নারদঃ নারদঃ

Reading Time: 3 minutes
একচালা দুইঘর দুলাল আর কেষ্টর, দুজনের  বউ নিয়ে সংসার।সামনে একটা খোলা বারান্দায় বিনা পার্টিশানেই দুজনের বউ রান্না করে।কথা চালাচালি –বাটি চালাচালি–মাঝেসাঝে চুলোচুলিও — তবুও ভালোমন্দ মিশিয়ে থাকে দুটো পরিবার।আপন বলতে এখানে আছেই বা কে?কাজের সুবাদে এখানে আসা। দুলাল আর কেষ্ট ছোটো বেলা থেকেই এক জায়গায় বড় হয়েছে। পাওয়ার হাউস এর পাঁচিলের উল্টোদিকের দেওয়ালে সারি সারি টালি আর খরের ছাউনিওয়ালা ছোটো পায়রার খোপের মতো ঘর। এখানেই কেটেছে কেষ্ট দুলালের শৈশব। তারপর কৈশোরে পা দিয়েই পড়াশোনা শিকেয় তুলে লুকিয়ে  বিড়ি টানা আর টো টো করে ঘুরে বেড়ানো। টানাটানির  ঘরে ছোটো ভাই বোন থাকলে এ আর কদ্দিন? ঘরে সারাক্ষণ মুখ ঝামটা পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা বাবার অন্ন ধংস শুনে শুনে দুইজনই ইনকামের পথে পা বাড়ায়। প্রথমে ছোটোখাটো কাজ।বিড়ির পয়সা রেখে বাকিটুকু মায়েদের হাতেই। কিন্তু এও আর কদ্দিন? যৌবন যে দোর গোড়ায়। কেষ্ট নিজেদের বস্তির মেয়ে কুসুম কে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে ক’রে আমোদপুর থেকে বর্ধমান চলে যায়।আগে থেকেই কাজ ঠিক করে রেখেছিল বর্ধমানের এক চালকলে।  চালকলে কাজে লেগে যায় কেষ্ট।ছেলে হাতের নাগালের বাইরে, কেষ্টর মা দুলাল কে ধরে অনেক কান্নাকাটি করলেও দুলাল আর কি করবে?কেষ্ট দুলাল কে টপকে গেল এ যে দুলালের হজম করা কি কষ্টের সে একমাত্র দুলালই জানে।মনে মনে রাগ, অভিমান দুটোই হয় কেষ্টর উপরে।
মাস আটেক পরে কেষ্ট বউ নিয়ে নিজেই এলো পাড়ায়। আগেই শ্বশুরবাড়ি ঢুকল পিঠ বাঁচাতে।কেষ্টর হাতে ঠ্যাং বাঁধা দুটো লটকান মুরগি আর মিষ্টির হাঁড়ি দেখে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়া রাগ গলে জল হয়ে সেই জল গলাকাটা মুরগির  রক্তে মিলে মিশে থৈ থৈ খুশি কুসুমের বাপের বাড়িতে। তাছাড়া কথায় আছে রাগ কমানোর বড় ওষুধ  হোলো সময়।কেষ্টর মা বাবাও খুশি দুদিনের জন্য হলেও ছেলেকে কাছে পেয়ে।
এদিকে দুলালও বিয়ে করে বউ এনেছে।কিন্তু মা বউএর রোজ ঝগড়া দুলালের অসহ্য লাগে। দূরে আছে বেশ আছে কেষ্ট…
কেষ্ট ও দুলাল এখন দুজনে একই চালকলে কাজ করে,দুলালকে কেষ্টই চালকলে কাজটা পাইয়ে দেয়। এর জন্য কেষ্ট দুলালের উপর একটু মাতব্বরিও করে।তাছাড়া কেষ্ট মাইনে বেশি পায় তার কিছুটা ঝাঁঝ তো থাকবেই।দুলালও সহ্য করে নেয় এটুকু ,মা বউ এর ঝগড়া থেকে তো মুক্তি পাওয়া গেছে। আর একচালার দুই ঘরে দুই পরিবার  থাকতে গেলে একটু আধটু তো মানিয়ে নিতে হয়। কেষ্ট অবশ্য  মানিয়ে নেওয়ার  ধার ধারেনা। এর জন্য দুলালের বউএর চাপা বিরক্তি ওদের উপর।
দুলালের বৌ বাড়ি বাড়ি ঠিকে কাজ করে।  সেই কারণে কেষ্ট কথায় কথায় দুলালের  বৌএর আড়ালে দুলালকে ঠেস মেরে কথা শোনায় ,“মেয়েছেলের ইনকাম? থু থু তার চেয়ে না খেয়ে মরা ভালো, বউএর আনা পয়সায় আমি ইয়ে করি, কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি, ” ছ্যা  ছ্যা বলতে বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুলালের বউএর ডবকা চটকদার চেহারা ,শ্যামলা গায়ের রং  নিটোল শরীর,তেল চপচপে ঘাড় আর ঘাড়ের কাছে এইয়া বড়ো একটা খোঁপা, কি লাগে মাইরী..
 কোমরে কাপড় জড়িয়ে যখন কাজে যায়  চোখ দিয়ে মাপে কেষ্ট ,পাঁচবাড়ি কাজকরে অথচ একটুও টসকাই নি দুলালের বউটা, যেন জলভরা তালশাঁস! ভাবতে ভাবতে মুখের কস বেয়ে লালা ঝরে কেষ্টর আর মনে মনে ভাবে আমার বউটা ঘরে ব’সে খেয়ে প’রে কি ছিরি হচ্ছে দিনদিন যেন সাতদিনের বাসি শুটকো বেগুনের মত! মনে মনে জ্বলে ওঠে কেষ্ট…
এবার চালকলের মালিক বোনাস দিয়েছে অনেক ঝামেলার পরে।কেষ্ট বোনাস পেয়েছে কিন্তু  দুলাল নতুন কাজে ঢুকেছে বলে বোনাস পায়নি।
মহালয়ার দিন কেষ্ট বউ নিয়ে  পুজোর কেনাকাটা ক’রে দুলালের ঘরে যায় জামাকাপড় দেখাতে,দেখাতে না ছাই,যায় জ্বলন  ধরাতে !
মনেমনে ভাবে কেষ্ট এবার লাগবে ঝগড়া দুলালের ঘরে।পারবে নাকি আমার মতো বউকে জরিপাড় শাড়ী এনে দিতে?ভেতরে ভেতরে খুশির খৈ ফোটে কেষ্টোর।
আজ সপ্তমীর ঘট ভরবে বলে ভোর বেলায় ঢাকের  আওয়াজে পাড়া জেগে উঠেছে –
কেষ্ট দেখে দুলালের বউকে, ভিজে এলোচুল  কোমর ছাপিয়ে আর ভেজাব্লাউজ থেকে আবছা পিঠের রেখা দেখা যাচ্ছে, বড় সিদুঁরের টিপ, পায়ে চওড়া করে পরা আলতা,পরনে নতুন  শাড়ি, একটা ছোট্ট পেতলের ঘট মাজছে আজ জলভরা ঘট পাতবে ব’লে।কেষ্ট টুকটুক করে দুলালের বউএর কাছে এসে হলুদ ছোপ ধরা দাঁত বের করে বলে, কি ব্যাপার দুলাল কি শাড়ি আর মনোহারীর ব্যাবসা করবে নাকি? বারান্দায় চটের উপর কতগুলো নতুন শাড়ি সায়া, ব্লাউজ , পাশে আলতা ,সিঁদুর ,গন্ধতেল , সাবান?
দুলাল পেছন থেকে এসে বলে দেখতো কেষ্ট তোর বউ এর কি হলো!
কেষ্ট ছুটে ঘরে ঢোকে– দুলাল শোনে কেষ্টর বউ চিৎকার  করে কাঁদছে আর ঝগড়া করে ব’লে চলেছে কেষ্টকে, সন্দেহ বাতিক মানুষ তুমি একটা,তাই তুমি আমাকে কারও ঘরে কাজ করতে পাঠাও না।পাঁচ ঘরে কাজ করে ব’লে দেখেছ দুলালের বউএর পুজোতে কত কটা শাড়ী কত মনহারী আর আমার মাত্র একটা শাড়ি আর পাঁচ দিন পূজো…
ঘট ভরতে চলে যায় দুলালের বউ।
নিজের বৌ যে দুলালের একমাত্র অহংকার! দুুলাল মুচকি হেসে ঘরে ঢুকে যায় আর মনে মনে বলে নারদঃ নারদঃ।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>