আনুমানিক পঠনকাল: 3 মিনিট
বলা যায় তাল-লয়-ছন্দে স্যালুট ঠুকে চমকে দিতে পারেন। এএসআই পদে বছর দেড়েক হল। সারদা পুলিশ একাডেমী থেকে প্রশিক্ষণ শেষে সীতাকুন্ড সার্কেলে। ডিউটি স্টেশন সীতাকুন্ড থানা। ডিউটি শিফটিং হলেও রাতে ইমারজেন্সী না হলে ডাক পড়ে না। প্রথম প্রথম পরিবার থেকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকলেও পরে অনেকখানি কেটে যায়। ‘মেয়েরা করবে পুলিশের চাকরি!’- আত্মীয়স্বজনের এমন ভাবখানাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন অনন্যা হক। ছুটি নেই বললেই চলে অনন্যার। পাবলিক পরীক্ষা, ভিআইপি প্রটোকল, কলেজে বন্দুক-যুদ্ধ, শ্রমিক অসন্তোষ, আনন্যাচারাল ডেথ, ইন্সপেকসন টিম,… একটির পর একটি লেগেই থাকে। নির্বাচন হলে তো কথাই নেই। কাছাকাছি হলে একদিন আগে; দূরে হলে দু-তিন দিন আগেই ডিউটি-স্টেশনে যেতে হয়। প্রথম দিকে একমাত্র নারী হওয়াতে কিছুটা আড়ষ্টতা ছিল। পরে দু’জন নারী এএসআই যোগ দেওয়ায় আত্মবিশ্বাস বেড়েছে অনন্যার। বয়সের দিক থেকে তিনজনই ত্রিশের কোঠা পার হন নি। ব্যাচমেট বলে তিনজনের বন্ধুত্বও তেমন। তাছাড়া ফিমেল কনস্টেবলও বাড়ছে। এসপি সাহেব ফিমেল পুলিশদের জন্য থানায় পৃথক কমন রুম দিয়েছেন। আছে ডিউটি শেষে বাসায় ফিরতে পরিবহন সুবিধাও। চলছিল অনন্যার এমন ছকবাঁধা পেশাগত জীবন। কিন্তু পৃথিবী কি সব সময় ছক বেঁধে চলে?
ইতিহাসের অপ্রত্যাশিত ঘটনা বিশ্বজুড়ে। শুরু হয়েছে নতুন এক লড়াই। শত্রু কে? শত্রু কোথায়? শত্রু কি মেঘের আড়ালে মেঘনাদ? পারমানবিক বোমা-যুদ্ধবিমান-দূরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র সব কিছুই অচল। গবেষণা-আবিষ্কার-ভবিষ্যদ্বাণী পথনির্দেশে অক্ষম। মৃত্যুহারের রেকর্ড প্রতিদিনই ভাঙছে। রোগীর আগে পড়ছে ডাক্তারদের উইকেট। ‘নাম শুনে যার এত প্রেম’ নয় বরং ভয় জাগে এমন শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই। সচিবালয়ের নথি থেকে বিমানবাহী রণতরী কোথায় হানা দিচ্ছে না শত্রু? তবুও জিততে হবে;– রাষ্ট্রপ্রধানের এমন অনলাইন ব্রিফিংয়ের পর ইমারজেন্সী রিলিফওয়ার্ক। লক ডাউনের আকস্মিকতায় দেশ হারিয়েছে স্বাভাবিকতা। দ্রুত পৌঁছে এক প্লাটুন পুলিশ সন্দ্বীপে। অনন্যার সঙ্গে মন্দাকিনী চাকমা ও হৃদিতা জাহান। তিন নারী-এসএসআই এর প্রথম দ্বীপ-ভ্রমণ। সাগর পাড়ি দিয়ে পৌঁছতেই সন্ধ্যা হয়ে যায়। মুন্সেফ-ভবনের পাশে বাগানঘেরা দোতলাবাড়িতে থাকবার ব্যবস্থা। সরকারী বাংলো নয় ব্যক্তিবিশেষের বাড়ি। নাম ‘নিভৃত নিলয়’। ঠিক মনে রাখবার মত। বুকে চোরাটান সাহিত্যের ছাত্রী অনন্যার। খাবার আসে থানা থেকে। ওসি সাহেব একজন কাজের বুয়াও পাঠিয়েছেন। দোতলার একটি কক্ষে তিনজনের থাকবার ব্যবস্থা। ইউরোপীয় ধাঁচের আসবাবপত্র, দেয়ালে তৈলরঙ, শেলফ্ জুড়ে ক্ল্যাসিক লিটারেচার। কক্ষটিকে সুসজ্জিত বললে কম বলা হয়। সেতার, এস্রাজ ও তানপুরার এমন উপস্থিতি তা-ও দ্বীপাঞ্চলে! ঘোর লেগে যায়। বুয়ার কাছে জানা যায় ছাদে বিচিত্র ফুলের বাগান।
বাইরে সমুদ্রের শোঁ শোঁ হাওয়া। কথা বেশি না বাড়িয়ে দুটি বিশাল খাটে চারজন গা এলিয়ে দেন। অনন্যার চোখে ঘুম তখনো গাঢ় হয়ে লাগে নি। বাকিরা ঘুমের গভীরে। হয়তো ক্লান্ত শরীর বলে। দূর থেকে থানার ঘণ্টা শোনা যায়। রাত একটার ঘণ্টার খানিক পরের ঘটনা। হঠাৎ ঝন্ ঝন্ আওয়াজ। ছাদের কলাপ্সিবল গেট খোলার শব্দ। গভীর রাত্রির নৈঃশব্দে শব্দটি স্পষ্ট। এ কী কে যেন খুলতে চাইছে! সত্যি সত্যি কেউ সিঁড়ি বেয়ে ধীর পদক্ষেপে নামছে। প্রথমে অনন্যার পাতলা ঘুম ছিঁড়ে যায় । ধড়্ফড়্ করে ওঠে । ঘুম ভাঙা চোখে মোবাইল, টর্চ খুঁজে নিতে দেরি হয় না। পাশের মন্দাকিনীকে জাগিয়ে দেয়। চট-জলদি জাগে পুলিশী-দায়িত্বশীলতা । হৃদিতা, বুয়া অঘোরে ঘুমুচ্ছে। দেরি না করেই মন্দাকিনীকে নিয়ে ছাদ, ছাদ থেকে নিচতলা; পুলিশী-সার্চ। কোথাও কেউ নেই। কলাপ্সিবল গেট যথারীতি তালাবদ্ধ। ভারী তালাদুটির বুকে দীর্ঘকাল না-খোলার ঘনীভূত বেদনা। নিচের দুটি গেটও তাই। সমুদ্রসুলভ নিরবতা। পাশেই পুলিশ ব্যারাক। মুন্সেফ ভবন, পর্তুগীজ আমলের আদালত ভবন, সামনে ধর্মসাগরের মত বিশাল দীঘি। এরপরও কেউ আসবে এমন দুঃসাহস কার! নিজের কানকে তো অবিশ্বাস করা যায় না। মন্দাকিনী দুষছে। অনন্যার মনের ভুল নিশ্চয়। ঘুমের ব্যাঘাতের জন্য মন্দাকিনীর মৃদু ভৎর্সনাকে সহ্য করতেই হল। যা হোক সে রাত কাটলো কোনভাবে। তারপর তিন দিন কাটলো রিলিফের ঝক্কি-ঝামেলায়। সেদিন রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর মন্দাকিনী ও হৃদিতার হাসি থামতেই চায় না। অনন্যাই কয়দিন ধরে বিনোদনের নতুন বিষয়। আস্ত ভীতুর ডিম সে! রাজশাহীতে জন্ম হলেও বাবা-মা মুর্শিদাবাদের। মুর্শিদাবাদের লোকজন সমুদ্র, দ্বীপাঞ্চলকে ভয় পায়। এমন ভীতুর জন্য পুলিশের চাকরি! অনন্যা যতই বলবার চেষ্টা করে পাত্তা পায় না। হাসির প্রত্যুত্তরে হাসি। ভয় পেলে সাতদিন থাকা যাবে ? কথার ফোয়ারা শেষ হতেই চায় না। তাদের সঙ্গে হাসলেও বুয়াটির হাসিতে কিছুটা রহস্য ! একসময় তারা শুয়ে পড়ে। চোখে চোখে ঘুম নামছে, নামবে। এমন সময় বাতাস ছাপিয়ে কার কণ্ঠস্বর ! ছাদ থেকে ভেসে আসছে। নারীকণ্ঠে গান! তিনজনই চমকে উঠে বসেছেন। সত্যি কেউ গান গাইছে! বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দের মধ্যেও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে । মিহিকণ্ঠে গানের কলি। ‘মনে রবে কি না রবে আমারে/ সে আমার মনে নাই, মনে নাই…।’ তিন পুলিশ কর্মকর্তাই টর্চ নিয়ে ছাদে যাবেন। রহস্য বের করতেই হবে। ফলাফল ভালো হবে না । ভয়ানক বাধ সাধলো বুয়া। কিছুক্ষণ পূর্বের হাস্যাস্পদ বিষয়টি পরিণত হল ভীতিজাগানিয়া কৌতুহলে। পরদিন ভোরেই ডাকা হল মালিক ভদ্রমহিলাকে। থাকেন কাছাকাছি আরেকটি দোতলায়। পুলিশী-জেরার মুখে তিনি যা বললেন। তার প্রয়াত স্বামী দু’মেয়ের জন্য দুটি বাড়ি করেছেন। মেয়েদের নামে দানপত্র। এটি ছোট মেয়ে লুসি খানমের বাড়ি। লুসি স্কলারশিপ নিয়ে শান্তিনিকেতনে। বছরে আসা-যাওয়া দু’তিনবার। রবীন্দ্রসঙ্গীতের গলা ছিল ভাল । বছর দশেক আগে পুজার ছুটিতে বাড়ি আসবে। বেলা দুটোর দিকে বর্ডার ক্রস করে । বেনাপোল থেকে চারটার গাড়িতে উঠেছেও। গাড়ি ছাড়ার পরপরই ফোন দিল। রাতের বেলায় যশোর রোডেই গাড়ি…। জেরা এখানেই শেষ। সমবয়েসী এমন তরুণীর জন্য তরুণী পুলিশকর্মকর্তাদের কণ্ঠ একবার কেঁপে ওঠে।
গল্পকার