অসমিয়া অনুবাদ কবিতা: নীলিম কুমার’র কবিতা । বাসুদেব দাস
সাম্প্রতিক অসমের অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বিতর্কিত কবি নীলিম কুমার ১৯৬২ সনে অসমের পাঠশালায় জন্মগ্ৰহণ করেন। প্রকাশিত গ্ৰন্থ ‘আচিনার অসুখ’, ‘স্বপ্নর রেলগাড়ী’, ‘জোনাক ভালপোয়া তিরোতাজনী’, ‘নীলিম কুমারের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ইত্যাদি।
কবি সম্মেলন
কবি সম্মেলন
আসলে যাতনার সম্মেলন।
যাতনার সম্মেলন মানে তো
হাসপাতাল-
বিছানায় পড়ে আছে যাতনা গুলি।
চিকিৎসক নেই, নার্স নেই
অপারেশন থিয়েটার অন্ধকার,
অক্সিজেন সিলিন্ডার খালি। ঔষধ নেই
নেই ইনজেকশন স্যালাইন…
সবাই চলে গেছে
যাতনাকে সম্মেলন পাততে দিয়ে!
যাতনার মধ্যে জ্যেষ্ঠ এক যাতনা
সঞ্চালক হয়েছে
যাতনাগুলি
একের পরে এক
যাতনা পড়ছে। আসলে কাব্য পাঠ
সঞ্চালক মাঝেমধ্যে
কোনো যাতনাকে জিজ্ঞেস করছে-
আপনি যাতনা হওয়ার জন্য
অসুখ পুষেছিলেন নাকি?
কোনো যাতনা বলছে
হ্যাঁ
কোনোটা বলেছে
না
শুনতে থাকা যাতনাগুলি
নিজের যাতনাগুলি পাঠ করার জন্য
অতি যাতনাময় হয়ে উঠেছে
কবি সম্মেলন আসলে
যাতনার সম্মেলন
যেভাবে কবিতার সমালোচক থাকে
সেভাবে যাতনার সমালোচক ছিল
ডিমেনসিয়া এবং স্কিজোফ্রেনিয়া
অন্য ওয়ার্ডে থাকা
ডিমনেসিয়া এবং স্কিজোফ্রেনিয়াকে
পর্যালোচনার জন্য ডাকা হল
ডিমনেশিয়া বলল-
যাতনাগুলি এখনও
শিল্প হয়ে উঠতে পারেনি,
যাতনাগুলি ছাড়তে হবে উস-আস
কাতরোক্তি এবং চোখের জল
স্কিজোফ্রেনিয়া বলল-
যাতনাগুলিকে করতে হবে
মৃত্যুকে অধ্যয়ন এবং অনুশীলন…
শিল্প অবিহনে যাতনা এক অসুখ মাত্র।
কবি ভাবেন
ডিমনেসিয়া এবং স্কিজোফ্রানিয়া
যাতনা নয়, কেবল শিল্প
নিজের স্বপক্ষে ডিমনেসিয়া বলে-
ঘুম না আসাটা শিল্প
নিজের স্বপক্ষে স্কিজোফ্রেনিয়া বলে-
অশুদ্ধগুলি শুদ্ধ বলে ভাবাটা এবং কিছু ভাবতে সবকিছু ভুল করে ভাবাটাই শিল্প!
সঞ্চালক সবশেষে মন্তব্য করেঃ
যাতনাগুলি শিল্প হয়ে উঠতে পারেনি।
যাতনাগুলি হয়েছে কবির আঙ্গিকে করা
উস আস কাতরোক্তির ভাষা!
যাতনাগুলি কাতরোক্তি করবেই
কারণ কোথাও লিখে রাখা নেই-
‘কীপ সাইলেন্ট’!
কবিতার খাতা এবং কলম
উঁচু সেতুটা পাওয়ার সময়
তুমি আমার পিঠ ধরে ঠেলে ছিলে
সেতুটার মাঝখান না পাওয়া পর্যন্ত
তোমার হাতে ছিল
কবিতার খাতা
আমার হাতে ছিল
ঢাকনি না থাকা কলম
তুমি ভেবেছিলে–
তুমি আমাকে ঠেলছ
আমি জানতাম
কবিতার খাতা
একটা কলমকে ঠেলছে
দুজনে সেতুর রেলিঙে বসে ছিলাম
ঠিক সেভাবে
যেভাবে একটা কলম
একটা খাতার মাঝখানে বসে
সেতুর নিচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল
কোনোদিনই না দেখা স্রোতের মতো কিছু
কলম আর কবিতার খাতা
হয়ে পড়েছিল নিশ্চুপ, স্থির তখন
তুমি বলে কোনো তুমি ছিলে না
আমি বলে কোনো আমি ছিলাম না
সেতুর রেলিঙে বসে ছিল
কেবল কবিতার খাতা এবং কলম
বিকেল আমাদের ছেড়ে গিয়েছিল
কবিতার খাতা কলমকে বলেছিল–
কিছু লেখ
কলম কবিতার খাতাকে বুঝিয়েছিল
শব্দগুলি লিপিবদ্ধ না হয়ে থাকতে চায়
শব্দগুলি কেবল বয়ে যেতে চায়
সেতুর নিচের স্রোতের মতো
কলমটা সবসময়
একটা বন্ধ করে রাখা খাতার উষ্ণতার মধ্যে
একটা আধালেখা কবিতার অনিশ্চয়তার সঙ্গে
যাপন করতে চায়
তার দিন-রাত
কারণ কলমটা জানে
লিখে ফেললেই কবিতার মৃত্যু
কবিতার খাতা সে কথা জানেনা।
দাগ
সেই দাগটার কোনো নাম নেই।
দাগটা যেন ভূমিকা না থাকা বইয়ের ভূমিকা/ একজন কবি আমাকে বলেছিল/ তিনি পোষা সেই দাগের কথা
একদিন কেউ তাঁর বিছানায়
একটা দাগ এঁকে রেখে চলে গিয়েছিল।
সেই ভেজা দাগটা উড়িয়ে নেবার জন্য
বাতাস আসে
তিনি খামচে ধরেন বিছানার চাদরটা,
সেই দাগটা ধুয়ে ফেলার জন্য
বৃষ্টি আসে
তিনি একটা ছাতা ধরেন
দাগটার ওপরে।
রোদ আসে
ভেজা দাগটা শুষে নেবার জন্য
তিনি একটা কবিতার বই দিয়ে
ঢেকে রাখেন দাগটা
এভাবেই তিনি দাগটা পুষে রাখেন
প্রতি রাতে তিনি শুনেন দাগটার কলকল
প্রতিরাতে দাগটা বকুল ফুলের মতো গন্ধ ছড়ায়
তিনি ঘুম পাড়ানি গান শোনান দাগটাকে
তিনি আলগোছে ছুঁয়ে থাকেন দাগটাকে
তিনি ভুলে যান দাগটা
ভেতরে না বাইরে!
তিনি এভাবে দাগটা ছুঁয়ে থাকেন যে
দাগটা তপ্ত হয়ে যায়
ছুঁতে না পারার মতো হয়,
তিনি ফ্রিজ থেকে বরফের টুকরোগুলি
দাগটার গায়ে দেন।
দাগটা শান্ত না হওয়া পর্যন্ত
তিনি উস- আস করেন না
নড়াচড়া করেন না
এভাবে তিনি কিছু সময়ের জন্য
মরে যান
পুনরায় বেঁচে উঠার জন্য।
একজন কবি আমাকে বলেছিল
তিনি পোষা সেই দাগের কথা
যার ভবিষ্যৎ তিনি জানেন না
সেই দাগটার কোনো নাম নেই
নাম না থাকলেও কবিতার মতো মহৎ সেই দাগটার
আমরা কিছু একটা নাম রাখতে পারি না
হে কবিরা?
রবীন বরুয়ার নামে একটি কবিতা
( প্রসিদ্ধ চিত্রশিল্পী রবীন বরুয়ার অকাল বিয়োগে রচিত কবিতা)
রবীন বরুয়াকে আমি প্রথম দেখেছিলাম
একটা দুপুর বেলা
সেদিন থেকে আমি
সমস্ত দুপুরের নাম রেখেছিলাম রবীন বরুয়া।
রবীন বরুয়ার সঙ্গে একদিন বিকেলে
এক কাপ কফি খেয়েছিলাম,
সেই কফি কাপটির কথা আমার সব সময় মনে পড়ে।
সেদিন থেকে আমার মনে হয় যেন
প্রতিদিন দুপুরবেলা বিকেলকে এক কাপ কফি খাওয়ায়।
আর যেদিন দুপুরবেলা আমি
রবীন বরুয়ার খোঁজে এসে দেখতে পেয়েছিলাম
তিনি বসা চেয়ারটা খালি,
আমার বিশ্বাস হয়নি।
আর আমি দুপুরবেলাকে বলতে চেয়েছিলাম-
‘চল অন্য জায়গায় খুঁজি রবীন বরুয়াকে’
ঠিক তখনই রবীন বরুয়া আমাকে ডেকেছিল
বলেছিল– আমাকে রবীন বরুয়া বলে ভুল কর না,
আমি নীরবতা! দেখ আমার হাতটা ঠান্ডা’…
সেদিন থেকে সমস্ত ঠান্ডা জিনিস আমার প্রিয়,
সেদিন থেকে আমার কাছে
সমস্ত ঠান্ডা জিনিসের নাম রবীন বরুয়া!

অনুবাদক