসেন, আর যারা ধ্যানাসনে বসে আছেন তাদের খাবার দিয়ে যায়। আমরা এগিয়ে চলেছি এমন সময় গাইড একটা গুহা দেখিয়ে বলল-এইখানে একজন সাহেব ছিল, কিছুদিন, সে চলে গেছে। গুহাটি খালি। বাবা দাঁড়িয়ে গেলেন। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল, “সে-ই নিশ্চয়, একেই বলে কর্মফল। এল পড়াশুনো করতে তা নয়, বনেরাদাড়ে ঘুরে দেশে ফিরে গেল।” বাবা বকতে বকতে এগোচ্ছেন, আমি বুঝতে পেরেছি তার মন কেমন করছে। তিনি ওকে ভালোবাসতেন। তার পক্ষে যতটা ভালোবাসা সম্ভব। তা বাসতেন। আমার জন্যই এমনটা হল। বাঃ, কে আগে খেলা শুরু করেছিল? আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করছি। কিন্তু আমার মনে পড়ছে না এর আরম্ভটা কোথায়—শেষ কোথায় তা তো জানি। জানি কি?

বড় বড় গাছের ছায়াঢাকা পাথুরে বন্ধুর পথ—আমরা সারিবদ্ধ এগোচ্ছি—এর পরের গুহাটায় একজন সাধু বসে আছেন একটা ছোট লাঠির উপর থুতনিটা রেখে। তার চোখ বড় বড়, দৃষ্টি দূরে নিবদ্ধ। মুখ দেখে বোঝা যায় এতক্ষণ যে সব সাধু দেখেছি তার চেয়ে ইনি অন্যরকম। গাইড বলল, ইনি একজন বাঙালী জজ ছিলেন—ঈশ্বরের আহ্বান শুনতে পেয়ে সব ছেড়ে এখানে চলে এসেছেন দুবছর। ইনি কোথাও যান না। দুদিন অন্তর একবার খান। একটিও কথা বলেন না। ঘুমোতেও কেউ দেখে নি, এইরকম বসে থাকেন। কৃচ্ছ্রসাধনের কথা শুনলেই আমার খুব ভক্তি হয়—আমি যে একটুও কৃচ্ছ্রসাধন করতে পারি না। আমি মনে মনে ভাবছি পাশের গুহায় যে সাহেব ছিল সে মির্চা কিনা এর কাছ থেকে জানতে হবে। স্বর্গদ্বারের এই জঙ্গলে তো আর দলে দলে সাহেব ঘুরে বেড়াচ্ছে না। আমি ঐ জজ সন্ন্যাসীর গুহার সামনে হোঁচট খেলাম। আমার পায়ে লাগল। আমি বাবাকে বললাম, “তোমরা একটু এগিয়ে যাবে তো যাও, আমি এখানে অপেক্ষা করি, আমার পায়ে লেগেছে।”

বাবা, মা এগিয়ে যেতে আমি সেই জজসাহেব সাধুর কাছে গিয়ে বললাম—“আপনি তো কথা বলেন না, কিন্তু আপনারা তো সাধু-জগতের দুঃখকষ্ট দূর করাও তো আপনাদের কাজ। ঐ গুহায় যে সাহেব ছিল তার কথা একটু বলবেন? তার নাম কি মির্চা?”

সন্ন্যাসীর মুখে রেখাপাত হল না। অনিমেষ দূরবদ্ধ দৃষ্টিতে কোনো ভাব নেই। আমি কাঁদতে লাগলাম—“বলুন না, বলুন আমার বড় জানা দরকার। একটা কথা বললেই কি আর আপনার সাধনা নষ্ট হয়ে যাবে?” কোনো ফল হল না। আর একজন আগন্তুক এসে পঁড়িয়েছে—সে এ ব্যাপার দেখে অবাক হয়ে গেছে। হঠাৎ এই বনের মধ্যে জটাধারী গুহাবাসীর কাছে বসে সুন্দরী তরুণীর রোদনের দৃশ্য তাকে খুবই অভিভূত করেছে—মানুষের উপর সম্পূর্ণ নির্দয় হয়ে ওঠার মত উপযুক্ত সিদ্ধিলাভ তার তখনো হয়নি। সে বললে, “মৎ রোইয়ে, মৎ রোইয়ে—কারণ যতই না কেন তুমি কাঁদ উনি কিছুতেই কথা বলবেন না। তুমি কি জানতে চাও মা?”

“ঐ গুহায় যে সাহেব ছিল তার নাম কি?”

“নাম তো জানি না। সাধুসন্ন্যাসীদের নাম কে জিজ্ঞাসা করে?”

“তুমি তাকে দেখেছ?”

“হ্যাঁ।”

“দেখতে কি রকম?”

“সাহেবের মতো?”

“সাহেবের মতো মানে?”

“মানে ফর্সা।”

“কতটা লম্বা, চোখে চশমা আছে?”

লম্বা সে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল। চোখে চশমা আছে কিনা সে বলতে পারে না। আমি ফিরে ঐ গুহায় গিয়ে ঢুকলাম। চারিদিকে দেখছি কোথাও নাম লেখা আছে কিনা, কিছু লিখে রেখে গেছে কিনা। তন্ন তন্ন করে দেখছি। আমার বুক ধড়ফড় করছে, যেন দেওয়ালের গায়ে নামটা দেখলেই ওকে দেখা হবে। আমি পাগলের মতো খুঁজছি, এক্ষুনি মা বাবা এসে পড়বেন। কোনোেখানে কিছু লেখা নেই। বাংলা অক্ষরে কয়েকটা অঙ্ক কষা আছে। আবার আমার বুদ্ধি ও নির্বুদ্ধিতে লড়াই লেগেছে। নির্বুদ্ধি বলছে, এ তো ইচ্ছে করে আমায় কষ্ট দেওয়া—এখানে একটা নাম কি লিখে যেতে পারত না? তাতে তো আর বাবা ওকে বকতেন না—এটুকু করতে কি হত? আর বুদ্ধি বলছে—বা রে, সে কি করে জানবে তুমি এখানে আসবে? এজন্য অত উতলা হবার কারণ কি? অত রাগই বা করছ কেন? কিন্তু আমি অভিমানের সমুদ্রকে শাসন করতে পারছি না। তার তরঙ্গ উত্তাল হয়েছে আমার কি শক্তি আছে, কি সাধনা আছে, যে এর সঙ্গে লড়াই করব? এখানে যে একটা নাম লেখা নেই সেটা ইচ্ছা করেই করা হয়েছে, আমার সঙ্গে সম্বন্ধচ্ছেদ করবার জন্যই করা হয়েছে…আর কিছু নয়। দূরে গাইডের সঙ্গে বাবা কথা বলছেন গলা পাওয়া গেল, আমি বেরিয়ে জজ সাধুর কাছে বসলাম। এ লোকটা কথা বলে না ভালই, নইলে বাবাকে বলে দিত।

আমরা রাস্তা পেরিয়ে ঘাটের দিকে চলেছি। নৌকায় অনেক ভীড়। দড়ি ধরে বসতে হয়। কিছুদিন আগে পাথরে ধাক্কা খেয়ে নৌকা উল্টে ত্রিশ জন লোক মারা গেছে—এ নদীতে নাকি একবার পড়লে আর রক্ষা নেই। এত স্রোত যে অত্যন্ত বেগের সঙ্গে পাথরে পাথরে ধাক্কা লেগে লেগে মুহূর্তের মধ্যে মানুষের শরীর চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাবে। আমি নৌকার কিনারে বসেছি। ডান হাত বাড়িয়ে জল ঠুচ্ছি। আর মনে হচ্ছে নাম না লিখে যাওয়ার উপযুক্ত শাস্তি দেবার এই সময়। আমি যদি এখানে পড়ে যাই মুহূর্তের মধ্যে শেষ হয়ে যাব। আমি তো কৃচ্ছসাধন করতে পারিনা, এবার একটা চূড়ান্ত শারীরিক কষ্ট পেয়ে দেখাই যাক না, উপযুক্ত শাস্তি হবে তাহলে। কি করে উপযুক্ত শাস্তি হবে? সে তো টেরই পাবে না—টেরপাবে না আর কি! বাবা যা একখানা চিঠি লিখবেন, এক নম্বর মেলডি স্ট্রীটে সেই মহাশয়টি সে চিঠিখানা পড়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে। বাবা লিখবেন, “তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম, আশ্রয় দিয়েছিলাম, অন্ন দিয়েছিলাম, শিক্ষা দিয়েছিলাম। পরিবর্তে তুমি আমায় মৃত্যু দিয়েছ, তোমার প্রতি স্নেহই আমার সেই ছিদ্র যে-পথে শনি হয়ে প্রবেশ করে তুমি আমার সংসার ধ্বংস করেছ।” আর মা বাবা দুজনেরই উপযুক্ত শিক্ষা হবে। প্রতিহিংসার উল্লাস আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ মা বললেন, “রু একটু সরে বোস, ও কি অত ঝুঁকছিস কেন?”

আমি কল্পনা করছি মীলুকে; ও মাথা কুটে কুটে কাঁদবে। দিদিমা, শান্তি, খোকা সকলকে মনে পড়ছে। ঠাকুমা বলতেন, ঠিক মৃত্যু সময়ে সকলের মুখ মনে পড়ে, আমার তাই হয়েছে নিশ্চয়, সকলকে মনে পড়ছে। সকলকে? হঠাৎ আমার কোনো মানুষ নয়—ভবানীপুরের আমার ঘরের দেওয়ালে যে ছবিটা টাঙান আছে, মখমলের টুপি পরা—যে ছবির দৃষ্টি তুমি যেদিকেই যাও তোমাকে অনুসরণ করে ফিরবে, সেই ছবিটা দেখতে পেলাম। সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমায় বলছে “ছিঃ তুমি এই? এত অল্পে পরাজিত হয়ে গেলে? তাহলে আমার গান তোমার জন্য নয়।” আমি যেন মোহাচ্ছন্ন অন্ধকার থেকে মুখ বাড়িয়ে সকালের আলো দেখতে পেলাম। বাবা হাত বাড়িয়ে আমাকে টেনে নিলেন, “সরে আয়, অত ধারে কেন?” আমি যে বাবাকে শিক্ষা দেব বলে ঝাঁপ দিতে চাইছিলাম তারই গলা জড়িয়ে বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলাম।

মা খুব ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, বলতে লাগলেন, “ও আবার কাদে কেন?” বাবা বললেন, “চারিদিকে সুন্দর দৃশ্য সুন্দর জায়গা দেখলে বরাবরই ওর চোখ দিয়ে জল পড়ে।” বাবা সবটা হাল্কা করে দিচ্ছেন—আর পারছেন না ওরাও—এ শোকভার সহ্য হচ্ছে না।

আমরা হরিদ্বারে ফিরে এলাম। বাংলোর বারান্দায় বসে আছিনদীর শব্দ শোনা যাচ্ছে—কল্লোলিনী নদী, এদেশের প্রাণবহা পুণ্যসলিলা গঙ্গার ধারা আমাকে ধুইয়ে দিয়ে যাচ্ছে। আমি চোখ বুজে ভাবছি এতদিনে ঐ গানটার মানে বুঝলাম—

কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি
অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত