বিজ্ঞানী নিউটন যখন দুর্ধর্ষ ডিটেকটিভ
।। রিজওয়ানুর রহমান প্রিন্স।।
বিজ্ঞানীদের এমনিতেই ডিটেকটিভ স্বভাবের হতে হয়। চেনা-পরিচিত জগতকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করার গুণ থাকতে হয়, সবকিছুকে সন্দেহ করতে হয়, ফেলতে হয় প্রশ্নের মুখে। এভাবেই তারা আবিষ্কার করেন চেনা জগতের অচেনা নতুন রূপকে। এমন দুর্ধর্ষ বিজ্ঞানীদের তালিকা করতে গেলে প্রথমদিকেই থাকবে আইজ্যাক নিউটনের নাম। ব্রিটিশ এই বিজ্ঞানীকে আজো বিজ্ঞানের জগত আসতে-যেতে সেলাম ঠুকে তাঁর অবিস্মরণীয় সব অবদানের জন্যে। কিন্তু তিনি যে বিজ্ঞান জগতের ডিটেকটিভ হবার পাশাপাশি অপরাধ জগতেরও এক দুর্ধর্ষ ডিটেকটিভ ছিলেন, সেটা আমরা ক’জনে জানি? তিনি ছিলেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা শার্লক হোমসের বাস্তবরূপ, কিন্তু শার্লক চরিত্রটা তৈরির ২০০ বছর আগেই তিনি দুঁদে গোয়েন্দা হিসেবে পদচারণা করে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের মাটিতে। চলুন জেনে নেয়া যাক, নিউটনের আরেক রূপ ‘শার্লক নিউটন’ সম্পর্কে।
.
১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দের এক সকালে ধূমায়িত চা খেতে খেতে নিউটন একটা চিঠি খুলে পড়তে লাগলেন। তাঁর বন্ধু, Halifax অঞ্চল এর আর্ল Charles Montagu একটা চিঠি পাঠিয়েছেন তাঁকে। সেখানে তিনি নিউটনকে অনুরোধ করছেন, ইংল্যান্ডের রাজার আদেশে মহামান্য নিউটন যেন Royal Mint-এর ওয়ার্ডেন-এর পদ অলংকৃত করেন। Royal Mint হচ্ছে ইংল্যান্ডের যাবতীয় ধাতব মুদ্রা তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। সেই ৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ হতে শুরু এই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস, যেটা আজও চলছে। এই প্রতিষ্ঠানের অতি উঁচু ওয়ার্ডেন পদে নিউটনকে দায়িত্ব নিতে বলা হচ্ছে। আমাদের ৫৫ বছর ছুঁই ছুঁই বিজ্ঞানীকে এই পদ দেয়া হচ্ছিলো শুধুই আলংকারিক রূপে। অর্থাৎ তিনি আসলে দুধ-ভাত, ওখানকার শোভা বর্ধন করবেন। কিন্তু আমাদের নিউটন এই পদটাকে অত্যন্ত সিরিয়াসলি নিয়ে বসলেন, আখেরে যেটা ইংল্যান্ডের বেশ লাভেই এসেছিলো। তিনি সম্মত হলেন এই দায়িত্ব পালন করার।
.
সেই সময়ে রাজা চতুর্দশ লুই বনাম অস্ট্রিয়ার ইউরোপিয়ান কোয়ালিশনের সাথে ৯ বছরের যুদ্ধে (১৬৮৮-১৬৯৭ খ্রিস্টাব্দ) ইংল্যান্ডের মুদ্রার বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ। অবস্থা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো যে, একটা সিলভারের মুদ্রার মূল্যমান ঐ মুদ্রার ভেতরে থাকা সিলভারের ওজনের মূল্যমানের থেকেও কম। অর্থাৎ ১ টাকার একটা সিলভার কয়েনের ভেতরে থাকা সিলভারের পরিমাণের বাজারি মূল্য ১০ টাকা, এমন আর কি! এদিকে সিলভারের এমন মূল্যের কারণে ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্সেও পাচার হচ্ছিলো সিলভারের কয়েন। তখন সরকারিভাবে ঘোষিত হলো সমস্ত সিলভারের মুদ্রা রাজকোষাগারে ফিরিয়ে দেয়ার। সেখান থেকে আবার নতুন করে সিলভার কয়েন বানিয়ে বাজারে ছাড়া হবে। সেক্ষেত্রে যা ঘটার তাই ঘটলো। সিলভারের মুদ্রা জাল করা শুরু হয়ে গেলো। সিলভারের মুদ্রা জাল করার পাশাপাশি ক্লিপিং করাও শুরু হলো। মানে হলো কয়েনের চারপাশ থেকে একটু একটু করে সিলভার কেটে রেখে দিয়ে পরে সেই জমানো সিলভার দিয়ে আবার নতুন মুদ্রা বানিয়ে ফেলা (এইজন্যে আমাদের পরিচিত সব ধাতব কয়েনের বাইরের দেয়ালে খাঁজকাটা থাকে। কোনোভাবে এই খাঁজকাটা অংশটা না থাকলে ধরে নিতে হবে মুদ্রাটাকে কেটে বিকৃত করা হয়েছে। তখন সেই মুদ্রা বাতিল হয়ে যাবে, বাজারে আর চলবে না)। ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দের আগের সব কয়েন ক্লিপিং করা হতে লাগলো, কারণ সেগুলোর চারপাশে অমন খাঁজকাটা ছিলো না। আর ১৬৬২ খ্রিস্টাব্দের পরের কয়েনগুলো মেশিনে জাল করা হতে লাগলো। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিলো, সেই যুদ্ধের বাজারে ইংল্যান্ডের মুদ্রার ১০ শতাংশই হয়ে গিয়েছিলো এমন জাল মুদ্রা! একপর্যায়ে ঘোষণা করা হলো, যারা মুদ্রা ক্লিপিং এবং জাল করে তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। এদের ধরতে পারলে সরাসরি ফাঁসিতে ঝোলানো হবে।
.
ইংল্যান্ডের মুদ্রাবাজারের এই দিশেহারা অবস্থায় এগিয়ে এলেন নিউটন। তিনি যেহেতু তাঁর চাকরিটাকে সিরিয়াসলিই নিয়েছিলেন, তাই ভাবতে লাগলেন কিছু একটা করার। মুদ্রাগুলোকে তাদের গায়ের মূল্যে না কিনে ভেতরের সিলভারের ওজন করে নিয়ে পরে প্রতি কেজি সিলভারের মূল্যে কিনে নিতে পরামর্শ দিলেন তিনি। এদিকে শুরু করলেন অন্য আরেকটা পরিকল্পনা। ইংল্যান্ড বিশেষত লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ডে ছেলেছোকরা, ভিখারিদের দিয়ে তাঁর এক বিশাল নেটওয়ার্ক বিস্তার করতে লাগলেন। প্রায় বছর দুয়েক ধরে তিনি করেছিলেন এই কাজ। তাদের সবার থেকে তথ্য নিয়ে ইংল্যান্ডের অনেক মানুষের প্রোফাইল বানালেন তিনি। তাদের অনেকের সাথে মিশলেন। মিশে তাদের চরিত্রের প্যাটার্নের সাথে মিলিয়ে তথ্য-প্রমাণ দাঁড় করাতে লাগলেন যে, কারা আসলে ইংল্যান্ডে মুদ্রা জালকারী চক্রের মূলহোতা। ১০০-রও বেশি প্রোফাইল ক্রস-এক্সামিনেশন করেছিলেন তিনি। সেখান থেকে বেছে তিনি ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ২৮ জনের একটা চূড়ান্ত তালিকা দাঁড় করিয়েছিলেন। এদের প্রত্যেকের বিপরীতেই তিনি অসংখ্য তথ্য-উপাত্ত জড়ো করেছিলেন মুদ্রা জালকারী হিসেবে। এদের প্রত্যেকের উপরেই নিজ আবিষ্কৃত অভিকর্ষ প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার করেছিলেন নিউটন। সবক’টাই ফাঁসিতে ঝুলেছিলো পরে। আর ইতিহাসের পাতায় নাম ঢুকে গেলো আমাদের শার্লক নিউটনের সবচেয়ে কম সময়ে সর্বাধিক মুদ্রা জালকারীকে ফাঁসিতে চড়ানোর সফলতার জন্যে। নিউটন আমাদের শার্লক হোমসের সেই কথাটারই যথার্থ প্রমাণ। “গোয়েন্দাগিরি যতোটা না মগজের খেলা, তার থেকেও বেশি পরিশ্রম এবং ধৈর্যের জায়গা”।
.
গল্পটা এখানেই শেষ করতে পারলে ভালো ছিলো। কিন্তু না, তা হবে কেন? এটা তো শার্লক নিউটনের গল্প! শার্লকের যেমন একজন ভয়ংকর শত্রু ছিলো জেমস এফ. মরিয়ার্টি, আমাদের নিউটনেরও সেরকম একজন ছিলো। নাম William Chaloner. মরিয়ার্টির মতোই ক্রিমিনাল মাস্টারমাইন্ড ছিলো সে। সে ছিলো রাজার প্রধান উপদেষ্টাদের একজন। কিন্তু সে কীভাবে এই পদে এসেছিলো, সেটা শুনবেন? আমাদের Chaloner বিভিন্ন সময়ে ক্যাথলিক বিরোধী অনেক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতো। নিজেই তাদের অনেক বুদ্ধি দিতো ক্যাথলিকদের বিরুদ্ধে হামলা-সন্ত্রাস পরিচালনার জন্যে। তারপরে হামলার ঠিক আগেরদিন সব ষড়যন্ত্রকারীকে সরকারী নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধরিয়ে দিতো। নিজে হয়ে যেতো ভালো মানুষ, দেশপ্রেমিক!
.
এই Chaloner একবার রাজদরবারে দাবী করে বসলো Royal Mint-এর লোকজন নিজেরাই বাইরের লোকদের কাছে মুদ্রা জাল করার যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তি সাপ্লাই দিচ্ছে। তাই তাকে Royal Mint-এর ভেতরে গিয়ে মুদ্রা বানানোর সব প্রক্রিয়া চর্মচোক্ষে দেখার সুযোগ করে দেয়া হোক। সে তারপরে সেখানকার সব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের মুখোশ খুলে দেবে। তাকে সেই অনুমতি দেয়া হলো। কিন্তু Royal Mint-এর নিজস্ব অনুসন্ধানে ধরা পড়লো ইংল্যান্ডের যেসব রুই-কাতলা লেভেলের মুদ্রা জালকারী আছে, Chaloner তাদের একজন। তখন তাকে ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে সরকারী আদেশে জেলে নিয়ে রাখা হলো। কিন্তু ৩ দিন পরেই প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো তাকে আবার। সে তখন গিয়ে নিজেই আরেকটা তদন্ত কমিটি খুললো এবং দাবী করলো Royal Mint-এর কর্ণধাররাই ইংল্যান্ডের মুদ্রা জাল এবং পাচারের সাথে জড়িত। সে ইংল্যান্ডের অভিজাত সমাজের কয়েকজনের নামও দিয়েছিলো তালিকায় মুদ্রা জালকারী হিসেবে।
.
প্রথমবার Chaloner ছাড়া পাওয়ার পরে নিউটন প্রচণ্ড ক্ষেপে দাঁতমুখ খিঁচে আরো বিস্তৃত করেন লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ডে তাঁর স্পাইয়ের জাল। এরা সেখানকার অপরাধীদের সাথে মিশে Chaloner-এর বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ সংগ্রহ করতে থাকে। সেই তথ্য নিয়ে নিউটন লন্ডনে Chalone-এর গতিবিধি এবং তার ব্যক্তিগত প্রোফাইলের সাথে মেলাতে থাকেন। ক্রস-এক্সামিনেশনের পর ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করেন নিউটন Chaloner-এর নামে। Chaloner -কে ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে আবারো ধরে এনে আদালতে হাজির করা হয়। সে এবারেও হয়তো ছাড়া পেয়ে যেতো, কিন্তু এবারে তাকে জালে আটকানোর সব ব্যবস্থাই করে রেখেছিলো নিউটন এবং Royal Mint. তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর আগ পর্যন্ত নিউটনের উপস্থাপিত রিপোর্ট সম্পর্কে কিছু জানতে দেয়া হয়নি। কোর্টে তার বিরুদ্ধে ৮ জনকে সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এদের মধ্যে দাগী আসামীরাও ছিলো, যারা বিভিন্ন সময়ে Chaloner-এর সাথে অপরাধে জড়িত ছিলো। নিউটনের তৈরি করা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট নিয়ে এই মামলা লড়ার কাজ শুরু করা হয় ৩ মার্চ, ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দে। এই মামলার বিচারক ছিলেন Sir Salathiel Lovell, যিনি ইতিহাসে বিখ্যাত “ফাঁসি প্রদানকারী বিচারক” হিসেবে। মামলা লড়াকালীন সময়ে Chaloner পাগল হয়ে যাবারও ভান ধরেছিলো। কিন্তু অন্যান্যবারের মতো এবারে তার এসব নাটক ধোপে টেকেনি। মামলা লড়া শেষে বিচারক লভেল অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করেন এবং ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় দেন।
.
অবশেষে ১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২২ মার্চ গলায় দড়ি দিয়ে “অভিকর্ষের টানে ঝুলে পড়ার মাধ্যমে” শেষ হয় Chaloner অধ্যায়ের। ফাঁসির আগের রাতে Chaloner নিউটনের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখেছিলো, যাতে আক্রমণাত্মক ভাষায় অনেক কিছুই লেখা ছিলো। বলাই বাহুল্য, সেই চিঠির কোনো প্রত্যুত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি আমাদের দুর্ধর্ষ ব্রিটিশ ডিটেকটিভ ‘আইজ্যাক (শার্লক) নিউটন’।
..
.
..
তথ্যসূত্রঃ
১। https://www.the-scientist.com/?articles.view/articleNo/27561/title/Newton-the-gumshoe/
২। https://www.forbes.com/sites/civicnation/2018/02/09/reaching-higher-with-asca-during-national-school-counseling-week/#69f2054a1961
৩। https://en.wikipedia.org/wiki/Later_life_of_Isaac_Newton
৪। https://en.wikipedia.org/wiki/Royal_Mint
৫। https://en.wikipedia.org/wiki/William_Chaloner
.