Irabotee.com,irabotee,sounak dutta,ইরাবতী.কম,copy righted by irabotee.com,nazrul-islam-music-irabotee-gitaranga-special

গীতরঙ্গ: শাক্ত সাধনা ও শ্যামা সঙ্গীতে নজরুল । পারমিতা চক্রবর্ত্তী

Reading Time: 4 minutes

সঙ্গীত হল এমনই  এক সাধনা যার মধ্য দিয়ে পাওয়া যায় নিরন্তর  মুক্তি৷ এটি এমনই এক শিল্প যার মধ্য দিয়ে শিল্পী নিজেকে উজাড় করে দিতে পারেন। সঙ্গীতের মূল লক্ষ্য হল মানুষকে আনন্দ, তৃপ্তি প্রদান করা৷ আনন্দে, দুঃখে, ভালোবাসায় সঙ্গীত শোনা যায়৷ আবার সঙ্গীত মানুষের ক্লান্তি নিবারণ করে, মননে শক্তি প্রদান করে৷

সঙ্গীতের ধরন অনুযায়ী সঙ্গীতকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়৷

ধর্মীয় সঙ্গীত- শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, শ্যামা সংগীত,মাইজ ভাণ্ডারী গান, সংকীর্তন।
জাতিগত সঙ্গীত-আগমনী গান, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া মাদার গান, বোলান গান, ধামাইল গান/নাচ গম্ভীরা চটকা গান, কবি গান।
ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত- রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি কবিগান, লালন মহীনের গান৷
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় গানগুলির অধিকাংশই ছিল ধর্মীয় সঙ্গীত। মধ্যযুগের প্রথম  দিকে বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস ও বলরাম দাস  প্রমুখ বৈষ্ণব পদকর্তাগণ রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক গানে জাগতিক ও আধ্যাত্মিক প্রেমচেতনার একটি পার্থক্য দর্শিয়েছেন। আবার মধ্যযুগের শেষ পাদে রামপ্রসাদ সেন ও কমলাকান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ শাক্তপদাবলিকারগণ তাঁদের গানে ঈশ্বরকে শুদ্ধ মাতৃরূপে বন্দনার কথা বলেছেন। বৈষ্ণব ও শাক্তপদাবলি (শ্যামাসঙ্গীতও উমাসঙ্গীত) উভয়েরই মূল উপজীব্য হিন্দু ভক্তিবাদ৷ভক্তিবাদী দর্শন। বৈষ্ণব সঙ্গীতে  যখন জীবাত্মা-পরমাত্মাকেন্দ্রিক প্রেমভক্তির তত্ত্ব প্রচারিত হয়, তখনই শাক্তগানে তন্ত্র ও শুদ্ধ মাতৃবন্দনার এক সম্মিলন গড়ে ওঠে।

আমি যে  বিষয় নিয়ে আলোচনা করব তা হল শাক্ত  সাধনা ও শ্যামাসঙ্গীতে নজরুল। নজরুলের শ্যামা কিংবা কালী সাধনার  কারণ সুস্পষ্ট ভাবে উল্লেখ না থাকলেও তিনি যে শ্যামা বা কালী সাধক  ছিলেন কিনা সে বিষয়ে  কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি৷ তবে তার সঙ্গীতে শ্যামা বা কালীসাধনায়  যে ভক্তি দেখা গিয়েছিল তা শুধুমাত্র তার মেধার জোড়েই লেখা হয়েছিল কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে৷ তবে একটা বিষয় স্পষ্ট নজরুল তাঁর  পুত্রশোক এবং স্ত্রীর অসুস্থতায় প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। সেই সময়ে তিনি মুক্তির পথ তীব্র ভাবে খুঁজছিলেন। সেই পথ কী  শ্যামা সাধনা? 
কাজী নজরুল ইসলাম রামপ্রসাদের পরেই  শ্যামা সঙ্গীতের উজ্জ্বল নাম। ভিন্ন ধর্মের মানুষ হয়েও এত বিস্তৃতরূপে আর কোন কবি পরবর্তীকালে শ্যামা সঙ্গীত রচনা করে বিখ্যাত হননি৷ নজরুলের শ্যামা সঙ্গীতের সংখ্যা ২৪৭ টি৷ এখন প্রশ্ন হল নজরুল কেন কালীসাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। ১৯৩o সালের মে মাসে নজরুলের পুত্র বুলবুল বসন্ত রোগে মারা যায়৷ তিনি তখন অনেক চেষ্টা করেছিলেন তাকে বাঁচানোর। কবি জসীমউদ্দীন লিখেছিলেন, “তিনি তখন নজরুলকে একদিন খুঁজে পেলেন বিএম ডব্লিউ দোকান ঘরের কোণে। পুত্রশোক ভোলার জন্য সে  সেখানে বসে বসে হাসির কবিতা লিখেছিল  এবং কেঁদে কেঁদে নিজের চোখ ফুলিয়ে ফেলছিল৷ এত করেও নজরুল বাঁচতে পারল না, শোকাতুর পিতার মানসে যে  দুর্বলতা প্রবেশ  করেছিল তার নিকট সে ধরা দিল। সে গেল লালগোলা হাই স্কুলের হেডমাস্টার শ্রীযুক্ত বরদাচরণ মজুমদারের নিকটে৷” [মুজজ্ফর ,২০০৬ ,২৪৩ ] নজরুল শুধুমাত্র নিজের মনের শান্তি লাভ করার জন্যই এই দুর্যোগের নিকটে যাননি৷ তাঁর এই আধ্যাত্মিকতা দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণ সম্ভবত পুত্রের  মৃত্যু থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া। তিনি হাসির গান লিখতে গিয়ে একা একা বসে কাঁদতেন এও তার বন্ধুরা  দেখেছিল৷ সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে নজরুলের শ্যামা সংগীত  লেখার পিছনে কারণ কী ছিল ৷

 
আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে (মাকে) কে দিয়েছে গালি –
রাগ ক’রে সে সারা গায়ে মেখেছে তাই কালি।।
যখনরাগ করে মোর অভিমানী মেয়ে
আরো মধুর লাগে তাহার হাসি–মুখের চেয়ে –
কেকালো দেউল ক’রলে আলো অনুরাগের প্রদীপ জ্বালি’।।

গানটির মাধ্যমে নজরুল ছুঁতে চেয়েছিলেন ঈশ্বরকে৷কালীকে তিনি কন্যারূপে দেখতেন ৷ 
শ্যামা মা কালী দশমন্ত্র মহাবিদ্যার প্রধানতম দেবী।তিনি কোন বাইরের দেবী ছিলেন না। জনগণ তাকে পূজা করেন মহা মমতায়। কালীর গায়ের রং কালো কেন সে নিয়ে  কোনো সুনির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি। বরং কালীকে শক্তির আঁধার অর্থাৎ অন্ধকার থেকে আলোর ফেরার দেবী  রূপে পূজা করা হয়। তাই কালীর গায়ের রং কালো রঙের হয়ে থাকে। তাই তিনি লিখেছিলেন :

“ভক্তি, আমার ধুপের মত,
ঊর্ধ্বে উঠে অবিরত।
শিবলোকের দেব দেউলে,
মা’র শ্রীচরণ পরশিতে।”
গানটি দ্বারা বোঝা যায় হৃদয়ের গভীরতা। নজরুল খুব আবেগ প্রবণ মানুষ ছিলেন। ঈশ্বর ও নারী দুই সত্ত্বাকে তিনি এক করতে চেয়েছিলেন। তিনি নারীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন৷ শ্যামা সাধনার পিছনে এই কারণ  থাকতে পারে ভাবা যেতে পারেI তাঁর হিন্দু ধর্মের প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ ছিল৷ আর সেই কারণের জন্যই মুসলিম সমাজ তাঁকে বিজাতি মনে করত৷ হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে, দুর্গাদেবীর একটি বিশেষ রূপ হল ‘কালী’। শাক্তসঙ্গীত নামটিরও ব্যবহার হয় এক্ষেত্রে। ‘শ্যামা মা’র পরিচয় দিতে গিয়ে কবি লিখেছিলেন-

“মার হাতে কালি মুখে কালি,
মা আমার কালিমাখা, মুখ দেখে মা পাড়ার লোকে হাসে খালি।  
মোর লেখাপড়া হ’ল না মা, আমি ‘ম’ দেখিতেই দেখি শ্যামা,
আমি ‘ক’ দেখতেই কালী ব’লে নাচি দিয়ে করতালি।”

সুনিবিড় ভাবনায় তিনি মিশে থাকতেন। তিনি প্রায় ৪০০০ গান রচনা করেছিলেন এবং অধিকাংশের সুর নিজেই করেছিলেন৷ যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা ‘নজরুল গীতি’ নামে পরিচিত। যার বড় একটি অংশই শ্যামা সঙ্গীত। সঙ্গীত বিষয়ক নজরুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হচ্ছে ‘রাঙা-জবা’। ১৯৬৬ সালে ১০০টি শ্যামা সঙ্গীতে সমৃদ্ধ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। তখন মূল্য ছিল মাত্র তিন টাকা। শক্তি পূজায় তাঁর ভক্ত হৃদয়ের অকৃত্রিম আকুলতা ও আর্তি রাঙা-জবা’র গানের মধ্যে রূপায়িত।
খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের পাশাপাশি শাক্তধর্মের উদ্ভব ঘটে এবং তাকে কেন্দ্র করেই শাক্তগীতি চর্চার একটি ক্ষীণ ধারা প্রচলিত হয়। এই সময় বঙ্গদেশে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৈষ্ণবধর্মের চেয়ে শাক্তদর্শন ও শক্তিপূজা ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। শ্যামা সঙ্গীতের ধারাটি বিকাশ লাভ করে খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। আঠারো শতকের মধ্যভাগে সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন এতে প্রাণ সঞ্চার করে বাংলা গানের জগতে শাক্ত পদাবলি বা শ্যামা সঙ্গীত নামে একটি বিশেষ সঙ্গীতধারা প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শ্যামা সঙ্গীতকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।তিনি এই সঙ্গীতকে একটি নির্দিষ্ট স্থান প্রদান করেছিলেন।তাঁর লেখা  সঙ্গীতের মধ্যে যে ঈশ্বর ভাবনা ,চেতনা ছিল তাতে  আপামর  বাঙালি ডুবে থাকত সেই   সাধনায়৷
সাহিত্য চর্চার জন্য সামান্য কিছু সময় পেয়েছিলেন নজরুল। কিন্তু জীবনের এই অল্প সময়েই তিনি রেখে যান বাংলার জন্য এক সুর ভাণ্ডার। ধর্মীয় দৃষ্টিতে শ্যামাসঙ্গীত নানাভাবে বিতর্কিত হয়-এটা সত্য। কিন্তু তার শ্যামাসঙ্গীতের রচনা কৌশল আর ভক্তির গভীরতা বোঝা যায় নির্দ্বিধায়। সে সব ভক্তিগীতির মধ্যেও ছিল ধূমকেতুর ন্যায় অন্তরজ্বলা আর বিষেভরা চির বিদ্রোহের বাণী। আজও ভারতবর্ষে শ্যামা সঙ্গীত বিষয়ে আলোচনা উঠলে সবার আগে নজরুলের সৃষ্টি দিয়ে শুরু করতে হয়। শ্যামা সঙ্গীতের নান্দনিক প্রভাব পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মরমী ও ভক্তিগীতি, এমনকি দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে আজও প্রবহমান।

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>