| 28 মার্চ 2024
Categories
ধারাবাহিক সাহিত্য

ন হন্যতে (পর্ব-১০)

আনুমানিক পঠনকাল: 28 মিনিট

আরো এগার বছর কেটে গেছে। ইয়োরোপে দু’বার ঘুরেছি, নানা দেশে। আর কখনো ওর নাম শুনি নি। ওর কথাও আর মনে পড়ে নি। এই এগার বছর আমি বিশেষ কতগুলি দায়িত্ব নিয়েছি। আমার সময় নিরন্ধ্র, আমার বয়স এখন বার্ধক্যের সীমায় পৌঁছেছে, শরীরও জীর্ণ হচ্ছে। ছেলেমেয়ে নাতিনাতনী নিয়ে আমার সুখের সংসার, কিন্তু এ ছাড়াও আর একটা বড় সংসার তৈরী হয়েছে বন্ধুবান্ধব সহকর্মীদের নিয়ে। তাদের সকলের কাছে আমার একটা ভাবমূর্তিও আমি খাড়া করতে সমর্থ হয়েছি। সেটা আমার যতদুর বিশ্বাস এই রকম—আমি খুব কড়া মানুষ, বিশেষত অসামাজিক প্রেম সম্বন্ধে আমি নির্দয় মনোভাব পোষণ করি। কাজেই বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে সেরকম কোনো ঘটনা ঘটলে আমার কাছ থেকে সযত্নে গোপন করা হয়। ন্যায়-অন্যায় সম্বন্ধে আমার মনোভাব অনমনীয়, সমবেদনাশূন্য। একটু এদিক ওদিক হলেই আমি কড়া কড়া কথা বলি। আর অতিরিক্ত প্র্যাকটিক্যাল। আমার নিজের কাছেও নিজের একটা ভাবমূর্তি তৈরী করেছি নিশ্চয়—সেটা হচ্ছে, আমি অন্যায়ের সঙ্গে আপস করি না। কোনো বিষয়ে অসংযম, মদ্যপান থেকে অন্যান্য সব কিছুই আমার দুচক্ষের বিষ। প্রত্যেক মানুষের সমাজের প্রতি দায়িত্ব আছে, ব্যক্তিগত অসংযম বা সাহিত্যের খাতিরে সে দায়িত্বচ্যুত হওয়া যায় না। যদি কেউ হয় আমি তার নিন্দা করি। অর্থাৎ ছোটখাট একটি নেত্রীর যা যা দোষগুণ সবই আমার মধ্যে দেখা যাচ্ছে। আমার পরোপকারস্পৃহাটা কেউ কউ নেই কাজ খৈ ভাজে’র দলে ফেললেও প্রশংসা ও সাহায্যও যথেষ্ট পেয়েছি। মোটের উপর ছোট এবং বড় দুই সংসারের বৃত্তই আমার সম্পূর্ণ হয়েছে। আমার অপূর্ণতা কিছু নেই।

এমন সময় উনিশ শ’ একাত্তর সালে আমি আবার ওর নাম শুনলাম। একটি বসবার ঘরে সহকর্মী ও বন্ধুদের হালকা আলোচনার পরিবেশে পার্বতী হঠাৎ বললেন, “অমুক শহরে অমৃতাদির একজন অ্যাড়মায়ারার আছেন।” সবাই উৎসাহিত, “তাই নাকি, তাই নাকি।” আমি বিস্মিত নই। এই দীর্ঘ জীবনে নিন্দা এবং প্রশংসা দুইই যথেষ্ট পেয়েছি। কাজেই অ্যাডমায়ার করেন এরকম কেউ থাকা তো অসম্ভব নয়।

“নামটি কি তার?”

“মির্চা ইউক্লিড—”

ভিতরে ভিতরে চমকে উঠেছি। মনে মনে ভাবছি এই মেয়েটা আমাকে ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে বলেই জানি। এখন কি রকম অপমান করছে দেখ! আমাকে যতদূর সম্ভব নির্বিকার থাকতে হবে। শ্রীমতী পার্বতী বলেই চলেছেন, বছর দুই আগে ‘জ’র সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। সেদিন তিনি ক্লান্ত ছিলেন, অসুস্থও। একজন বাঙালীকে দেখে কলকাতার কথা বলতে লাগলেন—এখন কলকাতার সবাই নিন্দা করে কিন্তু তিনি যে কলকাতা দেখেছিলেন তার তূণ্য শহর আর কোথাও দেখেন নি। বিশেষত সেখানকার মেয়েরা যাদের মাধুর্যের তুলনা নেই অথচ যারা সন্ত্রম রক্ষা করে চলতে জানে, তাদের মুখে সর্বদা রবীন্দ্রনাথের কবিতা ইত্যাদি, শুনতে শুনতে চতুর ‘জ’র মনে হয়েছে এটা গৌরবে বহুবচন এবং কোনো স্থানের কথা নয় কোনো ব্যক্তির কথা বলা হচ্ছে। তখন সে জিজ্ঞাসা করল, ‘মহাশয়, কলকাতার কথা বলতে আপনি কি কোনো স্থানের কথা বলছেন,না কোনো মানুষের কথা?’

অধ্যাপক বললেন, ‘চল, ওধারে একটু বসা যাক। একটি নির্জন কোণে বসে তিনি “জ’-কে জিজ্ঞাসা করলেন—“তুমি কি অমৃতাকে চেন? সে কেমন? তারপর তিনি একটা বই ওকে দিয়েছেন তার উপর বাংলায় লেখা আছে—‘তোমার কি মনে আছে অমৃতা, যদি থাকে তাহলে কি ক্ষমা করতে পার?

তা জ’ তো ওদের ভাষা জানে না, ও বই পড়বে কি করে, তাই বইটা আনে নি। আর একজন মন্তব্য করলে—তা আনতেই পারত, আমরা একটু দেখতাম। ঘরে অনেক লোক, সবাই মিলে খুব হাসাহাসি হচ্ছে। হা ভগবান, মানুষকে নির্যাতন করতে সবাই আনন্দ পায়—শত্রু মিত্র নেই! যাদের বন্ধু ভাবতাম তাদের নিষ্ঠুরতা দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি! আমার মাথা ঘুরছে—দীর্ঘ চল্লিশ বছর পরে এই আমি প্রথম একজনের কথা শুনলাম যে ওকে দেখেছে, যার সঙ্গে সে আমার কথা বলেছে। আমি শুনতে পাচ্ছি ঘরে কেউ একজন বলছে—“অমৃতাদি আপনি একটা চিঠি লিখুন না তাকে। ঠিকানাটা আনিয়ে দেব ‘জ’র কাছ থেকে। লিখুন লিখুন খুব মজা হবে।”

আমার মনে হচ্ছে আমার আঁচলে আগুন ধরে গেল, এখনি সারা গায়ে আগুন ছড়িয়ে পড়বে। এখান থেকে পালাই আমি।

কথাটা কিন্তু মনের ভিতরে ঘুরতে লাগল–এবার একটা ঠিক ঠিকানা পাওয়া গেছে, লিখিই না কেন একটা চিঠি। আমায় তো ভুলে যায় নি তাহলে। একটু যোগাযোগ করলে দোষ কি? আমরা দুজনেই বৃদ্ধ মানুষ। যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, কেমন আছ? তবে ক্ষতি কি?

এই সময়ে আমাদের অনেক কাজ। বাংলাদেশের যুদ্ধ চলছে—সারা পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল, সকলেই কর্মব্যস্ত, আমরাও। এর মধ্যে এই হালকা কথা কোথায় ভেসে গেল কে জানে। মানুষের চূড়ান্ত দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে শৌখীন সুখদুঃখগুলি কি অর্থহীন বোধ হয়! হাজারে হাজারে, লক্ষে লক্ষে গৃহহীন, অন্নহীন, বস্ত্রহীন মানুষ ছুটে আসছে আশ্রয়ের সন্ধানে, তাদের যন্ত্রণার উত্তাপ আমাদের গায়ে লাগছে। সীমান্তে আমরা রোজ যাই, সেখানে কলেরা। লেগেছে। আশ্রয়শিবিরের আশেপাশে মৃতদেহ পড়ে থাকে রোজই। একদিন একটি শিবিরের সামনে পথের উপরে আমার বয়সী একটি নারীর মৃত্যুশয্যা দেখলাম। গাছের তলায় ছিন্ন কাঁথার উপর পড়ে আছে প্রায় স্পন্দনহীন দেহ। মাঝে মাঝে খিচুনি উঠছে। কর্মীরা ঐ। পথের মাঝখানেই তাকে স্যালাইন দিচ্ছে—একটু পরেই সব শেষ হয়ে যাবে। তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে—পশ্চিমের আকাশে রঙীন রক্তরেখা—উদাসীন এই বিশ্বসৌন্দর্যের মাঝখানে একটা মানুষের জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে, দীপটা নিবে যাবে। কাল এসময় কোনো চিহ্ন থাকবে না, এ যে একদিন পৃথিবীতে এসেছিল, এর যে কেউ ছিল, এ যে কাউকে ভালোবেসেছিল, ভালোবাসা পেয়েছিল, তার কি কোনো অর্থ আছে তাহলে? ঐ মৃত্যুপথযাত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে আমি যেন আমার নিজের মৃত্যুশয্যা দেখতে পেলাম। যত দূর মনে হয় আমি পথের মধ্যে শুয়ে থাকব না, পালঙ্কে আত্মীয়-স্বজনবেষ্টিত হয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করব। কিন্তু তার পরে? ঐ দেহও যা আমার দেহও তাই, কোনো চিহ্নই থাকবে না। শ্মশানবৈরাগ্য আমার মনকে অভিভূত করেছে। আমার চোখ জ্বালা করে জল আসছে–সবাই ভাবছে আমি..করুণায় কাতর। রশিদ বললে, “মাসীমাকে এখান থেকে নিয়ে যা—আপনি বনগাঁয় চলে যান।”
এদিকে আমি কাঁদছি আমার নিজের মৃত্যুশোকে, এই তো ফুরিয়ে যাব। যা পেয়েছি, যা পাই নি সবই এক হয়ে যাবে—সোনা আর ধুলো এক। এই ক’দিনের জন্য পৃথিবীতে এসে মানুষ মানুষকে কত কষ্টই দিচ্ছে, সুখ কতটুকু দিতে পারে—যন্ত্রণা দেয় সীমাহীন। হঠাৎ যেন আমার মৃত্যুশয্যার পাশে ওকে দেখতে পেলাম। গাড়িতে ফিরতে ফিরতে সেই অদ্ভুত পরিবেশে আমাকে ওর চিন্তা পেয়ে বসল। এই তো ঠিকানা পাওয়া গেছে, লিখিই না একটা চিঠি, এতদিন হয়ে গেল এখন তো আর অন্য কিছু নয়, পুরানো বন্ধুকে একটা চিঠি লেখা যায় না? কিন্তু পার্বতীর কাছে ঠিকানা কি করে চাইব? সে কি ভাববে? যা খুশি ভাবুক, কি এসে যায়! মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে সব লজ্জাসঙ্কোচ আঁকড়ে ধরে এতদিন পড়ে আছি, সব অলীক বোধ হল। কেউ নিন্দা করলে বা মন্দ ভাবলেও আমি দুঃখিত হব না। পরদিন চিঠি লিখলাম, ‘ভাই পার্বতী, তোমার কাছে অধ্যাপক ইউক্লিডের ঠিকানাটা থাকলে দিও।’ ঠিকানা এল, সঙ্গে ‘জ’র চিঠি। সে লিখেছে, “ইনি অত্যন্ত ভালো লোক এবং ভারতেই ওর জীবন পড়ে আছে, কলকাতা ওর স্বপ্ন এবং এর বিদ্যার খ্যাতি ভুবনজোড়া। বিদ্যার খ্যাতি শুনে আমার মনটা বিকল হয়ে গেল। নিছক পাণ্ডিত্যে আমার শ্রদ্ধা নেই—এই সব লোভেই তো…যাক গে সেসব কথা, পরে কি হয়েছে তা দিয়ে আমার দরকার কি, আমি যাকে চিনি তাকে চিঠি লিখি না কেন, একটা চিঠি লিখে দেখি উত্তর দেয় কি না। আমি লিখলাম—

মির্চা ইউক্লিড, তুমি ‘জ’র কাছে আমার কথা জিজ্ঞাসা করেছ শুনলাম—আমি জানতে চাই তুমিই সেই ব্যক্তি কিনা, যাকে আমি চল্লিশ বছর আগে চিনতাম—যদি তাই হও তাহলে চিঠির উত্তর দিও। ইতি—অমৃতা

চিঠির উত্তর এল না। আমি অপেক্ষা করলাম, সন্দেহ হল ঠিকমত পোস্ট হয়েছে কিনা—ঐ সঙ্গে লেখা বিদেশ থেকে অন্য চিঠির উত্তর এল, ও চিঠিটার উত্তর এল না। যাকগে। অনেক কাজ আছে। অনেক চিন্তা আছে। অনেক সমস্যা আছে, যা আমাকে ভাবতে হচ্ছে, এই একটা বাজে কথা ভেবে লাভ নেই।

এই উনিশ শ’ একাত্তর সালেই আবার একবার ওর বইয়ের কথা শুনলাম। ইয়োরোপ থেকে সে সময়ে অনেকেই আসছেন বাংলাদেশের যুদ্ধ দেখতে, সমবেদনা জানাতে, সাহায্য করতে ও কৌতূহল মেটাতে। আমাদের প্রতিষ্ঠানের কাজও দেখছেন অনেকে। একটি বাঙালী দম্পতি ঘুরছেন আমাদের সঙ্গে, এঁরা ইয়োরোপে থাকেন। আমি এদের তেমন চিনি না, মেয়েটির নাম রিণা, অল্পবয়সী মেয়ে অনেক ভাষা জানে, ওদের ভাষাও জানে। মাঠের মধ্যে বসে আছি আমরা, সঙ্গীরা এদিক ওদিক-হঠাৎ রিণা আমায় বললে, “একটা বই পড়েছি তাতে আপনার নাম আছে, সে কি আপনারই নাম?” আমি চকিতে চারদিকে দেখে নিলামবঁাচা গেল কেউ নেই কিন্তু রিণার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না—সেও আর কথা বাড়াল।

আমাদের কর্মস্রোত উত্তাল হয়েছে। বিবিধ বিচিত্র সমস্যার সামনে পড়েছি। প্রতিদিন নূতন নূতন লোকের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে। ঘর এবং বাহির এক হয়ে গেছে, ঘরেও প্রতিদিন শত লোকের যাতায়াত। কর্ম যখন বিপুল আকার, গরজি উঠিয়া ঢাকে চারিধার’ সেই কর্মের গর্জন আমরা শুনছি। এমন বাচার মত বাচা যেন আর কোনোদিনও হয় নি। এই কর্মবিমুখ আলস্যজড়িত দেশে আমরা অনেকেই এমন কাজের মত কাজ পেয়েছি যাতে নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃশেষ করে দিয়েও আশ মিটছেনা, এখন তুচ্ছ ব্যক্তিগত কথা কতক্ষণ মনে থাকবে?

এই সময় থেকে অর্থাৎ উনিশ শ’ একাত্তরের শেষ দিক থেকে অকারণ আমার মনে কেবলই একটা আকাঙ্ক্ষা ফিরে আসে, ভাবি দূরে কোথাও যাব। কত লোককে যে বলেছি আমি বাইরে কোথাও যাব। কর্মসূত্রে বিদেশীদের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হচ্ছে, তাদের বলি তোমার দেশে তো শীঘ্রই যাব। আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাই কেন এই আকাঙ্ক্ষা, এর কারণই বা কি আর এর এত জোরই বা আসছে কোথা থেকে। আমার অবস্থা সেই রকম, ‘মোর ডানা নাই আছি এক ঠাই সে কথা যে যাই পাসরি।‘

উনিশ শ’ বাহাত্তর সালের আগস্ট মাসে সেরগেই সেবাস্টিয়ান কলকাতায় এসেছিল, এই কাহিনীর আরম্ভে যার কথা বলেছি। ১লা সেপ্টেম্বর সকালে যখন তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, মনে একটা কৌতূহল মাত্র, দেখি ওর কথা কি বলে—এইটুকু, কিন্তু তার সঙ্গে কথা বলে আমি অবাক হয়ে গেছি। মির্চা সম্বন্ধে আমার সংশয় অনেক আছে—কিন্তু ও যে এমন ভয়ানক মিথ্যাবাদী তা তো আগে বুঝতে পারি নি।

“কি জঘন্য মিথ্যা—ছি ছি, এত নীচ তোমার বন্ধু আর তারই গুণগান করছ?”

“আমি তার শিষ্য, সে আমার গুরু, আমি তার চেয়ে অনেক ছোট।”

“ভালো গুরু তোমার, নিজে অপরাধ করে পালিয়ে গিয়ে আবার আমার উপর প্রতিশোধ নিয়েছে, আমায় কলঙ্কিত করেছে।”

সেরগেই বলছে, “তুমি তো জানো না সে কি কষ্ট পেয়েছে, যদি তুমি ওর লেখা পড়তে তবে বুঝতে ওর যন্ত্রণা। কল্পনায় সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি খুঁজেছে। বইটা ছুঁলে রক্ত পড়ে।”

“এ সমস্ত কোনো ব্যাখ্যাতেই তার দুষ্কীর্তির ক্ষমা হয় না, জীবনে যে আমাকে কিছুই দেয় নি, সে শুধু কলঙ্ক দিয়েছে! নাম করে কেউ লেখে সেরগেই?—সেটা তো libel হয়ে যায়!”

“ওটা তো গল্প—গল্পের জন্য কিছুটা তো বানাতে হয়—অবশ্য ঠিকই যে ভারত এখনও এসব বিষয়ে একই আছে!”

“নাম করে লিখল কেন, আমাকে অপমান করবার জন্য?”

সেরগেই দুঃখ পাচ্ছে—“তুমি ওকে ভুল বুঝছ—ওর ভালোবাসাটা ভুলে গেলে? উনি এখনও তোমায় ভালোবাসেন, ওর অধিকাংশ লেখাতেই কোথাও না কোথাও তোমার ঘেঁয়া আছে-উনি যে ভারতীয় হয়ে গেলেন সে কি তোমার জন্য নয়? তিনি কি তোমার নামের বন্ধন কাটাতে পারেন?”

“এতই যদি ভালোবাসত তবে চিঠির উত্তর দেয় না কেন?”

সেরগেই চমকে উঠেছে—“দেয় না? তুমি চিঠি লিখেছ-“উত্তর পাও নি? ক’টা লিখেছ?”

“আমি তিনটে চিঠি লিখেছি। প্রতি কুড়ি বছর অন্তর একবার করে আমার অস্তিত্ব স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। উত্তর পাই নি।”

সেরগেই মাথা নীচু করে ভাবছে—“সে আত্মপীড়ন করে, he works against his heart—যা তার ইচ্ছা করে তার বিপরীত কাজ করেন, এই তাঁর স্বভাব। নিশ্চয় ওঁর খুব ইচ্ছে হয়েছে তাই লেখেন নি।”

আমি চুপ করে আছি। আমার ওর চরিত্রের এই দিকটার কথা মনে পড়ছে—কি জানি ওর মনে কি আছে, রহস্যময় মানুষ—যে তার দেশের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়েছে সে আমার এই মিথ্যা পরিচয় দিল কেন—একদিকে অসহ্য রাগ হচ্ছে, অন্যদিকে মনে পড়ছে তার অস্তিত্ব, তার স্মৃতি। আমি বলছি, “সেরগেই তার সঙ্গে আর কোনোরকমে দেখা হয় না?”

“হবে না কেন? এই পৃথিবীতে তোমরা দুজনেই বেঁচে আছ—কোনো না কোনো দিন দেখা হবেই হবে।”

আমি ভাবছি হা ঈশ্বর ওকে যে আবার দেখতে ইচ্ছে করছে।

“আচ্ছা সেরগেই আমি যদি ওর সঙ্গে দেখা করতে যাই ও দেখা করবে?”

“নিশ্চয়, তোমার সঙ্গে দেখা করবে না, ওর মন তো এদেশেই পড়ে আছে।”

সেরগেইর সঙ্গে কথা বলছি আর এবার বুঝতে পারছি সূক্ষ্ম শরীর আমার স্থূল দেহ থেকে বেরিয়ে গেছে—আমি আর এখানে নেই—অর্থাৎ আমি আমাকে পরিষ্কার দ্বিধাবিভক্ত দেখতে পাচ্ছি।

আমি বাড়িতে ফিরে সেই উৎসবের দিনটি কোনো রকমে পার করে দিলাম, সে কথা আগেই বলেছি কিন্তু ক্ষণে ক্ষণেই আমি বর্তমান থেকে অতীতে প্রবেশ করছি। একটি একটি দিন আবার পার হচ্ছি, প্রত্যেকটি ঘটনা যেন আবার ঘটছে। আমি এতক্ষণ যা লিখলাম তার প্রত্যক্ষ অনুভূতি হয়েছে আমার। এটা সহজে হয় নি। একই সময়ে দুই অবস্থায় বাস করার মানসিক যন্ত্রণাকে বাক্যে রূপ দেবার ভাষাই আমার নেই! একদিকে আমার বর্তমান জীবন তার পরিপূর্ণ দাবী নিয়ে উপস্থিত—অন্যদিকে আমার আর একটা অস্তিত্ব যেন এক ছায়ামূর্তিতে আমার সত্তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, আমার প্রত্যেক মুহূর্তকে স্পর্শ করছে। আমার মনটা যেন একটা তারের বাজনার মতো হয়ে গেছে একটু ছোয়া লাগলে ঝন ঝন করে বেজে উঠছে। ক্রমে ক্রমে এমন হচ্ছে যে পিছনটাই সামনে আসছে—আমি নিজেকে নিয়ে কি করব ভেবে পাচ্ছি না।

একেক দিন এমন অবস্থা হয় যে সকলের কাছে অপ্রস্তুত হয়ে যাই। ছেলে এসে একটা কিছু জিজ্ঞাসা করছে শুনতেই পেলাম না। একদিন আমার স্বামীর সঙ্গে একটা কর্মস্থলে যাচ্ছি, কুড়ি মাইল পথ গাড়িতে চলেছি—সচরাচর আমিই কথা বলি উনি উত্তর দেন, সেদিন উনি হয়ত দু’একটা কথা বলবার চেষ্টা করেছেন, উত্তর না পেয়ে চুপ করে গেছেন। যখন গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছি, বুঝলাম আমি কোনো কথাই বলি নি—আমার স্বামীকে বললাম, “এতদিন তুমি চুপ করে থাকতে, এবার আমি চুপ করলাম।”

তিনি বললেন, “তাই তো দেখছি, কম্পিটিশনে হারিয়ে দিলে!”

একেক দিন সকাল হচ্ছে আবার কখন রাত্রে পৌঁছে যাচ্ছি বুঝতেই পারি না। রাত্রিটা ভয়ঙ্কর, অতি ভয়ঙ্কর—ভয়ঙ্কর এই অগ্নিদাহ—আগুন জ্বলছে, ক্রোধের আগুন, একটা কিছু প্রতিকার আমায় করতেই হবে। আমি যখন জেনেছি তখন মুখ বুজে অন্যায়কে সহ্য করে নেব না। ওদের দেশে আমার এক বন্ধু থাকে তাকে আমি লিখেছি—চিঠিটা এই রকম—

সুমিতা, তুমি নিশ্চয় ইউক্লিডের লেখা পড়েছ, এতদিন আমায় জানাও নি—সেগগেইর কাছে সব শুনলাম। ঐ ব্যক্তি আমার বাবার ছাত্র হয়ে আমাদের বাড়িতে ছিলেন, আমাদের কাছে উপকৃতও হয়েছিলেন, তারই শোধ নিয়েছেন—তুমি এর একটা প্রতিবাদ লিখবে। ভারতীয় নারীর মর্যাদা যাতে নষ্ট না হয় সেটা দেখা তোমারও কর্তব্য। এই চিঠিটা আমি লিখেছি কিন্তু আমি জানি অভিযোগটা বাহ্যিক, আমার মনের গভীরে যে পরিবর্তনটা চলেছে তার রূপ তার প্রকৃতি অন্য। সুমিতা লিখল,..‘আমি সেরগেইকে বার বার অনুরোধ করেছিলাম আপনার কাছে বইটির নাম উল্লেখ না করতে। তিনি অত্যন্ত fixed idea-র লোক তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারি নি এখনো, অর্থাৎ আপনার সঙ্গে দেখা হবার পরেও

যে, এ আলোচনা আপনার কাছে প্রীতিপদ হবে না। আপনার রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মধারায় জগতে নানারকম চরিত্র দেখা অভ্যাস আছে—নিজগুণে মার্জনা করে নেবেন। আপনি খুব বিচলিত অবস্থায় চিঠিটা লিখেছিলেন বুঝতে পারছি-স্বাভাবিক।…সেরগেই যাই বলুন এখানকার দু একজন সাহিত্যিক বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করেছি, তারা আমার সঙ্গে একমত যে আপনার identity disclose করাটা অসঙ্গত হয়েছে। চল্লিশ বছর হয়ে গেছে, ও বই আর কারু মনে নেই। আপনার পরিবারের কারুর পক্ষেই ঐ বইয়ের বিষয়বস্তু জানার সম্ভাবনা নেই।

সুমিতার চিঠিটা হাতে করে আমি ভাবছি এই মেয়ে আমায় সান্ত্বনা দিয়েছে—কারণ এ বই জীবন্ত—চল্লিশ বছর আগে লেখা হলেও এখনও জীবন্ত। সুমিতা আরো লিখেছে, এখন নূতন করে এ বিষয়ে কিছু লিখতে গেলে কাদা ঘোলানো হবে। কোনটা কাদা এর মধ্যে? কাদা তো ছিল না সেই নির্মল বালিকাহৃদয়ে, কোনো কাদা ছিল না-কাদা যা তা ঐ ব্যক্তি তার কল্পনায় সৃষ্টি করেছে।

দিনের পর দিন রাতের পর রাত আমি ভাবছি কি করে আমি এই অসত্যের গ্লানি থেকে আমার নামকে মুক্ত করব। সত্যের দায় আমি বইতে প্রস্তুত কিন্তু মিথ্যার দায় কেন নেব? আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করছি—তাদের না বলে আর উপায় নেই। তারা চমৎকৃত হয়ে গেছে, আমার জীবনে এ ঘটনা অপ্রত্যাশিত। আমি ওদের বলছি, অদৃষ্টের পরিহাসটা দেখো, এতদিন ধরে যে সংসার আমি গড়ে তুলেছি আমার স্বামী সন্তান আত্মীয় পরিজন নিয়ে, যারা আমার জীবনের সঙ্গে এক হয়ে গেছে তারা তো কোথায় চলে যাবে, আমার এই সত্যকার জীবনটা ছায়া হয়ে মিলিয়ে যাবে। সমস্ত সামাজিক বন্ধন এমন কি রক্তসম্পর্কও তো মৃত্যুর সঙ্গে শেষ হয়ে যায়, শূন্যে মিলিয়ে যায়, কিন্তু ও যে বন্ধন সৃষ্টি করেছে তা অচ্ছেদ্য। কি হবে পার্বতী, যে আমার কেউ নয় কিছু নয়, দীর্ঘ জীবনের যাত্রাপথে দু দণ্ডের দেখা হয়েছিল যে-আগন্তুকের সঙ্গে, তার পরিচয়টাই সবচেয়ে সত্য হয়ে থাকবে। জীবনে যে কোথাও নেই, মরণে তার সঙ্গে বাঁধা পড়ে থাকব—‘পরপুরুষের সনে বাঁধা পড়ে রবে নাম মৃত্যুর মিলনে।‘

অল্পবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমি টের পেলাম এ জগৎটা কত বদলে গেছে। এরা সত্যকে দেখতে শিখেছে। আমি যে ভেবেছিলাম আমার এই অসামাজিক এবং অসময়ের মনোবিকারে এরা আমায় দূষিত বস্তুর মত পরিত্যাগ করবে তা তো হলোই না, এরা আমায় ধারণ করে রইল, আমার জীবনের সত্যের আলোকে এদের কাছে আমি প্রিয়তম হলাম। আমাদের সময় এমন হত না। আজকের এই পরিবর্তন ভালো না মন্দ, আগে সমাজ বেশি পরিচ্ছন্ন, নারী বেশি সতী, প্রেম আরো পবিত্র ছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে—আমারও সন্দেহ ছিল, মনে হত স্বাভাবিক প্রবৃত্তিগুলিকে কঠিন সংযমের নিবর্তনে নিয়মিত করা মনুষ্যত্ব বিকাশের পক্ষে অপরিহার্য, তা না হলে পশুত্বের আক্রমণ থেকে তার উত্তরণ হবে না। একথার সবটা হয়ত ভুল নয়, কিন্তু প্রথা সংস্কার ও কঠিন নিয়মের নির্দেশেও যে মনুষ্যত্ব বিভ্রান্ত হতে পারে এদেশের সামাজিক জীবনে তার তো দৃষ্টান্তের অন্ত নেই, যে দেশে সতীত্বের প্রমাণ সহমরণে দিতে হয়েছে।

মানুষের সবচেয়ে বড় দিক তার সত্যানুসন্ধানী মন। তার অন্যান্য অনেক মনোবৃত্তি পশুরও আছে কিন্তু সত্যকে খুঁজছে কেবল মানুষই। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে সত্যানুসন্ধান তাকে আজ দুশো বছর বিচিত্র পথে এগিয়ে নিয়ে চলেছে, তার আলো কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের অরণ্যের মধ্যে পথের নিশানা দিচ্ছে। আজ আমার একটা চরম উপলব্ধির মুহূর্তে দেখছি সমাজের মধ্যেও এক অভাবনীয় পরিবর্তন। শাস্ত্রবাক্য, গুরুর বিধান, বহু পুরাতন ধারণা ও বিশ্বাসের আবর্জনা সরিয়ে এরা সত্যকে দেখতে চাইছে। এজন্য আমি বন্দনা করি এই যুগকে। এক অর্থে এ সত্য যুগ।

দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে, আমি জানি না কার কাছে এ বিপদে সাহায্য চাই—আর সেই দুর্ভেদ্য লোকটি বেশ চুপ করে কচ্ছপের ঢাকনায় হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন চিরটা কাল। তা থাক, কিন্তু কি করে ঠিক এই সময়ে অর্থাৎ তার অন্তর্ধানের চল্লিশ বছর পরে এত যোগাযোগ হচ্ছে কে জানে—আমার এক নিকট আত্মীয় ওদের দেশে গেল। খবরটা শুনেই আমি ভয় পেয়েছি—ভয়টা অকারণ নয়, ওখানে গিয়েই সে শুনেছে এবং খুব রেগেছে, কোনো ভদ্রলোক একাজ করে না দিদি, কোন জন্মে কি একটু ঘটনা ঘটেছিল তাই নিয়ে এরকম বই লেখা।

আমি শুনছি আর বুঝছি এ বই মৃত নয়, চল্লিশ বছর জীবিত আছে—এই দীর্ঘায়ু গ্রন্থ ক্রমে আরো বলবীর্য লাভ করবে যখন পৃথিবী আরো ছোট হয়ে যাবে। হায় হায় কতদিন থেকে আমি শুনেছি, কেন আমি এতদিন একবারও খোঁজ করলাম না কি আছে ঐ বইতে। নিজের নাম খ্যাতি ও অখ্যাতি সম্বন্ধে আমি যথেষ্ট সজাগ, কেউ যদি আমাকে বলে অমুক কাগজে আপনাদের সম্বন্ধে বা আপনার সম্বন্ধে এই খবর বেরিয়েছে বা অমুক মিটিঙে আপনি ছিলেন কাগজে ছবি দেখলাম তাহলে আমি তখনই সে কাগজ আনিয়ে দেখি।

দেখে আমার স্বস্তি হয় না। আর যদি কোনো মন্দ কথা দেখি তাহলে রেগে অস্থির হয়ে যাই, প্রতিবাদ লেখাবার জন্য লোকজন ডাকি। সেই আমি বার বার শুনে আসছি এই বইয়ের কথা, একবার আমার জানবার ইচ্ছাই হল না ওতে কি আছে? বাবা বেঁচে থাকতে জানলে এর বিহিত করতাম। বাবা তো জানতেনই, কিছুই করলেন না। বাবার তো ঐ, বই লিখেছে, ভালোই। বহুদিন পরে আমি বাবাকে উনিশ শ’ ত্রিশ সালের মতো ভালোবাসছি। তাঁকে ডেকে বলছি, দেখ বাবা তোমার শিষ্যর কাণ্ড দেখ, যে একলব্যর মত দূরে থেকে তোমায় গুরু বলে সাধনা করে গেল, সে আমার কি অবস্থা করেছে দেখ—তখন তুমি চেয়েছিলে এর হাত থেকে আমায় বাচাতে, পারলে কি?

সেরগেই বলেছে, জীবনে আপনাকে কিছুই দিতে পারলেন না বলেই সাহিত্যের মধ্যে তিনি তার অবিনাশী প্রেমকে অমর করতে চেয়েছেন। হায় ভগবান, মিথ্যা কি কখনো অমর হয়, মিথ্যা দিয়ে কি অমরত্ব সৃষ্টি হয়? আমি ভাবছি ঐ ব্যক্তি, যার স্মৃতি আমি মনের গভীরে গোপনে গচ্ছিত ধনের মতো রক্ষা করেছিলাম, যার নাম কেউ কোনোদিন আমার মুখে উচ্চারিত হতে শোনে নি, সেই আমাকে লোকের চোখের সামনে উলঙ্গ করে ফেলেছে। এবং যদিও আমার চিঠির উত্তর দেবার তার সাহস নেই, গত চল্লিশ বছর ধরে আমার মাংস বিক্রি করে টাকা করেছে। এই হচ্ছে পাশ্চাত্য দেশ! কিন্তু আমি কি করে তোমাদের বোঝাই যে এই ভয়টা ভাবনাটা মনের একটা স্তরের, এটাই আমার প্রকাশ্য মন নাড়াচাড়া করছে—আর গুহায়িত গহ্বরেষ্ঠ আর একটা ভাব আছে সেটা একেবারে অন্য।

দিনের পর দিন কাটছে, রাতের পর রাত আমি বিনিদ্র। আমার এত দিনের সংস্কার সম্ভ্রমবোধ সমস্ত যেন পুড়তে শুরু করেছে। একটা ভয়ের শিখা অন্তস্থল থেকে উঠে চারদিক দগ্ধ করতে করতে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। আমি একটু একটু করে গলে যাচ্ছি, মোমবাতির মতো গলছি, আমার দেহমন জুড়ে আলো ছড়িয়ে পড়ছে আর বিন্দু বিন্দু করে গলে যাচ্ছে, পুড়ে যাচ্ছে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমার অহং, আমার দর্প, সাধুতার গর্ব, আমার সম্মানস্পৃহা—এতদিন যা কিছু মূল্যবান বলে ভেবেছি সবই ঐ শিখার মুখে জ্বলছে— এই অনির্বচনীয় অবস্থা শুধু গানেই বলা যায়—‘সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে। আমি বুঝতে পারছি যুগযুগান্তরের সংস্কার দিয়ে গড়া আমার এই অহংটা সত্যিই একটা মোমবাতির মতো ছিল, শক্ত ঋজু অনমনীয়, আজ ভয়ের ঐ তীব্র শিখাটা তাকে একটু একটু করে গলিয়ে ফেলেছে কিন্তু ওটা কি ভয়ের শিখা? পাছে আমার অখ্যাতি হয় সেই ভয়? আমি কি লোকনিন্দার ভয়ে কাতর? গভীর রাত্রে উর্ধ্ব আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আমি বুঝতে পারছি তা নয়, তা নয়, ভয়ের পিছনে যে নিশ্চল দাঁড়িয়েছিল সেই ভয়কেও গলিয়ে দিচ্ছে, সে প্রেম, অবিনাশী প্রেম, ও তারই জ্যোতির্ময় শিখা, সে আমার ভয়কেও গলিয়ে ধ্বংস করে দিয়ে দীপ্যমান হয়ে রইল। মাসের পর মাস আমি জ্বলতে লাগলাম, সব পুড়ছে আমার, এমন কি বয়সও। আমি যেন একেবারে উনিশ শ’ ত্রিশ সালে ফিরে গেছি। তেমনি প্রত্যক্ষ, তেমনি সত্য হয়ে উঠেছে আমার অনুভূতি। প্রেমের আলো আমার অন্তরের গভীরে প্রবিষ্ট হচ্ছে, তার সমস্ত কোণায় কোণায় অন্ধকার গলিতে গলিতে আলো জ্বলে উঠেছে, আর ভয়ের গর্বের সংস্কারের অন্ধকার দূরে হয়ে যাচ্ছে। যা কিছু ভান করেছি, নিজেকে বড় করতে চেষ্টা করেছি, যা কিছু নিয়ে আমার অহংকার, সব মিলিয়ে যাচ্ছে, ক্ষয়ে যাচ্ছে, সত্যের পূর্ণ মূর্তি দেখতে পাচ্ছি আমি। আমার জীবন এক নূতন অর্থে অর্থবান হচ্ছে। আমার ওকে মনে পড়ছে, ওর অধবিস্মৃত মুখ, ওর কথা, ওর অনেক দুর্বোধ্য ব্যবহার, ওর রাগ, ঈর্ষা, সর্বোপরি ওর প্রেম। ক্রমে ক্রমে আমি যেন এক অন্য স্তরে চলে গেলাম, এ এক অন্য অস্তিত্ব, যেখান থেকে এ জগতের ভালোমন্দ সত্যমিথ্যা কল্পনা ও ঘটনা এই বর্হিজগতের সমস্তই এক হয়ে যায়। আমার মন বলছে এ সবে কি এসে যায়, নিন্দা প্রশংসা সবই সমান, তার চেয়ে সত্য কিছু আছে। আমি ভাবছি কেন সে এমন করে এই মৃত্যুহীন প্রেমকে বিফল করল? চলে যেতে হয়েছিল তাতে কি? শরীরে কাছে পাওয়াই কি একমাত্র পাওয়া? যদি দশ বছরেও আমরা একটা চিঠি আদানপ্রদান করতে পারতাম—তাহলে? তাহলেই যথেষ্ট হত, যথেষ্ট। সেই একটা চিঠি দিয়েই আমরা পার হয়ে যেতাম আমাদের মধ্যের মহাদেশের ব্যবধান, বিচ্ছেদের অতলান্ত মহাসাগর। সেই একটা চিঠি দিয়েই আমরা অর্ধনারীশ্বর হয়ে যেতাম, আমাদের যুগ্মসত্তা একটি মিলিত বৃত্তে পেত সম্পূর্ণতা। কিন্তু ওরা কি এসব বোঝে? বোঝে না, বোঝে না, ওদের দেশে প্রেমকে পূর্ণ করবার জন্য এক বিছানায় শুতেই হবে! হা ঈশ্বর!

কিন্তু ও তো জানত জানতই ঠিক, আমি আমাকে একটা দরজার মাঝখানে ছবির মতো ওর বক্ষলগ্ন দেখতে পাচ্ছি, ও বলছে, “তোমার শরীরকে নয় অমৃতা তোমার শরীরের ভিতরে তোমার আত্মাকেই আমি ধরতে চেয়েছি–”

একথা সত্য, সত্য, শরীরের স্থায়িত্ব নেই, আত্মা অমরন হন্যতে হন্যমানে শরীরে। কোথায় সেই শরীর আমার? সেই যৌবননিকুঞ্জ শুকিয়ে গেছে—জীর্ণ বৃদ্ধ এই মাথায় বরফ পড়েছে, মুখে বলিরেখা—অথচ আমি তো এই জীবনের পরম অনুভূতিকে তেমনি অক্ষয় দেখতে পাচ্ছি। একে কেউ ধ্বংস করতে পারে নি, না আমার পিতা, না ও নিজে, না কাল, না আমার অহংকার, না আমার জীবনের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা। অমরত্বের অনুভব হচ্ছে আমার–

য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্‌
ঊভৌ তৌ ন বিজানীতে নায়ং হন্তি ন হন্যতে।

যে কথা কোনো দিন কোনো শাস্ত্র পড়ে বুঝতে পারতাম না, পারি নি, সে কথা এত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—মরে না, মরে না, প্রেম মরে না, ভবানীপুরের বাড়ির দরজার কাছে ওর দুই হাতে বিধৃত আমার আত্মা এখনও স্থির আছে, এই তো অসীম সীমার মধ্যে তরঙ্গিত, এই তো আমি দূরে এবং নিকটে, এখানে অথচ এখানে নয়!

আমি অবিশ্বাসী। আমি নাস্তিক। কোনো কুসংস্কারে আমার আস্থা নেই—কিন্তু আমার শরীর মনে যা ঘটছে আমার অবিশ্বাসের ভিত টলিয়ে দিচ্ছে—কেউ আমাকে বলুক আমি কি? আমার সেই ষোল বছরের সত্তার দেহহীন অস্তিত্ব কোথায় বাস করছিল এতদিন?

আমি সুমিতাকে লিখলাম, তোমাদের আর প্রতিবাদ লিখতে হবে না। আমার কাছে এখন এ সব ক্ষুদ্র সত্যমিথ্যা এক হয়ে গেছে। আমি আর কিছু চাই না, কিছুই নয়, শুধু একবার ওকে দেখতে চাই। এতদিন রেখেঢেকে লিখছিলাম, এখন জানাচ্ছি এই প্রেম পরম সত্য, এর কাছে আমার আজকের বাস্তব জীবন ছায়া হয়ে গিয়েছে—ওর যা খুশি লিখুক, সম্মানই হোক আর অসম্মানই হোক জীবনে এইটুকুই তো স্বীকৃতি দিয়েছে আমায়—ওর দেওয়া অপবাদও আমি মাথা পেতে নিচ্ছি।

তুচ্ছ ভয়টা আমার কেটে গিয়েছে কিন্তু আমি অবসাদে ভুগছি। সমস্ত জীবনটা যেন আমার হাত থেকে খসে পড়ে গেল—আমি শূন্য হাতে বসে আছি। আমি সেরগেইকে লিখলাম—“আমার মনে হয় সময়ের সমুদ্রতীরে এমবারকেশন কার্ড হাতে নিয়ে বসে আছি কিন্তু জাহাজ আসছে না। কতদিন আমি অপেক্ষা করব ভাই, ওকে না দেখে আমি মরতে পারব না।’

সুমিতার চিঠি পেলাম, ও লিখছে—

‘আপনার চিঠি পেয়ে কয়েকদিন এত অভিভূত ছিলাম যে কি লিখব ভেবে পাই নি। সেরগেইয়ের সঙ্গে কথা হল, সেদিন বললাম, truth is stranger than fiction! লেখক যখন ঐ উপন্যাসটি লিখেছেন, তখন কি জানতেন ভবিষ্যতের সত্য বর্তমানের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাবে। ঐ বইটির বিরুদ্ধে যত অভিযোগ ছিল তুলে নিচ্ছি। সত্যি কথা বলতে কি উপন্যাসের শেষ অংশ ট্র্যাজিক কিন্তু আজকের ট্র্যাজিডি তার চেয়ে বড়। মানুষের জীবনশিল্পীর হাত আমাদের হাতের চেয়ে অনেক পাকা।…

সুমিতা আরও লিখেছে, ‘অনধিকারচর্চা যদি ক্ষমা করেন তো একটা কথা বলতে চাই—আপনি লিখেছেন এই অনুভূতি এত প্রবল যে আপনার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত ভেসে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনার অন্তরের মধ্যে বসে যিনি সত্যকে স্বীকার করার নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন?

বিনিদ্র রাত্রে আমি সেরগেইর সঙ্গে কথা বলি—সত্যিই সেরগেই তুমি কোথা থেকে পাতাল ফুঁড়ে উঠে আমার জীবনটাকে ওলটপালট করে দিলে? যে ক্ষতর মুখটা চল্লিশ বছর ঢাকা ছিল, আমি শান্তিতে, সুখে ছিলাম, আজ তার ঢাকনা খুলে গেল। এখন রক্তক্ষরণ বন্ধই হয় না, রক্তে ভিজে যাচ্ছে আমার বিছানা-বালিশ, আমার বিনিদ্র রাত্রির আকাশ রক্তে লাল হয়ে গেল–

চোখ চেয়ে দেখি আমার স্বামী বিছানায় বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন—তাঁর চোখে জল—“তোমার কি হয়েছে আমায় বলবে না?”

এঁকে বলতে হবে, অনেকদিন থেকে আমার বন্ধুরা বলছে, ওঁকে বলুন। আমার বন্ধুরা সকলেই আমার স্বামীকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে। তারা বরাবর বলছে, উনি খুব সহানুভূতির সঙ্গেই চেষ্টা করবেন আপনার সন্তাপ দূর করতে। কিন্তু আমি ইতস্তত করছি। আমি ভাবছি ওকে কষ্ট দেওয়া হবে। আমার কি অধিকার আছে এঁকে কষ্ট দেবার। কষ্ট কি না হয়ে পারে? আমাদের আটত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে যার অস্তিত্ব একে এক মুহূর্তের জন্য স্পর্শ করে নি, যার নামটাও ওর জানা নেই—অদেখা অজানা সেই ব্যক্তি কি হঠাৎ কোনো গুহা থেকে বেরিয়ে আসবে, বোতলের মুখটি ফাক হতেই যেন একরাশ কুণ্ডলীকৃত ধোয়া আকাশবিলম্বী হয়ে দৈত্য হয়ে গেল? এ সংসারের সঙ্গে যার কোনো যোগ নেই, যার কোনো চিহ্নই আমার চারপাশে কেউ দেখে নি, তেতাল্লিশ বছর আমি যাকে চোখে দেখি নি, বাল্যকালের সেই স্মৃতি কি আজ এত বাস্তব হয়ে ওর এতদিনের সংসারকে টলিয়ে দিচ্ছে? এটা কি উনি সহ্য করতে পারবেন? এই সব ভেবেই আমি বলি নি। গোপন করার জন্য নয়। কোনো কিছু গোপন করার মতো আমার মনের অবস্থা নয়। বাস্তব সংসার আমার কাছে মরীচিকার মতো হয়ে গেছে।

“আমি তোমাকে বলতে চাই, কিন্তু তোমার কষ্ট হবে।”

“তোমাকে কষ্ট পেতে দেখে, আরও কষ্ট হচ্ছে।”

তখন আমি আমার স্বামীকে সমস্ত বললাম। উনি স্তম্ভিত হয়ে গেছেন, “এই আটত্রিশ বছর আমরা পাশাপাশি আছি আমি কিছু জানতে পারি নি? তুমি আমায় বল নি কেন গো, বল নি কেন? এত কষ্ট পাবার তো কোনো দরকার ছিল না।”

আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। এরকম পরীক্ষায় কি কেউ পড়েছে কখনো। ইনি আমার জন্য এত করেছেন, আমাকে এত ভালোবাসেন, আমার সুখই ওর সুখ আর আজ এই বৃদ্ধ বয়সে আমি কিনা এঁর মাথায় আকাশ ভেঙে ফেলতে উদ্যত। যে সব দিয়েছে, সে কি দেখবে সে কিছু পায় নি, তা নয়, তা কখনই নয়, আমি কাঁদছি “বিশ্বাস করো আমি তোমায় ঠকাই নি।”

“সে প্রশ্নই ওঠে না, সে কি তোমাকে বলতে হবে, আমার কোনো বঞ্চনা কোথাও নেই, কখনো এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় নি যে এর চেয়ে বেশি কিছু হতে পারে।”

উনি এখন অনেক কথা বলছেন, “আমি যা পেয়েছি তা অতুলনীয় অতুলনীয়, আমার কোনো ক্ষোভ নেই, শুধু দুঃখ এই তুমি এত কষ্ট পেলে। আর সেই ভদ্রলোক তাঁর জন্যই বেশি খারাপ লাগছে আমার।”

“ওর কথা ছাড়, প্রবঞ্চক, উচিত শাস্তি হয়েছিল।”

“ছিঃ, ও রকম করে ভাবলে তুমি শান্তি পাবে? শত হলেও তুমি তোমার মা বাবার কাছে ছিলে—আর বিদেশী একটি ছেলে, ঐ সামান্য বয়স, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাড়িয়ে দিলেন, সে বনেজঙ্গলে ঘুরতে লাগল, কি কষ্ট! তোমার বাবাকে ক্ষমা করা যায় না সত্যি।”

উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, আমি অবাক হয়ে দেখছি উনি কোনো ক্ষয়ক্ষতি অনুভব করছেন না। ক্ষয়ক্ষতি ওর হয়েছে কি?

“বিশ্বাস কর গো আমি এতদিন কষ্ট পাই নি, কষ্ট পেলে কি তুমি টের পেতে না? এই তো, পেলে।”

“তা ঠিক, কষ্ট পাও নি, আমি তো তোমায় কখনো কষ্ট পেতে দেখি নি।”

“কষ্ট যদি পেতাম, তাহলে তুমি কি সুখী হতে পারতে?”

“তা তো ঠিকই—তবে এই অর্ধশতাব্দী পরে তোমার কষ্ট হচ্ছে তার জন্য? কি আশ্চর্য কথা বলছ গো?”

“হাঁ তাই, আমিও কম অবাক হই নি, একেক সময় আমার মনে হয় আমার মাথা খারাপ হয়ে যায় নি তো, এরকম কখনো হয়! আমার খুব অন্যায় হচ্ছে, তাই না? বল বল আমায়।” আমি কাঁদছি, কাঁদছি, অনেক দিন পরে স্বামীর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে পেরে আমি যেন খোলা বাতাসে এসেছি—আমার কান্নাটা তাই মুক্তি।

“কি বলব তোমাকে ন্যায় কি অন্যায়, এমন ঘটনা কি আমি জীবনে দেখেছি, না শুনেছি, না জানি, আমি এর বিচার করবার কে? আমার দুঃখ শুধু এই যে, তোমার এত কষ্ট আমায় দেখতে হচ্ছে। কিন্তু জানো আমার মনে হয় তোমার ভালোই হবে, আমি বরাবর দেখে আসছি তোমার জীবনের ভিতরে একটা উদ্দেশ্য কাজ করছে।”

আমার স্বামীকে বলে আমি শান্তি পেলাম। কারণ ওর চেয়ে বড় সুহৃদ আমার আর কে আছে? আমার সকল অপরাধের ক্ষমা, সকল দুঃখের সান্ত্বনা ওর কাছে ছাড়া আর কোথায় পাব?

এই সময়ের কথা লেখা খুব কঠিন, কারণ লেখবার কোনো ঘটনা নেই—ব্যাকুলতা শুধু কবিতায় বা গানে প্রকাশ করা যায়, অন্য কোনো উপায়েই নয়। আমি আবার বহুদিন পর কবিতা লিখছি, গভীর রাত্রে যখন ঘুম হয় না আমি পাশের ঘরে বসে কবিতা লিখি। কোনো দিন তো ওর বিষয়ে কিছু লিখি নি। প্রথমে যা লিখেছিলাম ছিঁড়ে ফেলেছি, এখন লিখব, স্বীকৃতি দেব, স্বীকৃতি দিই নি বলেই এই দুর্ভোগ হচ্ছে আমার, আর কিছুই নয়। যার যা পাওনা চুকিয়ে দিতেই হবে।

সেরগেইর একটা চিঠি পেলাম—ওদের চিঠির পথ চেয়ে থাকি আমি, মনে হয় যেন ওরই খবর পাচ্ছি।

প্রিয় অমৃতা দেবী,

আপনি আমার উপর যে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন তাতে আমি এত অভিভূত হয়েছি। যা প্রকাশ করবার সাধ্য আমার নেই। আমি শুধু ভাবছি এ বিশ্বাসের আমি যোগ্য কি না। আমি ভাগ্যের খেলা দেখছি। আমি অবাক হয়ে গেছি, যা হয়ে গেছে আর আমাদের সাক্ষাতের পরে যা হল তাই ভেবে। ভারতে আমার মহত্তম অভিজ্ঞতা আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়া। আমি যখন বালকমাত্র আমার ভাগ্যের সূত্রে বাঁধা হয়ে সেই সময়ের সঙ্গে এই সাক্ষাৎ যুক্ত আছে। ঐ সময়ে আমি দুটি বই পড়েছিলাম— ‘অমৃতা’ ও ‘সাধনা এই দুটি বইয়ের গভীর প্রভাব আমার উপর পড়েছিল এবং ভারতীয় জগৎ আমাকে সারা জীবনের মতো মুগ্ধ করেছিল…আমি আপনাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হলাম—পড়তে লাগলাম, আমার বাকি জীবনটা ভালো বা মন্দ যা কিছু হয়ে উঠেছে তা এই জন্যই হয়েছে। অবশেষে আমি নিমন্ত্রিত হয়ে আপনার দেশে গেলাম—সেখানে আপনার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হবার সৌভাগ্য হল। আপনার গভীর বেদনা দেখেই আমি বুঝলাম, আমরা কি, আত্মা কি। আমি এখন স্বীকার করছি যে যদিও আপনার চিঠি পেয়ে আমি অত্যন্ত বিচলিত বোধ করছি তবু তখনও আপনাকে দেখা মাত্রই আমি বুঝেছিলাম, আপনার ভিতরের অবস্থাটা কি।

আমি বুঝতে পেরেছিলাম এবং আপনাকে বলেছিলামও যে সময় ও বিস্মৃতি কেবল আমাদের চেতনার উপরের আচ্ছাদনটাই স্পর্শ করে কিন্তু আমাদের যথার্থ স্মৃতি এক পরমসস্তু (absolute) কাজেই আমরা এক ভাবে অবশ্যই অমর। আমার এই কথায় চিরকালই দৃঢ় বিশ্বাস কিন্তু মানুষ হিসাবে আমাদের প্রত্যেক জ্ঞেয় বিষয়ের প্রত্যক্ষ প্রমাণ দরকার হয়। আপনি আমাকে অমরত্বর অলঙ্ঘ্য ও বিপুল প্রমাণ দিয়েছেন। প্রমাণ পেলাম যে আমাদের চৈতন্য খুবই বাহ্যিকভাবে কালের দ্বারা আক্রান্ত হয়, ইচ্ছা করলে আমরা কালের প্রভাব কাটিয়ে কালজয়ী হতে পারি। বিস্মৃতিই মৃত্যু—এই বিস্মৃতিকে সরিয়ে রাখলেই অমরত্ব লাভ হতে পারে, আমরা ‘অমৃতা’ হতে পারি।

আপনার কষ্ট যতই প্রবল হোক আপনাকে বুঝতে হবে যে এ সংসারের সমস্ত কর্তব্য সুসম্পন্ন করে আপনি এখন ঈশ্বরের করুণার মধ্যে বাস করছেন (grace condition) এ অবস্থা দুঃখ সুখের অতীত অবস্থা। কেবল প্রেমই কালকে ও বিস্মৃতিকে জয় করতে পারে। মানুষের ধ্বংস হয়ে যায়, মানুষ কালের কাছে পরাজিত হয় যখন তার ভালোবাসার শক্তি, প্রেমের কালজয়ী শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। আপনার চিঠি পাওয়ার চেয়ে আনন্দ আমার আর কিছু নেই।…আমি সর্বদা আপনার বিশ্বস্ত বন্ধু থাকব।।

সেরগেইর চিঠিটা আমাকে ভাবাচ্ছে, সত্য কি, অমরত্ব কি? অমরত্বর আস্বাদ আমি পাচ্ছি কারণ যা মরে গিয়েছিল তার সঞ্জীবিত রূপ আমি মন দিয়ে ছুঁতে পারছি। ঐ যে অমল একগাদা কাগজ নিয়ে ঘরে ঢুকছে এটা কি বেশি সত্য, ঐ যে দেখতে পাচ্ছি লাইব্রেরী ঘরে ক্যাটালগের বইয়ের উপর ঝুঁকে আমরা ক্যাটালগ করছি তার চেয়ে? অতীত কি বর্তমানের চেয়ে মিথ্যা? সে কি কোথাও চলে গেছে, না কি এইখানে স্তব্ধ হয়ে আছে? মনের ঢাকনাটা খুলে গেছে—একে একে ছায়ামূর্তিরা উঠে এসে তাদের অস্তিত্ব বাস্তব করে তুলছে। এক এক সময় ভয় হয় আমার এই আবেগ যেন এক উষ্ণ তপ্ত প্রস্রবণ পৃথিবীর গহ্বর থেকে উঠে এসে চারিদিকের মাটিতে যা ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি যেন এক অজ্ঞাত গভীর থেকে এই দাহকারী প্রেম হঠাৎ উঠে এসে আমার চারিদিকের সযত্নরক্ষিত বাগানের উপর ছড়িয়ে পড়ছে। আমি ভয়ে ভয়ে আছি, হে ঈশ্বর এর ফুল পাতা শুকিয়ে যাবে না তো!

কখনো কখনো উনিশ শ’ ত্রিশ সাল আর উনিশ শ’ বাহাত্তর সাল এমন ভাবে মিশে যায় যে আমি বিপদে পড়ি—অনুভূতির এই প্রত্যক্ষতাকে আমি কিছুতেই ভাষা দিতে পারি না। কারণ এই ধরনের অভিজ্ঞতার জন্য হয়ত ভাষাই তৈরী হয় নি। এরকম তো সচরাচর ঘটে না, এক বছর আগেও আমাকে কেউ বললে আমার বিশ্বাস হত না। তবু আমি বলবার চেষ্টা করছি, যদি কোনো দিন এই জীবনোপন্যাস প্রকাশিত হয় তাহলে হয়ত মনোবিজ্ঞানীরা এর কারণ, উৎপত্তি সবই নির্ণয় করতে পারবেন।

রাত্রি গভীর হয়েছে, আমি শুনলাম ঢং-ঢং করে দুটো বাজল। আমি দেখতে পাচ্ছি শান্তি আমার পাশে শুয়ে আছে—নিচে পিয়ানো বাজছে তো বাজছেই। বিছানায় এপাশ ওপাশ করছি আমি—“ভাই শান্তি, ঘুম আসছে না রে!”

“আমারও না। ইউক্লিডদা পিয়ানো বাজিয়েই চলেছে।”

“দেখ তো কি অন্যায়।” আমি উঠে বসেছি বিছানায়—

“যাই ওকে বারণ করে আসি—“

শান্তি বলছে—“না না, এখন না কাল কোরো।”

আমি খাট থেকে নেমে পড়েছি, একটা অব্যক্ত আকর্ষণ আমাকে ওর দিকে টানছে বাজনাটা যেন মন্ত্র, আমার সত্তা মন্ত্রাবিষ্ট হয়ে গেছে। আমি একবার এখনই ওর কাছে যাব, যাব, না যেয়ে উপায় নেই, ও ডাকছে, আমাকে ডাকছে, আমি দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। শান্তিও উঠে পড়েছে, “কি করছিস রু?”

“একটু বলে আসি বাজনাটা থামিয়ে দিক।”

“পাগল হয়েছিস নাকি, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখ দুটো বেজেছে, এত রাতে কখনো যায়?”

“যদি রাত আটটায় যাওয়া যায় তাহলে দুটোয় গেলে কি হয়?”

“তা যায় না। পুরুষ মানুষের ঘরে রাত্রে কখনো যায় না।”

“তুমি যে যাও?”

“আমি আবার কোথায় যাই, আচ্ছা মেয়ে তো।”

“সব ঘরে যাও, কাকার ঘরে, বাবার ঘরে”

“রাত দুটোয়? কখনো না, তাছাড়া আমরা তো আত্মীয়-” আমার রাগ হচ্ছে, রীতিমত রাগ হচ্ছে, আমি ওর হাতটা সরিয়ে দিয়ে দরজার দিকে এগোচ্ছি—আমি যাবই। একটু গিয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলে আসব, এখন বাজিও না। তাতে কি দোষ হবে? শান্তির আস্পর্ধা বেড়ে গেছে। ছড়ি ঘোরাচ্ছে আমার উপর। শান্তি দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছে, আমায় যেতে দেবে না।

“তোমার বাড় বেড়েছে, না? নিজেকে মনে করেছ কি?” আমি ওকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছি। শান্তিরও রাগ হয়েছে, ও বলছে “কি মনে করেছি নিজেকে? দেখবে কি মনে করেছি, ডাকব মামীমাকে?”

সাপের মাথায় মন্ত্র পড়ে গেছে, আমি বালিশে মুখ গুজে কাঁদছি।

“ভাই শান্তি তুই তো জানিস আমাদের মধ্যে কি হয়েছে—এতে পাপ হচ্ছে না তো?”

শান্তি গালে হাত রেখে ভাবছে, “তা হচ্ছে বৈকি।”

“কার হচ্ছে? ওর না আমার?”

শান্তি চিন্তান্বিত, “আমার তো মনে হয় দুজনেরই হচ্ছে।”

“কখনো না কিছুতেই না। আমার কেন পাপ হবে, আমি কত ওকে বারণ করি।”

“তাহলে ওর ঘরে যেও না আর।”

আমার মুখের অবস্থা দেখে শান্তি গলে গেছে—“পাপের ভাবনা ভাবছ কেন ভাই? তোমার যা ইচ্ছা কর, সকালবেলা যেও, আমি কখনও কাউকে বলব না।”

এটা কিন্তু উনিশ শ’ তিয়াত্তর সালের জানুয়ারী মাস, ঘড়িতে দুটো বাজছে ঢং ঢং। আমি বিছানায় উঠে বসেছি, আমার মনে হচ্ছে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে যাই, নৈলে শান্তি আমায় আটকাবে। আমি খাট থেকে নামতে যাচ্ছি–কে বললে, “কোথায় যাচ্ছ?”

“নিচে–” “নিচে কোথায় যাবে, রাত্রি দুটো বাজে”—“দুটোই বা কি আর আটটাই বা কি”, পিছন থেকে শান্তি আমায় ধরেছে—আমি হাত ছাড়িয়ে নিতে গেলাম, আর তখনই বুঝতে পারলাম এটা তিয়াত্তর সাল আর আমাকে ধরে আছেন আমার স্বামী, শান্তি নয়। আমি কাপছি, ভয়ে কাপছি, একি বিপদ হল আমার—সময়হারা হয়ে গেলাম—আমি আমার স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম, “বাচাও, আমাকে বাঁচাও—তুমি ছাড়া আমাকে কে বাঁচাবে, আমার মহাপাপ হচ্ছে—তোমাকে কষ্ট দিচ্ছি।” উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছেন, “আমার কোনো কষ্ট নেই। শুধু একটি কষ্ট এই যে তোমাকে শান্তি দেবার কোনো উপায় এখন আমার হাতে নেই। তবে যেটুকু আছে আমি করব। তুমি নিশ্চয়ই যাবে, একবার গিয়ে তাকে দেখে আসবে।”

“কি হবে যদি সবাই জেনে ফেলে?”

“কি করে জানবে, জানবে কেন?”

“আমিই হয়তো বলে ফেলব, আমার কিছু মনে থাকছে না, কিছু না, কে আমাকে ডাকছে বল তো, কে ডাকছে? সে কি একজন আগন্তুক হতে পারে? আজ বেয়াল্লিশ বছর যাকে আমি দেখি নি সে তো stranger একজন। মির্চা নিমিত্ত মাত্র, অন্য কেউ আমার সমস্ত মনটাকে বদলে দিচ্ছেন, আগুন যেমন জলকে বদলে বাষ্প করে দেয় তেমনি সম্পূর্ণ পরিবর্তন অনুভব করছি। সে বলছে সত্যকে দেখ, সত্যকে দেখ, জানি আমার এ ভাবটা বেশি দিন থাকবে না। আমি সংসারে ফিরে আসব, আসতেই হবে, কিন্তু আজ এই মুহূর্তে তুমি বিশ্বাস করবে আমি কতখানি বদলে গেছি? আমি রমাকেও ক্ষমা করে দিয়েছি, ওর উপর একটুও রাগ নেই আমার। ওর অল্প বয়সের কথা মনে পড়ছে, তখন ও খুব মিষ্টি মেয়ে ছিল, ও আমার মার সব কেড়ে নিয়েছে ঠিকই কিন্তু নিজেও কষ্ট পেয়েছে। শুধু বাইরের জিনিস পেল বলে ও ক্রমাগত অসঙ্গতভাবে পাগলের মত বাবার। বইগুলোর মধ্যে নিজের নাম ঢোকাচ্ছে—যে ব্যক্তির আমাদের মত ছ’টা সন্তান চোখের সামনে দপ দপ করছে, যার প্রতিপ্রাণা স্ত্রী বর্তমান, তার কতটুকু বেচারা পেয়েছিল বল তো? ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গিয়ে এসব ভাবি, জানো রমাকেও হয়ত এখন ভালোবাসতে পারি, বিশ্বাস করো, ওকে ভালোবাসছি আমি। রমাকে একদিন আমি বলেছিলাম, যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কি কেউ নিন্দিত, অপমানিত করতে পারে? কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে রমা তো নিমিত্তমাত্র—এ কার খেলা খেলছি আমরা? যা বাইরে থেকে ক্ষতি মনে হয়, অন্তরের দিক থেকে তাই হয়ত লাভ। হেথায় যা মনে হয় শুধু বিফলতাময় অনিত্য চঞ্চল, সেথায় কি চুপে চুপে অপূর্ব নূতন রূপে হয় সে সফল? বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বাবাকে বলেছিলেন, তোমার পতন হবে’, পতনের বীজ বাবা সঙ্গে করেই এনেছিলেন, সে তার আকাশস্পর্শী অহং—আমরা সর্বরকমে সেই অহংটাকেই রক্ষা করতে চেয়েছি—আমরা কত সময় ভেবেছি, বাবা কেন এ দেশের প্রেসিডেন্ট হলেন না, তার কি ক্ষমতা কম ছিল? শুধু ওরই জন্য সর্বস্ব খুইয়ে ওরই আশ্রয়ে তার নামহীন, যশহীন অবস্থায় প্রাণ গেল। কিন্তু আজ আমি ভাবছি প্রেসিডেন্ট হলেই কি চুড়ান্ত লাভ হত? হয়ত তার চেয়ে বড় লাভ হয়েছে—হয়ত যাবার আগে সম্পূর্ণ অহংশূন্য হয়ে, মাথা নিচু করে গিয়েছেন, বাইরের দিক থেকে সমস্ত হারিয়ে হয়ত অন্তরের দিক থেকে উন্নত হয়ে তার সত্তার পূর্ণতা হয়েছে, তাঁর বিরাট প্রতিভার মধ্যে যে ত্রুটিটুকু ছিল হয়ত চোখের জলে তা ধুয়ে তিনি মহিমান্বিত হয়ে গেছেন। রমা এর নিমিত্ত হয়েছে, আমরা নয়। আজকে আমি বুঝতে পারছি এ জগৎটা আমরা যেমন দেখি এ তেমন নয় বুঝতে পারছি ‘ঢাকনা খোলার অর্থাৎ ‘অপবৃণু’ কথাটার অর্থটা কি—সত্যের মুখটা যে দেখাচ্ছে আমাকে সে কে? সে কখনো আমার পূর্বপরিচিত অর্ধবিস্মৃত একজন মানুষ মাত্র হতে পারে না।”

আমি ওকে দেখছি, ওর সঙ্গে কথা বলছি, ওর সঙ্গে ঝগড়া করছি—আমার ঝগড়ার কারণ রিণা আমাকে বইটা শোনাচ্ছে। বইটাতে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা। আমাদের জগৎটা ও বুঝতেই পারে নি। আমি ওকে বলছি তুমি মনেও করো না মির্চা, যে তোমার বই পড়ে তোমার স্মৃতি জেগে উঠেছে বলেই পড়ছি তা একেবারেই নয়, আসলে স্মৃতি প্রাণ পেয়েছে বলেই তোমার লেখা পড়লাম। না হলে আগেও তো কতবার শুনেছি, কখনো ইচ্ছেও হয় নি পড়বার। এই বই পড়ে স্মৃতি তো জাগবে না, স্মৃতি বিভ্রান্ত হবে, কারণ বইটা সত্যের মুখোশ পরা কল্পনার বিকার। ও ধরেই নিয়েছিল আমার মা বাবা ওর মতো একটি পাত্র ধরবার জন্য ফাদ পেতেছেন। আমিও সেই ফঁাদের একজন কারিগর, এরকম, একটা কথা প্রথমেই ধরে নিয়েছে বলে ও আমাকেও বুঝতে পারে নি। বুঝেও বুঝতে পারে নি আমার মন। আমি তো কোনো দিন বলিই নি ওকে আমার মনের কথা। তা তো বলাই হল না, সময় পাওয়া গেল না, তাই ও আমার মুখে এমন সব কথা ঢুকিয়েছে যা আমি বলতেই পারি না, যা আমার ভাষাই নয়। ওর অতৃপ্ত মন যা পায় নি বইতে তারই আয়োজন করেছে। সাইকোলজিতে এর একটা নাম আছে, কি নাম তা জানি না, আমি ঐ বিদ্যাটার অনুরাগী নই—মানুষের অপার রহস্যময় মনের নাবিক হতে চাওয়া স্পর্ধা মাত্র। তবু আমি বুঝতে পারছি ওর মন, এ মন আমার বিপরীত, মিথ্যার দরজা দিয়ে কখনো সত্যের সামনে পৌঁছনো যায় না। মিথ্যার জজ্ঞাল দিয়ে সত্যের মুখ ঢাকা থাকে, তাকেই তো অপাবৃত করতে হবে। সেইজন্যই এই কলম ধরেছি।

বই পড়ছি আর ওকে সমালোচনা করছি, আমি জানি বাবার উপর রাগ করবার ওর সঙ্গত কারণ আছে, কিন্তু যার এত নিন্দা করছে এই বইতে, যে নিন্দা সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়, তাকেই আবার গুরু বলে বই উৎসর্গ করছে, তার শিষ্য বলে গৌরব করছে কি করে? এরকম মন আমি চিনি না, এ ‘ইউটিলিটেরিয়ান’ মন কিংবা কি রকম আমি জানি না। এই সমস্ত আলোচনা আমি ছোট্ট ছোট্ট বিষাক্ত তীরের মত ছুঁড়ে মারছি—কি আশ্চর্য সে তীর শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে, লক্ষ্যে পৌঁছচ্ছে না, ওর প্রতি আমার ক্রোধ যেন ছোট ছোট ঢেলা, আমার এই হৃদয় তরঙ্গের উপর স্থির থাকছে না, এক মুহূর্তে গড়িয়ে পড়ে তা ফসকে যাচ্ছে, সরে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে।

এতকাল যার কথা কিছু জানতাম না চারদিক থেকে যেন একটা চক্রান্ত হয়েছে, আমি নানা লোকের কাছে থেকে বার বার ওর খবর পাচ্ছি। এমন একটা, যোগাযোগের সৃষ্টি হয়েছে যে এই সময়টায় ভাগ্য আমাকে ওর কথা শোনাবে, জানাবে।‘স্মরণে’ একটা কবিতা আছে, মৃত পত্নীকে উদ্দেশ্য করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন এ সংসারে একদিন নব বধূবেশে তুমি যে আমার পাশে দাঁড়াইলে এসে, রাখিলে আমার হাতে কম্পমান হাত, সে কি অদৃষ্টের খেলা সে কি অকস্মাৎ, শুধু এক মুহূর্তের নহে এ ঘটনা, অনাদিকালের এই আছিল মন্ত্রণা।

আমরা নিজেরা কি কিছু করি? না আমরা সূত্রবদ্ধ ক্রীড়নক? এতদিন যার চিহ্নমাত্র ছিল না, হঠাৎ সে কি করে এত বড় হয়ে দাঁড়াল, আর ঠিক এখনই কেন বার বার ওর খবর পাচ্ছি।

আমার বন্ধুর স্বামীর সঙ্গে ওর দু বছর আগে দেখা হয়েছে, আর আমি এখন সে কথা শুনলাম। তিনি বলেছেন, অধ্যাপক ইউক্লিড খুব চমৎকার মানুষ আর কলকাতার কথায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। কলকাতার অনেক রাস্তা ওর চেনা, আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘বকুলবাগান রোডটা’ দেখেছি কিনা। চল্লিশ বছর আগে তিনি কলকাতায় ছিলেন কিন্তু তার সব মনে আছে, কলকাতা তাঁর স্বপ্নের দেশ।।

আমি ওর কথা আরও শুনেছি, ও এক কল্পনার জগতে বাস করে। ভারতই ওর ধ্যানের বস্তু। ওর লেখার মধ্যেও বাস্তব জগতের চেয়ে কল্পনার ও অলৌকিকের স্থান বেশি। ও নিজেকে ভারতীয় বলে।

আমি যত ওর খবর পাচ্ছি তত আরো উতলা হয়ে উঠছি। আমি ভালো করে বুঝতে পেরেছি ওর সঙ্গে একবার দেখা না হলে আমার এ যন্ত্রণা কিছুতে দূর হবে না। অথচ আমি এও ভাবি, আমি দেখব কাকে? সেই তেইশ বছরের ছেলেটি কোথায়! আর সে-ই বা দেখবে কাকে? কোথায় সেই যোড়শী কন্যা! ও তো আমাকে দেখতে চায় না, কাজেই ও কাকে দেখবে তা নিয়ে আমি ভাবি না কিন্তু আমি যাকে দেখতে চাই, তাকে পাব কোথায়? আমি কি একজন তেইশ বছরের বালককে দেখতে চাই? বালক? নয়তো কি? আজকের আমার কাছে বালক, আমার নাতি হতে পারে। যদি আজ তেইশ বছরের মির্চাকে দেখতে পেতাম তাহলে নিশ্চয়ই তার সঙ্গে আমার সৌহার্দ্য হতে পারত না। অন্যদিকে আমি আজ যাকে দেখতে পারি সে মির্চা তো বৃদ্ধ, তাকে তো চিনিই না—সে তো একজন অপরিচিত, আগন্তুক, তাকে দেখে আমি কি করে শান্তি পাব? আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না আমার অতন্দ্র রাত্রির এই ব্যাকুলতা যা অহরহ কোনো অকারণ বেদনায় অনির্দেশ্য অভিসারে বেরিয়ে পড়তে চায় সে কি কোনো অপরিচিত একটি ব্যক্তির জন্য হতে পারে? না এ আর কোনো অবস্থান থেকে আর কোন শক্তি আমায় ডাকছে, অজ্ঞাত ভবিষ্যতের দিকে? এমন কি কেউ থাকতে পারে, যিনি সব জ্ঞান, সব প্রেমের কারণ। সেখান থেকেই বার্তা আসছে? আমার চিরসংশয়ী মন এসব কথা মানতে চায় না, অথচ সন্দেহও ছাড়ে না।

আমার এই জীবনসায়াহ্নে প্রত্যুষের আলো এসে পড়েছে। সকাল সন্ধ্যা এক হয়ে গেছে, সময় যেন চিরস্থির।

মাঝে মাঝে সেরগেইর কথা আমার মনে হয়—এই কি অমরত্বের আস্বাদ? আমার সেই ছোটবেলার কবিতাটা আমি এতদিনে বুঝতে পারছি—কি মনে করে তখন লিখেছিলাম তা জানি না—‘কালের যবে হারিয়ে যাবে মুহূর্ত নিমেষ—’ সেই সর্ব অভিজ্ঞানশূন্য কালের স্পর্শহীন আলিঙ্গনে আমি বিধৃত, আমার অতীত ও বর্তমান এক হয়ে গেছে—এ তো অমরত্বই। তাই যদি হবে, তবে এত কষ্ট পাচ্ছি কেন? চোখের জলে দিশাহারা? আমি বুঝতে পারি না সত্যই এটা কষ্ট না অমৃতের স্বাদ। যদি কষ্ট হয় তবে তো নিষ্কৃতি চাইব—আমি কি নিষ্কৃতি চাই? আমি কি ভাবতে পারি এই কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা শূন্যে মিলিয়ে যাক, আমি আবার আমার ঘর-সংসার বিষয় সম্পত্তি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে থাকি? আমার বয়সে লোকেরা সকলেই তো তাই আছে। তারা কল্পনাও করতে পারে না, নাতি নাতনী পরিবৃত হয়ে, বাস্তব সংসারে বসে কেউ এমন একটা স্বপ্নের জগতে চলে যেতে পারে—দেহহীন, স্পর্শহীন শুধু একটা অস্তিত্বের সংবাদ তার চারপাশের দেওয়ালগুলো তুলে নিয়ে যেতে পারে। সংসারের ঘর্ষণে মানুষের মনে কড়া পড়ে যায়—বৈষয়িক মন তখন হিসাব কষে, আমারও তো তাই ছিলবাড়িঘরই তো করলুম এত দিন, কাণাকড়ির হিসাব করেছি, আর আজ? এখন এই মুহূর্তে যদি কেউ বলে সব ছেড়ে শূন্য হাতে চলে এস তাকে দেখতে পাবে, আমি কি যাব না? আমায় যদি কেউ বলে থিয়েটার রোডে একটা চারতলা বাড়ি চাও, না ওকে একবার দেখতে চাও, আমি কি বলব তাতে কোনো সন্দেহ আছে? এই যে অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে, এতে আমি অসুখী নই, আমি কখনো চাই না এটা নষ্ট হয়ে যাক। আমার বয়সের কোনো মানুষের মন অনুভূতির এই তীব্রতা ফিরে আসা আমি সৌভাগ্য বলেই মনে করি।

কার, এ করুণা বুঝিনা বুঝিনা আর
কার হাতে আছে অফুরাণ ভাণ্ডার
জল নেমে যাওয়া ভাটার কাদার পরে
গান কে জাগায় জল কল্লোল স্বরে
কী সৌভাগ্য কী সৌভাগ্য হায়
কে পাঠায় ডাক অজ্ঞাত মোহানায়—

এই অজ্ঞাত মোহানার দিকে তাকিয়ে আমি আর কাউকেই নয় আমাকেই লাভ করছি—যাজ্ঞবল্ক্য যা বলেছেন, মানুষ অন্য কাউকে কিছু দিতে পারে না, নিজেকেই দেয়—আত্মনস্তু কামায় পুত্রঃ প্রিয়ঃ ভবতি—পতির প্রতি প্রেম, পুত্রের প্রতি প্রেম সব আমাদের নিজের জন্যই, আমার আত্মাকেই তা পূর্ণ করছে। ওকে মনে পড়ে আমি আর কাকে কি দিলাম—এ জগতকে দেখবার একটি তৃতীয় নয়ন আমিই লাভ করলাম।

আমার আত্মীয়দের মধ্যে কারু কারু ধারণা যে, যে-স্মৃতি আমি এই চল্লিশ বছর ভুলে দিব্যি ঘরসংসার করেছি আজ এই বয়সে হঠাৎ তা মনে জাগিয়ে তুলবার কি হল—এবং কেনই বা আমি মনের জোর করে তা ভুলে যাচ্ছি না। এর কোনো উত্তর আমার জানা নেই। শুধু আমি অন্তরে বুঝতে পারছি কায়াহীন এই প্রেম আমার দেহে মনে এমন আশ্চর্য সঙ্গীত বাজাচ্ছে যা আমি এতদিন জানতাম না, যা পথে কুড়িয়ে পাবার বস্তু নয়। কৃষ্ণপ্রেম কি চাইলে মেলে, অনুরাগ না হলে হৃমলে—কৃষ্ণপ্রেম কিন’কড়া ছ’কড়া, কুড়িয়ে নেবে যারা তারা?

সেরগেইর কথা ঠিকই, এর মধ্যে অমরত্বের সংবাদ আছে, সুরের মধ্যে অশ্রুজলের আভাসে, প্রেমের মধ্যে চির অতৃপ্তি বসে থেকে যে অশেষের সংবাদ দেয় আমি তাই পাচ্ছি। আমি কোনো মতেই আর ভুলে যেতে চাই না।

তাছাড়া আর অন্য যে যাই বলুক আমার স্বামী তো বলেন না। তার সঙ্গে আমার কথা হয়, তিনি আমাকে বলেছেন সেদিন যে, সংসারে ঠিক একই ঘটনা দু জায়গায় ঘটে না, প্রত্যেকটি ব্যাপারকে আলাদা বিচার করতে হয়—“এটা তো সত্যিই যে তোমার জীবনের সব অংশের সঙ্গে আমার যোগ নেই, তুমি যখন কবিতা লেখ কি ভাব আমি জানি না, তোমার লেখার জগও আমার পরিচিত নয়, তোমার কর্মের জগৎও সবটা আমি জানি না, তেমনি এও তোমার একটা ভাব, এতে আমর ক্ষতি কি?” আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি যে উনি কোনো ক্ষয়ক্ষতি অনুভব করছেন না। যদি করতেন তাহলে আমার ভারি মুশকিল হত। আমি তো ওকে দেখতে যাবার কথা ভাবতেই পারতাম না। কারণ আমার স্বামীর মনে কষ্ট দিয়ে আমি কখনো কোনো মূল্যবান বস্তু পেতে পারি না, তাহলে যে ভালোবাসা লাঞ্ছিত হবে তার মতো আর পাপ নেই—সেই পাপের পসরা মাথায় নিয়ে আমি কি তীর্থযাত্রায় যেতে পারি?

ক্রমে ক্রমে এমন অবস্থা হচ্ছে যে আমার কাজকর্ম করাই মুশকিল হচ্ছে। বাইরের লোকজনের সঙ্গে নানা বিষয়ে আমি কথা বলব কি করে? দিল্লী চলেছি কাজে, এখন, সেখানে গিয়ে ডেপুটি-সেক্রেটারীর ঘরে বসে যদি আমার চোখে জল আসে তাহলে উপায় হবে কি? আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি স্বাভাবিক মন ফিরিয়ে আনতে। আমি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকি, আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে, ভৃত্যরা ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে যায় আমার এ বয়সে চোখ দিয়ে জল পড়ার একমাত্র কারণ হতে পারে পুত্রবধূর সঙ্গে কলহ! আমার বয়সী শ্বমাতাস্থানীয় সমস্ত বঙ্গমহিলার সেটি একটি কর্তব্য, ভৃত্যকুল সে রকম তো কিছু দেখছে না। তাছাড়া কোনো দুঃখজনক ব্যাপার ঘটলে তার, আলোচনা শোনা যায়। বাড়ির সকলকেই তা স্পর্শ করে, কিন্তু তাও নয়। সকলেই তো মানুষ, ওরাও আমার অস্বাভাবিক অবস্থা লক্ষ্য করছে এবং কিছু বুঝে উঠতে পারছে না—আমিও লজ্জা পাই কিন্তু আমার মন আমার বশে নেই, একেবারে নেই। যেতে যেতে সামনে দেখি একটা গাড়ি চলেছে, আমার মনে হয় নেমে যাই। ওর মধ্যে হয়ত সে আছে, আর কেউ বিদেশে যাচ্ছে শুনলে আমার মন হু হু করে ওঠে। এই অসহ বিরহভার আমার বৃদ্ধ শরীর বহন করতে পারবে না বলে আমার ভয় হয়—অসুস্থ হতে আমার ইচ্ছা নেই তাহলে ওর সঙ্গে আর দেখা হবে না। কিন্তু আশ্চর্য আমার শরীর ভালো হয়ে গেছে—এই ক’মাসই না আমার হার্টে কষ্ট হয়েছে, না ব্লাড প্রেসারের।

যারা আমাকে বলে একটু চেষ্টা করলেই তুমি এই স্মৃতির প্রকোপ থেকে উদ্ধার পেতে পার, তাদের সঙ্গে আমি মনে মনে তর্ক করি, প্রশ্নোত্তর করি। কারণ এ প্রশ্ন আমারও। তারা বলে তুমি যত ভাববে তত তোমায় এ-চিন্তা পেয়ে বসবে তুমি কষ্ট পাবে। অজ্ঞ জনের বিজ্ঞের মতো এ কথা সাধারণভাবে সত্য হলেও এ ক্ষেত্রে সত্য কি? চল্লিশ বছর যা আমাকে উদ্বিগ্ন করে নি, যখন আমার বয়স কম ছিল, যখন হয়ত কোনো সম্ভাবনাও ছিল, তখন যার স্মৃতি মনের উপর ছায়ার মতো ভেসে গেছে আমাকে তার বজ্রমুষ্টিতে ধরে নি, যেমন প্যারিসে যখন শুনলাম ও দুটো ব্লক ওদিকে থাকে তখন আমি পোপেস্কুর সঙ্গে ওকে দেখতে যেতে পারতাম—তারপর? তারপর কি হত কে জানে। আমার তখন বয়সই বা কত ছিল? যদিও আমি ভাবছিলাম আমার মেয়ের বিয়ে দিয়ে এসেছি আমি তো বৃদ্ধা একজন—আমরা বাঙালী মেয়েরা ঐ রকমই ভাবতে অভ্যস্ত কিন্তু আমার বয়স ছিল চল্লিশ মাত্র। এখন ষাটের ঘরে পঁড়িয়ে বুঝতে পারি যে ও বয়সটা বেশি নয়।

অথচ তখন তো এমন করে হৃদয় মন্থন হল না, এখন কেন হচ্ছে তবে এই বৈতরণীর ঘাটে দাঁড়িয়ে? বৈতরণীর ঘাট? এটা আমি বলছি, জানি বলেই বলছি, এটা কথার কথা, বয়সের অনুভূতি আমার হচ্ছে না, আমার বার্ধক্যের খোলস ঝরে পড়ে গেছে। এ কি কেউ ইচ্ছে করে করতে পারে? বা ইচ্ছে করেই বন্ধ করা যায়? মির্চা ইউক্লিড যেদিন আমার বাবার টেবিলের সামনে বসেছিল, বাবা বললেন, এই আমার ছাত্র, এখানে থাকবে, সে কি তিনি ঘটিয়েছিলেন? আর ১লা সেপ্টেম্বর যে সেরগেই সিবাস্টিয়ান এল তাকে কি আমি ডেকে এনেছিলাম?—“অনাদিকালের এই আছিল মন্ত্রণা’—যেদিন পৃথিবী নেবুলা ছিল, তখনকার সঙ্গে কার্যকারণে যুক্ত এই ঘটনা! এই কথাই ডি প্রফাণ্ডিস কবিতায় আছে—“Where all that was to be in all that was.’

কেউ কেউ বলে তুমি যদি একটু স্মৃতি রোমন্থন কর তাতে তো ক্ষতি নেই, কিন্তু যাবে কোথায়? দেখবে কাকে? আবার কেউ বা বলে দেখলে ভালোই হবে তোমার মন মোহমুক্ত হবে, সেই তরুণ যুবার প্রতি যে মোহ তা কেটে যাবে। আমার সংসারের মন, উপরের মনও তাই বলে, আমি ভাবি আমি দেখতে পাব অপরিচিত এক বৃদ্ধকে, অমনি আমার লজ্জা হবে, মনে হবে, এ কাকে দেখতে এলাম। কিন্তু আমার গভীরের মন বলে এ সে বস্তু নয়—যাকে তুমি দেখতে চাও সে চোখে দেখার নয়। তার বয়স হয় না। যেমন তোমার হয় নি। বয়স তো একটা আবরণ মাত্র, সেটা খুলে ফেলা যায়—কেউ সাধনা করে খোলে, কারু উপর করুণা হলে সে নিজের সত্তাকে পায়-কার করুণা? জানি না তো। কিন্তু আত্মার স্বরূপ আমি বুঝতে পারছি। আমার কোনো সংশয় থাকছে না। যে জানে না তাকে এ অনুভূতি বোঝানো যাবে না। অন্ধকে যেমন আলোর অর্থ বোঝানো যায় না। তর্কের অতীত এই উপলব্ধির কথাই বলা হয়েছে যা বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না, শাস্ত্র পড়ে জানা যায় না। ‘ন মেধয়া বহুধা ন তেন। আজ বুঝতে পারছি কালজয়ী এই প্রেমকে আর সংসার জয় করতে পারবে না, এ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে, আমাকে সংসারের আবর্ত থেকে বহন করে নিয়ে যাবে দূরে—যথা নদীনাং বহবাহমুবেগাঃ সমুদ্র মেবাভি মুখাদ্ৰ বন্তী নদীর বহুমুখী জলস্রোত যেমন সংসারের বিচিত্র আকর্ষণ পার হয়েও সমুদ্রাভিমুখী হয়।।

ওকে একবার দেখে আসতে আমায় হবেই, কিন্তু যাওয়া তো সোজা নয়। অনেক ব্যবস্থা চাই—তাছাড়া আমি তো ওকে আগে জানাতে চাই না, কারণ তাহলে নিশ্চয় ও দেশ ছেড়ে চলে যাবে। আমি বুঝতে পেরেছি ও আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় না, বা পারবে না। কেন পারবে না তার সঠিক কারণ আমি বুঝতে পারছি না। আমার বিষয়ে অমন একখানি কাব্য লেখবার পরে অপরাধবোধ জন্মাতে পারে কি? না তা নয়–সে বুঝতেই পারে নি যে এটা অন্যায় হয়েছে, যেমন সেরগেইও পারে নি। ওদের দেশে ওসব কিছু নয়। এখন আমার কাছেও নয়, বাইরের আসঙ্গ জলের উপর হাওয়ার ঢেউ, আমি এত বোকা নয় যে ঠিক সেজন্যই উতলা হয়েছি। আমার ক্ষোভের কারণ ও সত্যের সঙ্গে ভেজাল মিশিয়েছে।

তবে ও আমাকে সারাজীবন এড়িয়ে গেল কেন? আমি ‘জ’-কে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, “বলতে পার তুমি, আমি যদি যাই সে আমার সঙ্গে দেখা করবে?”

“নিশ্চয় করবেন। যিনি আপনার কথা আমায় অমন করে বলেছেন তিনি দেখা করবেন এ কথা আপনার মনে হল কেন?”

“চিঠির উত্তর দেয় না যে!”

“চিঠির উত্তর দেয় নি? সে কি?”

“আচ্ছা, ‘জ’ হতে কি পারে বাবার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে, হতে কি পারে সেজন্যই চিঠির উত্তর দেয় না?”

“তা হতে পারে বৈকি।”

“কি আশ্চর্য! এ কি একটা রাখবার মত প্রতিজ্ঞা?”

“তা কেন, সত্যবাদী কি কেউ হয় না?”

 

 

 

 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত