netajir khaoyadaoya indira mukhopadyaya 23january 2022

ইরাবতী ফিচার: নেতাজীর খাওয়াদাওয়া । ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

Reading Time: 3 minutes

 

 

দেশনায়কের জীবন মানেই তাঁর অবিরাম কর্মপন্থার আজীবন কাটাছেঁড়া। নিরন্তর আলোচনা, বাকবিতণ্ডা, সাক্ষাতকার, পরিকল্পনা । মানে যার নাম টাইম টেবিল একেবারে থইথই। অবিশ্রান্ত সংগ্রামী জীবনের কর্মব্যস্ততার আড়ালে রক্তমাংসের সেই ব্যক্তি মানুষটাওতো আমাদেরই মত একজন। কেমন ছিল এই কিংবদন্তী দেশনায়কের রসনাবিলাস? কি খেতে পছন্দ করতেন আর কি খেতেন না?

 

সুভাষচন্দ্র বসুর মা প্রভাবতী বসু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রী বাসন্তী দেবীকে বলতেন, “তুমিই সুভাষের আসল মা, আমি তো কেবল ধাত্রী।” বাসন্তী দেবীকে পরম শ্রদ্ধায় ‘মা’ বলে ডাকতেন সুভাষ।

বাসন্তী দেবী তাঁকে প্রথম দেখেছিলেন ১৯১৬ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের ওটেন-কাণ্ডের পরে। এক রাতে চিত্তরঞ্জনের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এল এক দল ছাত্র। দাশ-দম্পতির নৈশাহারের সময় । ছাত্রদল ভিতরে ঢুকে পড়ল, তার মধ্যেই ছিলেন সুভাষ। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত,  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও নিষিদ্ধ। অভিযোগ, তরুণ ব্রিটিশ অধ্যাপক এডওয়ার্ড এফ ওটেন, যাঁর উদ্ধত আচরণ ছাত্রদের আহত করেছিল, তাঁর উপর সংঘটিত ছাত্র-হামলার নেতা ছিলেন উণিশ বছরের সুভাষ।

 

মা বলে ডাকে যে সেই সুভাষের জন্য রান্না করা বাসন্তী দেবীর কাছে নতুন নয়। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পরেও তাঁর বাড়িতে নিয়মিত যেতেন সুভাষ। সুভাষ চলে যাওয়ার আগে তাঁকে সামান্য রাতের খাবার পরিবেশন করতেন বাসন্তী দেবী। সেদ্ধ ভাত আর তরকারি মানে যাকে বলে বাঙালির পাতি ‘ভাতে ভাত’। সেটাই সুভাষের সবচেয়ে পছন্দের খাদ্য ছিল। ১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে ৩৮/২ এলগিন রোড-এর (অধুনা নেতাজি ভবন) পারিবারিক ভবন থেকে বিদেশে পলায়নের ঠিক আগে সুভাষকে শেষ বার দেখেছিলেন বাসন্তী দেবী। অনশন করার পর দুর্বল শরীরে সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। বাসন্তী দেবীর দিকে তৃষ্ণার্ত ভাবে চেয়ে হেসে সুভাষ বলেছিলেন , “মনে রেখো, শিগগিরই আমাকে এক দিন ভাতে ভাত খাওয়াতে হবে।”

( কৃষ্ণা বসু / আনন্দবাজার পত্রিকা )

 

এই দোকানটির বয়স ১০০ পেরিয়েছে অনেকদিন। উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে লক্ষ্মীনারায়ণ সাউয়ের তেলেভাজার বিখ্যাত দোকান। সারাবছরই ভিড় সেখানে। তবে বিগত ৭৮ বছর ধরে নেতাজির জন্মদিনে সকাল থেকে সন্ধে অবধি অগণিত মানুষকে বিনা পয়সায় তেলেভাজা খাইয়ে আসছে এই দোকান। কি এই দোকানের মাহাত্ম্য? প্রথমতঃ সবার প্রিয় নেতাজি স্বয়ং এসে তেলেভাজা খেয়ে গিয়েছেন এই দোকান থেকে। তেমনি দাবী তাদের এ প্রজন্মেরও। দ্বিতীয়তঃ স্বদেশী আন্দোলনে বিপ্লবীদের গোপন ডেরায় তেলেভাজার জোগান দেওয়া হত এই দোকান থেকে।দোকানের প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ নিজেও যুক্ত ছিলেন বিপ্লবীদের সঙ্গে।

 

এরূপ বিপ্লবীর কটকে জন্ম, বাংলায় উচ্চশিক্ষা আর কর্মজীবন। রাজনীতির অলিগলিতে বিচরণ। সুভাষচন্দ্রের বাঙালি খাবারের প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসার গল্প শোনালেন মানবেন্দ্র পাণ্ডার নাতি অরুণাংশু পাণ্ডা। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় নেতাজী ক্লাসের ফাঁকে চলে আসতেন মানবেন্দ্র পাণ্ডার হোটেলে। সেই সময় তরুণ মানবেন্দ্র কলকাতায় এসে চাকুরি না পেয়ে রান্না করার বিদ্যা কে কাজে লাগিয়ে খুলে ফেলেছিলেন হিন্দু হোটেল। সেটা কলেজ স্ট্রিটে ১৯১৫ সাল। তখন ভালো হোটেল ছিল হাতেগোনা। সেখানে ওড়িশা থেকে আসা মানব ঠাকুরের হোটেল ঘরোয়া সুস্বাদু রান্নার জন্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। 

নেতাজী সেখানে শুধু নিজে খেতে আসেননি, সঙ্গে আনতেন রাজনৈতিক গুরু দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকেও। তাঁকেও  মানবঠাকুরের রান্নার স্বাদ পাওয়া তে হবে যে । কালে কালে সেদিনের হিন্দু হোটেল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পেটপুজো এবং রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার স্থান হয়ে উঠেছিল। পরবর্তী জীবনে কর্মজীবনের ব্যস্ততার মধ্যে নিয়মিত আসা হয়ে উঠত না। সে দিনের হিন্দু হোটেল নাম বদলে হয়েছে স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেল । এই নাম পরিবর্তন করেছিলেন মানবেন্দ্র পাণ্ডা । তাঁর নাতির কথায় সুভাষচন্দ্র বসু বাটা মশলার রান্না পছন্দ করতেন। নানা রকম সবজিতে তৈরী হয় পাঁচমেশালি  তরকারি, ঠিক যেমনটি পছন্দ করতেন নেতাজী।

একবার প্রেসিডেন্সি কলেজের দাপুটে, মেধাবী ছাত্র সুভাষচন্দ্র বসুর কানে খবর পৌঁছতেই ওড়িয়া ঠাকুরের হাতের রান্নার স্বাদ পেতে সুভাষ চললেন মানব পাণ্ডার হোটেলে কলাপাতায় ভুরিভোজের স্বাদ নিতে। সেখানকার পুঁইশাক চচ্চড়ি, মৌরলা মাছ, বেগুন পোড়া, মাছের কাঁটা দিয়ে ডাল ছিল সুভাষচন্দ্র বসুর প্রিয় পদ।

কলেজ স্ট্রিটের কাছেই ৮/২ ভবানী দত্ত লেনের এই স্বাধীন ভারত হিন্দু হোটেলে নিজের হাতে শতরঞ্চি পেতে বন্ধুদের নিয়ে এক আনায় বহু বছর ধরে দু’বেলা ভরপেট মাছ ভাত খাওয়ার খবর পেলাম আনন্দবাজার পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে।

 

নেতাজি সোনা মুগডালের অসম্ভব ভক্ত ছিলেন। বিবেকানন্দের মন্ত্রশিষ্য এমন  হবে সেটাই স্বাভাবিক। গুরুর মতো তিনিও  দেশের বাইরে যাবার সময় ভাজা মুগডাল সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন হয়ত। কেননা তিনি যখন জাপানের ইম্পিরিয়াল হোটেলে ছিলেন তখন তাঁর দুই সহকর্মী হাসান ও হাবিব তাঁদের বাড়ি থেকে তাঁদের মাকে দিয়ে মুগডাল রান্না করিয়ে সুভাষের জন্যে নিয়ে যেতেন। আর সুভাষ দেশবিদেশ যেখানেই ঘুরুন না কেন সর্বত্রই তাঁর পছন্দের মেনু ছিল ডাল, ভাত, পুরি, দই আর কলা। সেইসঙ্গে গুরু স্বামীজির মতোই ডালের খিচুড়ির প্রতি খুব আসক্তি ছিল আর পাঁচজন বাঙালির মতোই।

(ই-টিভি ভারত)

 

সকাল থেকে সন্ধে অবধি সুপারি চিবোনোর অভ্যেস ছিল তাঁর। মধ্যাহ্নভোজের পর মুখশুদ্ধি হিসেবে হরিতকী গ্রহণ শুরু হয়েছিল বেশী বয়সে।সারাদিনের মধ্যে বেশ কয়েক কাপ চা কিম্বা কফি পান ছিল নেশার মত। তারপর সুপারি-এলাচ-লবঙ্গ মুখে নেওয়ার তুমুল নেশা ছিল। বেশী বয়সে মাছ ছাড়া অন্য আমিষ গ্রহণে আপত্তি ছিল। বেশীরভাগ নিরামিষ খাদ্যেই সন্তুষ্ট ছিলেন। তবে ঈষদুষ্ণ জলে লেবুর রস আর বীট নুন দিয়ে নিয়মিত পানের অভ্যেস ছিল। তবে বাড়িতে বানানো মিষ্টির প্রতি একটু বেশীই দুর্বলতা ছিল জীবনের শেষদিন অবধি। রসগোল্লা, পিঠেপুলি, সন্দেশ, চমচম এসব বাঙালি মিষ্টি থেকে কখনও সরিয়ে নিতে পারেন নি নিজেকে । এছাড়াও প্রিয় ছিল নারকোলের মিষ্টি আর নানারকম নাড়ু। চিনির পুলি, মনোহরা, নারকেল নাড়ু, রসকরা, ছাতুর বরফি, মুড়ির নাড়ু, খইচুর, তিলের নাড়ু, তিলের তক্তি খুব তৃপ্তি করে খেতেন।

(https://bengalcuisine.in/)

নেতাজির সঙ্গ পেয়েছেন এমন বহু মানুষ দেখেছেন সারাদিনে ২০ থেকে ৩০ কাপ চা খাওয়ার কথা। রাজনৈতিক জীবনের প্রথমদিকে নিয়মিত কফি হাউসে ৪ নম্বর টেবিল আর সেখানের প্রিয় ছিল চিকেন কাটলেট।

কলেজ স্ট্রিটের প্যারামাউন্টের ডাব শরবত ছিল তাঁর প্রিয়।

 

 

 

 

 

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

You may use these HTML tags and attributes:

<a href="" title=""> <abbr title=""> <acronym title=""> <b> <blockquote cite=""> <cite> <code> <del datetime=""> <em> <i> <q cite=""> <s> <strike> <strong>