| 29 মার্চ 2024
Categories
প্রবন্ধ সাহিত্য

নজরুল প্রেমে নার্গিস ও কিছু প্রাসঙ্গিকতা

আনুমানিক পঠনকাল: 11 মিনিট



।।আরশি গাইন।।

কাজী নজরুল ইসলাম মোসলেম ভারতে লিখছেন তুখোড়ভাবে। সারা ভারতে না হলে আফজালুল হকের মোসলেম ভারত সমস্ত পশ্চিমবঙ্গে নজরুলের লেখা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ সময় আফজালুল হক নজরুলকে মোসলেম ভারতে অফিসিয়াল কাজে বসিয়ে দিলেন। দিন-রাত পত্রিকার কাজ করতে হয়। এমনি কাজের প্রবল চাপে তিনি হাঁফিয়ে ওঠেন। দেখা গেল আর কোনো নতুন লেখা তৈরি করতে পারছেন না। এমতাবস্থায় আফজালুল হক এবং আলী আকবর খানের পরামর্শ অনুযায়ী কিছুদিনের জন্য হাওয়া বদলাতে যান দেওঘরে। দেওঘর থেকে যত লেখা নজরুল লেখবেন তার সব মোসলেম ভারতের জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন, বিনিময়ে আফজালুল হক প্রতিমাসে একশত টাকা পাঠাবেন। এখানে আফজালুল হকের মুখ্য যে উদ্দেশ্য ছিল তা হলো নজরুলকে নিয়ে ব্যবসা করা। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। দেওঘরে গিয়ে আশানুরূপ রচনা তাঁর দ্বারা সম্ভব হয়নি। কাজী নজরুল ইসলাম এ সময় দেওঘরে যা রচনা করেছিলেন তা হলো স্নেহভীতু (ওরে এ কোন সুরধ্বনি নামলো আমার সাহারায়), প্রতিবেশিনী (আমার ঘরের পাশ দিয়ে সে), মুক্তিধারা (লক্ষ্মী আমার! তোমার পথে আজকের অভিসার), ছলকুমারী (কত ছল করে সে বারে বারে), অকেজোর গান (ঐ ঘাসের ফুলে মটরশুঁটির ক্ষেতে)। তিন মাসে তিনি মাত্র পাঁচটি গান রচনা করেন। বোধকরি নজরুল ইসলাম অসুস্থ হবার আগ পর্যন্ত আর কখনো এত দীর্ঘ সময়ে এত অল্প রচনা তিনি করেননি। শীতকালে নজরুল এই হাওয়া পরিবর্তন করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি আর্থিক সঙ্কটে পড়েছিলেন। আর তারই প্রমাণ দেওঘর থেকে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা নজরুলের এই চিঠি _

‘টাকা ফুরিয়ে গেছে, আফজাল কিংবা খান যেন শিগগিরই টাকা পাঠায়, খোঁজ নিবি আর বলবি আমার মাঝে মানুষের রক্ত আছে। আজ যদি তারা সাহায্য করে সে সাহায্য সুদে আসলে পুরে দেব।

(মুজফ্ফর আহমদ কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথা/পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা নং-১০৬) মুজফ্ফর আহমদ এবং তাঁর এক বন্ধু ইমদাদুল্লাহ নজরুলকে দেখতে গিয়েছিলেন। দেওঘরে নজরুলের অবস্থা সুবিধাজনক না দেখে মুজফ্ফর আহমদ ইমাদুল্লাহর কাছ থেকে টাকা ধার করে নজরুলকে কলকাতা নিয়ে আসেন। তখন মুজফ্ফর আহমদ থাকতেন ১৪/২ চেতলাহাট রোডের বাড়িতে। তিনি নজরুলকে সে বাড়িতে উঠালেন। পরদিন সকাল বেলা আফজালুল হক এসে তাকে বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এই বাড়িতে ছিল ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি’, আর এ সাতিহ্য সমিতির বাড়িতে কুমিল্লা (ত্রিপুরা) থেকে আগত শিশু পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা আলী আকবর খান থাকতেন। তিনিও নজরুলকে দেওঘরে যেতে উৎসাহিত করেছিলেন। আলী আকবর খান ঐ বাড়িতে থাকাকালে এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে নজরুল তাকে সেবা শুশ্রূষা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। সে কারণে নজরুলকে তিনি বেশ স্নেহ করতেন। এসব কারণে দেওঘরে থেকে ফিরে নজরুল তাদের ওপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এ সময় নজরুলকে দিয়ে খান সাহেব শিশু পাঠ্য পুস্তকের জন্য ‘লিচু চোর’সহ আরো কয়েকটি ছড়া লিখিয়ে নেন। পরে তিনি নজরুলকে তার দেশের বাড়ি যাবার প্রস্তাব দেন। আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে তার বাড়িতে যাওয়া উচিত কিনা তা সে সম্পর্কে মুজফ্ফর আহমদকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানিয়ে ছিলেন।

‘দেখ ভাই, আমার পরামর্শ যদি শুনতে চাও, তবে তুমি কিছুতেই আলী আকবর খানের বাড়িতে যেও না। তিনি অকারণে অনর্গল মিথ্যা কথা বলে যান, যেন অভিনয় করছেন এই রকম একটা ভাব তার কর্থাবার্তার ভিতর দিয়ে সর্বদা প্রকাশ পায়। কি মতলবে তিনি তোমায় তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চান তা কেউ জানে না। তিনি তোমাকে একটা বিপদেও ফেরতে পারেন।

(মুজফ্ফর আহমদ কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথা/পূর্বোক্ত পৃষ্ঠা নং-১২৩) তারপরেও ১৯২১ সালের ১৫ এপ্রিল কাজী নজরুল ইসলাম আলী আকবর খানের সঙ্গে চট্টগ্রাম মেলে যাত্রা করেন। পথে রচনা করেছিলেন ‘নীলপরি’ (ঐ সর্ষে ফুলে ফুটালো কার/হলুদ রাঙা উত্তরী/ঐ আকাশ গাঙে পাল তুলে যায়/নীল সে পরীর দূর তরী/তার অবুঝ বীণার সবুজ সুরে) কবিতাটি। যা পরে ছায়ানট কাব্য গ্রন্থে সংকলিত হয়।


পূর্ব বাংলার যে নৈসর্গিক দৃশ্য তা নজরুলের এই কবিতায় ধরা পড়েছে। ছোটবেলায় একবার তিনি ময়মনসিংহ এসেছিলেন। তারপর এই দ্বিতীয়বার তার পূর্ব বাংলায় আগমন। কিন্তু এবারের আগমন ও প্রত্যাগমন ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে ট্র্যাজেডিপূর্ণ। কুমিল্লায় পৌঁছে আলী আকবর খান ট্রেন থেকে নেমে নজরুলকে প্রথমে নিয়ে যান কান্দির পাড়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায়। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের পুত্র বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত ছিলেন আলী আকবর খানের সহপাঠী। তখন এই পরিবারের সঙ্গে ছিল তার গভীর সম্পর্ক। আলী আকবর খান বীরেন্দ্রের মা বিরোজা সুন্দরী দেবীকে মা ডাকতেন, সে সুবাদে এবার তিনি নজরুলেরও মা হলেন। বিরোজা সুন্দরী দেবী ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক এবং স্নেহময়ী রমণী। এ পরিবারের আরো ছিলেন বীরেন্দ্রের দুটি বোন-কমলা সেনগুপ্ত (বাচ্চি) ও অঞ্জলি সেনগুপ্ত (জটু), বীরেন্দ্রের বিধবা জেঠিমা গিরিবালা দেবী এবং তার একমাত্র সন্তান আশালতা (দুলি) (যে পরে প্রমীলা দেবী) এবং বীরেন্দ্র বাবুর স্ত্রী ও পুত্র রাখাল। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত সবাই ছিলেন সংস্কৃতিমনা। বিশেষ করে এ বাড়ির ছোট মেয়েরা (দুলি, বাচ্চি ও জটু) ছিল সংগীতে মুখর। নজরুলকে পেয়ে তারা অল্পদিনেই আপন করে নিলেন। কয়েকদিন কুমিল্লায় কাটানোর পর বৈশাখের শুরুতেই আলী আকবর খানের সঙ্গে তিনি তার দৌলতপুর গ্রামের বাড়িতে যান। আলী আকবর খানের গৃহকর্তী ছিলেন তার বিধবা বড় বোন। পাশেই ছিলেন আর এক বিধবা বোন মুন্সী আবদুল খালেকের স্ত্রী, ঐ বোনের এক পুত্র জাহাজে কাজ করতেন। সে কারণে তিনি সব সময় বাহিরে থাকতেন। আর ছিল এক কন্যা সৈয়েদা। সৈয়েদা মায়ের সঙ্গেই থাকতেন। নজরুল এ বাড়িতে অতিথি হবার পর আবদুল খালেকের স্ত্রী এবং সৈয়েদা প্রায়ই এ বাড়িতে আসা যাওয়া করতে থাকেন। নজরুলের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতাও হয়ে যায় তাদের। পরে এক সময় সৈয়েদা নজরুলের কাছে গান শিখতে আসে নিয়মিত। নজরুলের দৌলতপুরের কয়েকটি রচনায় ঐ ঘনিষ্ঠতার ছায়া পড়ে। ১৩২৮ সালের বৈশাখ মাসে দৌলতপুরে রচিত ‘হারামনির হার’ কবিতায় দেখি চির দূরন্ত কবিকে ঘরের মায়ায় মুগ্ধ করেছে।

তোরা কোথা হতে কেমনে এসে

মনিমালার মতো আমার কণ্ঠে জড়ালি

আমার পথিক জীবন এমন করে

ঘরের মায়ায় মুগ্ধ করে বাঁধন পরালি।

একই পরিস্থিতিতে জৈষ্ঠ্যমাসে রচিত আর একটি কবিতা হলো ‘মানস বধূ’। এ কবিতায় কবির বেদনার ছাপ পড়েছে। তবে তার মধ্য থেকে এক বধূর মূর্তি স্পষ্ট।

সে যেন কোন দূরের মেয়ে আমায় কবি মানস বধূ

বুক পোড়া আর মুখ ভরা তার পিছলে পড়ে ব্যথার মধু

নিশিথে রাতের স্বপন হেন

পেয়েও তারে পাইনি যেন

মিলন মোদের স্বপন কোলে কাঁদনভরা চুমোয় চুমোয়

নামহারা সে আমার প্রিয়া, তারেই চেয়ে জনম গোয়ায়।১৩২৮ সালের বৈশাখ মাসে দৌলতপুরে রচিত অবেলার গান, হার মানার হার, অনাদৃতা, বিদায় বেলায়, পাপড়ি খোলা এবং জৈষ্ঠ্য মাসে রচিত বেদনা অভিযান, হারামনির হার, মানস বধূ, বিধুরা পথিক প্রিয়া। কবিতাগুলো ছায়ানট কাব্যে সঙ্কলিত। এছাড়া একই সময়ে শিশুদের জন্যও তিনি রচনা করেন লাল সালাম এবং মুকুলের উদ্বোধন।

মূলত: আলী আকবর খানের যে উদ্দেশ্যে নজরুলকে কুমিল্লাতে আনা- তা হলো তাকে দিয়ে কিছু শিশু পাঠ্য পুস্তক উপযোগী ছড়া কবিতা লিখিয়ে নিয়ে ব্যবসা করে যাওয়া। কিন্তু তার সেই উদ্দেশ্য সফল না হওয়াতে খান সাহেব কৌশলে মন ঘোরালেন অন্যদিকে। তার ভাগ্নী সৈয়েদাকে নজরুলের সঙ্গে অবাধ সম্পর্কের টার্গেটে এ বাড়িতে নিয়ে আসলেন, আর নজরুলও দিন দিন সৈয়েদার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলেন। নজরুল তার নাম পাল্টিয়ে রাখলেন নার্গিস আশার খানম। এক পর্যায়ে আলী আকবর খানের উদ্যোগে তাদের মধ্যে বিবাহ স্থির হয়। নজরুল এ সময়ে তার বিয়ের খবর কোলকাতার বন্ধুবান্ধবদের লিখে জানান। কোলকাতার সাহিত্যিক বন্ধুরা এ সংবাদ শুনে অবাক হলেও তাদের বিবাহের জন্য শুভ কামনা জানিয়ে নজরুলকে পত্র দেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ১৯২১ সালের ৫ জুন নজরুলকে লিখলেন।


‘যখন আজ তোর চিঠিতে জানলুম যে, তুই স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে বরণ করে নিয়েছিস, তখন আমার অবশ্য কোনো দুঃখ নেই। তবে একটা কথা_তোর বয়স আমাদের চেয়ে ঢের কম, অভিজ্ঞতাও তদনুরূপ, ফিলিং এর দিকটা অসম্ভব রকম বেশি, কাজেই ভয় হয় যে হয়ত দুটো জীবনই ব্যর্থ হবে।’

(নজরুল রচনা)

সম্ভার, ঢাকা ২৫ মে ১৯৬৯)।

তবে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের ঐ পত্রে নজরুলের প্রেরিত চিঠির একটা উদ্ধৃতিও মেলে যাতে নজরুলের সৈয়েদা সম্পর্কে মনোভাব স্পষ্ট, ‘যাকে পেয়েছিস তিনিই যে তোর চির জনমের হারানো গৃহলক্ষ্মী এ কথা যদি একটুকু সত্যি হয়, তাহলে তোর সৌভার্গ্যের সত্যই ঈর্ষা হচ্ছে….। লিখেছিস এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছিস, যা কোনো নারীর কাছে কখনও হইনি। জেনে খুশিই হলাম যে তার বাইরের ঐশ্বর্যও যথেষ্ট।’ পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের এই চিঠিতে নজরুলের উদ্ধৃতি থেকে প্রমাণিত হয় যে, সৈয়েদার চেহারাও ছিল বেশ আকর্ষণীয়। ১৩ জুন ওজেদ আলী লিখেছিলেন;

‘নিভৃত পল্লীর যে কুটিরবাসিনী (দৌলতপুরের দৌলতখানার শাহজাদী বলাই বোধ হয় ঠিক না?) সঙ্গে আপনার মনের মিল ও জীবনের যোগ হয়ে গেছে, তাকে আমার শ্রদ্ধা ও প্রীতিপূর্ণ আদাব জানাবেন।’

সৈয়েদা মাত্র ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া জানতো। তাই নজরুলের সঙ্গে তার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেলে সৈয়েদার মামা আলী আকবর খান সৈয়েদাকে নজরুল ইসলামের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য নিজ হাতে শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সবকটি উপন্যাস বুঝিয়ে বুঝিয়ে পড়িয়ে বাস্তব জীবন সম্মন্ধে তাকে জ্ঞান দান করেন। এ ব্যাপারটি খান সাহেবের সংসারের কর্ত্রী তার বিধবা বোনের খুব অপছন্দ ছিল, কিন্তু তার করার কিছু ছিল না। তিনি শুধুমাত্র নজরুলকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তখন নজরুলেরও করার কিছু ছিল না। কারণ তাদের বিয়ে সমাগত। বিয়ে ঠিক হয়েছিল ৩রা আষাঢ় ১৪২৮ শুক্রবার। এই বিয়ে উপলক্ষে একটা নিমন্ত্রণ পত্র বিভিন্ন কাগজে ছাপা হয়েছিল। পত্রটি হলো:

জগতের পুরোহিত তুমি, তোমার এ জগৎ মাঝারে

এক চায় একেরে পাইতে, দুই চায় এক হইবার –

এ বিশ্ব নিখিলের সকল শুভ কাজে যার প্রসন্ন কল্যাণ আঁখি অনিমিখ হয়ে জেগে রয়েছে, তাঁর ওই মহাকাশের মহা সিংহাসনের নীচে আমার মাথা নত করে আমি আপনাদের জানাচ্ছি যে আমার পরম আদরের কল্যাণীয়া ভাগ্নী নার্গিস আশার খানমের বিয়ে বর্ধমান জেলার ইতিহাস প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের দেশ বিখ্যাত পরম পুরুষ, অভিজাত্য গৌরবে পরম গৌরবান্বিত, আয় মাদার মরহুম মেলৗভী কাজী ফকির আহমদ সাহেবের দেশ বিশ্রুত মুসলিম কুল গৌরব মুসলিম বঙ্গের রবি কবি সৈনিক নবযুগের ভূতপূর্ব সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। বাণীর দুলাল দামাল ছেলে বাংলার এই তরুণ সৈনিক কবি ও প্রতিভান্বিত লেখকের নতুন করে নাম বা পরিচয় দেয়ার দরকার নেই। এই আনন্দঘন চির শিশুকে যে দেশের সকল লেখক, লেখিকা সকল কবি যুবকরা ভালবাসা দিয়েছিলেন সেই বাঁধনহারা যে দেশমাতার একেবারে বুকের কাছটিতে প্রাণের মাঝে নিজের আসনখানি পেতে চলেছে এর চেয়ে বড় পরিচয় তার আর নেই। আপনারা আমার বন্ধু, বড় আপনজন। আমার এ গৌরব আমার এ সম্পদের দিনে আপনারা এসে আনন্দ করে আমার কুঠিরখানিকে পূর্ণানন্দ দিয়ে ভরাট করে তুলুন। তাই এ আমন্ত্রণ।


ছবিঃ সংগৃহীত

বিয়ের দিন আগামী ৩রা আষাঢ়, শুক্রবার নিশীথ রাতে।

আরজ

বিনীত আলী আকবর খান

দৌলতপুর ত্রিপুরা

২৮ শে জৈষ্ঠ্য ১৩২৮

(সূত্র : আবদুল আজীজ আল আমান ‘নজরুল পরিক্রমা’ কলকাতার ১৩৭৬)

ছবিঃ সংগৃহীত



এই নিমন্ত্রণপত্রে নজরুল ইসলামের বংশ এবং নিজের পরিচয়ে বেশ অহমিকার ছাপ স্পষ্ট যাতে তার অনেক বন্ধু, বান্ধব অখুশী। এই আমন্ত্রণপত্র কাগজে ছাপা হলে এক গোপন পত্রে মুজফফর আহমদ ২৬ জুন ১৯২১ সালে লেখেন ‘কাজী সাহেব, আপনার পত্রাদি যে মোটেও পাওয়া যাইতেছে না তাহার কারণ কী? খান সাহেবের নিমন্ত্রণপত্র পাইয়াছিলাম, পত্রখানায় আপনারই মুসবিদা করা দেখিলাম। পত্রের ভাষা দুই এক জায়গায় বড় অসংযত হইয়াছে একটু যেন কেমন দাম্ভিকতা প্রকাশ পাইয়াছে। আপনার হাত দিয়া অমোন লেখা বাহির হওয়া কিছুতেই ঠিক হয় নাই। আমার বড় ভয় হইতেছে যে, খান সাহেবের সংশ্রবে আপনিও না শেষে দাম্ভিক হইয়া পড়েন। অন্যে বড় বলিলে গৌরবের কথা হয়। আর নিজেকে নিজে বড় বলিলে অগৌরবের মাত্রা বাড়িয়া যায়। ‘মোহাম্মদী’ কে বিবাহের কথা ছাপিতে অনুরোধ করাটা ঠিক হইয়াছে কি? তারাতো নিজে হইতেই খবর ছাপিতে পারিতেন। বাস্তবিক আমার প্রাণে বড় লাগিয়াছে, বলিয়া আমি এত কথা বলিলাম। এই নিমন্ত্রণপত্র আবার ‘অপূর্ব নিমন্ত্রণ পত্র’ শিরোনামে বাঙালিতে মুদ্রিত হইয়াছে দেখিলাম। বাঙালিকে কে পাঠাইল?

(কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা/পূর্বোক্ত ভূমিকা ১৯৬৯)

আসলে মুজফফর আহমদের চিঠিতে আমরা যা পাই তাই ঠিক। কারণ কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টি ও জীবন পর্যালোচনা করলে কোথাও তার মধ্যে দাম্ভিকতার চিহ্ন পাওয়া যায় না। কুমিল্লায় থাকাকালীন সময়ে নজরুলের মধ্যে যে অহংকার জন্ম নিয়েছিলো তা সব আলী আকবর খানের জন্য। মুজফফর আহমদ ছিল তার খুব কাছের বন্ধু। তাই তার প্রাণে লাগাটাই স্বাভাবিক।

সে কথা এখানেই থাক। নজরুলের বিয়েতে আলী আকবর খান কান্দির পাড় থেকে ইন্দ্র কুমার সেন গুপ্তের পরিবার নিয়ে আসলেন। বিয়ের আসরে আরো ছিলেন বাঙ্গোরার জমিদার রায় বাহাদুর রূপেন্দ্রলোচন মজুমদার এবং বাঙ্গোরার হাই স্কুলের হেড মাস্টার অবনীমোহন মজুমদার। ঘটনার চক্রান্তে সে বিয়ে হয়নি। এই ঘটনা অনুসন্ধান করে মুজফফর আহমদ লিখেছেন ‘কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস বেগমের বিয়ে হয়নি এ সম্বন্ধে আমি স্থির নিশ্চিন্ত হইয়াছি। ইন্দ্র কুমার সেনের বাসা হইতে যে কয়জন নিমন্ত্রিত দৌলতপুরে গিয়েছিলেন সন্তোষ কুমার সেন নামক এক ১৫/১৬ বছর বয়সের বালক ছিলেন। অবশেষে সন্তোষের সঙ্গে আমার কথা হয়, তার দেয়া তথ্য থেকে বুঝা যায় আলী আকবর খানও এ বিয়ে ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। তার কাবিননামায় একটা শর্ত ছিল। তা হলো নার্গিসকে নিয়ে সে কুমিল্লাতে থাকতে পারবে কিন্তু ইচ্ছা মত যেখানে সেখানে নিয়ে যেতে পারবে না। যা কাজী নজরুল ইসলামের গৌরবে বেশ বেধেছিল আর বাধাটাই স্বাভাবিক।

এমন এক দুরন্ত কবিকে ঘর জামাই করে ঘরের কোণে বন্দি হওয়া কখনও সম্ভব নয়। সেবার কুমিল্লাতে বন্যা উঠেছিল। এমনি রাতে বিয়ের আসর হতে উঠে কুমিল্লার ১০/১২ মাইল পথ পায়ে হেঁটে কান্দির পাড়ে বিরোজা সুন্দরী দেবীর বাড়ি উঠেন। আবার বিরোজা সুন্দরী দেবীর প্রবন্ধ থেকেও এমনি তথ্য পাওয়া যায়।

৩রা আষাঢ় দিবাগত রাতে বিরোজা সুন্দরী দেবীর নিকট বিদায় নিতে এসে বললো, ‘মা আমি এখনি চলে যাচ্ছি’, ঐ অবস্থায় তাকে ফেরানোর কথাই ওঠে না। তিনি বললেন, তুমি বাইরের ছেলে কুমিল্লার পথঘাট চেনো না। যাও যদি বীরেন্দ্রকে নিয়ে যাও। সে কুমিল্লায় জন্মেছে আর কুমিল্লায় মানুষ হয়েছে। এ দেশের লোকজনকে চেনে। সে কাদা বিছানো পথে হেঁটে পরদিন সকাল বেলা কান্দির পাড়ে এসে পৌঁছালো। এমনিভাবে বিয়ের রাতে শাহ নজর ও বাসরের পরিবর্তে নজরুলকে হাঁটু কাদা পাড়ি দিতে হয়েছিল। পরদিন নজরুলের জিনিসপত্র বিরোজা সুন্দরী নিয়ে যান আলী আকবর খান নজরুলের জিনিসপত্র তল্লাশি করে কিছু চিঠি এবং কাগজপত্র রেখে দেন। এর পরে নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের আর কখনো দেখা হয়নি। এখানে নজরুল যে নার্গিসকে ভালোবাসতেন এ কথা সত্য তবে মুজফফর আহমদ নার্গিসকে অভিনেত্রী ও আলী আকবর খানকে অভিনেতা আখ্যা দিয়েছেন। মূলত আলী আকবর খান ভাগ্নীকে নজরুলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে নজরুলের মতো একজন প্রতিভাবান লেখককে হাতের মুঠোয় পুরে প্রকাশনা জগতে একচেটিয়া ব্যবসা করে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নজরুল তা বুঝতে পারেননি। আলী আকবর খান এবং নার্গিস আশার খানমের আচরণে নজরুলের পৌরষ যে প্রচ- আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল তা বিরোজা সুন্দরী দেবীর বাড়ি থাকাকালীন কিছুটা সামাল দিতে পেরেছিলেন। কিছুদিন পর তিনি সেখান থেকে মুজফফর আহমদকে একটা পোষ্টকার্ডে লেখেন তিনি যেন কুমিল্লাতে এসে তাকে নিয়ে যান। তিনি আলী আকবর খান দ্বারা প্রভাবিত এবং অপমানিত, দারুণ অসুস্থ। এ সংবাদ পেয়ে মুজফফর আহমদ ফকির দাস গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ৩০ টাকা ধার করে ১৯২১ সালের ৬ জুলাই কুমিল্লায় এসে পৌঁছান। এখানে এসে দেখেন বিরোজা সুন্দরী পরিবারের স্নেহমমতায় দৌলতপুর বিরহ অনেকটা সামলে উঠেছেন। তারা ৮ জুলাই কুমিল্লা থেকে কলকাতায় রওয়ানা দেন। চাঁদপুরে এসে টাকা ফুরিয়ে গেলে চাঁদপুর ডাকবাংলোয় উঠেন, আর কলকাতায় আফজালুল হককে টাকার জন্য টেলিগ্রাম করেন। তার অনুরোধে কুমিল্লার আরশাদ উদ্দিন চৌধুরী চাঁদপুর হরদয়াল নাথকে টেলিগ্রাম করে ভাড়ার টাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেন। পরে তার টাকায় তারা কলকাতা পৌঁছান। এরই মধ্য দিয়ে কুমিল্লার বেদনা বিধুর ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটে।

নজরুল কুমিল্লা থেকে কলকাতায় ফেরেন। কলকাতায় ফেরার পথে ১৭ দিনে ৪টি গান রচনা করেন। পরশপূজা (আমি এদেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তম…), মনের মানুষ (ফিরিনু যেদিন দ্বারে দ্বারে কেউ কি এসেছিল…), বিজয় গান (ঐ অভ্রভেদী তোমার ধ্বজ উড়লো আকাশে…), এবং পাগল পথিক (এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙিনায়…)। এর ৮ বছর পরে নজরুল প্রমিলা দেবীকে বিয়ে করেন।

ছবিঃ সংগৃহীত



নজরুল ফিরে এসে কলকাতায় মুজফফর আহমদের সঙ্গে ৩/৪ সি, তালতলার বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। দু’মাস পরে সেপ্টেম্বর মাসের এক রাতে আলী আকবর খান একদিন ঐ বাড়িতে যান। তিনি একটা মিটমাট করে নজরুলকে ফিরিয়ে নিতে চান। কিন্তু সফল হন না। খান সাহেব নিজে নজরুলের পাশে খাটের ওপর বসলেন। তার হাতে ১০ টাকার নোটের একটা বড় বান্ডিল ছিল। সেটা বার বার নাড়াচাড়া করছিলেন। খান চলে যাবার পরদিন নজরুল বিরোজা সুন্দরীকে লিখলেন ‘মা খান সাহেব আমাকে নোটের তোড়া দেখিয়ে গেল’।

নজরুল নার্গিসকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে ঢাকায় নিয়ে আলী আকবর খান নার্গিসকে কাছে ডাকলেন এবং নিজের প্রকাশনা দফতর, ঢাকার দোতলা বাড়ি তার নামে লিখে দিলেন। পরে তাকে অনেক শিক্ষিত করে তুললেন। নার্গিস অনেক শিক্ষিত হয়েছিল বটে কিন্তু নজরুলের উপযোগী হয়েছিল কিনা তাতে সন্দেহ আছে। দৌলতপুর ঘটনার ১৫ বছর পর নজরুল ০১/০৭/৩৭ তারিখে নার্গিসের একটা চিঠির উত্তর দেন। চিঠিটির বিভিন্ন অংশ বিশ্লেষণ করলে নজরুল-নার্গিসের সম্পর্ক স্পষ্ট। সে চিঠিতে সম্বোধন ছিল কল্যাণীয়াসু। তিনি লিখেছিলেন;

‘১৫ বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি বারিধারায় প্লাবন নেমেছিল। তা তুমি হয়তো স্মরণ করতে পারো। যাক তোমার অনুযোগ অভিযোগের উত্তর দেই। লোকের মুখের শোনা কথা দিয়ে তুমি যদি আমার মুখটি কল্পনা করে থাকো তাহলে আমায় ভুল বুঝবে। আর তা মিথ্যা।’

চিঠিতে নার্গিসের প্রতি কোনো অনুযোগ বা অভিযোগ ছিল না। একটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি নিয়েই লিখেছিলেন। ১৫ বছর পর নার্গিসের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ না থাকলেও নার্গিসের প্রতি ভালবাসা ও অসীম বেদনার অকপট স্বীকৃতি;

‘আমার অন্তর্যামীই জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা- কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমি নিজেই পুড়ছি। তা দিয়ে তোমায় কোনোদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি আগুনের এই পরশমনি না দিলে আমি অগি্নবীণা বাজাতে পারতাম না, ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণরূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনে সর্বপ্রথম ভালোবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম সেরূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মতো চির অমস্নান হয়ে আমার বক্ষে আছে।’

নজরুলের এই চিঠিতে যেমন নার্গিসের প্রতি ভালোবাসা ও অসীম বেদনা স্পষ্ট তেমনি তার অভিভাবকের প্রতি তার অভিযোগও স্পষ্ট।

‘তুমি ভুলে যেও না আমি কবি- আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর কুৎসিতের সাধনা আমার নয় আমার আঘাত বর্বর কাপুুরুষের মতো নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি শুনেছ জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোনো অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবিও নেই।’ উদ্ধৃতিতে স্পষ্ট তার অভিভাবক আলী আকবর খান সম্বন্ধে নজরুলের মন্তব্য। নার্গিসের চিঠিতে আত্মহত্যার কথাও হয়তো ছিল যার উত্তর নজরুল সহজভাবে দিয়েছিলেন ‘আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরনো কথা হলেও পরম সত্য। ‘আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না।’ এই চিঠিতে নার্গিসের প্রতি নজরুলের আরো অনুভব মেলে।

‘হঠাৎ মনে পড়ে গেল পনের বছর আগের কথা। তোমার জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র সুন্দর ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল, তোমার ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি। মনে হয় যেন কালকের কথা। মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারে না। কি উদগ্র অতৃপ্তি কি দুর্দমনীয় প্রেমের জ্বরই সেদিন এসেছিল, সারারাত আমার চোখে ঘুম ছিল না। যাক আজ চলেছি জীবনের অস্তমান দিনে শেষ রশ্মি ধরে ভাটার স্রোতে। তোমার ক্ষমতা নেই সেই পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করো না। তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক…।


ছবিঃ সংগৃহীত

নজরুল নার্গিসের পত্র পাবার পর একটি গানও রচনা করেছিলেন (যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই কেন মনে রাখো তারে…)। নজরুল নার্গিসের সম্পর্ক ও এই সম্পর্কে নজরুলের জীবনে প্রতিফলন নার্গিসের কাছে লেখা নজরুলের প্রথম ও শেষ চিঠি থেকে বুঝা যায়। তবে একথা সত্য যে নজরুল- নার্গিসের বিয়ে না হওয়ার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী নার্গিসের মামা আলী আকবর খান।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত