আজ ০৬ নভেম্বর কবি নাজনীন খলিলের জন্মতিথি। ইরাবতী পরিবার তাঁকে জানায় শুভেচ্ছা ও নিরন্তর শুভকামনা।
কাগজের নৌকা
রাতের বোতল উপুড় করে, দীর্ঘশ্বাসের মদ পান করেছি গোপনে
তার ক’ফোঁটা ভাগ আমি নদীকে দিয়েছি;
গড়াতে গড়াতে ঠিক মিশে গেছে সমুদ্রের নুনে।
আজ আবার বৃষ্টি
আজ আবার কাগজের নৌকা ভাসানো দিন;
কতদিন স্বপ্নের স্বাক্ষর এঁকে ভাসিয়েছি রঙ্গীন কাগজ ।
পায়ে পায়ে নিগড়ের নিষ্ঠুর ঝনৎকার ছিল। পথ ক্ষমাহীন।
আকাশ-উদ্যানের সিঁড়িতে রেখেছি দ্বিধান্বিত পদক্ষেপ
কত নক্ষত্রের ফুল জমে আছে আকাশের গোপন পকেটে,
আজো খুঁজে ফিরি।
পাথরে পাথর ঘষা আগুন থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে যে তারার ফুলগুলো ,
আমি কুড়িয়ে নিয়েছি ,
মায়াবতি স্বপ্নের ভেতর থেকে কুড়িয়ে নিয়েছি এক টুকরো চাঁদ।
গন্তব্য অজানা-
ঘাসফড়িংয়ের পেছনে ছুটতে ছুটতে
আমিও যে কতবার ঘাস হয়ে গেছি তৃণমূলের জলকণা জানে ।
আজ আবার-
আনমনে ঢুকে পড়ি এক ছবিঘরে
দেয়ালে ঝুলন্ত ক্যানভাসে খুঁজি
মেঠো আলপথ, শিশির ছড়ানো সর্ষের ক্ষেত।
মরফিন-চর্যায় নিঃসাড় পড়ে আছে যে অচেতন দেহ
সে কি সন্নিবদ্ধ হাতের কপাট খুলে হারিয়ে ফেলেছে জাদুর কপোত!
বিঁধে আছে তীর এবং ভাঙ্গাকাঁচের টুকরো
পায়ে বিঁধে গেছে ভাঙ্গা কাচের টুকরো
রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে ড্যান্সফ্লোরে—
নাচঘরে কেন এমন ছড়িয়ে দিয়েছো চূর্ণকাচ,
পাপড়ির নিচে গোলাপের কাঁটা?
আমার তো জানাই ছিল
পারশিগালিচার নিচে— রক্ত এবং কাচের টুকরো; দুটোই লুকনো যায়।
রোজ ঘুম ভাঙতেই দেখি
সমস্ত শরীর জুড়ে বিঁধে আছে ঈর্ষার ছোট ছোট তীরগুলো।
যখন বিভোরঘুমে
বুকের ভেতরে পাখি, প্রজাপতি আর ঘাসফুল তুলে রাখি;
কেউ ভালোবেসে দিয়ে যায় তীরউপহার।
তারপরেও এই যে ভাগাভাগি করে নিচ্ছি আকাশ
আর সমুদ্রের ঢেউ; ভালো লাগছে।
ইদানীং খুব সচেতনে
মানুষের ভাঁজকরা মুঠোর দিকে তাকিয়ে দেখি
কখন কোন ফাঁকে গুপ্তনখরগুলো বের হয়ে আসে।
চাঁদ ডুবে গেলে
আমাদের একটা ছায়াঘর ছিল—
খুব রোদ্দুরের দিনে চুপচাপ পাতাঝরার শব্দ শোনার জন্য
তখন—
আবছাম্লান নীহারকণার মতো স্বপ্নেরা উড়ে উড়ে যেতো চারপাশে।
আমি রাতকে বলেছি আরো কিছুটা সময় থেমে যেতে;
নীলজোনাকিরা যেটুকু সময়—
সোনালীআগুন জ্বালিয়ে রাখে মুঠোর ভেতরে।
ঝিঁঝিপোকারা কথা দিয়েছিল কণ্ঠে তুলে দেবে গুনগুন গুঞ্জরণের
ঝিনিকিঝিনি সুর।
খুব ভীরুতায় রাত বললো—
সেও থাকতে পারে না চাঁদের পাহারা ছাড়া;
চাঁদ ডুবে গেলে
সেও চলে যাবে।
থেমে গেল নক্ষত্রের সব কোলাহল।
চাঁদ ডুবে গেলে রাত নিভে যায় ।
কেন যে!
সভ্যতার হাত ধরে মুছে ফেলি সরল স্বীকারোক্তিগুলো।
ভুলে গেছি প্রথম বৃষ্টির সোঁদাগন্ধ।
টিনের চালে বর্ষণের ঝমঝম করতাল ঘুমের মদিরা।
“বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল…”
শ্রাবনের ভরা গাঙ্গে ভেসে যাওয়া পদ্মপাতায় আঁকা পায়ের ছাপ;অভিজ্ঞান।
বকুল তলায় জেগে উঠা ভোর
ডাকপিয়নের প্রতীক্ষা্য মন আনচান করা প্রহরগুলো।
ভাল লাগেনা-প্রিয়জনের উৎকন্ঠিত মুখ, ব্যাকুল জিজ্ঞাসা।তাই সারাক্ষণ ভাল থাকি।
মন্ত্রের মতো প্রবোধবাক্যে সান্ত্বনা খুঁজি-
কোন এক শিশির ভেজা ভোরে কুয়াশার চাদর গায়ে হেঁটে যাবো দূর গাঁয়ের অচেনা পথে
সবুজ ঘাসের বুকে ঝরে পড়া নীহারের ফুল কুড়োতে কুড়োতে যাবো
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে মেখে নেবো সর্ষেক্ষেতের ঘ্রাণ
নাগরিক বিষগন্ধ পিছনে ফেলে বহুদূর চলে যাবো।আর ফিরবোনা।
কোথাও যাইনা।শিকলে বেঁধেছি পা।শিকল খুলেনা।
চলে যাচ্ছি—-চলে যাচ্ছি—–চলে যাচ্ছি———–
ছুটে চলেছে বিশাল ড্রাগন মুখে আগুনের ধোঁয়া ।
আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে স্টেশন-চেনা শহরের শেষ চিহ্ন।
দু’পাশের ধানক্ষেত –ক্ষেতে কাজ করা চাষী-মাঠে চরা গরুর পাল-বাঁশী-বাজানো রাখাল-বালক-
-খাল-বিল-নদী-
কত দ্রুত পিছনে চলে যাচ্ছে সব-আড়াল হয়ে যাচ্ছে।
-” মামাবাড়ির পদ্মপুকুর গলায় গলায় জল
এপার হতে ওপার গিয়ে নাচে ঢেউয়ের দল।”
চা-বাগান–পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ফুটে থাকা নাম না জানা ফুলের নানারঙ -অচেনা লোকালয়-
এসব দুই চোখে মেখে নিয়ে আমিও ফিরে যাচ্ছি বার বার আমার শৈশবে-কৈশোরে।
স্মৃতি থেকে খুঁড়ে তুলছি সেইসব রূপালী-বিষাদ যারা চোরা-জ্যোৎস্নার আড়ালে লুকোনো ছিল।
আর আগুনের স্তব গাইতে গাইতে একদিন ছায়াপথে মিলিয়ে গিয়েছিল যে নীলকন্ঠ পাখীর ঝাঁক ,
আজ আবার ফিরে এলো ডানায় আগুন ছড়াতে ছড়াতে।
এমনি এক জংশনে আমি উঠে পড়েছিলাম একটি ভুল গাড়ীতে।
টিকিট-চেকার বললো-‘এ গাড়ীতো আপনার নয়,-এখানেই নেমে যান’।
সকলেরই কি থাকে অচেনা-মাঝপথে নেমে যাবার সাহস? আমার ছিলনা।
অনুচ্চারের বর্ণমালায় সাজানো ডিঙ্গা ভেসে গেছে মেঘের ঢেউয়ের ভেতরে।
পাখীর চঞ্চুতে লেগে থাকা বিষ
অথবা
স্বপ্নের ভেতরে হুটহাট কালোবেড়ালের আনাগোনার কথা কেউ কেউ জানে।
কিছুতে মেলেনা গনিতের ছক
পৌনঃপুনিক শূন্যের ভারে হিসেবের খাতা ভারী হয়ে ওঠে।
উপন্যাসের পরিণতিটা জানা গেলনা-
শেষ ক’টি পাতা ছেঁড়া ছিল।