| 16 এপ্রিল 2024
Categories
গীতরঙ্গ

ইরাবতী গীতরঙ্গ: ওড়িয়া মহাভারতের নবগুঞ্জর । সুকন্যা দত্ত

আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট

পুরাণ অনুযায়ী , যখন পৃথিবীতে ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় তখন দেবতারা অবতার রূপে মর্ত্যে আর্বিভূত হন। “অবতার” শব্দের  অর্থ হলো যিনি অবতরণ করেছেন। স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য ধর্ম অনুশীলন করেন।  কথিত আছে,  ধর্মকে যিনি রক্ষা করেন, ধর্ম তাকে রক্ষা করে ‘ধর্মো রক্ষতি রক্ষিতঃ’।

দেবতাদের অবতার রূপের কথা  বারংবার উঠে আসে পুরাণ কাহিনীতে, লোককথায়, মহাকাব্যে। তাঁরা  অনাদি, অনন্ত, অখন্ডিত। বিষ্ণুর দশাবতার এর কাহিনী আমাদের সকলের জানা।   

১৫০০ শতকে  ওড়িশার আদিকবি সরলা দাস রচিত মহাভারত এ “নবগুঞ্জর ” অবতারের  এর উল্লেখ রয়েছে।  “সরলা মহাভারত” নামে পরিচিত ওড়িয়া মহাভারতের এই সংস্করণ অনুযায়ী, “নবগুঞ্জর” রূপে  কৃষ্ণ অর্জুনের সামনে  আবির্ভূত হয়েছিলেন। “সরলা  মহাভারত” এর মধ্যপর্বের কাহিনী অনুযায়ী, মণিভদ্র পর্বতে অর্জুনের সম্মুখে হঠাৎ অপরিচিত একটি প্রাণীর আগমন ঘটে।   ” নবগুঞ্জর” অবতার   সরলা দাসের আদি সৃষ্টি  এবং  তার উৎস কোনো  মৌখিক আখ্যান কিংবা  ওড়িশার লোককাহিনী। পূর্ব ভারতের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পাওয়া মুন্ডা উপজাতিদের টোটেমিক গল্পও অবশ্য  এ কাহিনীর ভিত্তি হতে পারে। 

‘নব ‘শব্দের অর্থ হলো   নয় আর ‘গুঞ্জর’  অর্থাৎ সত্তা । “নবগুঞ্জর”মূলত পরম জীবন-শক্তির একটি অসাধারণ কল্পনাপ্রসূত চিত্রায়ন, যা তিনটি উল্লেখযোগ্য শ্রেণি “সত্তার” (গুঞ্জরা) সমন্বয় করে:

(ক) পশু/পাখি; 

(খ) মানুষ; 

(গ) ঐশ্বরিক বা ঈশ্বর সদৃশ সত্তা। 

তাছাড়া এই অবতারে একটি দেহে নয়টি প্রজাতির সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়।

 (১) একটি মোরগের মাথা; 

(২)ময়ূর পাখির গলা; 

(৩) একটি ষাঁড়ের কুঁজ হিসাবে শরীর; 

(৪) সিংহের কোমর; 

(৫) মানব/ঐশ্বরিক সত্তার হাত; 

(৬)বাঘের এক পা; 

(৭) একটি ঘোড়া/হরিণের একটি পা এবং খুর; 

(৮) একটি হাতির এক পা; 

(৯) লেজটি একটি সাপ। 

“নবগুঞ্জর ” কাহিনী অংশে টোটেমিক এবং আধ্যাত্মিক তাৎপর্যের  সাথে মিলিত রয়েছে  চিন্তাশীল পরিবেশ-সচেতনতার ছায়া । এই প্রাণীকে দেখে অর্জুনের মধ্যে বিস্ময় ও ভয়ের উদ্রেক হয়। 

যদিও অর্জুন প্রথমে মনে করেন যে এই প্রাণীটি একধরনের দানব , অবশেষে তিনি উপলব্ধি করেন যে এই রূপ   পরম দেবত্বের। বিদেশি পুরাণের এ জাতীয় অস্বাভাবিক প্রাণী “Hydra”,” Chimera”,”Dragon”,”Unicorn “নামগুলোর সাথেও  আমরা পরিচিত। “নবগুঞ্জর” এর সূচনা অর্জুনের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গকে কেন্দ্র করে। কথিত, পঞ্চপান্ডব  প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন,   দ্রৌপদীর সাথে  একে অপরের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত  পরস্পরের  অগোচরে থাকবে। কিন্তু  অগ্নিদেবতার আদেশের কারণে অর্জুন  এই ব্রত ভঙ্গ করতে বাধ্য হয়।  অগ্নিদেব  একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিতের ছদ্মবেশে এসে অর্জুনকে যুধিষ্ঠিরের সাথে সাক্ষাৎ করতে  বলেন।  অর্জুন জানতেন, সেই সময়টি   যুধিষ্ঠির এবং দ্রৌপদী  একান্ত নিজস্ব সময় ।  তাই অর্জুন অগ্নিদেবের আদেশে  অসম্মত হলে অগ্নিদেব ক্রোধিত হয়ে সমগ্র  সৃষ্টি পুড়িয়ে ফেলার  হুমকি দেন।  অর্জুন ভীত হয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে যান এবং দ্রৌপদীর সাথে  অন্তরঙ্গ মুহূর্তে তাদের  দেখে ফেলেন। অনুতাপে দগ্ধ হয়ে  অর্জুন মণিভদ্র পর্বতে ভ্রমণ করতে থাকেন।  পাপের প্রায়শ্চিত্তের  জন্য তপস্যায় রত হন এবং  পর্বতে বসবাস শুরু  করেন। অবশেষে কৃষ্ণ  নবগুঞ্জর রূপধারণ করে অর্জুনকে দেখা দেন।

গবেষকদের মতে,  অর্জুন  অগ্নিদেবতার ক্ষুধামান্দ্য দূর করার জন্য তাঁর  আদেশে অরণ্য খাণ্ডবপ্রস্থ দহন করতে সাহায্য করেছিলেন।  অগ্নিদেবতার অরুচি মেটাতে  অগ্নিকে সমস্ত ভেষজ, গাছ, পশু, পাখি, গুল্ম, গাছপালা ইত্যাদি গ্রহণ করতে সাহায্য করেছিলেন।  এভাবে  যখন সমগ্র খাণ্ডবপ্রস্থ আক্রমণাত্মকভাবে ধ্বংস হচ্ছিল, তখন পাখি ও পশুরা বিলুপ্তির ভয়ে কৃষ্ণের কাছে আশ্রয়ের জন্য ছুটে যায়।  মানব সমাজের  আগ্রাসনের কারণে প্রজাতির বিলুপ্তির বিপদ সম্পর্কে তাদের গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করে।   একজনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা ক্ষুধা মেটানোর জন্য একটি বন ধ্বংস করা  অনৈতিক।  অর্জুনকে সম্পূর্ণ খণ্ডবপ্রস্থ ধ্বংস করা থেকে বিরত রাখার জন্য এবং অন্যান্য প্রজাতিকে রক্ষা করার জন্য, কৃষ্ণ এই কামেরিক(  রূপটি গ্রহণ করেছিলেন। কেবল মানুষের মধ্যে  নয় “অন্যান্য” সকল প্রজাতির জন্য একজন রক্ষকের ভূমিকার প্রতীক  ” নবগুঞ্জর”।

অর্জুন যখন এই অস্বাভাবিক প্রাণীর সাক্ষাৎ পেলেন , তখন প্রথমে ধনুক নিয়ে তাঁকে মারতে উদ্যত হলে নবগুঞ্জর মনুষ্য হাতে একটি পদ্মফুল অর্জুন কে উপহার দিলেন। তৃতীয় পান্ডব  আত্মসমর্পণ করলেন নবগুঞ্জরের কাছে। 

নবগুঞ্জর  অবতারের কাহিনী  পরিবেশের প্রতি  সংবেদনশীলতা, অবলা প্রাণীদের প্রতি মায়া মমতা, সৃষ্টির সকল উপাদানের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়। কিছুদিন আগে আমাজন, অস্ট্রেলিয়ার গহন অরণ্যে দাবানল জ্বলে ওঠার ঘটনা সকলেরই জানা। প্রকৃতি  অত্যাচারিত হয় মানুষের কাছে।  বনের দাবানল,  হিমবাহ গলন, মৌমাছি এবং পাখিদের বিলুপ্তি, বিপন্ন সমুদ্র পৃষ্ঠ,  জলবায়ুর আকস্মিক পরিবর্তন পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলছে প্রতিনিয়ত। শিল্পায়ন, নগরায়ন,  সভ্যতার বিকাশ মানুষের আগ্রাসন নীতিকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করছে। প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস পৃথিবীর বিনাশকে ইঙ্গিত করছে। নবগুঞ্জর অবতার মানুষের অহং কে অনবদমিত করে জীবকুলের সমকক্ষে দাঁড় করায়। পৃথিবী সৃষ্টি সকল প্রজাতি ভিন্ন অসম্পূর্ণ। 

 

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

error: সর্বসত্ব সংরক্ষিত