আলমারির পাল্লাটা খুলতেই নেপথলিনের ঘ্রাণ নাকে মুখে হামলে পড়ল। শাড়িটা হয়ত এর মধ্যেই কোথাও আছে৷ কয়েকবার করে চোখ বুলিয়ে দেখলাম আমি। মেরুন রঙের জমিনের ওপর সলমা জরির কাজ।আমার মনে আছে সেদিন ওকে ছুঁতেও ভয় লাগছিল আমার। মনে হচ্ছিল এ পৃথিবীর কেউ নয়, সে হয়ত অন্য কোন গ্রহের মানবী, ছুঁয়ে দিলে ভীষণ কোনো পাপ হয়ে যাবে।
প্রায় তিন বছর পর বোধ হয় খুললাম আলমারিটা। হ্যাঁ, ওর রোগটা ধরা পড়ার পর থেকে আর হাত পড়েনি এটায়।নেপথলিনের ঘ্রাণের সঙ্গে মিলেমিশে থরে থরে ভাঁজ করা স্মৃতিরা সব সামনে এসে ভিড় করতে শুরু করল। দু’নম্বর তাকে রাখা প্রগাঢ় নীল রঙের বালুচরিটা চিনতে পেরেছি। প্রথমবার বেতনের টাকা পেয়ে উপহার দিয়েছিলাম ওকে। সহজে পরতে চাইতো না জেসমিন।
বলতো -যদি নষ্ট হয়ে যায়, থাকুক না স্মৃতি হয়ে।
আমি বলতাম -কতই বা দাম, আবার কিনে দেব।
জেসমিন বলত – যত দামীই কিনে দাও না কেন প্রথমবারের মত দামী আর হবে না কখনো। তোলা থাকুক ওটা৷
জেসমিন এমন ছিল! যত্নবান, গোছানো, পরিপাটি। আলমারির সবকটা তাকও তাই। মাড় দেয়া সুতি শাড়িগুলো একসাথে ভাঁজ করে রাখা। সিল্ক আর কাতান শাড়িগুলো রয়েছে অন্য তাকে। কিছু শাড়ি খবরের কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে রোল করে রাখা আছে। বোধ হয় ওগুলো জামদানী।
শেষদিকে জেসমিন এসব আর ছুঁয়েও দেখত না। বলত আমাকে আর মানায় না গো এসব।
রঙচঙে দামী শাড়িগুলো একে একে মেয়েদের দিয়ে দিয়েছিল। ওদের কি কম আছে? এই নিয়ে আমি রাগ করলে জেসমিন মুখ টিপে হাসতো। বলতো- এমন ছেলেমানুষ তুমি! লোকে কী বলবে?
লোকে কী বলবে মানে? এমন কিছু বয়স হয়নি তোমার!
শুধু কি বয়স? এই শরীরে এখন সবই বেমানান, জানো তো!
আমি রাগ করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতাম। জেসমিন ঘর থেকেই জড়ানো গলায় ডাকতো আমাকে। ডাকতে ডাকতে একসময় আর সাড়াশব্দ পেতাম না ওর। আচমকা ভয়ে বিহ্বল লাগত আমার। ছুটে গিয়ে দেখতে পেতাম কেমন গুটিসুটি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে জেসমিন। যেন ঝরে যাবার আগে ক্লান্ত জুঁইফুল। মাথায় অবিন্যস্ত চুল, ক্ষীণকায় শরীরে একটা মাড়ওঠা সুতি শাড়ি। ওরকম আলুথালু চেহারায় ওকে দেখতে আমার ভালো লাগতো না। আরো বেশি রোগা মনে হতো ওকে।
ফিরোজা রঙের একটা শাড়ি বের হলো মাঝের তাক থেকে। এটা বোধ হয় বেগমপুরি। বড়ো মেয়ের জন্মের পর নিউমার্কেট থেকে কিনে এনেছিলাম। মেয়েকে কোলে নিয়ে সদ্য মা হওয়া জেসমিন ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাসছে। চোখের নিচে রাজ্যের কালি। তবু সবসময় দেয়ালের ঐ ছবিটায় কি মিষ্টি দেখায় ওকে। বেগমপুরি শাড়িটার কথা বড়মেয়ে সেদিনও বলছিল। বোধ হয় নিতে চায় ওটা। সে নিলে নিয়ে যাক। আলমারিতে পড়ে থেকে নষ্টই তো হবে।
জেসমিন নেই বলে কতকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথচ এ সংসারটা এমন এলোমেলো ছিল না। খুব পরিপাটি ছিল, সাজানো, ঝকঝকে তকতকে ঘরদোর ছিল আমাদের। জেসমিন যেদিন বিছানায় পড়লো সেদিন থেকে ঘরকন্নার দায়িত্ব এলো আমার হাতে। ব্যস, এরপর থেকে এমন লক্ষ্মীছাড়া দশা।
আজ সকালে ছোটো মেয়ে ফোন করেছিল। দুদিন পর ওদের ফেরার ফ্লাইট। ওর তাড়া খেয়েই তো সব কাজ ফেলে রেখে আলমারির চাবিটা খুঁজে বের করতে হল। একতাড়া গোছার মাঝ থেকে প্রতিটা চাবি তালায় ঢুকিয়ে চেক করতে হয়েছে। তবেই আলমারি খুলতে পেরেছি।
ওদিকে বড়োমেয়ে দু’দিন ধরে বলছে কাঁসার থালাবাসনগুলো ওর চাই। সেসব যে জেসমিন কোথায় তুলে রেখে গেছে তার আর হদিশ মেলেনি। ওদের অস্থিরতা দেখে কদিন ধরে সারাঘর তোলপাড় করেছি। আজ সন্ধ্যায় আসবে ওরা। মায়ের পুরনো জিনিসপত্র ভাগ বাটোয়ারা হবে দু’বোনের মধ্যে৷
খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে কিছু অপ্রত্যাশিত জিনিসও বেরিয়ে এলো। আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম এ বাড়ির প্রথম টিভির রশিদটা পর্যন্ত এত বছর যত্নে তোলা ছিল। মনে আছে সাদাকালো নিপ্পন টিভিটা যেদিন বাড়িতে এলো, সেদিন জেসমিন খুশিতে ঝকমক করছিল। বৃহস্পতিবারের নাটক আর শুক্রবারের পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি একসাথে দেখার আনন্দটা ছিল অন্যরকম।
হতভাগা পানের বাটাটা বের হল সবচেয়ে নিচের তাক থেকে। একটা সময় এত বেশি পান সুপারি খেতে শুরু করেছিল জেসমিন। সেই তো কাল হল। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে বলা হল মুখের আলসারটা আর সুস্থ হবার পর্যায়ে নেই, রক্তের স্রোতের সাথে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে শরীরের আরো কিছু অংশে।
তবু আমি চেষ্টার ত্রুটি রাখিনি। অপারেশনের পর কেমোথেরাপিও চলল। যখন যা দরকার সবই করছিলাম শুধু ওর কষ্টটা চোখে দেখতে পারছিলাম না। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় যখন শরীরটা নীল হয়ে আসতো আমার মনে হতো কোনো এক জাদুবলে ওর সবটুকু কষ্ট আমি নিয়ে নিই। আমি ওর কাছে গেলে, হাত ধরে পাশে বসলে দূরে সরে যেত। রাতে একই বিছানায় শুতে দিতে চাইত না৷ শুলেও ছিটকে সরে যেত। বলত – কাছে এসো না, তোমারও হবে।
কত বোঝাতাম আমি। ক্যান্সার ছোঁয়াচে রোগ নয়। তবু জেদ করত। কখনো কখনো আমি খুব রাগ করতাম। বলতাম তবে আমারও হোক, তোমার যন্ত্রণা সব আমার হয়ে যাক, তবু তোমার একটু আরাম হোক। আমি অনর্গল বকতে থাকতাম আর ওর চোখ দিয়ে টুপটাপ জল গড়াত।
এভাবে সাত আট সাইকেল কেমোথেরাপি চলবার পর মনে হলওর শরীর আর ধকল নিতে পারছে না। কয়েক ব্যাগ রক্ত দেবার পরেও অ্যানিমিয়া সারছিল না। আমি ধীরে ধীরে হাল ছাড়ছিলাম। মনে মনে হেরে যাচ্ছিলাম। রক্তে স্যুগার বাড়ছিল আমারও। হাঁটুতে জল জমছিল। তেল,নুন,মসলার হিসেব রাখতে গিয়ে, চেম্বার আর হাসপাতালে ছুটতে ছুটতে ক্রমশ ক্লান্ত হচ্ছিলাম আমি।
একদিন রাতে ওর পাশে শুয়ে আছি। চোখ ভেঙ্গে ঘুম নেমে আসছিল আমার। কেমোথেরাপি দিয়ে আগের দিন বাড়ি ফিরেছে জেসমিন। সন্ধ্যার পরপরই নির্জীব হয়ে শুয়ে ছিল বিছানায়। ভেবেছি ঘুমিয়ে গেছে। বাতি নেভাতেই আমার গায়ের ওপর হাত রাখল সে। আমি কেঁপে উঠলাম ভেতরে ভেতরে। সেই কবে এমন করে নির্ভর করে ছুঁয়েছিল আমাকে, আর তো ছাড়তে চায়নি। এই রোগটাই আমাদের মাঝে এসে এমন অনতিক্রম্য এক পাহাড় হয়ে উঠেছে।
আমি ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম -কিছু বলবে জুঁইমণি?
কতকাল পর যেন আমাদের পুরনো সময়গুলো ফিরে আসছিল। আমার ইচ্ছে করছিল সেই আগেকার মতো রাত জেগে গল্প করি। ওর চুলে তেল আর জল মেশা অদ্ভুত ঘ্রাণটাও কী ভাললাগছিল আমার।
সেসব কিছুই বলতে দিল না সে। আমার ঠোঁটের ওপর হাত রেখে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে উঠলো- একটা জিনিস চাইবো, দেবে?
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। রাজি না হবার তো কারণ কিছুই পাইনিকখনো।
মনে আছে সে রাতে আর ঘুম হয়নি আমার। ওর এমন আকুতির কথা এর আগেও শুনেছিলাম। কিন্তু সেদিন কেন জানিনা কেমন অন্য রকম লাগছিল সব। আমি সেদিন বুঝেছিলাম আজ হোক আর কাল, ও চলে যাবে। ও চেয়েছিল। আজকাল নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করি। শুধু কি সেই চেয়েছিল চলে যেতে? আমিও কি অবচেতনে, ভীষণ ক্লান্তিতে, এক মুহূর্তের বিভ্রমেও এরকম কিছুচাইনি?
সেদিনের ঐ মুহূর্তটার কথা ভাবতে গেলে এখন দমবন্ধ লাগে আমার। এই ঘরটা যেন চারদিক থেকে গিলে খেতে আসে আমাকে। ছুটে বেরিয়ে পড়ি কোথাও, খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিই। মেয়েরা এলে বাড়িটা প্রাণ পায়। সময়টা উড়ে উড়ে চলে। কিছুক্ষণের জন্য হলেও এসব কথা ভুলে থাকি।
কিন্তু আজ কিছুতেই স্বস্তি লাগছিল না। ওরা এসেছিল দুপুরের দিকে। খাওয়াদাওয়ার পর মায়ের কথা মনে করে দু’বোন খুব কাঁদলো। তারপরজিনিসপত্র ভাগাভাগি করে নিল। বিয়ের শাড়িটা পেল না বলে ছোটোটা যাবার সময় আফসোসও করল। আমার উপর আস্থা রাখতে না পেরে নিজে একবার আলমারিতে তল্লাশি করেছে। বুঝিয়ে শুনিয়ে বিদায় দিয়েছি ওকে।
সবাই চলে গেলে ঘরদোর বন্ধ করে আগে আগে শুয়ে পড়লাম আমি। মেয়েরা সারাদিন মায়ের স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে। আমি তো এসবের মাঝেই থাকি সবসময়। ওরা থাকুক না থাকুক, আমাকে এরই মাঝে থাকতে হবে। চারিদিকে স্মৃতির বুদবুদ। মনে মনে, কখনো জেসমিন পাশে আছে ভেবে নিয়েও বলে উঠি কত শত পুরনো দিনের কথা।
মনে আছে, যেবার গরমের ছুটিতে আমরা কাঞ্চনজঙ্ঘায় বেড়াতে গেলাম? কী খুশি হয়েছিল মেয়েরা!
কিংবা ছোটোর জন্মের পর আমার যখন রোয়াংছড়িতে বদলি হলো, মনে আছে কেমন কেঁদেছিলে তুমি?
সেবার কিন্তু ঝুমুর বিয়েতে ভীষণ গন্ডগোল হয়ে যেত। তুমি সময়মতো এসেছিলে, ভাগ্যিস!
নিজের সাথেই এমন অজস্র সব রোমন্থন জারি থাকে আমার। মনে হয় বাড়িতে কেউ না এলেই বরং ভালো। আমি নিজের মতো থাকি, জেসমিনও থাকেআমারচারপাশজুড়ে।
মেয়েরা চলে গেলে তাই আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। তারপরআগেভাগেই বাতি নিভিয়ে বিছানায় গেলাম। জানিনা ঘুম আসবে কিনা। তবু চোখ বুজে রইলাম। মাথার দু’পাশে দপদপ করছে ব্যথায়। আজ বড্ড বেশিকথা বলে ফেলেছি৷ শোনারমানুষটিচলেযাবারপরথেকেকথা বলারঅভ্যাসটাকমেগিয়েছেআমার। আমাদেরমাঝেআমারইকথাবলারবাতিকছিল, অন্যজনতোবরাবরইশুনতেবেশিভালোবাসতো।
এইসবভাবতেভাবতেএপাশ থেকে ওপাশ ফিরে বালিশের তলায় হাত রাখতেই সলমা জরি শাড়িটা আমার আঙুল ছুঁয়ে গেল। আর যেন শুনতে পেলাম ওর অস্ফুটস্বর।
সারাদিন পার করে এবার সময় হল?
সত্যিই জেসমিনের সাথে সারাদিনে এই প্রথম কথা বলার অবসর হল আমার। আমিও ওরমতোচাপাগলায় বললাম-জুঁইমণি, সত্যি করে বলবে? তোমাকে যে যেতে দিলাম, এখন ভালো আছো তো?
সেইরাতে আমার বুকের ওপর হাত রেখে জেসমিন আমার কাছে মুক্তি চেয়েছিল। আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিল -আমাকে এবারে যেতে দাও,প্লিজ! একটু শান্তি চাই আমি।
সে রাতে এই বালিশটাই ওর মুখের ওপর প্রবলভাবে চেপে ধরে ছিলাম আমি। এক একটা সেকেন্ড যুদ্ধ করেছি ওর ছটফট করতে থাকা শরীরটার সঙ্গে, নিজের সঙ্গেও, যতক্ষণ অব্দি ওর হাত পা নিথর হয়ে না আসে,যতক্ষণ অব্দি ওর মুখটায় প্রগাঢ় শান্তির রেখা না নেমে আসে।
প্রতি রাতেই এই বালিশে নাক ডুবিয়ে রেখে বুক ভিরে ঘ্রাণ নিই আমি। ও চলে যাবার পর এর কভারটা ধুতে দিইনি একবারও। ঘুমোতে এলে এখনো ওর ঘ্রাণ পাই।
জন্ম ২ এপ্রিল, চটগ্রামে। বাবার চাকুরীসূত্রে তার শৈশব কৈশোর কেটেছে বিভিন্ন মফস্বল শহরে। তিনি পেশায় চিকিৎসক। বিভিন্ন অনলাইন পত্রিকা এবং খবরের কাগজে নিয়মিত লেখেন। ব্যস্ততার ফাঁকে লেখালেখিতেই তিনি মনের খোরাক খুঁজে পান।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ -কিছু গল্প অবাঙমুখ (২০১৮), নৈর্ঋতে (২০২০)।