১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে প্রথম আর্ন্তজাতিক নারী সম্মেলন হয় । ১৯১০ সালে ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে ডেনমার্কের কোপেনহাগেনে হয় দ্বিতীয় আর্ন্তজাতিক নারী সম্মেলন হয় । এই সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন ৮ মার্চকে আর্ন্তজাতিক নারী দিবস বলে ঘোষণা করেন । বিশ শতকের প্রথমার্ধে নারী সম্মেলন হলেও নারীমুক্তির আন্দোলন শুরু হয় ১৯৬০ সাল থেকে । নারীমুক্তির ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ এক স্মরণীয় দিন । এ দিন সারা পৃথিবীর ৪০০০ নারী হাইড পার্ক থেকে ট্রাফালগার স্কোয়ার পর্যন্ত মিছিল করেছিলেন । এর ফলে ১৯৭৫ সালে ইউনাইটেড নেশনস আর্ন্তজাতিক নারীদিবসের স্বীকৃতি দেন । ১৯৭৭ সালে ইউনাইটেড নেশনস ৮ মার্চ আর্ন্তজাতিক নারী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন ।
নারীমুক্তি আন্দোলন যখন দানা বাঁধেনি , তখন আমাদের দেশের একজন প্রথাগত শিক্ষাহীন, নিম্নবর্গের এক নারী পুরুষতন্ত্র, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন তাঁর নিজের পথে ।
দুশো বছর আগের কথা । ১৮০৩ সাল । নাঙ্গেলি নামে এক নিম্নবর্গের নারীর বিদ্রোহে কেঁপে উঠেছিল আলাপ্পুজা জেলা , কেঁপে উঠেছিল সেখানকার রাজা আর তাঁর রাজত্ব । সে সময় ভারতের অন্য কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের মতো ত্রিবাঙ্কুরে ছিল নানাধরনের কর । জমি ও ফসলের কর ছাড়াও ছিল বিচিত্র কর । যেমন : মাথার কর, দাড়ির কর, স্তন কর , মৃত্যু কর । জাতিবৈষম্য বজায় রাখার জন্য রাজারা এইসব করের বোঝা চাপাতেন নিম্নবর্গের মানুষের উপর । মুলাক্কারামই হল স্তন কর । নিয়ম ছিল শুধু ব্রাহ্মণনারীরা তাদের স্তন আবৃত রাখতে পারবেন । নিম্নবর্গের নারীরা তাঁদের স্তন আবৃত রাখতে চাইলে স্তনের আকার-আকৃতি অনুযায়ী কর দিতে হত ।
নাঙ্গেলি ছিল এজাভা সম্প্রদায়ের মানুষ । তাদের সম্প্রদায়গত পেশা ছিল তালরসের তাড়ি তৈরি করা । কিন্তু এই পেশায় নুন আনতে পান্তা ফুরোতো । উপবাসে কাটাতে হত দিনের পর দিন । কিন্তু রাজার পাইক-পেয়াদা এসে নিয়মিত আদায় করে নিয়ে যেত নানা কর । রেহাই ছিল না করের হাত থেকে ।
একদিন নাঙ্গেলির স্বামী চিরুকান্দন কাজের ধান্দায় বাইরে গেছে । এমন সময়ে ত্রিবাঙ্কুরের রাজার পরভাতিয়ার বা কর-আদায়কারী কর্মচারী লোকজন নিয়ে এল নাঙ্গেলির ঘরে । দাবি করল স্তন করের । কেননা নিচুজাতির মেয়ে হয়েও সে তার স্তন আবৃত করে রাখে । নাঙ্গেলি প্রতিবাদ করে। পরভাতিয়ার তাকে দাবড়ে দিয়ে বলে ,’যত বড়ো মুখ নয় তত বড়ো কথা !’ এবার রেগে যায় নাঙ্গেলি, বলে, ‘ আমার স্তন আমি আবৃত করব, তার জন্যে আবার কর দিতে যাব কেন !’ সে কথা শুনে রাজকর্মচারীরা রেগে আগুন । কি, এতবড়ো স্পর্ধা ! রাজার আদেশ অমান্য করে নিচুজাতির একটা মেয়ে !
পরভাতিয়া তার সঙ্গী-সাথিদের নির্দেশ দিল নাঙ্গেলিকে উচিত শিক্ষা দিতে । তারা তারা নাঙ্গেলির ঘরে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করে তরবারি দিয়ে তার স্তন কেটে নিয়ে এল কলাপাতায় মুড়ে । সেই কর্তিত স্তন উপহার দেওয়া হল রাজা আর মন্ত্রীকে। ঠিক কাজই হয়েছে । রামের ভাই লক্ষ্মণ তো এভাবেই শূর্পনখার স্তন কেটেছিলেন । কারণ শূর্পনখা ছিল রাক্ষসী । নাঙ্গেলিও রাক্ষসী কারণ সে অবাধ্য । কিন্তু এ ঘটনায় প্রতিবাদের ঢেউ উঠল । অসন্তুষ্ট হল বৃটিশপ্রভুরা । তখন রাজা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য মিথ্যে গল্প ছড়িয়ে দিল বাজারে । কি, না নাঙ্গেলি নিজের স্তন নিজেই কেটেছে ।
আজ থেকে দুশো বছর আগে নাঙ্গেলির এই লড়াই ছিল বিশ্বাসঘাতক মন্ত্রী ডেলুথাম্পি দালওয়া, বর্ণগৌরবে মত্ত রাজা অভিত্তম থিরুমল বলরাম ভার্মা, পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্য, ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে । বৃথা যায় নি নাঙ্গেলির আত্মদান । রাজা থিরুমল বাধ্য হয় স্তন কর বন্ধ করতে এবং দশ বছর পরে নারীর স্তন আবৃত করার আধিকার নিয়ে শুরু হয় চান্নার বিদ্রোহ ।
.